বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের বীরসেনানী শহীদ তিতুমীর

বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের বীরসেনানী শহীদ তিতুমীর

স্মরণ মার্চ ২০১৩

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম

আশা করি তোমরা সবাই শহীদ তিতুমীরের নাম শুনেছ। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অগ্রপথিক, নির্ভীক বীর, অমিতবিক্রম সিপাহসালার সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীরকে আজো এ দেশবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী শহীদ (১৭৮৬-১৮৩১) যখন মুহাম্মদিয়া আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে ব্রিটিশ বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসর শিখদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িত ঠিক তখনই বাংলাদেশে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর নামক একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর সিপাহসালারের আবির্ভাব হয়। বাংলাদেশের মাটি থেকে জুলুম শোষণ ও নির্যাতনের মূলোৎপাটনের সংগ্রামে যে, ক’জন দেশপ্রেমিক অস্ত্র ধারণ করে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অমর হয়ে রয়েছেন, তিতুমীর তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর প্রদর্শিত বীরত্বপূর্ণ কর্মকা- স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে আজও এদেশবাসীকে যুগপৎ অনুপ্রাণিত করে। স্বৈরাচার, আধিপত্যবাদ ও নির্যাতনমূলক শাসন নির্মূল করে এ দেশে ইসলামী আদর্শভিত্তিক কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার জীবনের প্রধান স্বপ্ন। তাই বাংলাদেশের স্বৈরশাসনবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে তিতুমীরের নাম প্রাতঃস্মরণীয়। সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগনা জেলার বারাসাতের অন্তর্গত চাঁদপুর গ্রামে ১৭৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ মীর হাসান আলী আর মা আবেদা রোকাইয়া খাতুন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিতুমীর তদানীন্তন সমাজে প্রচলিত সমস্ত শিক্ষার সাথে সাথে আধ্যাত্মিক শিক্ষাও লাভ করেন। শৈশবকালে শারীরিক কৌশল, কুস্তিগির, দক্ষ সংগঠক ও অসাধারণ বীরত্বের জন্য বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি অসাধারণ দৈহিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। ব্রিটিশ বেনিয়া ও তাদের দোসর হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারে তৎকালীন বাংলার মানুষ তখন জর্জরিত, নিষ্পেষিত। সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর স্বচক্ষে হতভাগ্য নিরন্ন মানুষের করুণ মুখচ্ছবি ও রুগ্ণ চেহারা দেখে কৈশোর থেকেই ব্যথিত হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তার মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। ইংরেজ বেনিয়াদের ওপর তার মনে প্রবল ঘৃণার সঞ্চার হয়। তিনি সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারের কন্যাকে বিয়ে করেন। নিজের জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে তুচ্ছ করে তিতুমীর স্বদেশের মানুষের মর্মান্তিক দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্য ১৮১৯ সালে পবিত্র হজ পালনের জন্য তিনি মক্কা শরীফ গমন করেন। সেখানে সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভীর সাথে তার সাক্ষাৎ হয় এবং ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন এবং নির্যাতিত মুসলমানদের প্রতি গভীর ভালোবাসার বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়। মক্কায় তিনি বিপ্লবী আন্দোলনের নেতা সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভীর নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিতুমীর ছিলেন সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভীর তরিকায়ে মুহাম্মদিয়া আন্দোলনের বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রধান। ইসলামী আন্দোলনের কর্মপ্রেরণায় তিতুমীর চিন্তাচঞ্চল হয়ে ওঠেন। ইসলামের প্রকৃত রূপায়ণের আশা নিয়ে তিতুমীর মক্কা-মদিনা থেকে দেশে ফিরে এলেন। ফিরে এলেন তিতুমীর আঁধারঘেরা লাঞ্ছিত বাংলার বুকে। দীনের যথার্থ শিক্ষা মানুষের কাছে তুলে ধরা, তাদেরকে অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন তিতুমীর। তিতুমীরের নেতৃত্বে বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিতুমীর ইসলামী আন্দোলনের কাজে যতই তৎপর হতে লাগলেন ততই বাধা আসা শুরু হলো। স্বভাবতই জমিদার মহাজন ও নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাকে কথা বলতে হলো। সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা মোকাবেলায় তিনি এসব জমিদার মহাজন ও নীলকর নামধারী শোষক ও প্রতারকদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনিই ১৮২৫ সালে