বিজ্ঞানীর কবলে বিজ্ঞান

বিজ্ঞানীর কবলে বিজ্ঞান

উপন্যাস মার্চ ২০১৪

এনায়েত রসূল

Uponnash(গত সংখ্যার পর) সকালে ডিপার্টমেন্টাল ল্যাবরেটরিতে বসে দু’ধরনের গেলো নিয়ে কাজ করছিলাম। সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের দুটি সেলের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তৃতীয় কোনো গেলো উদ্ভাবন করা যায় কিনা, তাই ছিলো আমার গবেষণার বিষয়বস্তু। আর এ জন্য একটা প্ল্যান্ট গেলো আর এনিমেল গেলোকে যেনো মাত্র মাইক্রোস্কোপের স্লাইডে রাখতে যাচ্ছি, অমনি পেছন থেকে ভেসে এলো ফ্যাঁসফেসে কণ্ঠÑইউনিক! ইউনিক! এ কণ্ঠ যে ডক্টর তুশোর, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চত ছিলাম। কিন্তু এমন অনাকাক্সিক্ষত মানুষটি যে আমার পেছনে এসে দাঁড়াবেন, সে কথা ভাবিনি। আমাকে অবাক চোখে তাকাতে দেখে ডক্টর তুশো বললেন,  কি করছো তন্ময় হয়ে? বললাম, প্ল্যান্ট আর এনিমেল গেলো নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু যতোই দিন যাচ্ছে ততোই নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছি। মনে হচ্ছে আমার স্বপ্ন কোনো দিনও সত্য হবে না। সব মিথ্যে আর অর্থহীন হয়ে যাবে। ডক্টর তুশো একেবারে রে রে করে উঠলেন আমার কথা শুনে। কণ্ঠে বিরক্তি ছড়িয়ে বললেন, যত্তোসব নাবালক ছেলেছোকরার দল! অন্যের প্রতিভাবেও মূল্য দেবে নাÑনিজের প্রতিভাকেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে। আমি বললাম, আমি কিন্তু স্যার আপানার অভিযোগের কারণটা খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ আমি অন্যের প্রতিভার মূল্য দিই। ডক্টর তুশো বললেন, শুধু অন্যের প্রতিভার মূল্য দিলেই চলবে? নিজের প্রতিভার প্রতিও আস্থা রাখতে হবে। আমি কিন্তু প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছি, নিজের প্রতিভাকে তুমি আন্ডার এস্টিমেট করছো। : কারণ একটাই। আস্থা রাখার মতো আমার কোনো প্রতিভা রয়েছে, আমি তা বিশ্বাস করি না। কথাটা দৃঢ়কণ্ঠে বললাম আমি। তা শুনে ডক্টর তুশো বিস্মিত চোখে তাকালেন আমার দিকে। তারপর বললেন, একটা কথা মনে রাখবে নিপু, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ওভার এস্টিমেট করা যেমন অন্যায়, আন্ডার এস্টিমেট করাও তেমন অন্যায়। আমি তো বলবো গবেষণা করার জন্য তুমি একটি অতি জরুরি আর মহামূল্যবান বিষয় বেছে নিয়েছো। আমি নিশ্চিত, তোমার সাফল্য এ পৃথিবীকে বদলে দেবে। ডক্টর তুশোর উৎসাহ বাক্য শুনে নিজের ভেতর কিছুটা আস্থা ফিরে এলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, শুনেছেন তো আমি দু’ধরনের গেলো নিয়ে গবেষণা করছি। আপনি কি মনে করেন এ ধরনের গবেষণার মূল আছে? ডক্টর তুশোর চোখমুখ সিরিয়াস হয়ে উঠলো আমার প্রশ্ন শুনে। তিনি বললেন, মূল্য আছে। শুধু তাই নয়, নতুন গেলো উদ্ভাবন করতে পারলে তোমাকে সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীর আসনে বসানো হবে। কাজ করে যাও খোকা, কাজ করে যাও। যে কোনো প্রয়োজনে আমাকে পাশে পাবে। অকৃত্রিম আন্তরিকতা নিয়ে কথাগুলো বললেন ডক্টর তুশো। তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। ১৮ জুন ১৯৫০ আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ছেড়ে যারা বিদেশ চলে আসে, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তারা মনের দিক থেকে পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসে। ডানহিলের দেশ স্কটল্যান্ড আর আমি পূর্ব পাকিস্তানি। ডানহিলের ভাষা স্কটিস আর আমার ভাষা বাংলা। কিন্তু অন্তরঙ্গ বন্ধু হতে এসব কোনো বাদ সাধেনি। তাই দুজন দুজনার সব ভালোমন্দই শেয়ার করে নিচ্ছি। যেমন আজ ডানহিল পড়ে শোনালেন তার স্ত্রীর লেখা চিঠি। স্বামীকে কাছে পাওয়ার জন্য ভদ্রমহিলা কতোটা ব্যাকুল কতোটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, তাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেই চিঠির ছত্রে ছত্রে। চিঠি শুনে মনে হলো ভদ্রমহিলা প্রকৃত অর্থেই স্বামী অন্তপ্রাণ। কিন্তু ডানহিল এ কথার সাথে একমত হলেন না। তিনি বললেন, কয়েক মাস ধরে চোখের আড়ালে রয়েছি, তাই স্ত্রীর ভালোবাসা উথলে উঠেছে। সামনে গিয়ে হাজির হলেই তা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যাবে। হয়তো ডানহিল তার স্ত্রীর ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে পারেননি। হয়তো ডানহিল ঠিকই বলেছেন, একটানা বহুদিন বাইরে আছেন বলেই তার স্ত্রী অনমভাবে স্বামীর অভাবটা অনুভব করছেন। কোনটা যে ভুল আর কোনটা সঠিক, আমি তা বুঝি না। দাম্পত্য জীবনে প্রবেশের সুযোগ আমার হয়নি, ইচ্ছেও নেই। নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে একাকী বেশ ভালোই আছি। ১২ ডিসেম্বর ১৯৫০ মাত্র কয়েক মাসের ব্যবহারে ডক্টর তুশো আমাকে নিবিড় করে কাছে টেনে নিয়েছেন। ফলে নবীন আর প্রবীণের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা দুর্ভেদ্য দেয়ালটি কর্পূরের মতো উবে গেছে। এই অসাধারণ জ্ঞানী মানুষটি কতো আন্তরিকভাবে যে অন্যের প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে পারেন, আমি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। আরো একটি ব্যাপারে ডক্টর তুশোর প্রশংসা না করে পারছি না। আর তা হলো, ভালো লাগার মানুষটির কাছে নিজেকে নিঃশেষে উজার করে দেয়া। এ কথা বলছি এ কারণে যে, ডক্টর তুশোর জীবনের এমন কোনো ঘটনা নেই, যা তিনি আমাকে জানাননি। তারপরও মানুষের কিছু কিছু কথা না বলা থাকা যায়, যা তার একান্তই নিজস্ব। তেমনি একটি ঘটনা শোনালেন আজ, যা শুধু বিস্ময়করই নয় রীতিমতো অবিশ্বাস্যও। আমাদের ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হোস্টেলটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে রোদ যেনো তার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে না পারে। কিন্তু এমনই সৌভাগ্য, নির্মাণ শৈলীকে ফাঁকি দিয়ে একচিলতে রোদ এসে আছড়ে পড়তো ঠিক আমার বারান্দায়। স্বাভাবিক কারণেই সবার লোভ ছিলো সেই বারান্দাটির ওপর। মাঝেমধ্যে খুব মজা হতো আমার বারান্দাটি নিয়ে। রোদের সুবিধা উপভোগ করার জন্য তড়িঘড়ি করে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় ছুটে যেতাম। গিয়ে দেখতাম, আমি পৌঁছার অনেক আগেই ডক্টর এডওয়ার্ড ফুলটন, মিকি চেম্বারলিন নয়তো প্রফেসর মিন ফাউ সেই জায়গাটির দখল নিয়ে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন! সুতরাং সেখান থেকে মানে মানে কেটে পড়া ছাড়া উপায় থাকতো না। অমন ঘটনা ঘটতো মাঝে মাঝে, সব সময় নয়। যেমন আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলাম যথারীতি রোদ এসে বারান্দায় পড়েছে, তবে তার দখল নিতে কেউ আসেনি। সুতরাং ইজি চেয়ারের ওপর  গা এলিয়ে দিয়ে আমি বই পড়ায় মন দিলাম। তন্ময় হয়ে বই পড়ছি, এমন সময় ভেসে এলো ডক্টর তুশোর কণ্ঠস্বরÑহ্যালো ইয়াং ম্যান? ভালো আছো তো? বললাম, ভালোই আছি স্যার। আপনি ভালো আছেন তো? ডক্টর তুশো বললেন, আছি কোনো রকম। এসেছিলাম রোদের খোঁজে। বুড়ো মানুষ। সুযোগ পেলেই স্বাস্থ্যটা বিদ্রোহ করে বসে। একটু বসবো তোমার পাশে? চেয়ার ছেড়ে দিয়ে আমি বললাম, আমার পাশে কেনো স্যার! আমার চেয়ারটাতেই বসুন। আমি ওই চেয়ারটা টেনে নিচ্ছি। আমার ছেড়ে দেয়া চেয়ারটাতে বসতে বসতে ডক্টর তুশো  বললেন, তুমি তো পড়ছিলে। কি বই ওটা? বললাম, ম্যান’স প্লেস ইন দ্যা ইউনিভার্স। চমৎকার বই। ডক্টর তুশো বললেন, আলফ্রেড ওয়ালেসের লেখা বই তো? পড়েছিলাম প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে উনিশশো তিন সালে। সম্ভবত সে বছরই বইটি প্রথম ছাপা হয়ে বের হয়েছিলো। আমি বললাম, ইউ আর রাইট স্যার। বইটা প্রথম উনিশো তিন সালেই ছাপা হয়েছিলো। আমার হাতেরটা অবশ্য সপ্তম এডিশনÑউনিশশো তেতাল্লিশ সালের। তো স্যার, বইটা আপনার কাছে কেমন লেগেছে? আমার প্রশ্ন শুনে একটা রহস্যময় হাসি ছলকে উঠলো ডক্টর তুশোর চোখেমুখে। পরক্ষণেই  চেহারায় স্বাভাবিকতা ফুটিয়ে বললেন, সত্য কথা বলবো? সেই পঞ্চাশ বছর আগে যখন ম্যান’স প্লেস ইন দ্যা ইউনির্ভাস পড়ি তখন মনে হয়েছিলো, আহা! কি মূল্যবান বই-ই না লিখেছেন ওয়ালেস সাহেব! কিন্তু এখন মনে হয়... কথা শেষ না করে থামলেন ডক্টর তুশো। তাতে অবশ্য আমার বুঝতে সমস্যা হলো না কি বলতে চাইছেন তিনি। তবুও তার মুখ থেকে শোনার জন্য বললাম, কি মনে হয়? একেবারেই অর্থহীন বাজে বই? ডক্টর তুশো বললেন, না না। তা মনে হবে কেনো! সব বইয়েরই কোনো না কোনো বক্তব্য থাকে। কিছু না কিছু মূল্য থাকে। আসলে আমি বলতে চাইছি, আমার জ্ঞান অর্জনের পেছনে এ বইটির কোনো অবদান নেই। সুতরাং প্রেরণা থাকারও কোনো অবকাশ নেই। : তাহলে কি আপনি কোনো বই বা কারো কাছ থেকে প্রেরণা পাননি? : পেয়েছি। তবে কোনো বই বা ব্যক্তির কাছ থেকে নয়। প্রেরণা পেয়েছি একটা হুলো বিড়ালে কাছ থেকে। আমার প্রতিষ্ঠার জন্য আমি সেই হুলো বিড়ালটার কাছে ঋণী। ডক্টর তুশোর কথা শুনে মনে হলো তিনি হয়তো আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে সেই ভুল ভাঙলো আমার। দেখতে পেলাম তার চেহারাতে রসিকতার কোনো চিহ্ন নেই। বরাবরের মতোই গাম্ভীর্য থমকে আছে সেই চেহারাতে। কিন্তু সমস্যা হলো, আমার মাথায় কিছুতেই এটা আসছে না, ডক্টর তুশোর মতো একজন বড়ো মাপের বিজ্ঞানী হুলো বিড়ালের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছেন, এ কেমন করে সম্ভব? প্রশ্নটা না করা পর্যন্ত মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই জিজ্ঞেস করলাম, বাবা নন মা নন, বিড়াল মহাশয় আপনাকে প্রেরণা দিয়েছেন। আর সেই প্রেরণার জোরে আপনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেÑএই তো? কিন্তু এ কথাটা থিয়োরি অব রিলেটিভিটির চেয়েও কঠিন মনে হচ্ছে আমার কাছে। অনুগ্রহ করে একটু বুঝিয়ে বলুন। চোখের ওপর