বিচিত্র পাখি ফ্লেমিঙ্গো -জাহিদ ইকবাল

বিচিত্র পাখি ফ্লেমিঙ্গো -জাহিদ ইকবাল

প্রচ্ছদ রচনা সেপ্টেম্বর ২০২০

উজ্জ্বল কমলা বর্ণের পালকের জন্য ফ্লেমিঙ্গোরা পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে সুন্দর পাখিদের মধ্যে অন্যতম। ফ্লেমিঙ্গোদের উজ্জ্বল গায়ের রং পাখিদের দুনিয়ায় এক অপূর্ব সৌন্দর্যের প্রতীক।
এরা অগভীর জলাভূমি, উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ জলাভূমি এবং বালুময় দ্বীপের তীরে চরে বেড়াতে পছন্দ করে। ক্যালিবিয়ান ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপ পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ফ্লেমিঙ্গো পাওয়া যায়।
ফ্লেমিঙ্গো শব্দটি স্পেনীয় এবং লাতিন শব্দ ফ্ল্যামেনকো থেকে এসেছে। যার অর্থ আগুন। পাখিটির পালকের উজ্জ্বল বর্ণের জন্যই এমন নাম। তবে সব ফ্লেমিঙ্গো উজ্জ্বল বর্ণের নয়। কিছু কিছু পাখি ধূসর বা সাদা। অল্প বয়স্ক পাখিরও কম রঙ থাকে।
বিশ্বে মাত্র ছয়টি প্রজাতির ফ্লেমিঙ্গো রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রজাতির উপ-প্রজাতি রয়েছে।
ফ্লেমিঙ্গোর পা সরু ও লম্বা, নিম্নমুখী ঠোঁট, লেজ খাটো, গলা লম্বা ও বক্রাকার। এদের উচ্চতা ৯০ থেকে ১৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। ওজন প্রায় ৪.৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এদের সবার শরীরের কিছু অংশ গোলাপি বর্ণ ধারণ করে। এরা ৬০ কিলোমিটার বেগে একটানা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার উড়ে নিজের বাসস্থানে পেঁৗঁছাতে পারে।
এই সুন্দর পাখিটি তাদের জীবনের ২০ শতাংশ সময় ব্যয় করে তাদের পালক পরিষ্কার করতে, কারণ এদের বিশেষ একটি গ্রন্থী থাকে যা থাকে তৈল নিঃসৃত হয় এবং ঠোঁটের মাধ্যমে তারা এই তৈলকে সর্বাঙ্গের পালকে ছড়িয়ে দেয়।
সাধারণত এই পাখিরা কলোনি হয়ে বসবাস করে। প্রতিটি কলোনি এতোটাই বড় হয় যে, অনেক সময় দশ লক্ষাধিক পাখি একই কলোনিতে বসবাস করতে দেখা যায়।
এরা মনোগেমাস অর্থাৎ সারা জীবন এদের একটি মাত্র সঙ্গী থাকে। এরা বছরে মাত্র একটি ডিম দিয়ে থাকে। পুরুষ এবং নারী দুজন মিলেই ডিমে তা দেয় এবং ডিম থেকে বাচ্চা বের হাওয়ার সাথে সাথে নারী-পুরুষ যৌথভাবে বাচ্চাকে লালন-পালনের দায়িত্ব নেয়।
যদি ফ্লেমিঙ্গো শিকারি দ্বারা বা কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয়, তবে এদের সংখ্যা আবার বৃদ্ধি পেতে কয়েক বছর সময় নিতে পারে।
জন্মের সময় এদের পালকের রং সাদা বর্ণের হয়। এরা গোলাপি, কমলা বা লাল রঙ হওয়ার জন্য তিন বছর সময় লাগে।
ফ্লেমিঙ্গোদের জীবনের প্রথম দিকে বাঁকানো ঠোঁট থাকে না, বয়স বাড়ার সাথে সাথে এদের ঠোঁট নিচের দিকে বেঁকে যেতে থাকে।
ফ্লেমিঙ্গো তাদের খাবারগুলোকে ফিল্টার করতে পারে। তারা শৈবাল, উদ্ভিদ উপাদান, পোকা-মাকড়, ব্রাইন চিংড়িসহ নানা ধরনের খাবার খেয়ে থাকে।
ফ্লেমিঙ্গোর গায়ে কমলা রং ধারণ করার পেছনে আছে এক বিশেষ কারণ। কারণটা হচ্ছে এদের খাদ্যাভ্যাস! ফ্লেমিঙ্গোরা সাধারণত সামুদ্রিক চিংড়ি এবং নিলাভ-সবুজ অ্যালজি খেয়ে থাকে, যেগুলোতে প্রচুর পরিমাণ কমলা রঙের স্যান্থাজ্যান্থিন নামক প্রাকৃতিক রং থাকে। মূলত এই প্রাকৃতিক রঙের প্রভাবেই এরা উজ্জ্বল কমলা রং ধারণ করে।
তবে চিড়িয়াখানায় রাখলে এদের রং পাল্টে সাদা হয়ে যায়। এ জন্য চিড়িয়াখানায় এদের রং ধরে রাখতে খাবারের সাথে কৃত্রিমভাবে স্যান্থাজ্যান্থিন মেশানো হয়।
ফ্লেমিঙ্গোদের একটি বিশেষ গুণ এরা বেশির ভাগ সময় এক পায়েই দাঁড়িয়ে থাকে। ফ্লেমিঙ্গোরা যদি দু’পায়ের বদলে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে তারা বেশি শক্তি সাশ্রয় করতে পারে। এটা বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন।
এটাকে এক রকম তাদের সিগন্যাচার পোজ বলেই ধরা যায়, যদিও কেন তারা এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সেটা বহুদিন ধরেই একটা রহস্য হয়ে ছিল।
