বিজ্ঞানীর কবলে বিজ্ঞান

বিজ্ঞানীর কবলে বিজ্ঞান

উপন্যাস ফেব্রুয়ারি ২০১৪

এনায়েত রসূল..

(গত সংখ্যার পর) Uponnashদশ. সেই যে ডক্টর নিপুর সঙ্গে অপুর পরিচয় হয়েছিলো, তারপর কেটে গেছে অনেক দিন! কিন্তু কউ দুর্বোধ্য কারণে তার সঙ্গে একটা হৃদয়ের বন্ধন অনুভব করে অপু। ওর মনে হয়, ডক্টর নিপুর মতো ভালো মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই। গ্রামবাসীরা তাকে নিয়ে যেসব কথা বলছে, তারও কোনো সত্যতা নেই। কেনো যে এসব মনে হয়, অপু তা জানে না। কিন্তু আত্মীয়-পরিজনহীন এ মানুষটির পাশে গিয়ে যে দাঁড়ানো দরকার, অপু তা বোঝে। তাই গ্রামের লোকজন যখন হাটে-বাজারে ডক্টর নিপুর সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে, কিশোর অপু তখন দুর্বল কণ্ঠে তার বিরোধিতা করে। বলে, আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। ডক্টর নিপু খারাপ মানুষ নন। তাকে দিয়ে এ গ্রামের কোনো ক্ষতি হবে না। অপুর কথা শুনে ডক্টর নিপুর ওপর মানুষের রাগ আরো বাড়ছে। তারা বলেছে, ডক্টর নিপুর মতো অপুও এ গ্রামের মানুষ নয়। তাই অপু ডক্টর নিপুর পক্ষ টেনে কথা বলছে। এসব শুনে অপু যতো অপমানিত বোধ করেছে, যতো কষ্ট পেয়েছে, ডক্টর নিপুর প্রতি আকর্ষণ ততো বেড়েছে। তাই সকালে গ্রামবাসীরা যখন ডক্টর নিপুকে ঘিরে ধরলো, অপু তখন উল্টো পথ ধরলো। সবার চোখ এড়িয়ে অপু ছুটে চললো নূপুর ভিলার পথে। অপু ভাবলো, এ হতে দেয়া যায় না। একটা নিঃসঙ্গ নিরপরাধ মানুষকে সবাই এভাবে নাজেহাল করবে, আর অপু তা বসে বসে দেখবেÑএ হতে পারে না। বরং সমস্ত শক্তি নিয়ে অপু এ অন্যায়ের বিরোধিতা করবে। তবে তার আগে ডক্টর নিপুর প্রকৃত পরিচয় জেনে নেবে। কে তিনি, কোথা থেকে এসেছেন, নূপুর ভিলায় বসে কী করছেন তিনিÑ সব ওকে জানতে হবে। দুর্বার সাহস নিয়ে ছুটে চললেও নূপুর ভিলার সামনে এসে অপু থমকে দাঁড়াল। ভগ্নপ্রায় বাড়িটার দিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই অপুর সাহস উবে গেলো। অপু দেখলো, নূপুর ভিলার সারাটা চত্বর চেনা-অচেনা ঝোপঝাড় আর হাঁটু ছুঁইছুঁই লম্বা ঘাসে ডুবে আছে। ছড়িয়ে আছে ইটের টুকরো, ভাঙা জানালা-কপাট, আরো অনেক কিছু। তার মাঝ দিয়ে সরু একটা পায়েচলা পথ চলে গেছে। সম্ভবত ডক্টর নিপুর চলাচলের কারণেই সরু এই পথরেখাটা তৈরি হয়েছে। এগোবে কি এগোবে না, ভেতরে যাবে কি যাবে না ভেবে ভেবেই কেটে গেলো অপুর অনেকটা সময়। অবশেষে একটা স্থির সিদ্ধান্তে এলো সে। অপু ভাবলো, মাঝবয়সী মানুষটি একাকী যদি এই অভিশপ্ত বাড়িটাতে কাটাতে পারেন, তাহলে অপু সে বাড়িতে পারবে না কেনো? অপু তো অন্য ছেলেদের মতো ভীতু নয়! সেদিন রাতেও তো অপু একা একা নদীর পাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলো। কই, কিছু তো হয়নি ওর। আসলে মানুষের জীবনে খারাপ কিছু কমই ঘটে। মানুষ মিছেমিছে নিজের চারপাশে ভয়ের আবহ তৈরি করে রাখে। যারা ভীতু, যাদের মন সন্দেহপ্রবণ, তারা হয়তো ভয় পায়, কিন্তু অপু তো অমন নয়। ভয় কাকে বলে জানেই না অপু। তাহলে সে কেনো এতোটা পথ ছুটে এসে ভীতুর মতো ফিরে যাবে? না, যাবে না। এসব ভেবে অপু নিজেকে নিজে সাহস যোগালো। তারপর পা বাড়ালো নূপুর ভিলার দিকে। প্রশস্ত বারোটি ধাপের সিঁড়ি পেরিয়ে উত্তর-দক্ষিণে টানা বারান্দা। তার গায়ে লাগানো সারি সারি ঘর। ঘরের দেয়ালে বিশাল বিশার দরজা আর জানালা। ওগুলোর পাল্লা বন্ধ। অসীম কৌতূহল নিয়ে বন্ধ দরজারগুলোর দিকে তাকালো অপু। এক এক করে চোখ বুলালো ওগুলোর ওপর। তারপর হাত রাখলো সিঁড়ি বরাবর যে ঘর, ওটির দরজায়। অবাক কাণ্ড, দরজার গায়ে সামান্য চাপ প্রয়োগ করতেই ক্যাচক্যাচ শব্দ করে ওটা খুলে গেলো। অপু দেখলো, ওর সামনে রয়েছে বড়ো একটা হলঘর। তার দেয়ালগুলো আসলে যে কোন রঙের ছিলো তা বোঝা যাচ্ছে না। সারাটা দেয়ালে ছোপ ছোপ শ্যাওলা ফুটে আছে। এখানে-ওখানে পলেস্তারা খসে পড়েছে। উঁচু শিলিং থেকে ঝুলছে মাকড়সার জাল। আর ভেতর থেকে আসছে একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে গিয়েও এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালো অপু। একবার ফিরে তাকালো পেছন দিকে। তারপর ঢুকে পড়লো নূপুর ভিলার ভেতরে। এতোক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যে জিনিসটি চোখে পড়েনি, এবার তা চোখে পড়লো। অপু দেখলো, দেয়ালের দুরবস্থার সাথে এ ঘরের মেঝের কোনো মিল নেই। মেঝেতে বসানো রয়েছে বড়ো বড়ো টাইলস। নানা রঙের ফুল, লতাপাতা আঁকা রয়েছে ওগুলোতে। তার ওপর ধুলোর প্রলেপ পড়েছে। কিন্তু মেঝের সৌন্দর্য খুব একটা ম্লান হয়নি তাতে। এ ঘরটি ছেড়ে আরেকটি ঘরে ঢুকলো অপু। তারপর আরেকটি ঘরে। এমন করে নিচতলার সবগুলো ঘরে গেলো অপু। নিচতলার ঘরগুলো খাঁখাঁ করছে। ধুলো আর ঝুলে ভরে আছে দেয়াল আর শিলিং। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে চড়–ই আর পায়রার পালক। দুটো ভাঙা আলমারি রয়েছে দু’ঘরে। দুটোরই তাকগুলো শূন্য। এ ছাড়া আর কিছু নেই কোথাও। তার মানে নিচতলা ব্যবহার করে না কেউ। ডক্টর নিপু নিশ্চয়ই উপরে থাকেন। সেখানে তিনি কি করেন, কিভাবে সময় কাটান তা জানতে হলে অপুকে উপরে যেতে হবে। কিন্তু উপরে ওঠার সিঁড়ি কোথায়? এ পর্যন্ত ছ-সাতটা ঘর দেখা হয়েছে অপুর। উপর তলায় ওঠার সিঁড়ি কোথাও দেখেছে বলে মনে পড়লো না ওর। এখানে যে ঘরটাতে অপু দাঁড়িয়ে আছে, তার ডান পাশে রয়েছে আরো দুটো ঘর। ও দুটোতে ঢোকা হয়নি এখনো। সম্ভবত দুটোর একটাতে রয়েছে কাক্সিক্ষত সেই সিঁড়ি, ভাবলো অপু। শুধু ভাবলোই না, অপুর মনে দৃঢ় বিশ্বাসও জন্মালো। সুতরাং পা বাড়ালো সে প্রথম ঘরটার দিকে। তবে সেই ঘরেও সিঁড়ি দেখতে পেলো না। তার পরের ঘরটিতেও নয়। ব্যাপার কি? নূপুর ভিলার মানুষজন দোতলায় উঠতো কেমন করে? আর ডক্টর নিপু? তিনিই বা উপরে ওঠানামা করছেন কোন পথে? প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে খুব সাবধানে দোতলায় উঠলো অপু। দেখতে পেলো নিচের ঘরগুলোর তুলনায় উপরের ঘরগুলো অনেক সুন্দর। সাজানো-গোছানো, পরিচ্ছন্ন। দেয়ালের নীলচে রঙ এখনো ম্লান হয়নি। তার ওপর ছোটো ছোটো শ্যাওলা পড়েনি। মেঝের টাইলস ঝকঝক করছে। ঘরের দু’দিকে দুটো ঝাড়বাতি ঝুলছে শিলিং থেকে। পুব দিকের দেয়ালে রয়েছে হিরে-মুক্তো বাসানো পোশাক পরা জমিদার খানবাহাদুর আসাদউল্লাহ খানের পূর্বপুরুষদের ছবি। এ ঘরের পাশের ঘরটিতে রয়েছে কয়েকটি ছবি। তবে ওগুলো কোনো মানুষের ছবি নয়। সবগুলোই প্রাকৃতিক দৃশ্য। আর সবগুলোই সৃদৃশ্য ফ্রেমে বাঁধানো ইংরেজ শিল্পীদের আঁকা ছবি। রয়েছে ধুলোয় ঢাকা একটি মেহগনি কাঠের উঁচু পালঙ্কÑসিংহের আকৃতির পায়াগুলোর দিকে তাকালে শতাব্দী প্রাচীন এই পালঙ্কটির প্রতি যে কারো মনেই সম্ভ্রম জাগবে। তবে এটি যে বহুদিন ধরে অযতেœ অবহেলায় পড়ে রয়েছে, তোষক-জাজিমহীন পাঁজর বের করা মাচাগুলো দেখে তা সহজেই বোঝা যায়। এ ঘরটির পেছনে রয়েছে সমান আয়তনের আরো একটি ঘর। সে ঘরে ঢুকেই স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এলো অপুর বুকের ভেতর থেকে। অপু দেখতে পেলো সারাটা ঘরে ছুড়িয়ে আছে নানা রকম যন্ত্রপাতি। ছোটবড়ো কাচের পাত্রের ভেতর টগবগ করে ফুটছে লাল-নীল তরল পদার্থ। অস্বস্তিকর একটা কটু গন্ধ ভারি করে রেখেছে ঘরের বাতাস। টেবিলের ওপর পড়ে আছে দু-তিনটি টেস্টটিউব আর স্লাইড গ্লাস। আর রয়েছে ঝকঝকে একটি মাইক্রোস্কোপ। অপুর মনটাই খারাপ হয়ে গেলো এ ঘরে ঢুকে। এমন সব উদ্ভট যন্ত্রপাতি আর বিচ্ছিরি গন্ধঅলা শিশি-বোতল নিয়ে একজন বিজ্ঞানী কি করে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারেন, ভেবে পেলো না অপু। বরং ওর মনে প্রশ্ন জাগলো, ডক্টর নিপু সুস্থ মানুষ তো? নইলে এমন পরিবেশে তিনি বসবাস করছেন কেমন করে? অনেক আশায় বুক বেঁধে নূপুর ভিলায় এসেছিলো অপু। ভেবেছিলো এখানে এসে ডক্টর নিপু সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে। কিন্তু ওর সে আশা মনে হয় পূর্ণ হবে না। অচেনা সব যন্ত্রপাতি, চোখ-নাক জ্বলা গন্ধ আর ধুলোবালির মাঝে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো অপুর। সে ঘুরে দাঁড়ালো ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু যাওয়া হলো না। ঘুরে দাঁড়াতেই চোখ পড়লো একটা আলমারির ওপর। অন্য আলমারিগুলোর চেয়ে একটু এগিয়ে রাখা হয়েছে ওটা। কি এক আকর্ষণে একপা একপা করে অপু গিয়ে দাঁড়ালো আলমারিটার কাছে। অন্য দুটো আলমারির মতোই কারুকার্যময় আলমারি। ভেতরের তাকগুলো শূন্য। তবে পেছনে রাখা আছে সুদৃশ্য একটি কাঠের বাক্স। এ বাক্সটির চেহারা দেখে অপুর একটি কথা মনে পড়লো। কোনো এক বইয়ে পড়েছিলো, এমন সব বাক্সের ভেতর জলদস্যুরা তাদের ধররতœ লুকিয়ে রাখে। পরে সুযোগ মতো তা নিজেদের ভোগ-বিলাসের কাজে লাগায়। ডক্টর নিপু তেমনি কোনো জলদস্যু নন তো? কঠিন এ প্রশ্নটি ভাবিয়ে তুললো অপুকে। অপু ভাবলো, ডক্টর নিপু চমৎকার মানুষ তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বাইরের ব্যবহারটা তার আত্মগোপনের হাতিয়ারও তো হতে পারে, যেমন অনেকে করে। আর তার চেয়েও বড়ো কথা, ডক্টর নিপুর চালচলন আর দশটা মানুষের মতো নয়। নূপুর ভিলার মতো একটা অভিশপ্ত বাড়িতে তিনি একাকী বসবাস করছেন। প্রয়োজন