রোদ পড়েছিলো। তাই চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে বসলেন ডক্টর তুশো। তারপর বললেন. যা সচরাচর মানুষের জীবনে ঘটে না, তাকে তো কঠিন আর অবিশ্বাস্য মনে হবেই। একটা কথা তোমাকে কখনো বলা হয়নি, প্রথম জীবনে আমি ইকোনমিক্সের ছাত্র ছিলাম। সাবজেক্ট ছিলো ম্যাক্রোইকোনমিক্স। সে সময় আমার ছোট বোন উরোশিমার একটা হুলো বিড়াল ছিলো। ভীষণ চঞ্চল আর হিংস্র ছিলো বিড়ালটা। একদিন সেই বিড়ালটা আমার বিছানার ওপর বসে একটা ইঁদুর মেরে খাচ্ছিলো। তা দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিলো আমার। আমি বিড়ালটাকে তেড়ে যেতেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় আমার পা আঁচড়ে দিয়েছিলো। তো... : কি বলছেন স্যার, ঘর থেকে বেরোবার সময় আপনার পা আঁচড়ে দিলো? কথা শেষ হবার আগেই জিজ্ঞেস করলাম আমি। ডক্টর তুশো বললেন, রেগে গিয়ে আঁচড়ে দিয়েছে, না ছুটে বেরিয়ে যাবার সময় ওর নখ আমার পায়ে লেগেছে, নিশ্চিত করে তা বলতে পারবো না। তবে পায়ে যে বিড়ালের নখের আঁচড় লেগেছিলো, সে কথা সত্য। : তারপর? আঁচড় খেয়ে কি করলেন আপনি? : প্রথমে কিছুই করিনি। মানে, ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দিইনি। তবে গুরুত্ব দিতে হলো। কারণ দু-একদিন যেতে না যেতেই সেই পা গদগদে ঘায়ের ছেয়ে গেলো। সেই বিচ্ছিরি ঘা আর অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে আমি যখন দিশেহারা, তখন এক খেয়াল চাপলো মাথায়। ভাবলাম, বিড়ালের থাবায় কোনো বিষের উৎস আছে কি না পরীক্ষা করে দেখবো। : তো কি দেখলেন স্যার? জিজ্ঞেস করলাম আমি। ডক্টর তুশো কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটা অসহায়ত্বের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে বললেন, নাথিং। দু’ঘণ্টা লাগিয়ে হুলোর থাবা নেড়ে চেড়ে দেখলাম। কিন্তু কিছুই খুঁজে পেলাম না সেখানেÑনট এ সোর্স অব পয়জন আর বার্ব। এটুকু বলে থামলেন ডক্টর তুশো। আমি বললাম, বিড়ালদের তরল বিষ নেই। তাই বিষের থলে বা উৎসও থাকার কথা নয়। আর মৌমাছিদের মতো ওদের হুলও নেই। এ কথা তো স্যার সবাই জানে। আপনি জানতেন না? ডক্টর তুশো বললেন, জানতাম। কিন্তু তখন যন্ত্রণায় এতোটাই অস্থির হয়ে পড়েছিলাম যে, মাথামুণ্ডু কিছু ঠিক ছিলো না। আর বিষের উৎস খুঁজে না পাওয়াটা আরো ভাবিয়ে তুললো আমাকে। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বিড়াল আঁচড়ে দিলে সে জায়গাটাতে ঘা হয় কেনো, আমি তার কারণ খুঁজে বের করবো। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ট্র্যাক বদলে ফেললামÑ ইকোনমিক্স ছেড়ে জুয়োলজিতে ভর্তি হলাম। অর্থনীতিবিদ না হয়ে আমি প্রাণিবিদ হলাম। আমি বললাম, আপনি অর্থনীতিবিদ হলে মানবজাতির জন্য কি অবদান রাখতে পারতেন জানি না। তরে প্রাণিবিদ হওয়ায় মানবজাতির যে উপকার হয়েছে, সে কথা সবাই স্বীকার করবে। ডক্টর তুশো হাসলেন আমার কথা শুনে। কোনো কথা বললেন না। আমি বললাম, কি বিচিত্র মানুষের জীবন। এ সময়ের এক সেরা বিজ্ঞানী তার পাঠক্রম বদলে ফেলেছেন বিড়ালের আঁচড় খেয়ে! তো সেই বিড়াল মহাশয়ের খবর কি? ওরা তো অনেক দিন বেঁচে থাকে। এখনো কি আপনাদের ফ্যামিলি মেম্বার হয়ে আছে? আমার প্রশ্ন শুনে কিছুটা সময় কি যেনো ভেবে নিলেন ডক্টর তুশো। তারপর বললেন, ফ্যামিলিই নেই, ফ্যামিলি মেম্বার হবে কেমন করে? সেই বিড়ালটি সম্ভবত কোথাও না কোথাও এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু আমার ফ্যামিলির কেউ বেঁচে নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার বোমা সবার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। যুদ্ধ আমাকে নিঃসঙ্গ করে ছেড়েছে, কথাটা মনে হলে আমার বুকের ভেতর প্রতিহিংসার ঝড় ওঠে। ইচ্ছে করে... কথা শেষ না করে থামলেন ডক্টর তুশো। কথা বলতে বলতে নিজের অজান্তেই একটু উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। দ্রুত তিনি নিজেকে সংযত করলেন। তারপর মুখে কষ্টকৃত হাসি ফুটিয়ে বললেন, দেখেছো তো কোন দিকের কথা কোন দিকে চলে যায়? এ জন্য কথা কম বলা ভালো। সে যাক, তোমাকে এবার হুলোর আঁচড়টা দেখাবো। এ কথা বলে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর তুশো। তারপর ডান পায়ের প্যান্টটাকে টেনে তুলে বললেন, দেখো। দেখা যাচ্ছে দাগটা? এটাই সেই বদমাশ বিড়ালের আঁচড়। আমি দেখলাম ডক্টর তুশোর গোড়ালির ওপর কিছুটা জায়গা সাদা হয়ে আছে। তবে সত্য সত্যই ওটা হুলো বিড়ালের আঁচড়ের দাগ কিনা, তা বোঝা যাচ্ছে না। গোটানো প্যান্ট ছেড়ে দিয়ে ডক্টর তুশো জিজ্ঞেস করলেন, কি দেখলে? বললাম, দাগটা এখনো জ্বলজ্বল করছে। বোঝা যায় ওখানে গভীরভাবে ক্ষত হয়েছিলো। ডক্টর তুশো বললেন, ওই ক্ষতই আমার জীবনধারা বদলে দিয়েছে। তো আমি এখন যাই। আবার দেখা হবে। চলে গেলেন রহস্যময় ডক্টর তুশো। আর আমার জন্য রেখে গেলেন এক নতুন বিস্ময়Ñ বিড়ালের আঁচড়ও বদলে দিকে পারে মানুষের জীবন! ৩ জুন ১৯৫১ আজকের দিনটির প্রতিটি মুহূর্ত আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দ্যা স্ট্রাকচার অ্যান্ড ইভ্যালুশন অব গেলোস শীর্ষক থিসিসের জন্য কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে আমার ডক্টর অব সায়েন্স উপাধিতে ভূষিত করেছে। এবার আমার সঙ্গে একই সম্মানে ভূষিত হয়েছেন ইতালীয় প্রাণিবিদ চিয়ানো টিউসেন। তার থিসিস ছিলো প্রাণীদের আচরণের ওপর। একটি কথা না লিখলেই নয়, আমার সাফল্যে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন ডক্টর তুশো। তার আনন্দ প্রকাশের ভঙ্গি কতো আন্তরিক আর অকৃত্রিম ছিলো, তা লিখে বোঝাতে পারবো না। ডক্টরেট সনদপত্র হস্তান্তর করার জন্য আমাদের সম্মানে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো। অনুষ্ঠান শেষে সভামঞ্চ থেকে নেমে আসতেই ডক্টর তুশো উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়ে বললেন, আজ প্রতিভার জয় হলো। বিলিভ মি অর নট মাই বয়, ইউ আর অ্যা রিয়েল জিনিয়াস। আমি বললাম, আপনি আমাকে স্নেহ করেন, তাই এ কথা বলছেন। আজ কিন্তু আরেকজনকেও সনদ দেয়া হয়েছে। আমি চিয়ানো টিউসেনের কথা বলছি। তাকেও আপনার উৎসাহ দেয়া উচিত। ডক্টর তুশো বললেন, তা তো দেবোই। তবে সবাইকে তো আর একভাবে মূল্যায়ন করা উচিত নয়। তোমার থিসিস আমাকে মুগ্ধ করেছে, সেটাতো আমাকে বলতেই হবে, কি বলো? বললাম, জ্বি স্যার। ডক্টর তুশো বললেন, আরো একটা ব্যাপার আছে তোমার বিষয়ে আগ্রহ দেখাবার পেছনে। সেটা কি জানো? আমি না জানার অভিব্যক্তি প্রকাশ করলে ডক্টর তুশো বললেন, বলতে পারলে না! তুমি এশীয়Ñআমিও তাই। তোমার সাফল্য আমাকে তো আবেগ তাড়িত করবেই। আমি বললাম, এ কথাটা না মেনে উপায় নেই। নিজ এলাকার মানুষের জন্য নিজের অজান্তেই একটা টান তৈরি হয়ে যায়। আমার জন্য আপনার ভেতর তেমন টান তৈরি হয়েছে। আমি শুধু বলবো, আপনার ভালোবাসা আর স্নেহ আমাকে আপ্লুত করেছে। আপনার মূল্যায়ন আমাকে সঠিক পথে চলতে প্রেরণা যোগাবে। আমার কথা শুনে ডক্টর তুশো যে খুশি হয়েছেন, তা তার চোখেমুখে ফুটে উঠলো। ডক্টর তুশো হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। তারপর বললেন, তোমার কথায় আশ্বস্ত বোধ করছি। তৈরি থেকো বয়, ভবিষ্যতে তোমাকে আমার প্রয়োজন হবে। ডক্টর নিকিতা তুশো স্বনামখ্যাত বিজ্ঞানী। তার মতো ব্যক্তিত্বের স্নেহধন্য হয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। জানি না সত্য সত্যই কখনো আমাকে তার প্রয়োজন হবে কিনা। যদি তেমন সময় আসে, আমি সঙ্গে সঙ্গে সেই সুযোগ লুফে নেবো। ৯ জুন ১৯৫১ আজ এসেছে আব্বার চিঠি। ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের পর মনে যে আনন্দের ঝড় বয়ে যাচ্ছিলো, তার রেশ ঝিমিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পেলাম এ চিঠি। সব মানুষের স্বভাব এক রকম হয় না এ কথা সত্য। তবে আমার আব্বা যেনো একটু বেশিই আত্মকেন্দ্রিক। ব্যক্তিগত অভাব অভিযোগ, সুখ-দুখের কথা তিনি কখনো কাউকে বলতেন নাÑএমনকি আমাকেও নয়। কিন্তু এবার সে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে আব্বা লিখেছেন: এলাহি ভরসা কুসুমপুর ঢাকা স্নেহের বাবা সাজ্জাদ, দয়াময় আল্লাহ্ তা’আলার কৃপায় ভালো আছো আশা করি। তোমাকে চিঠি লিখিব লিখিব করিয়াও লিখিয়া উঠিতে পারি নাই। তাহার অবশ্য যুক্তিসঙ্গত কিছু কারণ ছিলো। তাই অগ্রপশ্চাৎ না জানিয়া মন খারাপ করিও না। পর সমাচার এই যে, আমার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বিশেষ ভালো নহে। গত চার-পাঁচ মাস যাবত সেই পুরাতন হাঁপনি অসুখটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠিয়াছে। দিন যতোই যাইতেছে হাঁপানির প্রকোপ যেনো ততোই বৃদ্ধি পাইতেছে। কষ্ট সহিতে না পারিয়া সিরাজদিখান বাজারের ফতে ফকিরকে দিয়া চিকিৎসা করাইতেছি। কিন্তু তাহাতে কোনো সুফল দেখিতেছি না। মন বলিতেছে ঔষধ-পথ্যে এই রোগ সারিবে না। বাবা নিপু, আমার বয়স হইয়াছে। বুঝিতে পারিতেছি সময় দ্রুত শেষ হইয়া যাইতেছে। সেই কারণেই বলিতেছি, যদি সম্ভব হয় এবং তোমার বিদ্যা অর্জনের পথে ব্যাঘাত ঘটিবার আশঙ্কা না থাকে, তাহা হইলে একবার আসিয়া আমাকে দেখিয়া যাইও। এইবার তোমাকে একটি সুসংবাদ দিতেছি। এই বৎসর আমাদের ফসল ভালোই হইয়াছে। খোরাকের চাউল ঘরে রাখিয়া বাকিটা বিক্রয় করিবার ইচ্ছা আছে। ইদানীং তুমি চিঠিপত্র লেখার হার কমাইয়া দিয়াছো। ইহা কি পড়ালেখার চাপের কারণে, না তোমার অসুস্থতার কারণে তাহা জানাইয়া চিন্তা মুক্ত করিবা। তুমি আমার একমাত্র সন্তান। তোমার কথা মনে পড়িলে নানান আশঙ্কায় মন ভারাক্রান্ত হইয়া পড়ে। সে যাহা হউক, পত্র পাইবামাত্র উত্তর দিও। পুনরায় বলিতেছি, সম্ভব হইলে দুই-চার দিনের জন্য দেশে আসিয়া আমাকে দেখিয়া যাইও। সর্বশেষ, তোমার মঙ্গল কামনা করিতেছি। আল্লাহ্ তোমাকে সহি ছালামতে রাখুন। আমার চিন্তা করিও