বাজান    -আবদুল ওহাব আজাদ

বাজান -আবদুল ওহাব আজাদ

গল্প ডিসেম্বর ২০১৫

পুবের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়। চারিদিকে গুমট গরম, বৃষ্টি হলে গুমট ভাবটা হয়তো কাটতো কিন্তু বহুদিন যাবৎ আসমানে বৃষ্টি নেই।
পীর আলীর বয়স ষাট পেরিয়েছে। বয়সের তুলনায় শরীরটা ভেঙে গেছে রোগে-শোকে, পক্ষাঘাতে আক্রান্ত এক পাশ। এক পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারেন না। লাঠি নিয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন দু-এক পা। পীর আলী তার বারো বছরের ছেলে আয়নালকে ডেকে বললেন।
‘বাপ আয়নাল, পুব আসমানে দ্যাখতিছি বিরাট ম্যাঘ করেছে, দলক বোধায় হতি পারে, কি কইস বাপ?’
‘আয়নাল পুব আকাশে চোখ মেলে বললো, ‘হ বাজান, বিরাট ম্যাঘ করিছে, দলক এ্যালো বলে’।
পীর আলী ছেলেকে ডেকে বললেন-
‘আজ আর মাছ মারতি যাসনে আয়নাল, ম্যাঘের অবস্থা খুব খারাপ।’
আয়নাল ঘাড় নাড়ে। আয়নালের ঘাড়ে এখন সংসারের বোঝা, ছিপ বড়শি দিয়ে মাছ মেরে আয়নাল বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায়।
আয়নালের একটি মাত্র বিবাহযোগ্যা বোন আছে। টাকা পয়সার অভাবে বিয়ে দিতে পারছে না ময়নাকে। ময়না নূরু মেম্বরের বাড়িতে কাজ করে।
নূরু মেম্বর লোক সুবিধের নয়। সংসারে মা নেই, কারো কাছে সে কষ্টের কথা বলতে পারে না। অনেক কষ্ট ময়নার। একদিন ময়না পীর আলীকে নিরিবিলি পাশে বসে বলেছিল-
‘বাজান, আমি আর মেম্বরের বাড়ি কাজে যাবো না’Ñ কথা শুনে পীর আলী চিৎকার করে বলেছিলেন,
‘ক্যান কাজে যাবিনে, ক্যান।’
ময়না এই কেনর উত্তর দিতে পারেনি। শুধু পীর আলীর গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
‘বাজান সব কথার জবাব দেয়া যায় না।’
কথা শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আয়নাল সেদিন বলেছিল-
‘তুই কোন চিন্তা করিসনে বুজান, আমি বড় হলি তোরে আর পরের বাড়ি কাজে যাতি দেব না, খুব তাড়াতাড়ি আমি একটা গ্যাবরোর বাজারে দোকান দেব, তারপর থে দেখিস, আমাগের আর অভাব থাকপে না।’
ময়না সেদিন হাউ মাউ করে কেঁদেছিল। আয়নাল সান্ত¡না দিয়েও তার কান্না থামাতে পারেনি। তখন কেবল ক্লান্ত দুপুর। তারাপদ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো পীর আলীর বাড়ি। এক সময় তারাপদ আর পীর আলী এক সঙ্গে মাঝিগিরি করেছে। তারাপদ হাঁকতে হাঁকতে এসে বললো-
‘সব্বনাশ হইয়ে গেছে পীর আলী ভাই, সব্বনাশ হইয়ে গেছে।
পীর আলী উঠে বসার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। পীর আলীর চোখে মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ-
পীর আলী জিজ্ঞাসা করলেন,
‘কি হইয়েছে তারাপদ?