ছাড়া মানুষজনের সামনেও আসছেন না। এ কি শুধুই বিজ্ঞান সাধনার জন্য, না অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? আর এই কাঠের বাক্স? কি আছে ওটার ভেতর? অপু আবার তাকালো কাঠের বাক্সটার দিকে। এবার একটি নতুন জিনিস চোখে পড়লো ওর। অপু দেখলো, বাক্সটাতে তালা লাগানো নেই! তালা লাগানো নেই কেনো? ভেতরে মূলবান কিছু রাখা হলে তো তালা লাগিয়ে  রাখাটাই স্বাভাবিক ছিলো। অপু ভাবলো, ডক্টর নিপুর সবকিছুই রহস্যময়। নূপুর ভিলায় কাক-পক্ষীও ঢুকতে সাহস পায় না। হয়তো সে জন্যই বাক্সে তালা লাগানোর প্রয়োজন বোধ করেননি তিনি। আসলেই কি বাক্সের ভেতরে মূলবান কিছু নেই, না তালা লাগনোর প্রয়োজন বোধ করেননি ডক্টর নিপুÑএ নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে বরং বাক্স খুলে ভেতরে কি আছে দেখা যাক। দুরুদুরু বুকে প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে বাক্সটির ডালা উঠালো অপু। অমনি ওর নাকে একটা চেনা চেনা গন্ধ এসে লাগলোÑ যে কোনো বন্ধ বাক্স খোলার পর যেমন গন্ধ নাকে এসে লাগে। কিন্তু সমস্যা হলো, যতোটা উৎসাহ নিয়ে অপু বাক্সটা খুলেছিলো, ততোটাই নিরুৎসাহিত হলো সে। অপু দেখলো, গুপ্তধন তো দূরের কথা, একটা মরচে পড়া পয়সাও নেই বাক্সের ভেতর। তার বদলে রয়েছে ডায়েরির মতো কয়েকটি বাঁধানো খাতা আর এক বান্ডিল চিঠি। শখের গোয়েন্দাগিরি করতে এসে এভাবে নাজেহাল হবার জন্য মানসিক ভাবে একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না অপু। তাই বাক্সের ভেতর অমন সাধারণ জিনিস দেখে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো সে। আর প্রচণ্ড রাগ হলো ডক্টর নিপুর ওপর। এ মানুষটি এ গ্রামে আসার পর থেকেই শুরু হয়েছে যতো ঝামেলা। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বাক্সের ডালাটাকে বন্ধ করলো অপু। তারপর নূপুর ভিলা থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে তখন সূর্যের আলো ঝকঝক করছে। গনগনে চুলোর মতো তেতে আছে সারাটা গ্রাম। সেই অসহ্য তাপ অগ্রাহ্য করে হনহন করে ছুটে চললো অপুর। এভাবে হেঁটে হেঁটে অনেকটা পথ আসার পর হঠাৎ একটি নতুন কথা মনে পড়লো অপু। অপু ভাবলো, কি আশ্চর্য! বোকার মতো ও চলে এলো কেনো? বাক্সের ভেতরে হীরে-মুক্তো ছিলো না। কিন্তু কয়েকটি ডায়েরি জাতীয় খাতা তো ছিলো। ডায়েরির পাতায় তো মানুষ তার জীবনের কথাই লিখে রাখে। ডক্টর নিপুও হয়তো ওগুলোর পাতায় পাতায় তার জীবনের কথা লিখে রেখেছেন। আর সে সব কথা অতি মূল্যবান বলেই তিনি যতœ করে বাক্সের ভেতর রেখেছেন। অপুর উচিত ছিলো অন্তত দু-একটি ডায়েরি নেড়েচেড়ে দেখা। তাহলে হয়তো ডক্টর নিপু সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতো। তবে কি আবার নূপুর ভিলায় ফিরে যাবে অপু? শেষমেশ নুপুর ভিলায় ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো অপু। তারপর দ্রুত ফিরে চললো উল্টো পথে। বারো কাঠের বাক্সটির ভেতর ছিলো মোট সাতটি ডায়েরি আর একচল্লিশটি চিঠি। সাল অনুযায়ী ডায়েরিগুলো সাজালো অপু। তারপর তুলে নিলো প্রথম ডায়েরিটিÑএটি ১৯৪৮ সালের ডায়েরি। ডক্টর নিপু এর পাতায় পাতায় লিখে রেখেছেন তার জীবনের নানা কথা। সে সব লেখার ভেতর কোথাও কোথাও এমন সব মজার কথা ছিলো যা অপুকে শুধু বিস্মিতই করলো না, প্রবলভাবে আকৃষ্টও করলো। অপু ভুলে গেলো নূপুর ভিলায় সে অনধিকার প্রবেশ করেছে। আর তার চেয়েও বড়ো অন্যায় করে চলেছে ডক্টর নিপুর বিনা অনুমতিতে তার ডায়েরির পাতায় চোখ রেখে। ডক্টর নিপু লিখেছেন : ২৫ এপ্রিল ১৯৪৮ সোনারং বন্দরে বাবার দোকান ছিলো। সেখানেই ছোট একটা খুপরিতে বাবা থাকতেন। মা আমাদের নিয়ে থাকতেন কুসুমপুর। ওটাই আমাদের গ্রাম। সোনারং থেকে কুসুমপুরের দূরত্ব ছিলো বারো মাইল। মাসে দু’বার বাবা আসতেন সোনাররং। সোনারং থেকে ফিরে যেতেন পরদিন কাক ডাকা ভোরে। কিন্তু সেই সামান্য সময়টুকুকেই হাসি-গানে ভরিয়ে তুলতেন বাবা। এতো আনন্দ মাখা ছিলো সেই দিনগুলো, যা আমাকে আজও মুগ্ধ করে রাখে। আজও আমার হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। ছেলেবেলায় রূপকথায় অনেক রাজকন্যার রূপের কথা পড়েছি। তাদের নাকি মেঘবরণ চুল, দুধে-আলতায় মেশানো গায়ের রঙ। তারা হাসলে মুক্তো ঝরে। কাঁদলে হীরের মতো অশ্র“র ফোঁটা ঝলমল করে। আমার মা কোনো রাজকন্যা ছিলেন না। তবে সে সব রাজকন্যার চেয়ে তিনি রূপবতী ছিলেন, এ কথা আমি হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করি। মা খুব ভালোবাসতেন বাবাকে। অধীর আগ্রহ বাবার ফিরে আসার দিনটির জন্য অপেক্ষা