না। ইতি তোমার কল্যাণকামী আব্বাজী ২৮ বৈশাখ, ১৩৫৭ বাং প্রায় দু’ বছর হবে কেমব্রিজশায়ারে এসেছি। এ সময়ের মধ্যে আব্বাজীর লেখা বেশ কয়েকটি চিঠিই পেয়েছি। কিন্তু আজকের মতো এমন নিরাশায় ভরা চিঠি তিনি আগে কখনো লেখেননি। বয়স হয়েছে। সম্ভবত মনের জোর হারিয়ে যাচ্ছে। আব্বাজীকে দেখতে যাওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানকার কাজ শেষ না করে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। ১৪ জুন ১৯৫১ রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এ সময় সাধারণত ঘুমিয়ে থাকি। কিন্তু আজ দু’ চোখে কিছুতেই ঘুম আসছে না। তাই ফায়ার প্লেসের পাশে চেয়ার টেনে লিখতে বসেছি। তবে ওই বসা পর্যন্তই। লেখায় মন বসছে না। একটা অস্থিরতা ছেঁকে ধরেছে মনটাকে। বুঝতে পারছি এর পেছনে আব্বাজরি চিঠি ইন্ধন জোগাচ্ছে। এবারে চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে, তার সারাটা চিঠিতে একটা বিদায়ের সুর লুকিয়ে আছে। পিতা-পুত্রের সম্পর্ক কতোটা নিবিড় হয় জানি না। তবে আব্বাজীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক এতোটাই নিবিড় যে, তার কোনো তুলনা হয় না। এই নিবিড়তা গড়ে ওঠার অবশ্য কারণও আছে। আমার মা মারা গেছেন আমার শিশুকালে। তারপর থেকে আব্বাজীই আমাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করে তুলেছেন। আমার সব আবদার রক্ষা করেছেন। চরম ত্যাগ স্বীকার করে আমাকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছেন। সেই সর্বত্যাগী মানুষটি আজ অসুস্থ। বারবার তিনি আমাকে ফিরে যাবার জন্য অনুরোধ করছেন। কিন্তু তার এ অনুরোধ রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, এ কথাটা যতোবার মনে পড়ছে ততোবারই আমার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠছে। অস্থিরতা ছেঁকে ধরছে আমাকে। মনের এ অবস্থা নিয়ে কারো পক্ষেই ঘুমানো সম্ভব নয়। আব্বাজীর চিঠির জবাবও লিখতে পারছি না আমি। কি করবো ভাবছি, এমন সময় একটা টুকটুক শব্দ কানে এলো। তার মানে কেউ দরজায় নক করছে। কিন্তু এতো রাতে কে এসেছে? চেয়ার ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু দরজায় শব্দ হয়েই যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই দরজা খুলতে হলো। দরজাটা পুরোপুরি খোলা হয়ওনি, সেই দরজায় ধাক্কা দিয়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন ডক্টর তুশো। তিনি বিভ্রান্তের মতো তাকালেন এদিক-ওদিক। তারপর আমার চেয়ারটাতে ধপাস করে বসে পড়লেন। যতোই শ্রদ্ধেয় হোন, ঘরে ঢুকেই আমার চেয়ার দখল করে নেয়ায় একটু বিরক্তিই লাগলো। আর তা আমার ব্যবহারে ফুটেও উঠলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার স্যার? এতো রাতে কি মনে করে? ডক্টর তুশো বললেন, জেগে জেগে তোমার থিসিসটা পড়ছিলাম। হঠাৎ মনে পড়লো একটা জরুরি কথা। তাই অসময়ে বিরক্ত করতে হলো। মনে যাই থাক মুখে বললাম, ছিছি, এতে বিরক্ত হবার কি আছে! আপনার মতো বিজ্ঞানীর সঙ্গ পাওয়া যে কতো ভাগ্যের ব্যাপার, সে শুধু আমিই জানি। ডক্টর তুশো বললেন, তবুও সময়-অসময় বলে একটা কথা আছে। তুমি আমাকে শ্রদ্ধা করো। সে সুযোগ নিয়ে আমি তো আর তোমাকে অত্যাচার করতে পারি না! বললাম, আমার ওপর অত্যাচার করছেন, তাই বা ভাবলেন কেনো? আমার কাছ থেকে কি কখনো তেমন কোনো আভাস পেয়েছেন? ডক্টর তুশো বললেন, না, আভাস পাইনি। মনে এলো কথাটা তাই বললাম। ঠিক আছে, আর ওসব ভাববো না। তো যে জন্য এলাম এবার সে কথা বলি। কথাটা হলো, তোমার গবেষণা সম্পর্কে জানতে ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করছি। কি নিয়ে কাজ করছো একটু খুলে বলো। আমি বিব্রত বোধ করলাম ডক্টর তুশোর কথা শুনে। তিনি চাইছেন আমি তাকে আমার গবেষণার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অভিহিত করি। ডক্টর তুশোর মতো বড়োমাপের বিজ্ঞানীকে নিজের গবেষণা সম্পর্কে জানাতে পারাটা সম্মানের ব্যাপার। কিন্তু সমস্যা হলো, আমি যে জিনিসটি নিয়ে গবেষণা করছি, তা নিছকই একটি ধারণা মাত্র। এটা অন্যের কাছে অবাস্তব এবং পাগলামি ছাড়া আর কিছু মনে হবে না। এমন একটি বিষয় সম্পর্কে আমি কেমন করে তাকে জানাই? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ডক্টর নিপু আবার তার আগ্রহের কথা জানালেন। বললেন, কি নিয়ে গবেষণা করছো? বললাম, একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথায় এসেছিলো। তাকেই নেড়েচেড়ে দেখছি। প্ল্যান্ট আর এনিমেল সেলের সংযোগ ঘটিয়ে তৃতীয় কোনো গেলো উদ্ভাবন করা যায় কিনা, তা যাচাই করে দেখছি। : ধরো উদ্ভাবন করা গেলো। সেই সেলের পরিচয় কি হবে? জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর তুশো। আমিও নিঃসঙ্কোচে বললাম, পরিচয় বলতে কি আপনি সেই তৃতীয় গেলোটির নাম কি হতে পারে তা জানতে চাইছেন? ডক্টর তুশো বললেন, হ্যাঁ, ধরে নাও তাই। : আমি ভেবে রেখেছি অমন যদি কোনো গেলো উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়, তবে তার নাম রাখবো প্ল্যান্টিমেল গেলো। প্ল্যান্ট আর এনিমেল শব্দ দুটোর অর্ধেক অর্ধেক নিয়ে নতুন একটি শব্দÑপ্ল্যান্টিমেল। ডক্টর তুশো নড়েচড়ে বসলেন আমার কথা শুনে। বললেন, আবার তুমি আমাকে বিস্মিত করলে। আচ্ছা, অমন একটি প্ল্যান্টিমেল গেলো যদি সৃষ্টি করা সম্ভব হয়, তাহলে তা মানব জাতির কি কাজে লাগবে, তাও নিশ্চয়ই তোমার ধারণায় আছে? বললাম, পাকাপোক্ত ধারণা না থাক, ভাসা ভাসা ধারণা তো আছেই। আমার ধারণা প্ল্যান্টিমেল গেলো আবিষ্কৃত হলে মানুষের পক্ষেও মাটি ও সৌর উৎস থেকে খাবার সংগ্রহ করা সহজ হবেÑবৃক্ষরা যেমন করে। : আমারও তাই ধারণা। তা, গবেষণার কোন পর্যায়ে রয়েছো? প্রাথমিক পর্যায়ে। কিন্তু আর মনে হচ্ছে এগোতে পারবো না। কারণ কাজে নেমে কেমন হতাশ হয়ে পড়ছি। মনে হচ্ছে এটা একটা আকাশ-কুসুম কল্পনা। আর এর বাস্তবায়ন কোনো দিনও সম্ভব হবে না। : এমন মনে হচ্ছে কেনো? গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন ডক্টর তুশো। আমি বললাম, একটা কোনো কারণ তো আছেই। প্ল্যান্ট সেল আর এনিমেল সেলের গঠন প্রক্রিয়া এক নয়। সম্ভবত তাই বারবার চেষ্টা করেও এই গেলো দুটোর সংযোগ ঘটানো সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে আল্ট্রাভায়োলেটরের প্রভাবে কোষগুলো তাদের স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে ফেলছে। ওগুলো সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। : সঙ্কুচিত হচ্ছে? এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! বলো নিপু, বলে যাও। তুমি যাকে গবেষণার ব্যর্থতা বলে মনে করছো, আমার কাছে তা সফলতার ইঙ্গিত মনে হচ্ছে। একটা ক্ষীণ আলোক রশ্মি দেখতে পাচ্ছি। উত্তেজিত কণ্ঠে একটানা কথাগুলো বললেন ডক্টর তুশো। আমি সঙ্কোচের সঙ্গে বললাম, এখানেই জ্ঞানী ব্যক্তি আর সাধারণ ব্যক্তিদের মধ্যে পার্থক্য। জ্ঞানীরা কখনো নিরাশায় ভোগেন না। যেমন আপনি আমার ব্যর্থতার মধ্যেও সফলতার আলো দেখতে পাচ্ছেন। অথচ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি অর্থহীন গবেষণার পেছনে আর এক সেকেন্ডও সময় ব্যয় করবো না। : হোয়াট? টেবিলের ওপর ঘুঁষি মেরে প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়লেন ডক্টর তুশো। কণ্ঠে আদেশের সুর ছড়িয়ে বললেন, কি বলতে চাইছো তুমি? এক্সপেরিমেন্ট করবে না? না নিপু, এ হতে পারে না। এক্সপেরিমেন্ট তোমাকে চালিয়ে যেতেই হবে। দিস ইজ নট এ রিকোয়েস্ট, বাট এ্যান অর্ডার। এমনিতেই আব্বাজীর চিঠি পড়ার পর থেকে মন খারাপ ছিলো, ডক্টর তুশোর কথা শুনে তা আরো খারাপ হলো। আমি বললাম, অর্ডার দিন আর রিকোয়েস্ট করুন, আমি স্যার নিরুপায়। যে গবেষণার ওপর আমার আস্থা নেই, সে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমার জবাব শুনে ডক্টর তুশো কিছুটা সময় চুপ করে রইলেন। সম্ভবত আমার এই মনোভাব কতোখানি যুক্তিসঙ্গত তাই ভাবলেন তিনি। তারপর বললেন, গবেষণা হলো একটি একনিষ্ঠ কাজ। এ কাজকে জোর করে আদায় করা যায় না। তোমাকেও আমি জোর করতাম না। কিন্তু সত্য কথা কি জানো নিপু, এ গবেষণার কোনো সম্ভাবনা নেই, এ আশঙ্কা সত্য নয়। আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি এক যুগান্তকারী গবেষণায় হাত দিয়েছো। তার চেয়েও সত্য কথা হলো, আমার সাফল্য তোমার সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে। সাজ্জাদ, প্লিজ মাই সন, তুমি আমাকে সাহায্য করো। বললাম, স্যার! এখানকার কাজ শেষ করে আমাকে দেশে যেতে হবে। ডক্টর তুশো বললেন, তোমরা সব সময় দেশ দেশ করো কেনো বলো তো? দেশের কথা বলতে গিয়ে এতোটাই আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠো যে, শুনলে মনে হয় বাইরের পৃথিবীটা তোমাদের শত্র“Ñ সেখানে আপনজন নেই কেউ। বললাম, এটা আপনার ভুল ধারণা। তবে এ কথা সত্য, দেশের কথা মনে পড়লে আমরা আবেগপ্রবণ হয়ে যাই। আসলে আমরা আল্লাহ্র পরেই পিতা-মাতাকে আপন মনে করি। আর পিতা-মাতার পরে স্থান দিই জন্মভূমিকে। : জন্মভূমি সবার কাছেই প্রিয়। তবে বাঙালিরা যে একটু বেশি মাত্রায় ঘরমুখো, এ কথাটিও নিশ্চয়ই স্বীকার করবে। সে যা হোক, কাজ শেষ হলেই চলে যাবে কেনো? জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর তুশো। আমি বললাম, আমার আব্বা বুড়ো হয়েছেন। তিনি অসুস্থ। সন্তান হিসেবে এ সময় তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো আমার কর্তব্য। আপনি কি বলেন স্যার, কর্তব্য নয়? এবার মাথা নিচু করলেন ডক্টর তুশো। বার দুই ঢোক গিলে বললেন, হ্যাঁ কর্তব্য। এর চেয়ে বড়ো কর্তব্য আর হতেই পারে না। কিন্তু তোমাকে খুব প্রয়োজন হবে আমার। বললাম, আপনার প্রয়োজনে লাগতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম স্যার। কিন্তু আমার কথা তো খুলে বলেছি। আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ। : ভুল