তারাপদ বললো-
‘গ্যাবরো ভেঙে গেছে পীর আলী ভাই, গাঁয়ে জল এ্যালো বলে’।
পীর আলী কিছু বলতে পারলেন না, শুধু নির্বাক চেয়ে রইলেন তারাপদের দিকে।
কিছুক্ষণ পর পীর আলী নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললেন ‘মা ময়না, বাপ আয়নাল, বানের পানি গাঁয়ে এ্যালো বলে, গ্যাবরো ভেঙে গেছে, তোরা জিনিস পাতি গোছাতি লাগ’।
জিনিস পাতি বলতে থালা বাসন, হাঁড়ি কুঁড়ি তা ভিন্ন নেই খুব বেশি হলে কাঁথা, মাদুর, দু-একটি টিনের বাকস, সবকিছু দু’ভাই বোন মিলে এক জায়গায় রাখলো। ঘণ্টা পার হতে না হতেই গ্রামে পানি ঢুকে গেল, মাঠ-ঘাট-নদী-গ্রাম সব মিলিয়ে পানিতে একাকার। বিকেলে এসে তারাপদ আর কয়জন গ্রামবাসী মিলে একটা বাঁশের মাচা বানিয়ে সেখানে পীর আলীকে রেখে গেল।
আয়নাল এখন আর ছিপ বড়শি নিয়ে মাছ ধরতে যেতে পারে না। চোখ মেললে শুধু পানি আর পানি। সাগরের পানির মত চকচক করে চারিপাশ। এখন জীবন বাঁচানোই দুষ্কর, বাবার ওষুধ, তিনজন মানুষের ভরণ পোষণ, ময়না নূরু মেম্বরের বাড়ি থেকে যে ভাত তরকারি আনে তাতে পুরোটা সঙ্কুলান হয় না। বাকিটা কিশোর আয়নালকে সামলাতে হয়। দু-একটি সংগঠন যা ত্রাণ বিতরণ করছে, তা গ্রামের ভেতরে পৌঁছাচ্ছে না। আয়নাল বড়দের সাথে সাথে ত্রাণ আনতে যায় দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে। ফেরে সেই সন্ধ্যা রাতে। খুব কষ্ট হয় ওর। ওর কষ্ট বাজানের জন্য, বোন ময়নার জন্য। আয়নাল নিজের কষ্টের বিনিময়ে ওদের মুখে হাসি ফোটাতে চায়।
টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পানি আর ময়নার চোখের পানিতে যেন একাকার-আয়নাল বললো-
‘তোর আর কাল থে মেম্বরের বাড়ি কাজে যাতি হবে না এ সংসার আমি একাই চালাবো আমি।’
পীর আলীর চোখের কোনায় পানি জমতে থাকলো। আয়নালের মাথায় হাত বুলিয়ে পীর আলী বললেন-
‘তুই পারবি বাজান?’
আয়নালের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। চোখ মুছে আয়নাল বললো-
‘তুমি দোয়া করো বাজান।’
পীর আলী আবারো আয়নালের মাথায় হাত রেখে কি যেন বিড় বিড় করে বললেন-
বিকেলে তারাপদ এসে বসলো পীর আলীর মাথার কাছে। তারাপদ দেখলো, পীর আলীর চোখে পানি, তারাপদ বললো-
‘কি বিপার পীর আলী ভাই, তোমার কি হয়েছে, তুমি কানতেছ ক্যান?
পীর আলী চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন-
আমি কি আর নাও চালাতি পারবো না তারাপদ?
তারাপদ বললো-
‘পারবা না ক্যান, তুমি সুস্থ হয়ে উঠলি অবশ্যই পারবা? তা এই সময়ে আবার নাও চালাবার কথা উঠতেছে ক্যান পীর আলী ভাই।’
পীর আলী হাউ মাউ করে কেঁদে বললেন-
‘আমায় বিষ এ্যানে দেও তারাপদ, আমায় বিষ এ্যানে দেও।’ তাৎক্ষণিকভাবে তারাপদ এ কান্নার অর্থ বুঝলো না। পরে যখন তারাপদ আয়নালের কাছে বিস্তারিত শুনলো, তখন তারাপদ বুঝলো এ তার কষ্ট আর অভিমানের কান্না।
বিকাল থেকে পীর আলীর ডায়েরিয়া শুরু হলো, আয়নাল ডিঙি নৌকা বেয়ে ১ মাইল দূরে একটি মেডিক্যাল ক্যাম্প থেকে বাজানের জন্য ওষুধ আনলো। রাতে ডায়েরিয়ার প্রকোপ আরো বৃদ্ধি পেল, পরদিন সকালে আয়নাল শুনতে পেল, মাইল তিনেক দূরে গাবুরা বাজারে ত্রাণ দেয়া হবে, অনেক রকমের ত্রাণ, শাড়ি, লুঙ্গি আর নানা রকমের খাবার তো আছে। বড় একটি টিনের হাঁড়ি নিয়ে আয়নাল পথে নামে, যাওয়ার পথে পীর আলীর পাশে যেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো-