করতেন। রাতের পর রাত জেগে থেকে মা আমাদের বলতেন তার নিজের কথাÑআমার বাবার কথা আর বলতেন  রাজা-রানীর গল্প। মা বলতেন আমার বাবার রাজার মতো মন। খুব উদার আর সাহসী তিনি। আমি জানি না মা কেনো এ কথা বলতেন। তবে আমার নিজের কাছে বাবাকে খুব হাশিখুশি প্রাণোচ্ছল মানুষ মনে হয়েছে। তিনি আমাদের বন্ধু ছিলেন। এখনো মনে পড়ে সে সব দিনের কথা। জোছনা রাতে মাদুর বিছিয়ে উঠোনে বসতেন বাবা। তাকে ঘিরে বসতো গ্রামের ছেলে-বুড়োরা। বাবা বলে যেতেন সোনারং বন্দরের গল্প। বলতেন পদ্মার বুক চিরে স্টিমারগুলো কেমন করে কোলকাতা যায় সে সব কথা। আমি অভিভূত হয়ে যেতাম সে সব গল্প শুনে। খুব গর্ব হতো বাবার জন্য। কি সৌভাগ্যবান তিনি। স্টিমার দেখতে পান, দেশ-বিদেশের মানুষ দেখতে পান। কবে যে আমার অমন ভাগ্য হবে! ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে দূরের বন্দরে যাওয়ার জন্য কতো যে বায়না ধরেছি, কেঁদে বুক ভাসিয়েছি, তার হিসেব নেই। তখন দূরের পৃথিবীটা মায়ের মতোই হাতছানি দিয়ে ডাকতো আমাকে। আর আমার ইচ্ছা হতো রাজপুত্র-কোটালপুত্রের মতো অজানা পথ পাড়ি দিয়ে কোনো এক অচেনা রাজ্যে পৌঁছে যেতে। ইচ্ছে হতো পাখির মতো ডানা মেলে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে। আজ আমি দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আধুনিক জীবনযাত্রার সব সুবিধা উপভোগ করছি। কিন্তু মনে শান্তি পাচ্ছি না। কেমন একটা অতৃপ্তির হাহাকার ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার মনের মাঝে। বারবার মনে পড়ছে আমার জন্মভূমির কথা। আমার দেশের শাপলা-শালুক, নদ-নদীর ঢেউ আর পাখির কল-কাকলির কথা। আজকাল মাকে ভীষণ মনে পড়ে। মারা যাবার সময় আমার মাথায় হাত রেখে তিনি বলেছিলেন, দোয়া করি অপু, তুই অনেক বড়ো হবি। মানুষের প্রতি ভালোবাসায় যেনো তোর মন ভরে থাকে, সেই দোয়া করছি। তোর যেনো বিশ্বজোড়া নাম হয়Ñএ আমার কামনা। আমার কখনো বিশ্বজোড়া নাম হবে কিনা জানি না। শুধু জানি, মানুষের দুঃখে আমার মন কাঁদে। আমি চেষ্টা করি আমার সীমিত সাধ্য নিয়ে দুঃখী মানুষদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে এসেছি। এখানে থেকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর চেসেস্কোর তত্তাবধানে প্রাণিতত্ত্বের ওপর গবেষণা করবো। শুনেছি রাশভারী স্বভাবের প্রফেসর চেসেস্কো হাঙ্গেরির মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে চলে এসেছেন। প্রাণিতত্ত্ব খুব পরিচিত বিষয়। বিজ্ঞানীদের নানা আবিষ্কারের ফলে এ সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা হয়ে গেছে। তারপরও অজানাকে জানার চেষ্টা চলছে। তারই পথ ধরে মাঝে মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠছে অজানা অনেক তথ্য। বেরিয়ে আসছে পুরনো সমস্যার নতুন সমাধান। আমি তেমনি কোনো সমস্যার সমাধান খুঁজে ফিরবো। ৫ মে ১৯৪৯ ইউরোপীয়দের সম্পর্কে আমার একটা ভুল ধারণা ছিলো। কেনো যেনো মনে হতো এরা ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক। নিজেদের চারপাশে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে সেই দেয়ালের মাঝে থাকতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে এরা। কিন্তু প্রফেসর ডানহিলের সাথে আলাপ হওয়ার পর আমার সেই ধারণা মিথ্যে হয়ে গেলো। নতুন করে বুঝতে পারলাম, ভালো এবং মন্দ, আত্মকেন্দ্রিক এবং সর্বজনীনÑএ নিয়েই আমাদের এই পৃথিবী। কেমব্রিজশায়ারে এসেছি প্রায় দু’সপ্তাহ হলো। এর মাঝে রাতদিন ছোটাছুটি করে আমাকে অনেকের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছেÑবিশেষ করে যে সব অধ্যাপকের অধীনে কাজ করবো, তাদের সঙ্গে। আমাদের দূতাবাসে হাজিরা দিতে হয়েছে লন্ডন গিয়ে। রেঁধে-বেড়ে খাওয়ার মতো কিচেন হোল্ড সামগ্রী কিনতে হয়েছে। বেডকভার-কম্বল কিনতে হয়েছে। এ ছাড়াও আরো ছোটবড়ো কাজ করতে হয়েছে এ ক’দিনে। কিন্তু আজ হাতে কোনো কাজ ছিলো না। তাই সকালে নাশতার পাট চুকিয়েই হোস্টেল থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ইচ্ছে মতো ঘুরে বেরিয়েছি কেমব্রিজশায়ারের অলিগলি আর গ্রানাটা নদীর পাড় ছুঁয়ে। নদীর পাড় বাঁধানো। তাতে রয়েছে কংক্রিট আর ঢালাই লোহার বেঞ্চ। পথশ্রান্ত পথিক আর প্রকৃতিপ্রেমীরা সেখানে বসে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করে। অমনি একটি বেঞ্চে বসে দেখেছি অল ইউনিভারসিটির ইয়ট্স রেসÑযাকে বলা যায় নৌকা বাইচ। বিকেলের দিকে গিয়েছিলাম শহর ছেড়ে অনেক দূরে। এর অবশ্য কারণও ছিলো। আজ হোস্টেল থেকে বেরোবার