সর্বপ্রথম হিন্দু জমিদার ও ইংরেজ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৮৩১ সালে তিতুমীর নারিকেল বাড়িয়ায় একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। অসংখ্য বাঁশের সমাহার ছিল বাঁশবেড়িয়া-নারিকেল বাড়িয়ায়। তিতুমীরের নিজের পরিকল্পনায় তৈরি এক আশ্চর্য বাঁশের কেল্লা। বাঁশের দুর্গ বলা যায়। সম্পূর্ণ বাঁশ ও মাটি দিয়ে তৈরি। সেখানে ছিল বৃহৎ বিস্তীর্ণ এক আম্রকানন। পলাশীর সে আম্রকাননের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বলা যায় পলাশীর আম্রকাননের যুদ্ধক্ষেত্রের মতোই হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের আরেক সংগ্রামের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ তিতুমীরের এই দুর্ভেদ্য বাঁশের কেল্লা। চারিদিকে গড় কেটে বাঁশ পুঁতে দেয়া হয়েছিল। কেল্লার ভেতরটা ছিল একেবারে সেনানিবাসের মত। সেখানে তিতুর খাস কামরা, দরবার কক্ষ, সৈন্যদের থাকার জন্য সারি সারি ঘর তৈরি করা হয়েছিল। ঘরগুলোতে রাত যাপন করতো তার সৈন্যরা। তিতুমীরের আন্দোলন ছিল নিয়মতান্ত্রিক। ব্যাপক নির্যাতিত জনগণের পক্ষ থেকে তিনি স্থানীয় জমিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের প্রতিকারের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনের কাছে তথ্য প্রমাণসহ লিখিত আবেদন জানান। এতে হিন্দু জমিদাররা তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে কৃষ্ণদেব রায় (পুর্ণিয়া), কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, রামনারায়ণ (তারাগুনিয়া), গৌরী প্রসাদ চৌধুরী (নাগরপুর) প্রমুখ জমিদার সদলবলে তিতুমীরকে আক্রমণ করেন। অপূর্ব বীরত্ব ও দক্ষতার সাথে তিতুমীর এই সম্মিলিত আক্রমণকে নস্যাৎ করে দেন। এভাবে জমিদাররা তাঁর হাতে পরাজিত হলে তিনি চব্বিশপরগনা, নদীয়া ও ফরিদপুর জেলার কিছু অংশব্যাপী একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। পরাজিত হিন্দু জমিদাররা ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের বুঝালেন তিতুমীর দেশদ্রোহী। বাংলা থেকে ইংরেজ ও হিন্দুদেরকে তাড়িয়ে তিতুমীর মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইংরেজ বেনিয়ারা তিতুমীরকে দমন করার উদ্যোগ আয়োজন করতে থাকে। ফলে সংঘাত শুরু হয়। তিতুমীর ইংরেজদের এদেশ থেকে বিতাড়নের জন্য তার সৈন্যদেরকে সংঘবদ্ধ করেন। স্বাধীনতার মন্ত্রে তাদের উজ্জীবিত করেন। তিনি ইংরেজদের বিতাড়িত করে বাংলার হৃত স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প গ্রহণ করেন। তিতুমীরের সাথে প্রথম যুদ্ধ করতে আসেন ইংরেজ সেনাপতি আলেকজান্ডার। সঙ্গে পাঠান পাইক, বরকন্দাজ প্রায় ৭৫০ জন। ইংরেজ সাহেবদের হাতে বন্দুক। কিন্তু তিতুমীরের বাহিনীর হাতে সড়কি, বল্লম ও তীরের অব্যর্থ নিশানা। ইংরেজ পক্ষের বহু পাইক বরকন্দাজ প্রাণ হারায়। প্রায় ৫০০ জমিদার সৈন্য ও ইংরেজ পরাজয় বরণ করে। ইংরেজ সেনাপতি আলেকজান্ডার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। দ্বিতীয়বার যুদ্ধে আসেন কর্নেল স্কট। ১৮৩১ সালের ১ নভেম্বর মধ্যরাতে সুশিক্ষিত ইংরেজ সৈন্যরা তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার কাছে পৌঁছে তা ঘিরে ফেলে। বহু গোলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তিতুমীরের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তিতুমীর অসীম বীরত্বের সাথে এই সুসজ্জিত বাহিনীর মোকাবেলা করেন। ইংরেজদের কামানের গোলায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। কেল্লার সামনে বীরবিক্রমে জুলুমের মোকাবেলা করে ১৮৩১ সালের ১১ নভেম্বর তিতুমীর শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ হন তার সঙ্গী-সাথী বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তিতুমীরের সুদক্ষ সেনাপতি গোলাম মাসুদ যুদ্ধে বন্দী হন। পরে ইংরেজদের বিচারে তার ফাঁসি হয়। পরবর্তীতে তিতুমীরের ২২৫ জন অনুসারীর বিচারে জেল হয়। নিষ্ঠা, কর্তব্যবোধ, আদর্শিক অনুরাগ, বীরত্ব, দেশপ্রেম তিতুমীরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনে তিতুমীরের সংগ্রামী চেতনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সর্বপ্রকার অত্যাচার, শোষণ ও দলননীতিকে সমূলে উৎপাটিত করে স্বাধিকার অর্জনের মাধ্যমে আদর্শিক সত্তা সুপ্রতিষ্ঠিত করার নিমিত্ত ইসলামী জাগরণের যে অগ্নিশপথ শিক্ষা দিয়ে যান তাই কালক্রমে এদেশবাসীকে সকল প্রকার অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন, স্বৈরাচারের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনে বীর সৈনিকের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করে। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অগ্রপথিক নির্ভীক বীর, অমিতবিক্রম সিপাহসালার সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীরকে এসো আমরা সবাই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