বালক ও জাদুকর

বালক ও জাদুকর

গল্প আগস্ট ২০১৪

মাখরাজ খান

Balokবাবা-মা মরা ছেলে, বাড়িঘর নেই, সেখানে ইচ্ছা যায়। খয়রাত করে খায় আর যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুমায়। একদিন সে নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলো, সকাল থেকে খাবার মেলেনি। খুব ক্লান্তি লাগছে, সে একটা বড় পাথরের ওপর বসে পড়লো। বিরাট পাথর, অনেক দিন রাস্তার ধারে পড়ে থেকে পাথরের ওপর শ্যাওলা ধরে গেছে। চার পাশে বড় বড় ঘাসের ছোবা গজিয়েছে। কাছেই একটা বিরাট বটগাছ, এর ডালপালা পথের দিকে ছাতার মতো ছায়া দিচ্ছে। বসে পড়ার পর ছেলেটির ঘুমাতে ইচ্ছে হলো আর শুয়ে পড়ার পর সে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমের পর স্বপ্ন। পেটে কিছু না থাকলেও ক্লান্ত মানুষ শুয়ে পড়ে কিন্তু ঘুম আসে না। ছেলেটির হলো বিপরীত। সে শুধু ঘুম নয়, ঘুমিয়ে পড়ার পর স্বপ্ন দেখতে লাগলো। পাথরের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে, তার কানে যেন কে ফিসফিস করে বলছে, শুধু আওয়াজ, শুধু ফিসফিস। কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষের ঘুমই বা কতক্ষণ থাকে আর স্বপ্নই বা কতক্ষণ স্থায়ী হয়। সে জেগে উঠলো। আশ্চর্য! জেগে ওঠার পরও কানের কাছের সেই ফিসফিস শব্দ বন্ধ হচ্ছে না। কে যেন তার কানের কাছে ফিসফিস করছে। সে পাথরের ওপর কান লাগালো, ভেতর থেকে ফিসফিস আওয়াজ আসছে। প্রথমে সে মনে করলো পুরনো পাথর। জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে, হয়তো পিঁপড়া বা উইপোকা পাথরের ভেতর ঢুকে এ ধরনের আওয়াজ করছে। অথবা হয়তো বাতাস গাছের মধ্যে আওয়াজ করছে। অথবা হয়তো বাতাসে গাছের মধ্যে আওয়াজ হচ্ছে। সে মনে করছে পাথরের ভেতর গুনগুন করছে। ওসব না, পাথরের ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে। মানুষের গলায় কে যেন ডাকছে। হে বালক, আমাকে রক্ষা কর, আমি এখানে বন্দী হয়ে আছি। সাত শতাব্দী ধরে বাইরের দুনিয়ার সাথে আমার যোগাযোগ নেই। এখানে এমন জায়গা যে মরিও না, বের হতেও পারি না। তুমি যখন এই পাথরের ওপর এসে বসেছো, তখনই আমি বুঝতে পেরেছি একমাত্র তুমিই আমাকে রক্ষা করতে পার, তোমার শরীরের গন্ধ আমি এই পাথরের ভেতর থেকে পেয়েছি। পবিত্র ঈস্টারে তোমার জন্ম। হে ঈস্টারের জাতক, প্রভু যিশুর দোহাই আমাকে উদ্ধার কর। বালকটি জবাব দিলোÑ একে তো আমি ক্ষুধার্ত, তার ওপর এতিম, না আছে বাপ-মা, না আছে অন্য কিছু। আমি কিভাবে তোমাকে উদ্ধার করবো? পাথরের ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, একমাত্র তুমিই আমাকে এখান থেকে মুক্তি দিতে পার। ডান দিকে যে বন আছে সেখানে যাও, বনের ভেতরে গেলে তুমি