‘বাজান আমি গ্যাবরো বাজারে ত্রাণ আনতি যাতিছি। অনেক পাটি আইয়েছে ত্রাণ দিবার জন্যি। শোনলাম শাড়ি, লুঙ্গিও দেবে, তুমি কোন চিন্তা কইরে না বাজান, তোমার ডায়েরিয়া যদি না সারে কাল নৌকো করে শ্যামনগরে যে যাবো, আমি তারাপদ কার সঙ্গে আলাপ করিছি।’
পীর আলী বললেন-
‘তাড়াতাড়ি ফিরিস বাজান।’
‘আচ্ছা বাজান।’ বলে ত্রাণ আনতে রওয়ানা হলো আয়নাল।
আসলে যা শুনেছে ঠিক তাই, অনেক ত্রাণ পেয়েছে সে, শাড়ি, লুঙ্গিও পেয়েছে, বাজান, ময়না বুজান এগুলো পেয়ে আজ খুব খুশি হবে।
আয়নাল টিনের হাঁড়িতে ত্রাণগুলো ভরে হাঁড়িটা ভাসিয়ে বিলের পানি ভেঙে পথ এগোতে থাকে। বিল পথে অনেকটা পথ কম। আয়নাল বারবার টিনের হাঁড়ির মধ্যে ত্রাণসামগ্রীগুলো দেখে, বিশেষ করে বাজানের জন্য কয়েক পিস স্যালাইন নিয়ে আসছে আয়নাল, বাজানের ডায়েরিয়া, স্যালাইনগুলো খুব কাজে লাগবে।
একাকী বিলের মধ্য দিয়ে পথ চলে আয়নাল, কখনো কোমর পর্যন্ত কখনো বুক বরাবর পানি হাঁড়িটা শক্ত করে ধরে রাখে আয়নাল। কোনক্রমে হাঁড়িটা খোয়া যেতে দেবে না সে। তার মধ্যে যে আয়নালের সমস্ত সঞ্চয়।
বিলজুড়ে লাশ আর মরা মাছের পচা গন্ধ। পশু-পাখি ভেসে রয়েছে বিভিন্ন জায়গায়, দুর্গন্ধে বমি আসার উপক্রম হয় আয়নালের। জনমানবহীন বিলজুড়ে মনে হয় আয়নাল একা। মাঝে মধ্যে বুকটা কেঁপে ওঠে ভয়ে। আবার দোয়া দরুদ পড়ে পথ চলে আয়নাল, হঠাৎ মরা গাঙে এসে পড়ে সে। এক সময় এখানটায় নদী ছিল গভীর পানি, তার সাথে স্রোত। আয়নাল ঠাঁই পায় না, পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পায় না আয়নাল। সাঁতরে পথ চলে সে, কিছুদূর যেতে না যেতে কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে আসে আয়নাল। হাত-পায়ের বল হারিয়ে যায়, তবু শক্ত হাতে হাঁড়িটা জড়িয়ে ধরে অতি কষ্টে পথ চলে। এক সময় সকল শক্তি শেষ হয়ে আসে আয়নালের। পেটে ক্ষুধা, মনে ভয়, গভীর পানি, কতক্ষণ সাঁতরাবে সে। হঠাৎ পা দু’খানা জড়িয়ে আসে, কে যেন আটকে ধরেছে পা দুটো। হাত দু’খানিও আর চলে না। শক্ত করে ধরে রাখা হাঁড়িটা হাত থেকে ফসকে যায়, এক সময় শেষবারের মতো অতি কষ্টে আয়নাল বললো আমি পারলাম না বাজান, আমি পারলাম না।
আয়নাল এখন অথৈ পানির নিচে। কেবলমাত্র ত্রাণের হাঁড়িটা ভাসছে গাবুরার বিলে।
সন্ধ্যে হয়ে এল, আয়নালকে ফিরতে না দেখে পীর আলী বললেন-
‘মা ময়না, আমার বাজান যে এহনও বাড়ি এলো না।’
ময়না পীর আলীকে সান্ত¡না দিয়ে বললো, ‘আসপে বাজান, তুমি কোন চিন্তা কইরো না’। পীর আলীর শরীরের অবস্থা মোটেও ভালো না, পীর আলী হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে বললেন ‘বাজান, তুই ফিরে আয়, বাজান, আমার আর ত্রাণের দরকার নেই।’
পীর আলীর করুণ আর্তনাদ, কেবলই আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো, কিন্তু আয়নাল শুনতে পেল না।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