সময় রিচার্ড বলেছিলো শহরতলী এলাকাটা দেখে আসতে আমি যেনো ভুলে না যাই। সেখানে একের পর এক দাঁড়িয়ে রয়েছে গির্জা, প্রাচীন দুর্গ, কারুকাজ খচিত রাজপ্রাসাদ আর ঐতিহাসিক স্মৃতিজড়িত ইমারতগুলো। রিচার্ডের বলে দেয়া গির্জা আর ভবনগুলো দেখা শেষ করে গিয়েছিলাম একটি প্রাচীন কলেজ ভবন দেখার জন্য। সেখানেই পরিচয় হলো প্রফেসর ডানহিলের সাথে। আর তার পরপরই ইউরোপীয়দের সম্পর্কে আমার ধারণা আমূল বদলে গেলো। প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন কলেজ ভবনের চুড়োর দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ পিঠের ওপর হাতের ছোঁয়া অনুভব করলাম। বুঝতে সমস্যা হয়নি আমার পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। ঘুরে তাকাতেই দেখলাম, সববয়সী এক ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। হাড় জিরজিরে শ্যাওলা পড়া একটা ভবনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক খুব মজা পেয়েছেন ভেবে মনে মনে অপ্রস্তুত হলাম। তাই কৈফিয়াত দেয়ার ভঙ্গিতে বললাম, দশম শতাব্দির নির্মিত ভবন তো, তাই মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সব সময়ই আমাকে আকৃষ্ট করে । আমি বিস্ময়ে আপ্লুত হয়ে যাই প্রযুক্তি আর শিল্পবোধের চমৎকারিত্ব দেখে। ভদ্রলোক বললেন, প্রাচীন নিদর্শনগুলো সত্যই ভাবিয়ে তোলে। মনে হয় সে যুগের স্থাপত্য বা প্রকৌশল দক্ষতা আমাদের চেয়ে খুব একটা পিছিয়ে ছিলো না। আপনি জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ, মিসরের পিরামিড, গ্রিসের জিউসের ধর্মশালা, আগ্রার তাজমহল আর টেমস নদীর সুড়ঙ্গ পথের কথা ভেবে দেখুন। একেকটি স্থাপনা একেক শতাব্দীর প্রতিনিধিত্ব করছে। অথচ মেকানিক্যাল আর টেকনিক্যাল দিকগুলো আজও আমাদের চমকে দিচ্ছে। মুগ্ধ করে রাখছে। আমি বললাম, ঠিক বলেছেন। আমি যখন কোনো প্রাচীন নিদর্শনের দিকে তাকাই, তখন সবচেয়ে আগে মনে পড়ে ওটার নক্শাবিদের কথাÑআই মিন আর্কিটেক্ট যিনি তার কথা। তারপর মনে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকদের কথা। কতো শ্রম, ত্যাগ আর মেধা মিলে আছে এক একটি সৃষ্টির সঙ্গে। তো মিস্টার, আপনাকে তো ... : চিনতে পারছেন না, এই তো? আমি কিন্তু ঠিকই চিনেছি আপনাকে। আমার নাম ডানহিলÑঅ্যালবার্ট ডানহিল। ক্রিটিক্যাল একটা জিনের ওপর গবেষণা করার জন্য কেমব্রিজে এসেছি। প্রফেসর ডানহিলের নাম শুনে আমি চমকে উঠলাম। এই স্কটিশ বিজ্ঞানীর নাম শোনেনি, এমন বিজ্ঞান অনুরাগী প্রায় নেই বললেই চলে। জিন উল্টাপাল্টা করে জীব-জন্তুর স্বভাব বদলে দেয়া সম্ভব বলে মতো প্রকাশ করায় প্রচণ্ড হৈচৈ ফেলেছিলেন তিনি বিশ্বজুড়ে। কয়েকটি দেশ আর বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গবেষণা চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেছিলো তাকে। গবেষণার ব্যয়ভার বহন করবে বলে প্রতিশ্র“তিও দিয়েছিলো। তিনি বিনয়ের সঙ্গে সেই সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেই স্বনামখ্যাত বিজ্ঞানী দাঁড়িয়ে আছেন আমারই পাশে, এ যেনো স্বপ্নেরও অতীত! তাই একটু সঙ্কোচের সাথে বললাম, দেখুন তো কি লজ্জার কথা! আপনি আমার এতো প্রিয়, এতো শ্রদ্ধেয়, অথচ আপনাকে চিনতে পারিনি। আমি খুব দুঃখিত। ডক্টর ডানহিল হো হো করে হেসে উঠলেন আমার কথা শুনে। সেই হাসির রেশ ধরে রেখেই বললেন, দুঃখ প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই ভাই। আজকাল তো মানুষ নিজেই নিজেকে চেনে না। সেখানে আমরা দু’জন তো দু’মহাদেশের মানুষ। না চেনারই কথা। আমি বললাম, একেবারেই যে চিনি না তা কিন্তু নয়। আসলে সামনাসামনি কখনো দেখা হয়নি তো, তাই ফিজিক্যালি চিনতে পারিনি। প্রফেসর ডানহিল বললেন, ওটা কোনো বিষয় নয়। আমার নামটা যে জানেন, আমার কাজকর্মের বিষয়ে বিন্দুমাত্র হলেও ধারণা আছে, তাই বা কম কি! তবে একটা অনুরোধ, আমাকে আর সদ্য পরিচিত মানুষদের মতো দূরে সরিয়ে রাখবেন না। আমি বললাম, আচ্ছা রাখবো না। আমাকেও কিন্তু দূরে সরিয়ে রাখা চলবে না। প্রফেসর ডানহিল বললেন, একজন কাছে এলে অন্যজন তো কাছে এসেই যায়। এটাই তো বিজ্ঞানের ধর্ম। তো, আগে কখনো এদিকে এসেছিলেন? বললাম,না। আজই প্রথম। এগারো দিন হলো কেমব্রিজশায়ারে এসেছি। এর মাঝে সব দিক সামলে সময় করে উঠতে পারিনি। আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে প্রফেসর ডানহিল বললেন, তবু ভালো যে সময় করে এসেছেন। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের আকর্ষণ দিনদিন কমে যাচ্ছে। ইট ইজ টু ব্যাড। তো, আমি এখন যাই। আবার দেখা হবে। অমায়িক হাসি উপহার দিয়ে বিদায় নিলেন প্রফেসর ডানহিল। আর একবুক ভালো লাগা নিয়ে আমি সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। ৯ ফেব্র“য়ারি ১৯৫০ নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। আজ রীতিমতো অপ্রত্যাশিতভাবে পরিচয় হলো স্বনামখ্যাত এক বিজ্ঞানীর সাথেÑতিনি নিকিতা তুশো। ডক্টর নিকিতা তুশো এ সময়ের এক সেরা প্রাণিবিদ। আগাছা থেকে ক্ষুধা নিবারণের ট্যাবলেট আবিষ্কার করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়ে ছিলেন। বিশেষ করে রাজকীয় জাপান সেনাবাহিনীতে এই ট্যাবলেটের ব্যাপক ব্যবহার ছিলো। ইন্টারন্যাশনাল বায়োলজিক্যাল সোসাইটির আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড এসেছেন তিনি। ডক্টর স্টোনহাইস, ডক্টর আলেজান্দর আনাতলি আর প্রফেসর মিন ফাউসহ কয়েক বিজ্ঞানীর সঙ্গে ডক্টর তুশো এসে উঠেছেন আমাদের হোস্টেলে। রাতে খাবার টেবিলে মুখোমুখি আলাপ হলো ডক্টর তুশোর সাথে। ডাইনিং টেবিলে একটি চেয়ার দখল করে ডানহিলের জন্য অপেক্ষা করছি, হঠাৎ ভেসে এলো এক ফ্যাসফেসে কণ্ঠÑহ্যালো মাই বয়! তোমার পাশে কি বসতে পারি? কয়েকদিন আগে হাইনরিখ ডক্টর তুশোকে দূর থেকে চিনিয়ে দিয়েছিলো। তার সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিলো। সে সব কথা ডক্টর তুশোর সম্পর্কে শুধু আমার কৌতূহলই বাড়িয়ে দেয়নি, শ্রদ্ধাও বাড়িয়ে দিয়েছিলো। তাই তিনি পাশে বসার অনুমতি চাইতেই আমি অভিভূত হয়ে বললাম, কি আশ্চর্য! বসতে পারবেন না কেনো? আপনার মতো বিখ্যাত ব্যক্তির সান্নিধ্য পাওয়া তো আমার সৌভাগ্য। আছেন কেমন, ডক্টর? ডক্টর তুশো স্মিত হেসে বললেন, ভালো, তবে একটু টায়ার্ড ফিল করছি। আর এজন্য পরোক্ষভাবে তুমিই দায়ী। : আমি? কেমন করে? ডক্টর তুশোর টায়ার্ড হওয়ার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক তা বুঝতে না পেরে অবাক হলাম আমি। ডক্টর তুশো বললেন, ঘাবড়ে গেলে? ঘাবড়াবার মতো কিছু বলেছি আমি? সে যা হোক, ছিলে কোথায় এতোক্ষণ? সেই সন্ধে থেকে ঘুরঘুর করে শুধু তোমাকেই খুঁজছি। এবার আরো অবাক হওয়ার পালা। ডক্টর তুশোর মতো স্বানামখ্যাত বিজ্ঞানী খুঁজে বেড়াচ্ছেন আমাকে! ব্যাপার কি? আমার মতো এক অতি নগণ্য ব্যক্তিকে কেনো খুঁজে বেড়াচ্ছেন তিনি জানতে চাইলে ডক্টর তুশো বললেন, কি যে বলো! তুমি হলে এশিয়ার তরুণ বিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিভাবান। তার ওপর গবেষণা করছো প্রাণিকোষ নিয়ে। পদার্থবিদ্যায় যে তোমার অভাবনীয় দখল আছে, তাও আমি জানি। বললাম, অভাবনীয় দখল কথাটা ঠিক নয়, বলতে পারেন পদার্থবিদ্যায়ও আমার আগ্রহ আছে। এমন আগ্রহ অনেকেরই থাকে। ডক্টর তুশো বললেন, নিজের সম্পর্কে দেখছি তোমার কোনো ধারণাই নেই! অথচ ভিন দেশের লোক হয়েও আমি তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। : যেমন? বিপুল কৌতূহল নিয়ে আমি তাকালাম ডক্টর তুশোর দিকে। ডক্টর তুশো বললেন, যেমন তোমার প্রাণিকোষ নিয়ে গবেষণার ব্যাপারটা। বলতে দ্বিধা নেই, প্রাণিকোষের বিষয়টাই তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছে আমাকে। আমি ভীষণ বিব্রত বোধ করলাম ডক্টর তুশোর মতো প্রখ্যাত বিজ্ঞানীর মুখে আমার প্রশংসা শুনে। খুবই অসহায় মনে হলো নিজেকে। আমি বললাম, আমার সম্পর্কে সম্ভবত আপনি ভুল শুনেছেন। আসলে গবেষক হিসেবে এখনো সফলতার মুখ দেখিনি আমি। আর বিজ্ঞানী হিসেবেও নিজেকে মনে করি তৃতীয় সারির একজন। ডক্টর তুশো মিষ্টি করে হাসলেন আমার কথা শুনে। রহস্যময় দৃষ্টি ছড়িয়ে বললেন, বিনয়ের ওপর যদি কোনো প্রতিযোগিতা হতো, আমি নিশ্চত তুমি প্রথম পুরষ্কার জিতে নিতে। সে যাক, এবার বলো কি করছো এখানে? বললাম, প্রাণিকোষ নিয়ে কয়েকটি জটিল গবেষণা মাঝপথে বন্ধ রেখেছি। এখন ব্যস্ত আছি থিসিস নিয়ে। শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না ওটা। : খুব টাফ সাবজেক্ট  বেছে নিয়েছো নিশ্চয়ই। কিসের ওপর থিসিস লিখছো? জানতে চাইলেন ডক্টর তুশো। বললাম, স্ট্রাকচার অ্যান্ড ইভ্যালুশন অব গেলোসের ওপর কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম একসময়। ওগুলোকে একটু বিশদভাবে বর্ণনা করে একটা কিছু তৈরি করছি। তেমন আহামরি কিছু নয়। ডক্টর তুশো বললেন, আহামরি কিছু নয় মানে? আমি তো বলবো সর্বকালের সেরা সাবজেক্ট বেছে নিয়েছো। এ জন্য ব্রিলিয়ান্ট সায়েন্টিস্ট অব এশিয়ার তালিকায় তোমার নাম এক নম্বরে বসাতে কোনো দ্বিধা নেই আমার। বললাম, আমি এশিয়ার, আপনিও তাই। এ কারণে একটু পক্ষপাতিত্ব আমি পেতেই পারি। কিন্তু