রয়ান গাছ পাবে, যার পাতা ছোট ছোট ও রং উজ্জ্বল লাল। এর ডাল আঙুলের মতো সরু, এতে সুস্বাদু ফল ফলে আর এ ফল খেলে রোগীরা ভালো হয়ে যায়। Ñ তাতো বুঝলাম, তুমি তো রোগী না। তোমাকে ঐ গাছ এনে দিলে কী হবে? আর ফল এনে দিলেই বা তোমার কী উপকার হবে। Ñ বৎস! আমার ফলের দরকার নেই, তুমি ঐ গাছের কয়েকটি ডাল কেটে আন আর সূর্যের দিকে মুখ রেখে ঐ ডালে আগুন ধরাও, তারপর এই পাথরটির চার পাশে ৯ বার প্রদক্ষিণ কর। এতে পাথর ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে আর আমি এখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো। যদি তুমি আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করো, তা হলে তোমাকে আমি অনেক ধন সম্পদ দেবো। তুমি হবে সবচেয়ে ধনী-মানি শান-শওকতওয়ালা বাদশাহ। বালকটি ভাবলো, বিপদে মানুষকে উদ্ধার করা মানবধর্ম কিন্তু পাথরের ভেতর যে কথা বলে সে মানুষ না জিন, ভালো না খারাপ কিছুই জানা নেই। গর্ত থেকে বেরিয়ে যদি ঘাড় মাটকাতে চায়, তা হলে হবে আরেক বিপদ! ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করা যায়। কিন্তু অত অল্প বয়সে মরণজ্বালা সহ্য করবো কিভাবে? Ñ কী, কথা বলছ না কেন? Ñ কী বলবো? ভাবছি তুমি ভালো না খারাপ? পাথর থেকে বেরিয়ে যদি তুমি আমার ক্ষতি কর, যদি জনপদে গিয়ে মানুষের ওপর অত্যাচার চালাও। তোমাকে শপথ করতে হবে, এখান থেকে বেরিয়ে কোনো মানুষের ক্ষতি করতে পারবে না। পাথরের ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, তোমার কথা মেনে নিলাম। কারো ক্ষতি করবো না, অকারণে কাউকে কষ্ট দিব না। বেশ যদি তাই হয়, তা হলে আমি যাত্রা করলাম। বনে যাব, রয়ান গাছ আনবো, তারপর তোমাকে মুক্ত করবো। Ñ যাও বৎস! আমার দোয়া তোমার সঙ্গে রইলো। যুবকটি হাঁটতে হাঁটতে বনের কাছে পৌঁছে গেলো কিছুক্ষণের মধ্যে। বিরাট বন, বড় বড় গাছপালা, তাকে রয়ান গাছ খোঁজার জন্য বনের ভেতর যেতে হবে। লতাপাতা সরিয়ে, মরা পাতা মাড়িয়ে সে বনের ভেতর প্রবেশ করলো। বেত ঝাড় আছে, পাটিপাতা গাছ আছে, স্বর্ণলতা আছে কিন্তু রয়ান গাছ কোথায়? বেলা দ্বিপ্রহরে সূর্যের দিকে মুখ করে তাকে ৯টা পাক দিতে হবে পাথরের চারদিকে। শেষ পর্যন্ত সে রয়ান গাছ পেয়ে গেলো। লাল উজ্জ্বল পাতা, লোহার মতো শক্ত ডালপালা। ছুরি দিয়ে কয়েকটা ডাল কাটলো, পাতা ছাঁটলো তারপর সেগুলো খণ্ড করে একটা বান্ডিলের মতো করে রওনা দিলো সেই পাথরের দিকে। তখন বিকেল হয়ে গেছে কিন্তু সূর্য ডোবেনি। সে পাথরের কাছে এসে বললো, আমি এসে গেছি, এখন আমার কাজ শুরু করবো। Ñ শুভস্য শীঘ্রম বৎস! প্রথমে সে দেখে নিলো কাঁচা ডালে আগুন ধরবে কি না, ডালগুলি কাঁচা দেখালেও প্রকৃতপক্ষে এ ডালে আগুন ধরাতে কোনো