কোনও কোনও গবেষকের ধারণা ছিল, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্যই বোধ হয় ফ্লেমিঙ্গোরা এক পায়ে দাঁড়ায়।
এখন আমেরিকার একদল বিজ্ঞানী প্রমাণ করেছেন এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকলে ফ্লেমিঙ্গোদের আলাদাভাবে সক্রিয় কোনও পেশিশক্তি খরচ করতে হয় না- ফলে তাতে তাদের এনার্জিও কম খরচ হয়।
আগে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, যেহেতু একপায়ে দাঁড়ানোর সময় ফ্লেমিঙ্গোরা একটু পরপর পা বদলায়, তাই বোধ হয় তারা মাসল ফ্যাটিগ বা পেশির ক্লান্তি কাটানোর জন্যই এমনটা করে।
আটলান্টার জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক ইয়ং-হুই চ্যাং এবং আটলান্টার এমোরি ইউনিভার্সিটির লেনা এইচ টিং ফ্লেমিঙ্গোর এই এক পায়ে খাড়া থাকার পেছনে মেকানিক্যাল রহস্যটা উদ্ধার করেছেন।
এই গবেষকরা তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন জীবিত ও মৃত, দু’ধরনের ফ্লেমিঙ্গো নিয়েই।
আশ্চর্যজনকভাবে তারা দেখেছেন, একটা মৃত ফ্লেমিঙ্গোকেও বাইরের কোনও সাহায্য ছাড়াই এক পায়ে খাড়া করে দাঁড় করানো সম্ভব।
রয়্যাল সোসাইটি জার্নাল বায়োলজি লেটার্সে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে তারা এই পদ্ধতির নাম দিয়েছেন ‘প্যাসিভ গ্র্যাভিটেশনাল স্টে মেকানিজম’।
ফ্লেমিঙ্গোরা সাধারণত ২০-৩০ বছর বেঁচে থাকে। তবে চিড়িয়াখানায় ৫০ বছর বা তার বেশি সময় বেঁচে থাকার রেকর্ড রয়েছে। বন্দী ফ্লেমিঙ্গো সাধারণত বেশি দিন বাঁচে কারণ তাদের কেউ শিকার করতে পারে না আবার এখানে পশুচিকিৎসা, যত্ন এবং প্রচুর খাদ্যের ব্যবস্থা থাকে।
ফ্লেমিঙ্গোর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় এদের আফ্রিকার তানজানিয়ার নাট্রোন হ্রদে বিচরণ। বিশ্বের ৭৫ শতাংশ ফ্লেমিঙ্গোর দেখা মেলে এখানে। প্রায় ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন ফ্লেমিঙ্গো বাস করে তানজানিয়ার এই বিষাক্ত হ্রদে।
এই হ্রদের পানি এত বিষাক্ত যে, মানুষের চামড়া এতে গলে যায়। অন্যান্য প্রাণীও এ হ্রদে বাস করে না। কিন্তু কোনো এক কারণে ফ্লেমিঙ্গোরা এ পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। এখন এই হ্রদ হুমকির মুখে।
তানজানিয়ার কস্টিক সোডা মিশ্রিত হ্রদ ও অতিরিক্ত লবণাক্ত হ্রদগুলোতে এ পাখি নিজেদের শান্তির আবাস বানিয়ে নিয়েছে। আফ্রিকার গ্রেট রিফট উপত্যকার ক্ষারীয় পানির হ্রদে খুদে নীল-সবুজ শৈবাল পাওয়া যায়; যা খেয়ে এ পাখি বেঁচে থাকে। কিন্তু বিষাক্ত এ শৈবাল প্রচুর ক্ষতিকর রাসায়নিক উৎপাদন করে থাকে, যা কোনো প্রাণীর পক্ষে হজম করা সম্ভব নয়। কিন্তু ফ্লেমিঙ্গোরা তা অনায়াসে খেয়ে জীবনধারণ করছে। যদিও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তাদের বর্ণিল পাখার মধ্যেই দেখা যায়। অর্থাৎ গোলাপি রঙের পালকের মূলে এই বিষাক্ত শৈবালের বিষক্রিয়া।
ফ্লেমিঙ্গোর অতিরিক্ত রুক্ষ চামড়া এবং শরীরের আঁশ তাদেরকে বিষাক্ত পানির জ্বালা-পোড়া থেকে বাঁচায়।
কাছাকাছি উষ্ণ পানির ঝরনা থেকে তারা সাধারণত পানি সংগ্রহ করে। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে লবণাক্ত পানিই তাদের ভরসা।
ফ্লেমিঙ্গোর মাথার কাছের গ্রন্থী অতিরিক্ত লবণ পাকস্থলীতে যাওয়ার আগে শুষে নেয় এবং তাদের নাকের গর্ত দিয়ে বের করে দেয়। খুব কম প্রাণী এ পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে চলার ক্ষমতা রাখে। ফলে বেঁচে থাকার জন্য ফ্লেমিঙ্গোকে প্রতিযোগিতা খুব কম করতে হয়।
ফ্লেমিঙ্গোরা একা থাকতে ভালোবাসে না। ঝাঁক বেঁধে বিষাক্ত হ্রদে থাকাটা তাদের জন্য আরামদায়ক। কিন্তু এ ধরনের লবণাক্ত হ্রদের সংখ্যা খুবই কম। পরিবেশ দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তাদের বসবাসের জায়গা হুমকির মুখে। প্রতি বছরই ফ্লেমিঙ্গোর সংখ্যা কমে আসছে। হ্রদগুলো থেকে সোডিয়াম কার্বোনেট বের করে নেয়ার ফলে হুমকির মুখে পড়ছে বৈচিত্র্যময় এ প্রজাতি।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