বারুদের গন্ধ তামীম আদনান

বারুদের গন্ধ তামীম আদনান

তোমাদের গল্প মে ২০১৬

রাতের আকাশে তারারা মুক্তোর মত জ্বল জ্বল করছে। তাদের মাঝে বাঁকা চাঁদ হাসছে। আঁধার কালো আসমানের এই রূপটা রিয়ানার কাছে বড্ড ভালো লাগে। সে জানালার সাথে কপাল ঠেকিয়ে আকাশের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। তার সবচেয়ে অবাক লাগে এই দেখে যে, বাঁকা চাঁদটা ঠিক তাদের বাগানের সবচেয়ে বড় খেজুর গাছটার ওপরই হাসতে থাকে। রিয়ানাদের বাড়ির সামনে বিশাল বাগান রয়েছে। সেখানে হরেক রকম ফল ফুলের গাছের সাথে অনেক খেজুর গাছও রয়েছে। ওদের গ্রামের প্রতিটি বাড়ির সামনেই দু-চার প্রজাতির খেজুর গাছ লাগানোই থাকে। ওরা সিরিয়ার সুভেলা নামক ছোট্ট গ্রামে বাস করে। গ্রামটি অখ্যাত হলেও সৌন্দর্যের অভাব নেই। আল্লাহ তায়ালা যেন গ্রামটিকে ঢেলে সাজিয়েছেন। গভীর মনোযোগে রাতের সৌন্দর্য দেখতে থাকা আট বছরের শিশু রিয়ানাকে ডাক দেন তার দাদী, ‘রিয়ানা ঘুমাতে এসো, সকালে তোমার স্কুল আছে।’ হঠাৎ সম্বিত ফিরে পাওয়া রিয়ানা জবাব দেয় ‘আসছি দাদী’। রিয়ানা আর ওর দাদী একসাথে থাকে। অন্য ঘরে বাবা আর মা থাকেন। চারজনার ছোট্ট সুখী পরিবার। রিয়ানা জানালা লাগিয়ে ঘুমাতে যায়, না হয় সকালে স্কুলে যেতে কষ্ট হবে। রিয়ানার স্কুল খুব ভালো লাগে। সেখানে বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, খেলাধুলা হয়, আর কত্ত নতুন জিনিস শেখা যায়। বিছানায় এসে দাদীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে রিয়ানা। সে স্বপ্ন দেখতে থাকে। পরী হয়ে বাঁকা চাঁদ ধরার স্বপ্ন।
দুই. লিবিয়া, মিসর, তিউনিসিয়ার পর আরব বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে এবার সিরিয়াতে। স্বৈরাচারী সরকার বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে সিরিয়ার মানুষের নরম অন্তর। সরকারবিরোধী আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে সিরিয়ার অভ্যন্তর। রুশ শক্তিনির্ভর বাশার আল আসাদ ক্ষমতা না ছাড়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। সেই সুযোগে মার্কিনিরা খেলতে চাইলো সাম্রাজ্যবাদের ভয়ঙ্কর খেলা। উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোর সাহায্যে লাগিয়ে দিলো গৃহযুদ্ধের মেলা। উন্মুক্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হলো সিরিয়া।
তিন. জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রিয়ানা। আজ তার চোখে মুগ্ধতার পরিবর্তে ঝরে পড়ছে বিষণœতা। প্রায় দশ এগারো দিন হলো সে স্কুলে যেতে পারে না। প্রতিদিন সকালেই ওর তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙে। কিন্তু যখনই মনে পড়ে স্কুলে যেতে পারবে না তখনই মনটা খারাপ হয়ে যায়। ফুলের মতো সুন্দর মুখটা বিষণœতার আঁধারে ছেয়ে যায়। আজ আকাশে নেই বাঁকা চাঁদের হাসি। নেই তারাগুলোর মাঝে মুক্তোর ঝলকানি। শেষ যেদিন স্কুলে গিয়েছিল রিয়ানা, তার আগের রাতে জানালা দিয়ে আসা পূর্ণ জোছনার আলোতে ভরে গিয়েছিল তার বিছানা। জোছনা ভরা বিছানায় ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখছিল। বাগানভরা ফুলের মাঝে অনেক হলুদরঙা প্রজাপতি ধরার জন্য দৌড়াচ্ছে। প্রজাপতিগুলো যখন উড়তে উড়তে উপরে উঠতে লাগল, তখন তারও পাখা গজিয়ে উঠল। সেও প্রজাপতিদের সাথে উড়তে লাগল। হঠাৎ স্বপ্ন শেষে যখন রিয়ানার ঘুম ভাঙল, তখন বিছানায় চাঁদের আলোর জায়গায় সূর্যের আলো আছড়ে পড়ছে। নাস্তা সেরে মায়ের হাত ধরে স্কুলের পথ ধরল রিয়ানা। আজই যে স্কুলে তার শেষ ক্লাস সে জানে না। স্কুলে যেয়ে দেখে সেনাবাহিনী ক্যাম্প করেছে সেখানে। আজকের পর আর ক্লাস হবে না। রিয়ানা যুদ্ধ বোঝে না। শুধু এতটুকুই বোঝে যুদ্ধ ভয়ঙ্কর। যুদ্ধ ভালো না। সেদিনের পর থেকে রিয়ানার মনটাও ভালো না। মন খারাপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা মেয়েটাকে ঘুমানোর জন্য ডাকতে এসেও দাদী ডাকলেন না দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, থাকুক না মেয়েটা, একটু হালকা হোক মনটা। ঘুম ধরলে এমনি এসে ঘুমাবে।
চার. দুই ডজন মানুষের নিম্নস্বরে কানাকানি কথায় পুরো হলরুমটা গম গম করছে। সবাই ন্যাটো প্রধানের আসার অপেক্ষায় বসে আছে। যারা অপেক্ষা করছে তারা সবাই ন্যাটোর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। কারণ এই রুমে ন্যাটোর অফিসার ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারে না। আজ ন্যাটো প্রধান এসে জানাবেন সিরিয়ার ব্যাপারে ন্যাটোর সিদ্ধান্ত এবং দিকনির্দেশনা। রুমের একমাত্র দরজা ঠেলে প্রবেশ করল ন্যাটো প্রধান। মুহূর্তেই নিশ্চুপ হয়ে গেল পুরো রুম। চেয়ারে বসে মাইক্রোফোনটা ধরে গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে লাগলেন ন্যাটো প্রধান। ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সিরিয়াতে বিদ্রোহীদের সাহায্য করার জন্য বিমান হামলা করবো। যেহেতু আমরা বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করছি, সেহেতু আমাদের লক্ষ্যবস্তু হবে সরকারি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। আর ... বলতে যেয়ে ঠোঁটের কোনায় ভয়ঙ্কর হাসি ফুটে উঠল। আর উগ্রপন্থীদের দোহায় দিয়ে আমরা যে কোনো জায়গাকেই লক্ষ্যবস্তু বানাতে পারি। কারণ তারা আমাদের জন্যই সবকিছু করছে। কাল থেকেই শুরু হবে অপারেশন। ওকে। বেস্ট অব লাক। কথাটা শেষ করার সাথে সাথেই হাততালিতে ফেটে পড়ল পুরো রুম।
পাঁচ. বাগানে খেলতে থাকা একমাত্র মেয়ে রিয়ানার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রামিসা। মেয়েটা অনেক দিন পর প্রাণখুলে হাসছে। বাবা আর দাদীর সাথে বসে গল্প করছে। হাসতে হাসতে দু’জনার গায়ের ওপর ঢলে পড়ছে। অনেকদিন ধরে স্কুলে যেতে পারে না বলে চঞ্চল মেয়েটা কেমন যেন মনমরা হয়েছিল এতদিন। বাবাকে কাছে পেয়ে যেন ফিরে এসেছে আনন্দের দিন। মেয়েটা অনেক ভালোবাসে বাবাকে। যদিও বাবা ব্যবসার কারণে তেমন সময় দিতে পারে না মেয়েকে। তবুও বাবার প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই। বাবার জন্য ভালোবাসার কমতি নেই। পাখির মত চঞ্চল মেয়েটাকে বুকের মাঝে আগলে রাখতে চান রামিসা। কোনো অশুভ শক্তিই যেন তাকে খুঁজে না পায়। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই বুকের মাঝ থেকে একটি দীর্ঘশ্বাষ বেরিয়ে আসে রামিসার। শেষ বিকেলে আকাশের লালিমার দিকে তাকিয়ে সে ভাবতে থাকে, কিযে হলো দেশটাতে? কিযে হবে যুদ্ধ বিদ্রোহ করে? হঠাৎ ন্যাটোর একটি জঙ্গিবিমান উড়ে আকাশে। আতঙ্কের আগুন ধুক করে জ্বলে ওঠে রামিসার অন্তরে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাক দেয় ‘রিয়ানা.....’। সাথে সাথে গর্জে অন্য একটি বিমান থেকে নিক্ষেপ করা বিধ্বংসী বোমা। মেয়েকে বাঁচাতে দৌড়ে বাগানে আসে রামিসা। কিন্তু যেখানে ওরা তিনজন বসা ছিলো সেখানে কেউ নেই। তার জায়গায় আগুনের কালো কুন্ডলী দ্রুত বেগে আকাশে উঠছে। একটু সামনে তাকাতেই রিয়ানার বাবা আর তার দাদীর রক্তে মাখা লাশ দেখতে পেলো। দৌড়ে যেয়ে রিয়ানার বাবার মাথা উঠিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল ‘কি হয়েছে তোমার? কথা বলো, কথা বলো।’ কিন্তু রিয়ানার বাবার তো মুখের কথা কেড়ে নিয়েছে নির্দয় বোমা। কাঁদতে কাঁদতেই বিড়বিড় করে রামিসা বলে উঠে ‘রিয়ানা আমার রিয়ানা কই’। উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত দিয়ে পাগলের মত খুঁজতে থাকে আর চিৎকার করে ডাকতে থাকে রিয়ানা...রিয়ানা...। কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না রামিসা। ধ্বংসস্তূপের কালো ধোঁয়ায় কাশতে কাশতে পড়ে যায় মাটিতে। পড়ে যেয়ে কালো ধোঁয়ার মাঝে সামনে তাকিয়ে দেখে কয়েক গজ দূরে পড়ে রয়েছে রিয়ানার নিথর দেহ। পুরো শরীর হয়েছে রক্তে রঞ্জিত। হামাগুড়ি দিয়ে কোলে তুলে নেয় মেয়েকে। ডান হাত পা উড়ে গেছে বোমার আঘাতে। মাথা ফেটে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে শুভ্র মুখের চোয়াল বেয়ে। মায়াভরা মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে। বন্ধ চোখ দুটো যেন আকস্মিকতায় ছেয়ে গেছে। ঐ চোখে দেখা যাবে না আর বাঁকা চাহনি। মুখে ফুটে উঠবে না চঞ্চল হাসি। রক্তমাখা মেয়ের লাশকে বুকে চেপে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে রামিসা। বুক ফেটে বেরিয়ে আসে আর্তনাদ। সেই আর্তনাদের আওয়াজকে ছাপিয়ে শোনা যায় শুধু বন্দুকের ভয়ঙ্কর হুঙ্কার।
ছয়. আমরা আসলে কোনো জায়গায় এমনি হামলা করি না। যেই বেসামরিক স্থানে হামলা হয়েছে সেখানে অবশ্যই উগ্রপন্থীদের ঘাঁটি ছিলো। বেসামরিক স্থানে হামলার ব্যাখ্যা দিয়েছে ন্যাটো। স্বামী শাশুড়ি আর একমাত্র মেয়ে রিয়ানাকে হারিয়ে শরণার্থী শিবিরে যোগ দেয়া রামিসা হঠাৎ হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ওঠে। তার অশ্রুজল একটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। শিশু রিয়ানা কি জঙ্গি ছিল? এই নির্মম হত্যার বিচার কি পৃথিবীর কারো কাছে নেই? আজও সুভেলার আকাশে তারারা মুক্তোর মতো জ্বল জ্বল করছে। তাদের মাঝে বাঁকা চাঁদ হাসছে। তবে মুগ্ধ নয়নে এই সৌন্দর্য দেখার জন্য রিয়ানা নেই। তার জায়গায় রয়েছে ধ্বংসস্তূপের কালো ধোঁয়ায় ভেসে বেড়ানো বারুদের গন্ধ।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