বোঝার কথা নয়। বলছিলাম প্রয়োজনের কথা। তোমাকে না পেলে হয়তো আমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। আচ্ছা নিপু, তোমার দ্বারা পৃথিবীর উপকার হোক, তুমি কি তা চাও না? অসহায় দুটো চোখ তুলে ডক্টর তুশো তাকালেন আমার দিকে। সেই চোখে চোখ পড়তেই আমার বুকের ভেতর একটা অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হলো। দেশে যাবার তাগিদ ফিকে হয়ে গেলো। আর ডক্টর তুশোর প্রতি সহানুভূতিতে মন ভরে গেলো। মনে হলো, শুধু আত্মীয়স্বজন নয়, বিশ্ববাসীর প্রতিও আমার কিছু কর্তব্য আছে। আমি যখন এসব কথা ভাবছিলাম সে সময় ডক্টর তুশো হঠাৎ আমার হাত ধরে বললেন, মাই বয়! সারাটা জীবন মানুষের কল্যাণ করে এসেছি। কখনো কারো মুখাপেক্ষী হতে মন চায়নি। কিন্তু এ বয়সে একাকী কাজ চালিয়ে যেতে একটু সমস্যাই হচ্ছে। তাই তোমার সাহায্য চাইছি। আমি বললাম, আমি আপনার সন্তানের মতো। প্রয়োজন মনে করলে অবশ্যই আপনি আমার সাহায্য চাইতে পারেন। কিন্তু ডক্টর ... আমার কথা শেষ হবার আগেই ডক্টর তুশো বললেন, কিন্তু কি? কিন্তুর অর্থ তো আমার পাশে এসে দাঁড়ানো সম্ভব নয়? আমি তো বলেছি আমার সাফল্যের জন্য তোমাকে প্রয়োজন! তুমি কি চাও ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে আমি তিলে তিলে ধুঁকে ধুঁকে মরি? প্রাণিকোষের সংকোচনের ওপর গবেষণা চালিয়ে যাওয়া কি এতোই অসম্ভব তোমার জন্য? শত হলেও আমি মানুষ, তার ওপর বাঙালি। তাই ডক্টর তুশোর কাকুতি-মিনতিতে আমি সম্পূর্ণভাবেই প্রভাবিত হলাম। সুতরাং মন থেকে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বললাম, যতোই অসম্ভব হোক, আমি গবেষণা চালিয়ে যাবো। আপনি মানব কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। সে কাজে আমার গবেষণার ফলাফল যদি কাজে লাগে, তাহলে নিজেকে আমি ধন্য মনে করবো। ডক্টর তুশোর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো আমার কথা শুনে। প্রবল আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। বারবার পিঠ চাপড়ে দিলেন। তারপর বললেন, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। আমি বলছি মনোযোগ দিয়ে কাজ করে গেলে অবশ্যই সফল হবে। এ কথার জবাব না দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। তা লক্ষ্য করে ডক্টর তুশো  অপ্রস্তুত হলেন। সঙ্গে সঙ্গে লাজুক হেসে বললেন, অনেক রাত হয়ে গেছে, তাই না? আজ তোমার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম। তো আমি এখন যাই। চলে গেলেন ডক্টর তুশো। ৪ আগস্ট ১৯৫১ রাত দেড়টা। এইমাত্র ব্রিটেনের পুলিশ বিভাগ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে ফিরে এলাম। আমার কাছে ওরা এমন কিছু প্রশ্নের জবাব চেয়েছিলো, যা আমাকে রীতিমতো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। গতকাল সারাটা দিন আমাকে ল্যাবরেটরিতে কাটাতে হয়েছে। সে জন্য একটু ক্লান্ত ছিলাম। শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় হয়ে ঘুম এসেছিলো। হঠাৎ দরজায় শব্দ শুনে সে ঘুম ভেঙে যায়। বাধ্য হয়েই দরজা খুলতে হয় আমাকে। দরজা খুলতেই দেখি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ৩১২ নম্বর রুমের অমৃক সিং। তার চোখেমুখে ফুটে আছে উদ্বেগের চিহ্ন। অমৃক সিং আমার বন্ধু ডানহিলের রুমমেট। অন্তরঙ্গতা না থাকলেও এর আগে কয়েকবার তার সঙ্গে কথা হয়েছে। তবে সে সব হয়েছে ক্যাফেটেরিয়া নয়তো ডানহিলের ঘরে। আমার ঘরে এই তার প্রথম আসা। তাও এতো রাতে। ব্যাপার কি? ভেতরে ঢোকার জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়ে বললাম, ব্যাপার কি অমৃক? কোনো সমস্যা হয়েছে? এতো রাতে কি মনে করে? অমৃক সিং বললো, আপানাকে জ্বালাতন করতে হলো বলে দুঃখিত। আসলে আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার কি করা উচিত, তাই আপনার কাছে ছুটে এসেছি। বললাম, এসে ভালোই করেছো। প্রয়োজন পড়লে তো মানুষ পরিচিতজনের কাছেই যায়। তো সমস্যা কি? হয়েছে কি বলো তো? অমৃক সিং বললো, আমার রুমমেটকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গত চার বছরের প্রবাসী জীবনে যে ক’জন ইউরোপীয়ের সাথে আমার হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে, ডানহিল তাদের অন্যতম। শুধু অন্যতমই নয়, অন্তরঙ্গ এবং বিশ্বস্ত বন্ধু বলতে যা বোঝায় ডানহিল হলো তাই। বন্ধুবৎসল সেই মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে আমি চিন্তিত হলাম। বললাম, ঘটনা কি খুলে বলো তো? অমৃক সিং বললো, সে এক ভৌতিক কাণ্ড। কাজ শেষ করে ডানহিল আগেই শুয়ে পড়েছিলেন। আমি শুয়েছি সামান্য পরে। ঘুম ভেঙে যেতেই দেখি ঘরে বাতি জ্বলছে আর প্রফেসর তার বিছানায় নেই। প্রথমে এ ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছি টয়লেটে গেছেন। কিন্তু এক ঘণ্টা পেরিয়ে যাবার পরও যখন তিনি টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলেন না তখন চিন্তিত না হয়ে পারিনি। প্রথমেই টয়লেটে খুঁজেছি। তারপর করিডোর, প্যাসেজ আর আশপাশের রুমগুলোয়ও খুঁজেছি, পাইনি। হোস্টেলের গেটও বন্ধ। তারপর সিকিউরিটির লোকজনের কাছে গিয়েছি। ওরা বলেছে হোস্টেল থেকে কেউ বাইরে যায়নি। শেষমেশ মনে হলো আপনার কথা। ভাবলাম এখানে এসেছেন কিনা খোঁজ নিয়ে যাই। সম্ভবত এখানে আসেননি, তাই না? বললাম, আজ দেখাই হয়নি ডানহিলের সঙ্গে। অমৃক সিং বললো, আমার মাথায় কিছু আসছে না। দু’জন দিব্যি শুয়ে আছি। হঠাৎ জলজ্যান্ত মানুষ উধাও হয়ে গেলোÑএ মেনে নেওয়া যায়? তাও নিজের রুমমেট! বলুন, আমি এখন কি করবো? বললাম, বঝুতে পারছি না কি করা উচিত? এমন পরিস্থিতিতে তো পড়িনি কখনো। এক কাজ করো, আমাকে একবার তোমাদের রুমে নিয়ে চলো। দেখা যাক ব্যাপারটা কি! এমনও তো হতে পারে, ঘরে ঢুকে দেখবো ডানহিল দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন। অমৃক সিং বিড়বিড় করে বললো, তাই যেনো হয়। আসুন আমার সঙ্গে। অমৃক সিংদের ঘর পরীক্ষা করে একটা ব্যাপার নিশ্চিত হলাম, প্রফেসর ডানহিলের অন্তর্ধান সম্পর্কে অমৃক সিং এক বর্ণও বাড়িয়ে বলেনি। সত্য সত্য তিনি লা-পাত্তা হয়ে গেছেন। যথা সময়ে এ কথা জানানো হলো হোস্টেল কর্তৃপক্ষকে। এর কিছুক্ষণ পরেই হোস্টেলে এসে উপস্থিত হলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দুই কর্মকর্তাÑএকজন প্রৌঢ় আর অন্যজন তরুণ। ডানহিলের ঘর পরীক্ষা করে তারা অনেকগুলো টুকিটাকি জিনিস তাদের ব্যাগে ভরলেন। ছোট নোট খাতায় কিসব তথ্য লিখলেন। আর ডানহিলে সঙ্গে অমৃক সিং ও আমার ঘনিষ্ঠতা ছিলো জেনে দু’জনকে ধরে নিয়ে গেলেন তাদের অফিসে। সেখানে কয়েকজন ঝানু গোয়েন্দা প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে আমাদের নাজেহাল করার চেষ্টা করলেন। সারাদিনে কম করে হলেও চারবার আলাদা আলাদা ভাবে জবানবন্দী দিতে হলো দু’জনকে। গোয়েন্দাদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বললাম, ডানহিলকে ফিরে পাবার জন্য তোমরা ব্যস্ত হয়েছো কর্তব্যের তাগিদে, কিন্তু আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছি হৃদয়ের টানে। সুতরাং আমাদের সন্দেহ করে আটকে রাখাটা হবে তোমাদের জন্য সবচেয়ে বড়ো বোকামি। আমার কথার প্রতিবাদ না করলেও তারা কটমট করে তাকালো দু’জনার দিকে। তাদের মধ্য থেকে একজন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, খুব গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছো। যা হোক, আপাতত  তোমাদের যেতে দেয়া হলো। তবে ভবিষ্যতে প্রয়োজন পড়লে ডাকা হবে, মানসিকভাবে তৈরি থেকো। ২ সেপ্টেম্বর ১৯৫১ বৈজ্ঞানিক নিউটন সম্পর্কে একটা মজার গল্প শুনেছিলাম। একবার ডিম সিদ্ধ করতে গিয়ে তিনি নাকি তাঁর হাতঘড়িটাকে ফুটন্ত পানির ভেতর ছেড়ে দিয়েছিলেন। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে নিয়েও মজাদার গল্পের কমতি নেই। কিন্তু ডক্টর তুশোর কাণ্ডকারখানা যেনো তার চেয়েও চমৎকার! সকালের ঘটনা। আমি চিড়িয়াখানায় যাবো শুনে ডক্টর তুশোও আমার সঙ্গী হলেন। সারি সারি খাঁচা সাজানো। তার পাশ দিয়ে দু’জন হাঁটছি আর চেনা-অচেনা জীবজন্তু দেখছি। কোথাও কোথাও দু’জন দু’জনার কাছ থেকে অল্প সময়ের জন্য বিচ্ছিন্নও হচ্ছিÑআবার পাশাপাশি চলে আসছি। এ সময় পেছনে তাকিয়ে দেখি ডক্টর তুশো আমার পেছনে নেই। পেছনে কেনো, আশপাশে কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপার কি? কোনো বিপদে পড়েননি তো তিনি? চিড়িয়াখানার জীবজন্তুকে খাঁচায় আটকে রাখা হয় সত্য। কিন্তু তাই বলে তাদের মাধ্যমে বিপদ ঘটে যেতে পারে নাÑএ কথা সত্য নয়। এ কারণে ডক্টর তুশোর ব্যাপারে একটু চিন্তিতই হলাম। একে-ওকে জিজ্ঞেস করেও যখন তার খোঁজ পাওয়া সম্ভব হলো না তখন রীতিমতো দিশেহারা অবস্থা হলো আমার। আর একটুও সময় নষ্ট না করে আমি নিজেই ডক্টর তুশোকে খোঁজার কাজে লেগে গেলোাম। নানা আকৃতির খাঁচার পাশ দিয়ে, গলিঘুচির ভেতর দিয়ে খোঁজাখুঁজি করার এক পর্যায়ে দেখতে পেলাম কাক্সিক্ষত মানুষটিকে। দেখতে পেলাম একটা ঝোপের নিচে ভিজে মাটির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন তিনি। তার ডান হাতে ধরা একটি ম্যাগনিফাইং গ্লাস। বোঝাই যাচ্ছে নিবিড় মনোযোগ দিয়ে তিনি কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছেন। শুনেছি বিজ্ঞানীরা সাধারণত একটু অন্য রকম মানুষ হোন, মানে দুর্বোধ্য আর খেয়ালি প্রকৃতির। তাদের কোনো কোনো কাজের মাঝে চমক খুঁজে পাওয়া যায় ,তবে তার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। ডক্টর তুশোও কি তেমন কোনো চমকের জন্ম দিচ্ছেন? অসীম কৌতূহল নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ডক্টর তুশোর পেছনে। আমার পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে তাকালেন ডক্টর তুশো। আমার ওপর চোখ পড়তেই মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন তিনি। চোখের পলকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটি পকেটের ভেতর লুকিয়ে ফেললেন। ডক্টর তুশোর আচরণে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি খুঁজছেন ডক্টর? কিছু হারিয়েছে কি? ডক্টর তুশো শুকনো হেসে বললেন, না, কিছু হারায়নি। আমি বললাম, হারায়নি যদি তাহলে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে কি খুঁজছেন? আমি তো তাই দেখলাম এইমাত্র। আমার কথায় ডক্টর তুশোর চেহারাজুড়ে একটা বিব্রতভাব ফুটে উঠলো। তিনি বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে কিছু একটা করতে ঠিকই দেখেছো। আমি আসলে ক্ষুদে প্রাণী খুঁজে ফিরছিলাম। যেমন ধরো উইপোকা, পিঁপড়ে জাতীয় প্রাণী। : কেনো ডক্টর? হঠাৎ পিঁপড়ে-উইপোকার প্রয়োজন পড়লো কেনো? জিজ্ঞেস করলাম আমি। ডক্টর তুশো বললেন, কারণ আছে। আমার খুব ইচ্ছে মানুষ আর খুদে প্রাণীর খাদ্য চাহিদার ওপর তুলনামূলক একটি প্রবন্ধ লিখবো। বলতে পারো এটিও আমার গবেষণারই একটি অংশ। যা হোক, চলো চিড়িয়াখানাটা ঘুরে দেখি। সে জন্যই তো আমরা এখানে এসেছি, তাই না? আমি এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগেই ডক্টর তুশো উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দ্রুত হেঁটে চোখের আড়ালে চলে গেলেন। আমি অবাক হয়ে তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৫১ আজ বড়োদিন। খ্রিস্টধর্মের প্রচারক হযরত ঈসা (আ)-এর শুভ জন্মদিন। এমন একটি পবিত্র দিনে এমন একটা খারাপ খবর পাবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। ঘুম থেকে উঠে সংবাদপত্রের পাতায় চোখ বোলানো নিত্যদিনের অভ্যাস। আজ লন্ডন পোস্টের প্রথম পাতায় তাকাতেই চোখে পড়েছিলো ডানহিলের হাস্যোজ্জ্বল ছবির সাথে গতকালের সেই খবরটিÑবিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানি নিখোঁজ! পত্রিকাটির সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার সিগমন্ড ফ্যালো লিখেছেন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছে জার্মান বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট ডানহিলের এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বহুমুখী তদন্ত চালিয়েও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এ রহস্যের জট খুলতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে তারা ধারণা করছে, কোনো সুচতুর খুনী ডানহিলকে খুন করে লাশ গোপন করেছে। অথবা কোনো কারণে ডানহিল নিজেও আত্মগোপন করে থাকতে পারেন। সে যা হোক, স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগ পর্যন্ত স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তদন্ত চালিয়ে যাবে। মানুষের অবচেতন মন অনেক সময় সত্য কথা বলে। আমার সেই মন বলছে , ডানহিলকে আমরা আর ফিরে পাবো না। আর শুনতে পাবো না তার প্রাণখোলা হাসি। ২৫ ফেব্র“য়ারি ১৯৫২ রূপকথার নিঝুমপুরীর মতো নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস হোস্টেল ভবনটিকে। কেমব্রিজশায়ারে পা দিয়েই বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলাম অ্যালবার্ট ডানহিলকে। পরিচয় হয়েছিলো অমৃক সিং, আলেকজান্দর আনাতলি আর প্রফেসর মিন ফাউয়ের সঙ্গে। অভিভাবক হিসেবে কাছে পেয়েছিলাম ডক্টর তুশোকে। এদের সবাইকে নিয়ে কেটে যাচ্ছিলো আমার দিন। কিন্তু একদিন হারিয়ে গেলেন ডানহিল। আর আজ দেশে ফিরে গেলেন নিকিতা তুশো। সকালে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে দাঁড়িয়ে ডানহিলের প্রসঙ্গ তুলে ডক্টর তুশো বললেন, জানিÑডানহিলের সঙ্গে তোমার গভীর বন্ধুত্ব ছিলো। তবে তার কথা ভেবে নিজেকে কষ্ট দেয়াটা যুক্তিসঙ্গত নয়। আর এ কথাটা আমাদের মনে রাখতে হবে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দেয়া রায়ই শেষকথা নয়। হয়তো ডানহিল আত্মহত্যাও করেননি, খুনও হোননি। অন্য কোথাও সুখে-শান্তিতে আছেন। সৃষ্টিকর্তাই সব ভালো জানেন। জানি না কোন বিশ্বাসের জোরে ডক্টর তুশো আমাকে এমন সান্ত্বনার বাণী শোনালেন। তবে এ কথা মেনে নিতেই হয়, ডক্টর তুশোর কথা শোনার পর থেকে মনের কোণে একটা আশা বাসা বেঁধেছে। মনে হচ্ছে হয়তো একদিন আচমকাই ডানহিল আমার সামনে এসে দাঁড়াবেন। যে পৃথিবীর মানুষ চাঁদে যাবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, তাদের দিয়ে কিছুই অসম্ভব নয়। ২২ ফেব্র“য়ারি ১৯৫২ বিবিসির বিশ্বসংবাদে একটি দুর্দান্ত খবর প্রচারিত হয়েছে আজ। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের দাবিতে গতকাল ঢাকায় বিক্ষোভ হয়েছে। ধীরে ধীরে সেই বিক্ষোভ পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে। জানা যায়, একুশে ফেব্র“য়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়লে পুলিশ তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। গুলিতে তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন বহুজন। গ্রেফতারও করা হয়েছে অনেককে। এতোদিন ভেবে এসেছি দেশে বাবা ছাড়া আমার আপনজন বলতে কেউ নেই। কারো জন্য কোনো দায়বদ্ধতাও নেই আমার। কিন্তু বিবিসির এই খবর শোনার পর থেকে নিজের ভেতর একটা অস্থিরতা অনুভব করছি। মনে হচ্ছে আমার কোনো  সহোদর ভাই শহীদ হয়েছেন। আসলে বিদেশে এলে সব সময়ই আপনজনদের জন্য মন উদ্বিগ্ন থাকে। কারোরটা আচার-আচরণে প্রকাশ পায়Ñকারোরটা পায় না। আমার এই উদ্বিগ্নতাও হয়তো মনের গভীরে লুকানো ছিলো। এক বিশেষ মুহূর্তে তা প্রকাশ পেয়েছে। ৮ মার্চ ১৯৫২ আজ সৌভাগ্যের দিন। ডক্টর তুশো চলে যাবার পর থেকে শুধু তার চিঠির আশায় দিন গুনেছি। দুপুরে পেলাম সেই কাক্সিক্ষত চিঠি। সেই চিঠিতে ডক্টর তুশো লিখেছেন: হোক্কাইডু জাপান ২০.২.৫২ সুপ্রিয় নিপু, কথা ছিলো দেশে ফিরেই তোমায় লিখবো। কিন্তু নানা কারণে তা হয়ে ওঠেনি। এখানে আসার পর ব্যস্ততা আমাকে চারদিক থেকে জেঁকে ধরেছে। তার ফাঁকে সময় বের করে তোমাকে লিখছি। কথা দিয়েছিলে আমার প্রয়োজনের সময় পাশে এসে দাঁড়াবে। সেই প্রয়োজন অনুভব করছি। তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন। কবে আসছো জানিও। হোক্কাইডু বিমানবন্দরে তাকাসাকি ইকুডা নামে আমার প্রতিনিধি থাকবে। সেই তোমাকে আমার কাছে পৌঁছে দেবে। আজ আর নয়। এখানে এলেই দেখতে পাবে কি বিশাল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। ভালো থেকো। তোমার নিত্য শুভার্থী নিকিতা তুশো ডক্টর তুশোর এই চিঠিটি আমার জন্য এক নির্মল বার্তা বয়ে এনেছে। আগে থেকেই জাপানে যাবার সিদ্ধান্ত ছিলো। তাই জাপানী ভাষা শেখার কাজও চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবছি ল্যাংগুয়েজ কোর্স শেষ হলেই জাপানের পথে পাড়ি জমাবো। তবে কোর্স শেষ হতে যে আরো মাস দুয়েক  লেগে যাবে, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। ১৭ জুন ১৯৫২ ল্যাবমেরিন থেকে লিখছি। এটি একটি নানান ধরনের যন্ত্রপাতিতে সমৃদ্ধ সাবমেরিন। আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ল্যাবরোমেরিনের তেরো নম্বর কেবিন। এইমাত্র আমার কেবিন থেকে ইকুডা বেরিয়ে গেলো। এখন ঘড়িতে রাত তিনটা বেজে বত্রিশ। চুলচেরা হিসাব করলে রাত শেষ হতে মাত্র দু’ঘণ্টা সাতাশ মিনিট বাকি। সেই সন্ধে থেকে শরীরের ওপর দিয়ে যে ধকল বয়ে গেছে, তার পর জেগে থাকার মতো এনার্জি আমার নেই। কিন্তু মনের অস্থিরতা জোর করে আমাকে জাগিয়ে রাখছে। কারণ, এই সীমাবদ্ধ সময়ের মধ্যেই আমাকে আজকের ডায়েরি লিখতে হবে। বিওএসির বিমান হোক্কাইডুর মাটি স্পর্শ করেছিলো সন্ধ্যা সাতটা বারো মিনিটে। কাস্টমসের ঝামেলা চুকোতে না চুকোতেই বেঁটেখাটো এক জাপানী এসে দাঁড়ালো আমার পেছনে। আমাকে প্রায় চমকে দিয়ে সে বললো, আই ইকুদা। আই সিউর ইউ দক্তর নিপু। আমি বললাম, ইয়েস, ইউ আর রাইট। বাট হু আর ইউ? ইকুডা বললো, ফ্রেন্দ। উই আর তু ফ্রেন্দ। নাউ ফলো মি। ডক্টর তুশো ইকুডা সম্পর্কে আমাকে আগেই লিখেছিলেন। ডক্টর তুশোর প্রতিনিধি হিসেবে তারই আসার কথা রয়েছে। ইকুডা কথা বলছিলো ইংরেজিতে, তবে খুব কষ্ট করে। সম্ভবত ভেবেছে আমার সঙ্গে কথা চালিয়ে যাবার দ্বিতীয় আর কোনো পথ নেই। কিন্তু পথ তো আয়ত্ত করেছি আমি। সেই কথাটিই গর্বের সঙ্গে জানালাম তাকে। বললাম, শুনে খুশি হবে ইকুডা, চালিয়ে যাবার মতো জাপানি ভাষা আমার জানা আছে। সুতরাং আমার সঙ্গে তুমি তোমার মাতৃভাষাতেও কথা বলতে পারো। আমার কথা শুনে ইকুডা খুশি না হয়ে বরং অখুশিই হলো। মুখ কালো করে সে বললো, নো নিদ জাপানিজ। আই তেল গুদ ইংলিশ। নাউ ফলো মি। বুঝতে পারলাম, যেচে জাপানী ভাষা জানি বলায় ইকুডার বিরাগভাজন হয়েছি। তাই আগের চেয়ে কঠোর স্বরে কথা বলছে। যা হোক, আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আমি ইকুডার পিছুপিুছ হেঁটে চললাম। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে চকচকে একটা সবুজ গাড়িতে গিয়ে বসলাম আমরা। পরক্ষণেই গাড়ি তীব্রগতিতে ছুটে চললো। ছেলেবেলা থেকেই ভেবে এসেছি আল্লাহ্ যদি কখনো আমাকে সামর্থ্য দেন তবে আমি পৃথিবী ঘুরে দেখবো। লেখাপড়া শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিই। তার দশ বছর পর ভারত বিভক্ত হয়। আর তার কিছুদিন পরই কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে আমাকে কেমব্রিজশায়ারে চলে যেতে হয়। ডক্টর তুশোর আমন্ত্রণে আজ এসেছি জাপানে। সত্য, এমন সৌভাগ্য ক’জনার হয়? একটানা ত্রিশ মিনিট পূর্ণ গতিতে চলার পর ডানে মোড় নিয়ে গাড়িটা ছুটে চললো এক নির্জন পথে। দুপাশে গাঢ় অন্ধকার। সেই অন্ধকার চিরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে তার গন্তব্যে। হেডলাইটের আলোয় শুধু এটুকুই বোঝা যাচ্ছে, আমরা গ্রামের মধ্য দিয়ে শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলেছি। এই যে আধঘণ্টা ধরে গাড়ি ছুটে চলেছে, এ সময়ের ভেতর ইকুডার সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে দু’ ঠোঁটের ফাঁকে চুরুট রেখে একমনে গাড়ি চালাচ্ছিলো সে। সেই অখণ্ড নীরবতা ভেঙ্গে বললাম, একটা কথা ভেবে অবাক না হয়ে পারছি না। আমিই যে নিপু, তুমি তা বুঝলে কেমন করে? অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে ইকুডা বললো, এটা কোনো সমস্যাই ছিলো না আমার জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমি রাজকীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য ছিলাম। বর্ণনা শুনে মানুষকে শনাক্ত করতে তাই সমস্যা হয় না। আর বিমানবন্দরে যাবার আগে ডক্টর তুশো তোমার বর্ণনা দিয়েছেন আমাকে। যেতে যেতে একটা খালের পাড় ঘেঁষে গাড়ি থামালো ইকুডা। আমি বললাম, গাড়ি থামালে যে? ডক্টর তুশোর কাছে এসে গেছি নাকি? ইকুডা বললো, নো ফ্রেন্দ নো। দক্তর ইজ নত হিয়ার। : তাহলে এখানে থামলে কেনো? ইকুডা চুরুটে টান মেরে তাকালো আমার চোখে। তারপর আদেশের সুরে বললো, নো মোর তক্। গেত আপ দক্তর। ফলো মি লাইক এ জেন্তলম্যান। কথা বাড়াবার মনোবৃত্তি আমার ছিলো না। আর ডক্টর তুশোর প্রতিনিধির ইচ্ছে মতো যে আপাতত আমাকে চলতে হবে তাও আমি জানি। তাই খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবেই গাড়ি থেকে নেমে এলাম। আমি নেমে দাঁড়াতেই গাড়ি লক করে ইকুডা খালপাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গেলো। ওকে অনুসরণ করে একটা স্পিডবোটে গিয়ে উঠলাম আমি। আগে থেকেই স্পিডবোটে একটি লোক শুয়ে ছিলো। আমরা বোটে নামতেই ধড়মড় করে উঠে বসলো সে। ইকুডাকে মাথা নিচু করে সম্ভাষণ জানিয়ে লোকটি বললো, ইনিই কি তিনি? এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে ইকুডা বললো, ফুল স্পিডে চালাও। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। লোকটি আর কোনো কথা বললো না। সোজা স্পিডবোট স্টার্ট দিলো। স্পিডবোট ছুটে চলেছে তো চেলেছেই। তিন ঘণ্টা ছুটে চলার পরও ছুটে চলার শেষ নেই এ জালযানটির। ওদিকে পাশে বসে ইাকুডা চুরুট টেনেই  যাচ্ছে। এই দুঃসহ দীর্ঘ সময়ের ভিতর আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি সে! আমিও তাকে বিরক্ত করা উচিত হবে না ভেবে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থেকেছি। কিন্তু সবকিছুরই তো একটা সীমা আছে! অন্ধকার রাতে অন্ধকার ভেদ করে কোথায় চলেছি আমরা, তাও জানানো হচ্ছে না ঠিক মতো! কৌতূহল থাকাটা তো দোষের নয়। তাই এক সময় নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ইকুডা! আমরা কি ডক্টর তুশোর কাছে যাচ্ছি? নাকি দু’জন বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছি? আমার প্রশ্ন শুনে বিরক্তি ফুটে উঠলো ইকুডার চোখেমুখে। তার তা লুকিয়ে না রেখে সোজাসুজি সে বললো, আমার ওপর আস্থা রেখে চুপ করে বসে থাকুন। আর যাই হোক, আপানকে নরকে নিয়ে যাচ্ছি না। আমি বললাম, সে বিশ্বাস আমার আছে। আমার এ কথার পর ভদ্রতার খাতিরে হলেও সমর্থনসূচক কোনো জবাব দেয়া উচিত ছিলো ইকুডার। কিন্তু সে কেনো জবাব দিলো না। চোখ বন্ধ করে পরম আয়েশে চুরুট টেনে যেতে লাগলো। স্পিডবোটে ওঠার পর কেটে গেছে পাঁচ ঘণ্টা। এর ভেতরে এক সেকেন্ডের জন্যও কোথাও থামেনি ইকুডার স্পিডবোট। একভাবে বসে থাকতে থাকতে হাত-পা জমে যাবার মতো অবস্থা হয়েছে। ধৈর্যের বাঁধও ভেঙে গেছে আমার। ভাবছি ইকুডার সঙ্গে গন্তব্যের ব্যাপারে একটা বোঝাপড়া আমাকে করতেই হবে। সে সময় কাক্সিক্ষত ঘটনাটা ঘটলো। স্পিডবোটের ইঞ্জিন বন্ধ করলো চালকের আসনে বসা সেই লোকটি। আর তার দু’মিনিট পরেই শক্ত একটা কিছুর সঙ্গে স্পিডবোটের নাক ঢাক্কা খেলো। বুঝতে অসুবিধা হয়নি আপাতত আমরা কোনো গন্তব্যে পৌঁছেছি। তবুও জিজ্ঞেস করলাম, এসে গেছি আমরা? ইকুডা বললো, গেত আপ দক্তর। প্লিজ জাম্প বিহাইন্দ মি। বসে থেকে হাত-পায়ের গিঁটগুলো ব্যথায় টনটন করছিলো। এ অবস্থায় কারো পক্ষে লাফ-ঝাঁপ দেয়া সম্ভব নয়। তবুও আমি ভূমির স্পর্শ পাওয়ার আনন্দে ইকুডার সঙ্গে লাফিয়ে পড়লামÑঅনেকক্ষণ পর ভূমিতে পা পড়লো আমার। এটি একটি দ্বীপ। চারদিকে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন আকৃতির পাথর। কোনো বড়ো গাছ আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, তবে কোমর সমান লম্বা এক ধরনের ঘাস রয়েছে। আমরা তার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। বলা নি®প্রয়োজন যে, ইকুডাই আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আকাশে পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। তার আলোয় হেঁটে যেতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে একটি কথা সত্য, কেনো যেনো খুব একটা স্বস্তি পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে সম্মোহিতের মতো উকুডাকে অনুসরণ করে যাচ্ছি আমি। দীর্ঘ ঘাসের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে দ্বীপের অন্য প্রান্তে এসে পড়লাম আমরা। সামনে দেখতে পেলাম দরজার পাল্লার মতো থির হয়ে মাথা তুলে আছে দু’টো বড়ো পাহাড়। তার মাঝখানে কাঠ-বাঁশ দিয়ে বানানো একটি অস্থায়ী জেটি। জে১িটর পাশে ভেসে আছে ছোটখাটো একটি সাবমেরিন। প্রায় এক ঘণ্টা হবে এ দ্বীপে নেমেছি। হেঁটেছিও প্রায় মাইল দুয়েক পথ। কিন্তু দ্বীপের কোথাও মনুষ্যবসতির চিহ্ন খুঁজে পাইনি। এমন দ্বীপে সাবমেরিন এলো কোথা থেকে? ইকুডাকে এ প্রশ্নটা করলাম। জবাবে সে বললো, মানুষজন নেই বলেই এখানে সাবমেরিন অপেক্ষা করছে। এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমার সঙ্গে সঙ্গে এসো। যতোই আমাকে দমিয়ে রাখতে চাক, আমার অদম্য কৌতূহলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হলাম আমি। তাই আবার জিজ্ঞেস করলাম, এবার কি আমাকে সাবমেরিনে উঠতে হবে? ইকুডা বললো, হ্যাঁ, সাবমেরিনেই উঠতে হবে। এটা ল্যাবরেটরিও, আবার সাবমেরিনও। ডক্টর তুশো, মানে আমাদের প্রভু এটার নাম রেখেছেন ল্যাবরোমেরিন। চমৎকার নাম না? আসুন আমার সঙ্গে। ল্যাবরোমেরিনে ঢুকে ইকুডা আমাকে একটি সাজানো গোছানো কেবিনে নিয়ে বসালো। তারপর অন্তরঙ্গ কণ্ঠে বললো, সারাটা পথ আপনাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এবার বিশ্রাম করুন। এটা আপনার কেবিন। আমি বললাম, ডক্টর তুশো কোথায়? ইকুডা বললো, তিনি কোথায় আছেন তা নিশ্চিত করে বলতে পারবো না। তবে এটুকু জেনে রাখুন, প্রয়োজন হলে ডক্টর তুশো নিজেই আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। সেই শুভক্ষণ আসার আগ পর্যন্ত এখানে বিশ্রাম নিন। তো আমি এখন যাই। শুভরাত্রি। ১৮ জুন ১৯৫২ ডক্টর তুশোর প্রতিটি কাজের ভেতরই একটি করে চমক থাকে। এটা দেখে দেখে আমি প্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। তারপরও একটি কথা স্বীকার না করে উপায় নেই, ল্যাবরোমেরিন দেখে আমি অবাক হয়েছি। তার মতো বিশ্ববরণ্যে বিজ্ঞানী যেখানে চাইলেই সরকারি খরচে সর্বাধুনিক একটি ল্যাবরেটরি গড়ে তুলতে পারতেন, তিনি কেনো সেখানে সাবমেরিনের সীমাবদ্ধ পেটের ভেতর ল্যাবরেটরি বানাতে গেলেন? এটা কি শুধুই চমক? না এর ভেতর কোনো রহস্য আছে? এখন সকাল সাতটা। ভোররাত থেকে একাকী বসে বসে যখন ক্লান্ত হয়ে উঠেছি, সে সময় থপথপ পা ফেলে একটি রোবটা এসে ঢুকলো কেবিনে। ব্যাপারটা কি তার বুঝে ওঠার আগেই রোবট তার একটি হাত আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো। দেখতে পেলাম সেই হাতে রয়েছে আমার নাম লেখা একটি চিঠি। এতোদিন বিভিন্ন আর্টিকেলে রোবটের কথা পড়েছি। একটা সিনেমাতেও রোবট দেখেছিলাম। তেমন কোনো  রোবট আমার জন্য চিঠি নিয়ে আসবে, এ আমি ভাবতেও পারিনি। এ যেনো বাস্তব নয়Ñস্বপ্ন! যন্ত্রমানব হলেও রোবটটির চালচলন ছিলো অবিকল মানুষের মতো। তার হাত থেকে চিঠি নিতে দেরি হচ্ছে দেখে সে আরো কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। তারপর ঝুঁকে পড়ে আমার বিছানার ওপর চিঠিটি রাখলো। এবার আর সময় নষ্ট করা যুক্তিসঙ্গত মনে হলো না। রোবট নিয়ে আমার যে ভয় ছিলো, তাও অনেকটা কেটে গেছে। তাই বিছানার ওপর থেকে চিঠিটা তুলে নিলাম। ভাঁজ খুলতেই জ্বলজ্বল করে উঠলো ডক্টর তুশোর হস্তাক্ষর। ডক্টর তুশো লিখেছেন : ল্যাবরোমেরিন জাপান ১৮.৬.৫২ স্নেহভাজনেষু ডক্টর নিপু, অবশেষে তুমি যে আমার ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে এসেছো, এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তোমার দেখা পাবার জন্য ব্যকুল হয়ে আছি। রোবট ওয়াংলির সঙ্গে চলে এসো। অনেক কথা আছেÑসাক্ষাতে কথা হবে। নিত্যশুভার্থী তুশো সর্বশেষ খেয়েছি গতরাতে বিওএসির বিমানে। সারারাত কিছু খাইনি। দিনের আলো ফোটার পরও কিছু মুখে দেইনি। এখন খিদেটা ভীষণভাবে অনুভূত হচ্ছে। তবে তারচেয়েও বেশি তাগিদ অনুভব করছি ডক্টর তুশোর সাথে দেখা করার। তাই খাওয়া-দাওয়ার পাট স্থগিত রেখে ওয়াংলির সঙ্গে পা বাড়ালাম। কেবিন থেকে বেরিয়ে তিন সাড়ে তিন ফুট চওড়া প্যাসেজ। তার দু’পাশে সারিসারি কেবিন। প্রতিটি কেবিনের দরজায় কেবিন ব্যবহারকারীর নাম লাগানো রয়েছে। ওয়াংলির পেছনে যেতে যেতে সে সব নাম পড়ছি, হঠাৎ দেখতে পেলাম চলা থাসিয়ে ওয়াংলি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ওর মাথার ওপর একটা লাল বাতি জ্বলে উঠছে আর নিভছে। কেনো থমকে দাঁড়িয়েছে তা বুঝে ওঠার আগেই ওয়াংলি খপ করে আমার হাত চেপে ধরলোÑঅভিভাবকরা যেমন করে ছোটদের হাত চেপে ধরেন। হাত ধরেই নিজের কর্তব্য শেষ করলো না ওয়াংলি, সে আমাকে তার সঙ্গে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চললো। ওয়াংলির সঙ্গে যেতে যেতে আমার বারবার শুধু মনে পড়ছিলো কেবিনের দরজায় লাগানো নামগুলোর কথা। ইচ্ছে হচ্ছিলো নামগুলো পড়ে দেখি। কিন্তু ওয়াংলি নামের এই রোবটটা আমাকে এতো দ্রুত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো যে, সেদিকে তাকাবারও সুযোগ পেলাম না। হাতে হাত রেখে