অসুবিধা নেই। সে ঘুরতে শুরু করলোÑ একটা করে পাক দেয় আর একটি করে কাটা ডালের খণ্ড মাটিতে নামিয়ে রাখে। তারপর আর একটি ঘুরানি দেয়Ñ এভাবে যখন নয় বার প্রদক্ষিণ করা হয়ে গেলো, সে চকমকি পাথর ঠুকে আগুন ধরিলে দিলো। কয়েকটি ছোট্ট কাষ্টখণ্ড, কিন্তু কী ধোঁয়া হচ্ছে আগুন দেয়ার পর, তারপর জ্বলে উঠলো দপ করেÑ যেন মাটি ফেটে আগুন বেরুচ্ছে। পাথরটি নড়ছে, কাদামাটির মতো নরম হয়ে গেছে পাথর। আশপাশের গাছপালা এমনকি বিরাট বটগাছটিও দুলছে সমান তালে, তারপর হঠাৎ একটা বিকট শব্দ হলো আর পাথরটি ইটের গুঁড়ার মতো গুঁড়া হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। ধীরে ধীরে ভগ্ন পাথরের স্তূপ থেকে উঠে এলো ছোট্ট একজন মানুষ। তার গায়ে শ্যাওলার গন্ধ। মনে হয় পাথরের ভেতর থেকে সে নিজেও পাথর হয়ে গেছে আর গায়ে শ্যাওলা ধরে গেছে। এই ক্ষুদ্র অদ্ভুত মানুষটি লাফ দিয়ে যুবকটির ঘাড়ে উঠলো আর তার গলা জড়িয়ে ধরে চুম্বন করতে লাগলো। চারদিকে ধুলাবালি আর ভাঙা পাথরের স্তূপ। এর মধ্যে লোকটা এসে চেপে বসেছে বালকটির ঘাড়ে, বালক ভীত, সে এখন কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। এমন সময় লোকটা বালকটির কানের কাছে মুখ এনে বলতে লাগলোÑ আমি ছিলাম বিখ্যাত জাদুকর। অদ্ভুত জাদু দেখিয়ে আমি বিত্ত ও খ্যাতি দুই-ই লাভ করে ছিলাম। আমি শুধু একজন জাদুকরই ছিলাম না, একজন চিকিৎসক ছিলাম, আমার ওষুধবিহীন চিকিৎসায় মানুষ ও úশু-পাখির কঠিন রোগ ভালো হয়ে যেতো। মানুষের ওপর অশুভ শক্তি ভর করলে অথবা কাউকে ডাইনিতে ধরলে আমি ঐ অশুভ শক্তি বা ডাইনিকে দেশ ছাড়া করতাম। এ কারণে অন্যান্য জাদুকরেরা আমার ওপর গোস্বা হয়ে গেলো, কারণ তারা টাকা খেয়ে শত্রুতা উদ্ধার করার জন্য মানুষের ওপর এই সব অশুভ শক্তি চালান করে দিতো। আমার কারণে যখন তারা কোণঠাসা, তখন এসব শয়তান জাদুকরেরা মিলে প্রচুর টাকা খরচ করে দক্ষিণাঞ্চল থেকে একজন জাদুকর নিয়ে এলো। তারা আমাকে কৌশলে এই জায়গায় নিয়ে এলো, না ছিলো আমার অন্যকে জাদু করার প্রস্তুতি, না ছিলো অন্যের জাদু থেকে বাঁচার প্রস্তুতি। তারা হঠাৎ আমার চোখ বেঁধে ফেললো আর এই পাথরের গুহায় নামিয়ে এর মুখ বন্ধ করে দিলো। ওরা বলেছিলো, পবিত্র ঈস্টারে জন্মগ্রহণকারী কোন পুরুষ তোমাকে উদ্ধার করতে পারবে। যখন আমাকে এখানে রাখা হয় তখন এটা ছিলো নির্জন জায়গা। দু-এক মাইলের মধ্যে কোনো জনবসতি ছিলো না। বন ছিলো আর বনের পাশে নদী। সাত শ’ বছরে বন সরে গেছে আর নদী মরে গেছে। যাই হোক, তুমি আমাকে নতুন জীবন দান করেছ। আমার প্রতিজ্ঞা আমি রক্ষা করবো, তোমাকে ধনে মানে সেরা মানুষ বানাবো। ছেলেটি বললো, আমি তো গরিব, এই দুই দিনে শুধু বনের কুড়ানো ফল আর ঘাস পাতা খেয়ে বেঁচে