বাবারা কখনও কাঁদে না - মোশতাক আহমেদ বিন নূর

বাবারা কখনও কাঁদে না - মোশতাক আহমেদ বিন নূর

গল্প ফেব্রুয়ারি ২০২০

আনু মিয়া। পুরো নাম আনোয়ার মিয়া। সবাই আনু মিয়া বলেই ডাকে। পেশায় দিনমজুর। আনু মিয়া স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে থাকেন ঢাকার অখ্যাত এক বস্তিতে। বাঁশের চাটাই আর ছেঁড়া-ফাটা পলিথিনের ছাউনির ছোট্ট খুপরি ঘর। দরজা কিংবা জানালার কোনো বন্দোবস্ত নেই। ছেঁড়া কাপড় চোপড় দিয়ে তৈরি পর্দা দিয়ে খুপরির মুখ আটকে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘরের আসবাবপত্র বলতে ওই কয়েকটা হাঁড়ি পাতিল, থালা বাসন আর জগ গ্লাস মিলিয়ে কোন রকম চালিয়ে নেয়া। রাস্তার পাশ থেকে ৫০-১০০ টাকায় পুরাতন জামা-কাপড় কিনেন পরিবারের সবার জন্য। তাও সবসময় জোটে না।

আনু মিয়া প্রতিদিন সকালে বস্তির পাশের একটা বাজারে যান শ্রম বিক্রি করতে। সেখানেই মজুর কেনাবেচা হয়। আনু মিয়ার মতো আরো অনেক দিনমজুর জড়ো হয় সেই মজুর বাজারে। সেখান থেকেই যে যার প্রয়োজনমতো মজুর ঠিক করেন। কাজের ধরনের ভিত্তিতে দরদাম ঠিক করা হয়। ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০, ৪০০ টাকায়ও ঠিক করা হয়। তবে কোন কোন দিন কাজই জোটে না। সেদিন খালি হাতেই ফিরতে হয়। আনু মিয়া সারা দিন খেটেখুটে যা রোজগার করে তা দিয়ে চাল, তেল, নুনসহ তরকারি কিনে আনে। এভাবেই চলছে আনু মিয়ার সংসার। গতকাল রাত থেকেই আনু মিয়ার ছোট মেয়ে ফুলির গায়ে ভীষণ জ্বর। গায়ে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। সারা রাত কাউকে ঘুমুতে দেয়নি? রাতেও মেয়েটি কিছু খায়নি। সকালে আনু মিয়া কাজের খোঁজে বের হওয়ার সময় মেয়েটি বিছানায় শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে বললো, বাবা আমার জন্য একটা মুরগি আনবা। আমি মুরগির গোশত দিয়া ভাত খাবো। আনু মিয়া মুখে কৃত্রিম হাসি এঁকে বললো, আচ্ছা মা আনবো। আনু মিয়া জানে, আজকে হয়তো মুরগি আনা সম্ভব হবে না একদম। কারণ, গতকালও সারা দিন কোন কাজ পায়নি। আজ কাজ জুটবে কি-না সংশয় রয়েছে। যাহোক, চোখে মুখে চিন্তার ভাঁজ রেখেই বেরিয়ে পড়লো কাজের সন্ধানে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে এলো। কোন কাজের জোগাড় হয়নি। ওদিকে মেয়েটা অসুস্থ। পকেটে দশ টাকা নিয়ে বেরিয়েছিলো। নাশতা খাওয়া হয়নি। কিছুক্ষণ আগে পাঁচ টাকা দিয়ে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনে খেয়ে চার গ্লাস পানি খেয়েছে। বসে রইলো চাতক পাখির মতো। বসে আছে কোন একটা কাজের আশায়। নাহ, বেলা যথেষ্ট হয়েছে। কোন কাজ জুটলো না। না জানি কী আছে অদৃষ্টে। হাজার চিন্তা মাথায় বিড়বিড় করছে। বিকেল হয়ে এলো। কোন কাজ না পেয়ে আনু মিয়া ভগ্ন হৃদয়ে বস্তির দিকে এগুলো। কিন্তু, পা চলছিলো না। মেয়েটার জন্য একটা মুরগি কিনবে, তা আর হলো না। তারচেয়ে বড় চিন্তা, আগামীকাল চুলায় উনুন জ্বলবে কি-না তা-ই অনিশ্চিত। আনু মিয়ার শরীর ঘেমে যাচ্ছে। গরমে নয়; দুশ্চিন্তায়। অনেক চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরলো। বিমর্ষ, মলিন চেহারা। বাবাকে দেখে ফুলি কাঁপা গলায় শুধালো, মুরগি কই বাবা? আনু মিয়ার চোখ ছলছল করছিলো। মেয়েকে কী করে বুঝাবে? তবুও মিথ্যা সান্ত¡না দিয়ে বললো শোন মা, বাজারে মুরগি পেলাম না। আমি যাওয়ার আগেই সব বেচা শেষ হয়ে গেছে। কালকে আনবো। এহেন উত্তর শুনে ফুলির মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো মুহূর্তেই। কোন কথা বললো না। আনু মিয়া কিছু একটা গোঙানির মতো আওয়াজ আন্দাজ করতে পারছে। বোধ হয় ফুলি কাঁদছে। আসলেই ফুলি কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আনু মিয়া মেয়ের চোখের জল মুছতে গিয়ে নিজেই কেঁদে ওঠার জোগাড়। কিন্তু, বাবারা চাইলেও কাঁদতে পারে না। ফুলি সারাদিন কিছু খায়নি। ভেবেছিল, বাবা মুরগি আনবে। গোশত দিয়ে ভাত খাবে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। রাতে ফুলিকে কলমি শাক দিয়ে ভাত দিলো। মেয়েটা মুখেও তুলেনি। সারাদিন আধখাওয়া হয়ে থেকে ছিলো। রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো। খাট কিংবা চৌকি নেই। মাটিতেই মাদুর পেতে ঘুমায় তারা। আনু মিয়া প্রতিদিন অন্যপাশে ঘুমালেও আজ ফুলির পাশে শুয়েছে। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চিন্তা করছে, কাল যেভাবেই হোক কাজ করতেই হবে। মুরগির টাকা জোগাড় করতেই হবে। এসব ভাবতেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো ঘুমে। পরদিন খুব সকালেই বেরিয়ে পড়লো কাজের সন্ধানে। একটা কাজ পেয়েও গেলো। তবে মাত্র আধবেলার কাজ। দুপুর পর্যন্ত কাজ করলে ১৫০ টাকা পাবে। মনে মনে একটু খুশি হতে পারলেও হিসাব কিছুতেই মিলছে না। ১৫০ টাকায় কী হবে? শুধু মুরগি কিনলেইতো হচ্ছে না। ঘরে চাল নেই। অন্তত ১ কেজি চাল হলেওতো নিতে হবে। ওরা মোটা চাল খায়। তা-ও ৩০ টাকা কেজি। কিভাবে কী হবে? কাজ শেষ করে আনু মিয়া মজুরির ১৫০ টাকা নিয়ে বাজারে গেলো। আগে মুরগির দোকানে গেলো। ভাই, মুরগি কত টাকা কেজি? ১৪৫ টাকা। কয় কেজি দেবো? ভাই, সবচেয়ে ছোট মুরগিটা কতটুকু ওজন হবে? তা ধরেন, ১ কেজি ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম। ১৯০ টাকা থেকে ২০০ টাকার মতো দাম আসতে পারে।