যতোটা আস্থা নিয়ে বলছেন, আমি ততোটা ব্রিলিয়ান্ট নই। ডক্টর তুশো আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ঠিক আছে, কাজ করে যাও। প্রয়োজনে আমার সাহায্য পাবে। আমি বললাম, ধন্যবাদ ডক্টর। প্রয়োজন হলে অবশ্যই আপনার সাহায্য নেবো। এ কথার জবাব দিলেন না ডক্টর তুশো। যেমন হঠাৎ এসেছিলেন তেমনি হঠাৎ চলে গেলেন। আজ ডক্টর তুশো যেভাবে কথা শুরু করেছিলেন, তাতে মনে হয়েছিলো একটু গায়েপড়া গোছের লোক তিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার মতো নিরহঙ্কারী মানুষ খুব কমই আছে। দূরের মানুষকে কাছে টেনে নেয়ার জন্য যেমন মনের প্রয়োজন, তার রয়েছে তেমন একটি মন। বিজ্ঞানীরা সাধারণত এতোটা মিশুক হন না। ১১ ফেব্র“য়ারি ১৯৫০ নিজের ভালো লাগার মানুষটি সম্পর্কে অন্য কেউ যদি বিরূপ মন্তব্য করে, তাহলে বিব্রত না হয়ে উপায় থাকে না। আজ আমাকে পড়তে হয়েছিলো তেমন এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। বিকেলে গিয়েছিলাম এখানকার এক মলে কেনোাকাটা করার জন্য। সেখানে আলাপ হলো অপর এক জাপানী বিজ্ঞানী ইসিকাওয়া কুবুতার সাথে। অমায়িক ভদ্রলোক। সদা প্রফুল্ল একটা ভাব জ্বলজ্বল করে তার চেহারাতে। তার দিকে তাকালেই মন বলেÑএর কাছে মনের কথা খুলে বলা যায়। কথায় কথায় বললাম, আপনার দেশের আরেক বিজ্ঞানী খুব øেহের চোখে দেখেন আমাকে। অবশ্য তার মতো বড়ো মাপের মানুষের øেহ পাওয়ার যোগ্যতা যে আমার নেই আমি জানি। ইসিকাওয়া কুবুতা বললেন, আপনি কার কথা বলছেন? কে এমন অযোগ্য পাত্রে øেহবর্ষণ করছেন? বললাম, ডক্টর তুশোÑনিকিতা তুশো। চেনেন নিশ্চয়ই তাকে। ইসিকাওয়া বললেন, চিনি। বলতে পারেন একটু বেশিই চিনি। আর সে কারণেই আমার চেনাটা একটু অন্যরকম। : কি রকম? : সে না শোনাই ভালো। তবে এটুকু বলবো, সব চেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে বন্ধু চেনা অন্যতম কঠিন কাজ। অতি বুদ্ধিমানও বিভ্রান্ত হয় প্রকৃত বন্ধুকে চিনে নিতে। খুব গম্ভীর কণ্ঠে কথাগুলো বললেন ইসিকাওয়া। আমি বললাম, আমি আপনার সাথে একমত। ইসিকাওয়া বললেন, একমতই যদি হোন, তাহলে কথাটা বলা যায়। কোন কথা? আমি তাকালাম ইসিকাওয়া কুবুতার দিকে। তিনি বললেন, প্রকৃত বন্ধুর অপর বন্ধুকে যে কথাটা বলা উচিতÑ সেটাই আমি বলবো। প্রথম আলাপেই কাউকে আপন ভাববেন নাÑএমন কি আমাকেও। ডক্টর তুশোর কাছ থেকে একটু দূরে থাকবেন। আমি বিব্রত বোধ করলাম ইসিকাওয়া কুবুতার শেষ কথাটি শুনে। তবু ভদ্রতার খাতিরে কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে বললাম, সদুপদেশ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু কেনো? ইসিকাওয়া পুরনো বন্ধুর মতো আমার পিঠে হাত রাখলেন। তারপর বললেন, সব কথা সব সময় বলা যায় না। আর বললেও আপনার কাছে হয়তো তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। মাঝ থেকে ভুল বুঝবেন আমাকে। স্যরি, আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। একটা শর্ত আরোপ করে দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন ইসিকাওয়া কুবুতা। তার এই খোলসে ঢুকে পড়ার ধরনটা আমার ভালো লাগলো না। আমি তাই ক্ষোভ চেপে না রেখে বললাম, বেশ, জিজ্ঞেস করবো না। আর আমি তো যেচে জিজ্ঞেস করিওনি! আপনিই... : হ্যাঁ, আমিই যেচে কথা বলেছি। এ বদঅভ্যাসটা অনেক জাপনীর মাঝেই রয়েছে। এ জন্য আমি দুঃখিত। তবে আবার বলছি, যাচাই-বাছাই করে বান্ধুত্ব গড়ে তুলবেন। সবার কাছে নিজেকে মেলে ধরবেন না। আই মিন, আপনার গবেষণার ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে কাউকে কিছু বলবেন না। বললাম, সাবধান করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আর কিছু বলার আছে আপনার? ইসিকাওয়া কুবুতা ম্লান হাসলেন আমার দিকে তাকিয়ে। তারপর তাকালেন তার ঘড়ির দিকে। বোঝা যাচ্ছিলো আরো কি যেনো বলার রয়েছে তার, কিন্তু বলতে পারছেন না। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বলবেন? ইসিকাওয়া কুবুতা ধীরে ধীরে তাকালেন আকাশের দিকে। তারপর সারা মুখে কষ্টকৃত হাসি ছড়িয়ে বললেন, নাহ্। আর কি বলবো! তো আমি এখন যাই। কালই সিকোকু ফিরে যাচ্ছিÑআমার দেশের বাড়ি। ভাবছি এবার কিছু দিন গাঁয়ের বাড়িতে বসে বিশ্রাম নেবো। তারপর পুরনো কাজে যোগ দেবো। : কি কাজ? যদিও এভাবে জানতে চাওয়া ভদ্রতা নয়, তবু জানতে ইচ্ছে করছে। বললাম আমি। ইসিকাওয়া কুবুতা বললেন, না না, সমস্যা নেই জানাতে। আমি কোবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স আমার সাবজেক্ট। তো, অনেক সময় নষ্ট করলাম আপনার। কিছু মনে করবেন