আছি। আমার সঙ্গে থাকলে তোমার যে না খেয়ে থাকতে হবে। কানের ভেতর ক্ষুদ্র লোকটা আওয়াজ দিল, সাত শ’ বছর আমি না খেয়েই ছিলাম। ইতোমধ্যে লোকটা আরো ছোট হয়ে গেছে এবং সে একটা মশার আকার ধারণ করেছে। এখন আর আমার খাবারের দরকার নেই। সাত শ’ বছর বন্দী থেকে আর আহার না করে আমার পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান অর্জন হয়েছে। এখন পৃথিবীর সব রহস্য আমার চোখের সামনে ভাসে, সব অদৃশ্য আমি দেখতে পাই। তুমি উত্তর দিকে যাত্রা কর। ছেলেটি চলতে লাগলো। পথে তিনজন লোকের সাথে দেখাÑ এরা গণক। ক্ষুদ্র লোকটা ফিসফিস করে জানালো, ওদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় কর আর ওদের দলের একজন হয়ে যাও। ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো, তারা কোথায় যাচ্ছে? গণকদের একজন তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, তুমি একজন বালক, আমাদের গন্তব্যের কথা শুনে তোমার কী লাভ? ছেলেটার কানের ভেতর আবার ফিসফিস আওয়াজ এলো, ছেলেটা বললো, লাভ কিছু নেই তবে তোমাদের একজন বালক তো, দরকার হতে পারে। যে তোমাদের খাবার সময় থালা বাসন ধুয়ে দিবে। তোমাদের ঘুমানোর সময় বিছানা পেতে দিবে আর তোমাদের আজ্ঞাবাহী হয়ে থাকবে। আমার কেউ নেই, তোমাদের সেবা করলেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো। গণকদের একজন সবার মুখের দিকে চেয়ে বললো, ঠিক আছে থাক। তারা চারজন চলছে, মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য। তারা হাঁটতে হাঁটতে এক লোকালয়ের কাছে উপস্থিত হলো। গণকদের একজন বললো, চল ঐ গাছের নিচে বসে একটু জিরিয়ে নেই। Ñ ও গাছের নিচে জিরাব কেন? একটা ফলগাছ দেখে জিরাই, যদি পাকা ফল পড়ে খেতে পারবো, না হয় ওকে গাছে চড়িয়ে দিয়ে পেড়ে খাব। বালকের দিকে লক্ষ্য করে বললো একজন। Ñ না, ওখানেই জিরাই। গাছের নিচে পড়ে আছে কতগুলি ছেঁড়া কাপড় আর একটা ছেঁড়া ব্যাগ। গণকদের একজন বললো, না রে এখানে বসবো না। কানের ভেতর থেকে ক্ষুদ্র মানুষটি বালককে জানিয়ে দিলোÑ ঐ পুরনো ব্যাগটি নাও, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। বালকটি পুরনো ব্যাগের কোনা ধরে টান দিয়ে নিজের কাঁধে ফেললো। গণকেরা বললো, এটা দিয়ে কী করবে? এটা তো জন্মের ছেঁড়া। Ñ থাক না কাছে। Ñ থাক। ছেলেটি ছেঁড়া ব্যাগটি কাঁধে তুলে নিলো। ব্যাগটি যত হালকা মনে হয়েছিলো, ততটা হালকা নয়, বেশ ভারী। গণকের দল আগে, ছেলেটা পেছনে। Ñ হে বালক, তুমি কি জান, আমরা কোথায় যাচ্ছি? Ñ তোমরা তো আমাকে বলনি। Ñ তা হলে শোন, আমরা যাচ্ছি রাজবাড়িতে রাজকুমারী নিখোঁজ, তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তুমি কি এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পার? কানের ভেতর থেকে ক্ষুদ্র লোকটা বললো, Ñ রাজি হয়ে যাও। আমি জানি রাজকুমারী কোথায় আছে। Ñ পারবো। বললো ছেলেটি। তা হলে এখন থেকে তুমিও আমাদের দলের একজন। আমরা রাজার কাছে গিয়ে বলবো, গণৎকার চারজন। পাঁচজন, মিনমিন করে বললো ছেলেটি। Ñ পাঁচজন। Ñ চার আর পাঁচ একই কথা। Ñ তা যা বলেছ। যাহা বায়ান্ন তাহাই তিপান্ন। রাজার দরবারে গিয়ে হাজির হওয়ার আগে তারা আবার এক জায়গায় বসলো। ফাইনাল শলা পরামর্শ করতে চায় কিন্তু ক্ষুধায় যে পেট জ্বলে যাচ্ছে। কানের ভেতর থেকে ক্ষুদ্র লোকটা বললো, ব্যাগের কাছে খাবার চাও, তোমরা যে কিসিমের খাবার পছন্দ কর, সেই কিসিমের খানা তোমাদের সামনে হাজির করবে। ছেলেটি কোনো কথা না বলে সোজা ব্যাগটির কাছে গিয়ে বললো, আমাদের সবার জন্য খানা হাজির কর। ব্যাগটি লম্বা হতে থাকলো আর এর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা টেবিল। টেবিলের ওপর কাপড় এসে টেবিল ঢেকে দিলো। হাজির হলো নানা রকম সুস্বাদু খাবার। চেয়ার এসে হাজির হলো চারজনের সামনে। গণৎকারেরা তো হতবাক! এ কী! এ যে দেখছি জাদুর ব্যাগ। সবাই ক্ষুধার্ত। তারা খানা খেলো পেটপুরে। তারপর একটু বিশ্রাম করলো, ব্যাগটি আগে যেমন ছিলো তেমনি জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেলো। খানার ডিস, টেবিল, চেয়ার হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। রাজদরবারে হাজির হলো তারা পরদিন সকালে। রাজা বিষণœ, দরবারিরা চুপচাপ। গণৎকারদের দেখে রাজা বিষণœতা কিছুটা কাটিয়ে উঠলেন। Ñ তোমরা কি পারবে? গণৎকারেরা সবাই চুপ। তারা আশা করছে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি রাজার প্রশ্নের জবাব দেবে। Ñ হ্যাঁ পারবো মহারাজ। রাজা ইঙ্গিত করলেন ছেলেটিকে সামনে আসার জন্য। Ñ তুমি তো বাচ্চা ছেলে, আমার মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে নদীর জলে, কতদিন হয়ে গেলো? দরবারিরা বললো, জাঁহাপনা ছেলেটা যখন বলছে চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী? Ñ ঠিক আছে। গণৎকার আর ছেলেটিকে নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে রাজকর্মচারীরা দেখাতে লাগলো, হ্যাঁ এখান থেকেই রাজকুমারী নিখোঁজ হয়ে গেছে। আমরা কত খুঁজেছি, তার সন্ধান পাইনি। রাজা অদূরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছলেন। রানী চোখ মোছার জন্য দাসীর কাছে রুমাল চাইলেন। বালকটি এদিক ওদিক তাকালোÑ মরা নদী, সামান্য পানি আছে, এখানে কেউ নদীর পানিতে ডুবেও মরতে পারে না। ভেসেও যেতে পারে না। রাজকুমারীকে হয়তো কেউ অপহরণ করেছে। ছেলেটির কানের ভেতর থেকে আবার মশার গুনগুনের মতো আওয়াজ হলোÑ রাজকুমারীকে দৈত্য অপহরণ করেছে, তুমি নদীতে নাম আর পায়ের তলায় যে গর্ত পাবে তাতে সজোরে আঘাত করো। ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে নদীতে নেমে গেলো, যা ভেবেছিল তাই। কোমর পানি, তবে বেশ পরিষ্কার। পায়ের নিচে একটা মাছের খাড়ের মতো মনে হচ্ছে। সে সজোরে ডান পায়ের গোড়ালি দিয়ে আঘাত করলো আর সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যেমন গাছ থেকে নিচে পড়ে যায়, তেমনিভাবে সে নিচে পড়ে গেলো। প্রশস্ত রাস্তা, সামনে রাজপ্রাসাদের মতো পেল্লাই দালান। দালানের রঙ লাল আর দরজার পাশে বিরাট দুই সিংহ হাঁ করে বসে আছে। প্রথমে বালকটি মনে করলো এরা হয়তো পাথরের সিংহ নয়। রক্তমাংসের জীবন্ত পশুরাজ। বালকটিকে কানের ভেতর থেকে জাদুকর স্মরণ করিয়ে দিলোÑ ভয় পেয়ো না, এগিয়ে যাও। সিংহটি দু-একবার হুঙ্কার ছাড়ল বটে কিন্তু আক্রমণ করলো না। বালকটির সাহস বেড়ে গেলো, সে মনে করলো এটা জীবন্ত সিংহ হলেও মানুষখেকো নয় আর দেখতে ভয়ঙ্কর হলেও কাউকে আক্রমণ করে না। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর বালকটি দু’টি ভল্লুকের সাক্ষাৎ পেলো। ভল্লুক দু’টিও একইভাবে বসে আছে। কানের ভেতর থেকে এবার জাদুকর বলে দিলো ভল্লুক কিন্তু সিংহের মতো নয়। ওদের সামনে মধু রাখ। ওদেরকে প্রলোভন দেখাও। তারপর সামনে যাও। রাজকুমারী সামনের কামরায়ই আছে। বালকটি জাদুকরের কথা মতো কাজ করলো। তার কাঁধের ঝোলা তাকে মৌচাক এনে দিলো। সবুজ দালানের সবুজ কামরা, সেখানে সবুজ রঙের বাতি জ্বলছে। জানালা দিয়ে দেখা যায় ঘরের দরজায় দু’টি তালা একটি সোনার অপরটি রুপার। ভল্লুক দু’টি মধু খাওয়ার সময় বালকটি সোনার আর রুপার তালার চাবি হস্তগত করেছিলো, এবার সেই চাবি দিয়ে দরজার তালা খুলে ফেললো। ঘরের পালঙ্কে শুয়ে আছে রাজকুমারী, সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার পাশে আরো দু’জন রাজকুমারী। তাদের বয়স, চেহারা, পরিধানের বস্ত্র সবই একই রকম। বালকটি ধান্ধায় পড়ে গেলো। মহা মুশকিল তো, উদ্ধার করতে এলাম একজন রাজকন্যা, এখন দেখি তিনজন। কাকে উদ্ধার করি, কাকে রেখে যাই। কানের ভেতর থেকে জাদুকর চুপি চুপি জানিয়ে দিলো, যার মাথায় লাল ফিতা বাঁধা তাকে স্পর্শ কর। আর দু’জনের ধারে কাছেও যেয়ো না। তাই করলো ছেলেটি আর রাজকুমারীর ডান হাত ধরে সরু পথে বের হয়ে এলো। নদীর তীর থেকে তখন সবাই চলে গেছে, বিষণœ হয়ে বসে আছেন রাজা আর রানী। তারা রাজকন্যাকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর বালকটির কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, তুমি আমাদের সাথে রাজপ্রাসাদে চল।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