আনু মিয়ার মাথায় কাজ করছে না। ১৫০ টাকা দিয়েতো মুরগির দামই হচ্ছে না। চাল নেবে কী করে? ভাবতেই মেয়ের জলে ভেজা চোখ দুটো আনু মিয়ার চোখে স্পষ্ট হয়ে ভাসছে। আজ মুরগি না নিয়ে কী করে ঘরে ফিরবে? ফুলি এমনিতে খুবই শান্ত স্বভাবের। কোন বায়না করে না সহজে। অবশ্য গরিবের মনও বোধ হয় গরিবই হয়। অভিলাষ তেমন বড় হয় না। কিন্তু মেয়েটা অসুস্থ। খুব বেশি কিছুতো আবদার করেনি। কিন্তু এই ছোট্ট আবদারটাও আজ পাহাড় সমান উচ্চতায় পৌঁছেছে। আনু মিয়া অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে একটা বুদ্ধি বের করলো। মনে হচ্ছে হাতে আকাশ ছুঁয়ে নিয়েছে। চোখে মুখে সারল্যের হাসি ফুটছে। বাজারের শেষ মাথায় এক লোক বড় ঝাকায় করে মুরগির মাথা, ঠ্যাং, গিলা, কলিজা বিক্রি করে। আনু মিয়া জোরে পা চালাতে লাগলো। খুঁজে বের করলো গিলা-কলিজা বেচার দোকান। ভাই, গিলা-কলিজা কত টাকা কেজি বেচেন? ৮০ টাকা কেজি। দেবো? আচ্ছা, আমারে এক কেজি দেন। আনু মিয়া এক কেজি গিলা-কলিজা আর চাল কিনে বাসায় গেলো। বাসায় গিয়ে মেয়েকে ডেকে বলছে মা, তুমি না কলিজা পছন্দ করো? মুরগির ভিতরেতো মাত্র একটা কলিজা থাকে। সেইজন্য আমি মুরগি না কিনে তোমার জন্য অনেকগুলো কলিজা আনছি। সাথে ঠ্যাংও আছে, গিলা, আর মাথাও আছে। ফুলি তাতেও খুশি। ফুলির মা তাড়াতাড়ি গিলা-কলিজা পরিষ্কার করে রান্না করলো। ফুলি দারুণ খুশি। দুদিন পর পেট পুরে ভাত খেলো। আনু মিয়া মেয়ের খুশিতে প্রায় কেঁদেই দিয়েছিল। কিন্তু কাঁদতে পারেনি। কারণ, বাবারা কখনও কাঁদে না।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