না। আর ওই ডক্টর তুশোর...। স্যরি,কাল তো চলেই যাচ্ছি। আর কখনো দেখা হবে কিনা জানি না। দেখা না হলেও মনে রাখবেন আমাকে। কথাটা বলেই দ্রুত চোখের আড়ালে চলে গেলেন ইসিকাওয়াÑচলে গিয়ে যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। ইসিকাওয়া কুবুতা তাঁর কথা অসমাপ্ত রেখে চলে গেলেও আমার বুঝতে সমস্যা হলো না ডক্টর তুশো সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু বলতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কি সেই কথা? আর গায়ে পড়ে তিনি এসব বলতে চাইছেনই বা কেনো? তবে কি ডক্টর তুশোর সঙ্গে তার কোনো স্বার্থগত সংঘাত রয়েছে? কে দেবে এসব প্রশ্নের জবাব? ২০ মে ১৯৫০ প্রকৃত অর্থেই ডক্টর তুশো এক রহস্যময় লোক। প্রথম পরিচয়ের পর কেটে গেছে তিনটি মাস। তিন মাস পরে আজ আবার দেখা হলো ডক্টর তুশোর সাথে। তবে গত বারের মতো ডাইনিং হলে নয়, আজ দেখা হলো হোস্টেল লনে এক অনুষ্ঠানে। সেখানেই কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় তো ‘গ্রাস ট্যাবলেট’ উদ্ভাবন করে সারা পৃথিবীতে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই এখনো চমকপ্রদ তেমন কিছু নিয়ে গবেষণা করছেন? আমার প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলেন ডক্টর তুশো। পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে গেলো তার চেহারা। তিনি বললেন, কিছু একটা নিয়ে তো সময় কাটাচ্ছিই। আর বিজ্ঞানীদের কাছে তার কোনো সৃষ্টিই চমকপ্রদ নয়। বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন লোকচক্ষুর আড়ালে জিনিসটির অস্তিত্ব রয়েছে। ঐকান্তিক চেষ্টার বিনিময়ে তিনি সেটা লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে আসেন। আমি বললাম, এটা শুধু বিনীত জবাব নয়, কঠিন জবাবও। আসলে আমার খুব জানার ইচ্ছে করছে আপনি এখন কি নিয়ে কাজ করছেন। ডক্টর তুশো বললেন, যে বিষয় নিয়ে কাজ করছি, ওটা তোমার বিষয় নয়। তাই বলতে চাইছি না। বললেও তুমি বুঝবে না। ডক্টর তুশোর কথা শুনে বিব্রত বোধ করলাম। সেই সঙ্গে একটা জিদও চেপে গেলো, আসলেই কি নিয়ে তিনি গবেষণা করছেন তা জানতে হবে আমাকে। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আপনি বড়ো বিজ্ঞানী। অবশ্যই জটিল সব বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন। আমার পক্ষে সে সব বোঝা কঠিন তাও বুঝি। তবুও জানতে ইচ্ছে করছে। নিছক কৌতূহল থেকেই জানতে চাইছি। ডক্টর তুশো কিছুটা সময়ের জন্য অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর বললেন, এতোই যখন জানার ইচ্ছে তখন আর না বলে উপায় কি! আমার বর্তমান পরিকল্পনার সারমর্মটা তোমাকে বলছি। বললাম, বেশ তো, সারমর্মটাই বলুন। ডক্টর তুশো বললেন, আমি এমন একটা বিষয় নিয়ে গবেষণা করছি, যা সফল হলে এ পৃথিবীর চেহারা বদলে যাবে। কল্যাণ আর সমৃদ্ধির বন্যা বয়ে যাবে পৃথিবীতে। বললাম, দারুণ ব্যাপার তো! এ বিষয়ে সাফল্য পেলে নির্ঘাত আপনি নোবেল প্রাইজ পেয়ে যাবেন। ডক্টর তুশো বললেন, তুমি তো জানো নোবেল প্রাইজ পাওয়ার মতো কাজ আমি আগেও করেছি। প্রাইজটা কোনো মুখ্য বিষয় নয়। যা হোক, এ নিয়ে প্রশ্ন করে আমাকে আর বিব্রত করবে না। যাই নিপু। আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে ডক্টর তুশো ভিড়ের ভেতর হারিয়ে গেলেন। ২৮ মে ১৯৫০ এখানে সবাই নিজ নিজ কাজ নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত থাকে যে, ডানে-বামে তাকাবার মতো সময়ও হয় না কারো। প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার অপ্রয়োজনীয় মানুষটি সামনে এসে দাঁড়ায়। এ কথাগুলো লিখতে হলো ডানহিলের কথা ভেবে। একই হোস্টেলে আছি অথচ প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও ডানহিলকে খুঁজে বের করতে পারছি না। কখন রুমে ঢোকেন আর কখন বেরিয়ে যান, তা জানে না কেউ। অন্যদিকে অনাকাক্সিক্ষত হওয়া সত্ত্বেও ডক্টর তুশোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। ডক্টর তুশোকে অনাকাক্সিক্ষত বলছি এ কারণে যে, তার সেদিনের রহস্যময় আচরণে খুবই আহত হয়েছিলাম আমি। মনে পড়েছিলো ইসিকাওয়া কুবুতার কথা। তাই সাধ্যমতো এড়িয়ে চলছিলাম তাকে। কিন্তু এড়িয়ে চলতে চাইলেও সব সময় সবাইকে এড়িয়ে চলা যায় না। যায় না বলেই হঠাৎ দেখা হলো ডক্টর তুশো সাথে। আর তা এমন এক আবহের সৃষ্টি করলো যে, আমি অভিভূত হয়ে গেলোাম তার আন্তরিকতায়। মন থেকে সব অভিমান মুছে গেলো।                                (চলবে)

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