প্রায় ছুটে ছুটে আমরা অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত একটি কেবিনে এসে ঢুকলাম। চমৎকারভাবে সাজানো গোছানো কেবিন, সেই কেবিনের একটি সোফায় আমাকে প্রায় ছুড়ে ফেলে ওয়াংলি সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো। প্রতিটি মানুষেরই ব্যক্তিগত কিছু অভ্যাস থাকে। আমারও রয়েছে। সাজানো গোছানো ঘরদোর দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। ল্যাবরোমেরিনের এ কেবিনটি রুচিসম্মত ভাবে সাজানো। তাই ওয়াংলি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি উঠে দাঁড়ালাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম সুন্দর কেবিনটির সবকিছু। হঠাৎ এক জায়গায় এসে আমাকে থমকে দাঁড়াতে হলো। চোখ আটকে গেলো একটি বিশেষ জায়গায় এসে। সেখানে ডারউইনের ছবির পাশে রাখা ছিলো দাঁত-মুখ খিঁচানো একটি হুলো বিড়ালের ছবি। এ কেমন কথা! বিশ্বখ্যাত এক বিজ্ঞানীর পাশে বিড়ালে ছবি রাখা হয়েছে কেনো? অদ্ভুত ছবিটি থমকে দিয়েছে আমাকে। বিস্মিত আমি কতোক্ষণ যে ছবিটির দিকে তাকিয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এলাম ডক্টর তুশোর কণ্ঠস্বরে। পেছন থেকে তিনি বললেন, আমার আসতে একটু দেরি হলো। ভেতরে ঢুকে মনে হলো তন্ময় হয় কিছু দেখছো। কি দেখছিলে অমন করে? বললাম, ছবি। একটা ছবি দেখে আমার মনে... : তোমার মনে প্রশ্ন জেগেছে। ভীষণ দুর্বোধ্য মনে হয়েছে, এই তো? যে কারো মনেই প্রশ্ন জাগবে। নাউ রিমেম্বার ওয়ান থিং মাই বয়, কেমব্রিজশায়ারে তোমাকে একটা বিড়ালের গল্প বলেছিলাম। বিড়ালটা রেগে গিয়ে আমার পায়ে আঁচড় দিয়েছিলো। এটা সেই বিড়ালের ছবি। পাশের ছবিটি মহাবিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের। আমার কথা শেষ না হতেই গড়গড় করে কথাগুলো বলে গেলেন ডক্টর তুশো। আমি বললাম, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু ডারউইনের ছবির পাশে ওই বিড়ালটির ছবি রাখা হয়েছে কেনো, তা বুঝতে পারছি না। এতে কি ডারউইনের প্রতি অসম্মান দেখানো হচ্ছে না? ডক্টর তুশো বললেন, অ-স-ম্মা-ন? নো মাই বয়Ñনেভার। যার যতোটুকু সম্মান প্রাপ্য আমি তাকে ততোটুকু সম্মানই দিয়েছি। আমি ডারউইনকে শ্রদ্ধা করি একজন বিজ্ঞানী হিসেবেÑআর ওই হুলোটাকে ভালোবাসি আমার প্রতিষ্ঠার পেছনে অবদান রাখার জন্য। সে যাক, এবার কাজের কথায় এসো। আমি কাজের কথা শোনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিলেও সঙ্গে সঙ্গে কোনো কাজের কথা শোনালেন না ডক্টর তুশো। বরং আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়ার জন্যই যেনো অনেকটা সময় লাগিয়ে একগুচ্ছ হিজিবিজি কাগজ নাড়াচাড়া করলেন তিনি। তারপর কেমব্রিজশায়ারে তো তুমি দু ধরনের গেলো নিয়ে গবেষণা করতেÑআই মিন প্ল্যান্ট গেলো অ্যান্ড এনিমেল গেলো, ইজ ইট নট? বললাম, ইউ আর কোয়েট রাইট স্যার। দুটো গেলো মিলিয়ে মিশিয়ে তৃতীয় কোনো গেলো উদ্ভাবন করতে চেয়েছিলাম। ডক্টর তুশো বললেন, ভেরি রিচ অ্যান্ড টাফ আইডিয়া। তবে আমি তোমাকে তেমন শক্ত পথে ঠেলে দেবো না। নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমার এখানে রিল্যাক্স মুডে কাজ করতে পারবে। আমারও তাই ধারণা। তো স্যার, আমাকে কি করতে হবে? : বলছি সে কথা। তুমি এনিমেল গেলো নিয়ে কাজ করবে, শুধুই এনিমেল গেলো। তোমাকে এমন কোনো মিডিয়া আবিষ্কার করতে হবে, যার বিক্রিয়ায় গেলোগুলো সঙ্কুচিত হবে, তবে ওগুলোর মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো বজায় থাকবে। বুঝতে পেরোছো কি বলতে চাইছি? ডক্টর তুশো কৌতূহল মেশানো দুটো চোখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। আমি তার প্রস্তাবটিকে আরো নির্ভুলভাবে বোঝার জন্য বললাম, কিছুটা বুঝেছি কিছুটা বুঝিনি। আরেকবার বুঝিয়ে বললে হানড্রেট পারসেন্ট বুঝে যাবো। ডক্টর তুশো মুচকি হেসে বললেন, স্কুল বয়দের মতো কথা বললে। যা হোক, বুঝিয়ে বলছি। আমি চাইছি তুমি যে কোনো ভাবে এনিমেল গেলোকে সঙ্কুচিত করার পদ্ধতি বের করবে। গেলো ক্ষুদ্রাকৃতি হলেও তার কাজকর্ম যেনো আগের মতোই সতেজ থাকে, তাও দেখতে হবে তোমাকে। তোমার মতো বিজ্ঞানীর পক্ষে নিশ্চয়ই এ কোনো কঠিন কাজ নয়। আমি বললাম, কি যে বলেন স্যার। শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভবও। : অসম্ভব! বলছো কি? উত্তেজনায় ফেটে পড়লেন ডক্টর তুশো। আমি কোনো জবাব দেয়ার আগেই আবার তিনি বললেন, অসম্ভবকে  সম্ভব করে তোলাই তো বিজ্ঞানীতের কাজ। তুমি বিজ্ঞানী। তোমাকে তো অসম্ভব বললে চলবে না। বললাম, আচ্ছা অমন কথা বলবো না। সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। ডক্টর তুশো বললেন, বেশ; তাহলেই হবে। তোমার মতো প্রতিভার জন্য চেষ্টা মানেই সাফল্য। তো আমি এখন যাই। অনেক সময় নষ্ট হলো। তুমি বিশ্রাম নাও। ১৯ জুন ১৯৫২ উহ্! এ কেমন করে হয়? নিজের চোখে যা দেখে এসেছি, তাকে বিশ্বাস করতে গিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছি। বারবার শুধু মনে প্রশ্ন জাগছেÑএ কী সত্য? আমি ভুল দেখিনি তো? দৃষ্টিভ্রম ঘটেনি তো? এই যে ডায়েরির পাতায় এসব লিখছি, অন্যদিনের মতো স্বচ্ছন্দে লিখতে পারছি না। উত্তেজনায় হাত কাঁপছে। গতকাল ডক্টর তুশোকে কথা দিয়েছিলাম আজ থেকে রিসার্চ শুরু করবো। প্রবল উৎসাহ নিয়েই আমার কেবিন সংলগ্ন ল্যাবরেটরিতে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে পড়লো সেই নেমপ্লেটগুলোর কথা, কেবিনের দরজার গায়ে যেগুলো লাগানো ছিলো। ওগুলো কাদের নাম? কারা ব্যবহার করছে কেবিনগুলো? আমার আর ল্যাবরেটরিতে ঢোকা হলো না। সে ইচ্ছা স্থগিত রেখে বাইরে চলে এলাম। এসে দাঁড়ালাম করিডোরে। আমার ঠিক পাশের দরজায় লেখা রয়েছে ডক্টর হিউগ্যালোর নামÑঅনরে দ্য হিউগ্যাল, প্রফেসর অব এমব্রায়োলজি, ইউনিভারসিটি অব তুলোন, রিপাবলিক অব ফ্রান্স। তার পরবর্তী কেবিনগুলোতে পরপর লেখা রয়েছে জন সোয়ান এডিসন, প্রফেসর অব মাইক্রোবায়োলজি, প্রিনিট কলেজ অব মেডিক্যাল সায়েন্স, আইরিশ রিপাবলিক। বিন্দু বোস, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, অ্যারোনটিক অ্যান্ড মেরিন অথোরিটি অব ইন্ডিয়া। নামগুলো পড়তে পড়তে একটি প্লেটের ওপর চোখ পড়তেই আমি ভূত দেখার মতো চমক উঠলাম। একটু ধাতস্ত হয়ে আবার তাকালাম সেই প্লেটটির দিকেÑহ্যাঁ, যা দেখেছিলাম তাই তো লেখা রয়েছে প্লেটটিতে! উঁচু উঁচু সোনালি অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে চারটি লাইন: অ্যালবার্ট ডানহিল প্রফেসর, ডিপার্টমেন্ট অব নিওরোলজি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হসপিটাল ওয়েস্ট বার্লিন রিপাবলিক অব জার্মানি। এতোদিন পর কেমব্রিজশায়ার থেকে হাজার মাইল দূরে এই ডুবোজাহাজের কেবিনে ডানহিলের নাম দেখতে পাবো, আমি তা ভাবতেও পারিনি। তিনি এখানে এলেন কেমন করে? কেমন করে এসেছেন তার জবাব দিতে পারবেন একমাত্র ডানহিল নিজে। আমি তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ডানহিলের কাছ থেকেই সব কথা শুনবো। ডানহিলর বন্ধ দরজার গায়ে নক করার জন্য হাত তুলেছি মাত্র, সে সময় ঘটে গেলো এক অবিশ্বাস্য ঘটনা, যার কথা ভেবে এখনো আমি শিউরে উঠছি। বুকের ওপর হাত রেখে বুকের ধুকধুকানি এখনো অনুভব করতে পারছি। তো যে কথা লিখছিলামÑডানহিলের বন্ধ দরজার ওপর হাত রেখেছি কি রাখিনি, অমনি জাদুমন্ত্রের মতো আমার সামনে এসে দাঁড়ালো ওয়াংলি। কোথা থেকে রোবটটা এলো, কোথায় ছিলো সে এতোক্ষণ, সে সব বুঝে ওঠার আগেই এক ঝটকায় সে আমাকে সরিয়ে দিলো। টাল সামলাতে না পেরে আমি আছড়ে পড়লাম। কিন্তু সেদিকে ফিরেও তাকালো না সে। বরং ওয়াংলির ধাতব কণ্ঠস্বর ভেসে এলো সে সময়Ñডোন্ট ট্রাই টু ক্রস ইউর লিমিট। শুধু এবারই ক্ষমা করা হলো। এই প্রথম ওয়াংলি আমার সঙ্গে কথা বললো। সে যে এমন নির্ভুল ইংরেজি ও বাংলায় কথা বলতে পারে, তা জেনে বিস্মিত হলাম। তবে সেই বিস্ময় প্রকাশ করার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই সে হিড়হিড় করে টেনে আমাকে আমার কেবিনে নিয়ে এলো। ওয়াংলির আচরণে খুব রাগ হলো আমার। আমি বললাম, ব্যাপার কি বলো তো? আমার সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার করছো কেনো? ওয়াংলি বললো, এখানে সবাইকে শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। কেউ যদি তা ভঙ্গ করে, তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হয় আমাকে। এটা আমার অন্যতম কাজ। তুমি কোথাও যাবে না। নিজের কেবিনে বসে কাজ করে যাও। আমি আশেপাশেই থাকবো। রীতিমতো কমান্ডিং ভয়েসে কথাগুলো বলে ওয়াংলি কেবিন থেকে চলে গেলো। আর আমার জন্য একরাশ বিস্ময় রেখে গেলো। ২২ জুন ১৯৫২ এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! আমি যা চাই আমাকে করতে হয় ঠিক তার উল্টো কাজ। যেমন আজ ভেবেছিলাম ডায়েরি লিখবো না। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বো। রাতের খাবার খেয়ে শুয়েও পড়েছিলাম অন্যদিনের চেয়ে দু’ঘণ্টা আগে। ঘুমও এসেছিলো চমৎকার। কিন্তু তারপরই আমার জীবনে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে, যার কথা না লিখে স্বস্তি পাচ্ছি না। আজ বিকেল থেকেই ক্লান্তি বোধ করছিলাম। তাই শুয়ে পড়ার পরপরই চোখে ঘুম নেমে এসেছিলো। কতোক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ মনে হলো আমি শূন্যে উঠে যাচ্ছি। আর একটা কনকনে ঠাণ্ডা স্রোত আমার শিরা-উপশিরায় বয়ে যাচ্ছে। তার তীব্রতা এতোই প্রচণ্ড ছিলো যে, তা আমার ঘুম কেড়ে নেয়। ঘুম জড়ানো চোখ দুটো অনেক কষ্টে খুলি আমি। সঙ্গে সঙ্গে আমার রক্ত জমে যাবার মতো অবস্থা হয়। আমি দেখতে পাই ওয়াংলির কোলে আমি শুয়ে আছি। আর সে আমাকে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ সারাটা দিনে যতবার ওয়াংলির মুখোমুখি হয়েছি, প্রতিবারই তার কাছ থেকে কেমন একটা শীতল ব্যবহার পেয়েছি। এখন মাঝরাতে এসে সে আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে কেবিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপার কি? আমি কি ওয়াংলিকে জিজ্ঞেস করবো সে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? মনের ভেতর কথাটা মাত্র এসেছে, অমনি ওয়াংলির চোখের কোটরে বসানো লাল বাতি দুটো দপদপ করে জ্বলে উঠলো। আর বুকের ভেতর থেকে ঘড়ঘড় শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগলো। কোনো একটা বিজ্ঞান সাময়িকীতে পড়েছিলাম, আজকাল উন্নত বিশ্বের কোনো কোনো দেশে এমন কিছু রোবট বানানো হয়েছে, যাদের ভেতর কিছু স্পর্শকাতর সেন্সর বসিয়ে দেয়া হয়। সেগুলো আশপাশের পরিবেশ অনুভব করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর যখন ওদের সেন্সরগুলো উত্তেজিত হয়ে ওঠে তখন এ ধরনের কিছু বাতি নিজ থেকেই জ্বলে নিভে বিপদ সংকেত ঘোষণা করে। এ যদি সত্য হয় তবে এ কথাও সত্য, ওয়াংলি কোনো কারণে আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছে। কারণটা কি তা আমাকেই খুঁজে বার করতে হবে। অনেক সাহসে ভর করে আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ কি ব্যাপার ওয়াংলি! আমাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? ঘুমোবো না? আমার প্রশ্ন শুনে ওয়াংলি থমকে দাঁড়ালো। তারপর খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসতে হাসতে বললো, ঘুম? অফকোর্স ডক্টর, অফকোর্স। ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার জন্যই তো তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। ওটা হবে তোমার চিরস্থায়ী ঘুম। এ তো তোমার জন্য সুসংবাদ, তাই না? ওয়াংলির কথা শুনে আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। অসহায় লাগলো নিজেকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমার সঙ্গে শত্র“র মতো আচরণ করছো কেনো? ওয়াংলি ঝটপট জবাব দিলো, কারণ একমাত্র আমিই বুঝতে পেরেছি তুমি আমাদের কতোটুকু উপকারে লাগবে। তুমি হবে আমার প্রভুর সবচেয়ে বড়ো শত্র“। ধ্বংস করে দেবে ডক্টর তুশোর সব পরিকল্পনা। তা তো হতে দেয়া যায় না। আমি কোনো বিশ্বাসঘাতককে বাঁচিয়ে রাখতে পারি না। আমি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা নই। তাই নিশ্চিত করে বলতে পারবো না আগামী কোনো দিন ওয়াংলির আশঙ্কাই সত্য হয়ে উঠবে কিনা। তবে এখন পর্যন্ত ডক্টর তুশোর সঙ্গে আমার এমন কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়নি, যার দরুন তাকে আমি বিরূপ দৃষ্টিতে দেখতে পারি। সে কথাটা আমি বললাম ওয়াংলিকে। বললাম, তুমি আমাকে ভুল বুঝেছো ওয়াংলি। বিশ্বাস করো, আমি তোমার প্রভুর অন্যতম মঙ্গলকামী। প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দাও। ওয়াংলি বললো, না ডক্টর, তা হয় না। তোমাকে ছাড়া যায় না। বললাম, ধরে রেখে কি করবে? মেরে ফেলবে? : না। নিজ হাতে মারবো না। তোমাকে আপাতত ব্যালাস্ট ট্যাংকে রেখে আসবো। সেখানে ঘুমোবার সুযোগ পাবে তুমি। অসহ্যকর একটা থমথমে গলায় কথাগুলো বললো ওয়াংলি। ওর কথা শুনে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেলো। কারণ এ ল্যাবরেটরিটা একটা সাবমেরিনের ভেতর। সাবমেরিন সম্পর্কে যতোটুকু পড়েছি তাতে ব্যালাস্ট ট্যাংক সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা গড়ে উঠেছিলো আমার ভেতর। সাবমেরিনকে ডুবিয়ে রাখার জন্য ব্যালাস্ট ট্যাংকে পানি ঢুকানো হয়। আবার ভাসিয়ে তোলার সময় প্রচণ্ড চাপে পানিকে বাইরে বের করে তার শূন্যস্থান বাতাস দিয়ে পূর্ণ করা হয়। অমন ভয়ঙ্কর ট্যাংকের ভেতর আমাকে রেখে এলে আমি তো চিড়া চ্যাপ্টা হয়ে যাবো। আমি যতোক্ষণে এসব ভাবছিলাম ততোক্ষণে আরো দু’পা এগিয়েছিলো ওয়াংলি। সেদিকে তাকিয়ে মনে হলো মৃত্যুর দিকে আমি দু’পা এগিয়ে গেছি। এমন যখন অবস্থা, ঠিক সে সময় হঠাৎ আমার চোখ পড়লো একটি তারের ওপর। ওয়াংলির গলার নিচ থেকে বের হয়ে তারটা মাথার ভেতরে ঢুকে গেছে। ওয়াংলির গঠন প্রণালী নিয়ে আমার কোনো ধারণা না থাকলেও সবুজ তারটি যে তার কাজকর্মের ওপর কোনো না কোনো ভূমিকা রাখছে, সেটুকু বোঝার মতো জ্ঞান আমার আছে। তাই সরু সেই তারটির ওপর চোখ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, এই সবুজ তারটিই হয়তো আমাকে রক্ষা করতে পারবে। মুহূর্তের মধ্যে আমি আমার করণীয় ঠিক করে ফেললাম। ওয়াংলি আরেক পা অগ্রসর হবার আগেই এক টান মেরে তারটাকে দু’ টুকরো করে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ছট করে একটা শব্দ হলো। এক ঝলক আলো ঝলসে উঠলো, আর উৎকট একটা গন্ধ এসে আমার নাকে লাগলো। কিন্তু ওয়াংলির কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা বুঝতে পারলাম না। কারণ তারটা ছিড়ে দু টুকরো করে দেয়ার পরও সে আমাকে ছেড়ে দিলো না, বরং আরো শক্ত করে বুকের সঙ্গে সেঁটে ধরলো। তারপর এলোমেলো পা ফেলে কেবিনের দরজা পেরিয়ে সরু প্যাসেজে চলে এলো। তবে আর এগোতে পারলো না। আচমকা হাঁটু ভেঙে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ওয়াংলি। আমিও ইস্পাতে মোড়া করিডোরে ছিটকে পড়লাম। ওয়াংলির দিক থেকে আপাতত আর বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই যখন বুঝতে পারলাম, আমি তখন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। এ সময় সবচেয়ে আগে আমার মনে পড়লো ডক্টর তুশোর সহকারী ইকুডার কথা। ওয়াংলিকে নাকি সে দেখভাল করে। আমার সঙ্গেও তার পরিচয় আছে। সুতরাং এইমাত্র যে ঘটনা ঘটে গেছে, তা ইকুডাকে জানাতে হবে। তবে অবশ্যই কিছুটা কাটছাঁট করে। ওয়াংলির মনের মাঝে আমাকে নিয়ে যে ধারণার জন্ম হয়েছে এ কথাটা এখন ওকে জানাবো না। কারণ একটাইÑএতে অন্যদের মনেও সন্দেহ জাগবে। আমি এবার সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজটি করলামÑ ইকুডাকে ডেকে ওয়াংলি সম্পর্কে মনগড়া এক গল্প শুনিয়ে দিলাম। সেই গল্প শুনে কেমন একটা বিব্রত ভাব ফুটে উঠলো ইকুডার চেহারাতে। সে বললো, ওয়াংলির ব্যাপারে তো আমি তেমন কিছু বলতে পারবো না। আমি বরং প্রোপার চ্যানেলে খবর দিই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ইকুডা ছুটে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ার ইয়ামামাটোকে ডেকে নিয়ে এলো। দুজন মিলে প্রথমেই গলদঘর্ম হয়ে ওয়াংলিকে আট চাকাঅলা ট্রলিতে টেনে তুললো। তারপর ম্লান হেসে আমার দিকে তাকারো। ওদের এই বিব্রত অবস্থাটাকে আমি দক্ষতার সঙ্গেই কাজে লাগালাম। বললাম, মিস্টার ইয়ামামাটো! আপনার রোবটটি কিন্তু ভীষণ অসামাজিক। সে আমাকে এমনভাবে চেপে ধরেছিরো যে, পাঁজরের হাড়গুরো এখনো টনটন করছে। আমার অভিযোগের ধাক্কায় ইয়ামামাটোর চেহারা লাল হয়ে গেলো। এগিয়ে এসে সে আমার হাতটি তার হাতে তুলে নিরো। তারপর বললো, ওর আচরণের জন্য আমি দুঃখিত। রোবটটা কেনো আপনার সঙ্গে অমন আচরণ করেছে তা খুঁজে বের করে আপনাকে জানাবো। ২৩ জুন ১৯৫২ গতরাতের ঘটনা যে এতো দূর গড়াবে, আমি তা ভাবতেও পারিনি। কিন্তু বাস্তবে তাই হলো। দুপুরে ল্যাবরেটরি থেকে ফিরে খাবার টেবিলে বসার সাথে সাথেই ইকুডা একটি চিঠি তুলে দিয়েছিলো আমার হাতে। সেই চিঠিটা ছিলো ডক্টর তুশোর। ডক্টর জানিয়েছেন অত্যন্ত প্রয়োজনে তিনি আমার অপেক্ষা করছেন। সুতরাং চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি যেনো সিক্রেট চেম্বারে চলে যাই। ডক্টর তুশো আমার কাছে এক সম্মানীয় ব্যক্তি। তার ডাকে সাড়া দিতে কখনো গড়িমসি করিনি, আজও করলাম না। খাবার প্লেটটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে ঝটপট ছুটে গেলোাম তার সিক্রেট চেম্বারে। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলো ইঞ্জিনিয়ার ইয়ামামাটো, ইকুডা, ওয়াংলি আর হাড়জিরজিরে এক নিগ্রো কিশোর। এ ছেলেটিকে আজই আমার প্রথম দেখা। আমি চেম্বারে পা রাখতেই সামনে এগিয়ে এসে ইয়ামামাটো বলালো, খবর পাবার সাথে সাথেই ডক্টর নিপু এসে গেছেন। একেই বলে করিতকর্মা লোক। আমি বললাম, আপানর মূল্যায়ন আমাকে সম্মানীত করেছে ইঞ্জিনিয়ার। আসলে ডক্টর তুশোর ডাকে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেবো না, ততোটা বোকা আমি নই। তো কি ব্যাপার স্যার, এমন জরুরি তলব? ডক্টর তুশো জবাব দেয়ার আগেই ইয়ামামাটো বললো, আপনি নিশ্চয়ই ওয়াংলি সংক্রান্ত রিপোর্টের অপেক্ষায় আছেন? বললাম, তা বলতে পারেন। কারণ তেমনই কথা দিয়েছিলেন আপনি। ইয়ামামাটো বললেন, হ্যাঁ, কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আপাতত ওর সম্পর্কে নতুন কোনো তথ্য আমরা বের করতে পারিনি। ওয়াংলির আচরণ এখনো আমাদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছেÑ অপ্রত্যাশিত তো বটেই। ইঞ্জিনিয়ারের কথা শেষ হতেই আমি বললাম, অপ্রত্যাশিত নয় শুধু ভদ্রচিত নয় বলেও মনে হয়েছে। আরে ভাই, আরেকটু হলে তো ওয়াংলি আমাকে মেরেই ফেলতো। আমার অভিযোগ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ইয়ামামাটোর চোখেমুখে একটা বিব্রতভাব ফুটে উঠলো। ইয়ামামাটো আলতো করে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, দুঃখিত ডক্টর। ওয়াংলির যে কোনো রকম ভুলভ্রান্তির জন্য আমি দুঃখিতÑদুঃখিত এ কারণে যে, ওই রোবটটা আমার সৃষ্টি। : ওর আচরণ নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা রাখেননি? জিজ্ঞেস করলাম আমি। সে প্রশ্ন শুনে এক মুহূর্ত কোনো কথা বললো না ইয়ামামাটো। হয়তো কি জবাব দেবে তা ভেবে নিলো। তারপর বললো, বিশ্বাস করুন ডক্টর, ওয়াংলিকে যে কতোটা নিখুঁত আর যুগোপযোগী করে বানানো হয়েছিলো, সে শুধু আমিই জানি। যুগের পর যুগ যেনো সে নির্ভুলভাবে কাজ করে যেতে পারে, তেমন প্রোগ্রাম সেট করা ছিলো ওর চিপগুলোতে। অথচ চার বছর যেতে না যেতেই গর্দভটা এমন কাজ করে বসলো যে, লজ্জায় আমার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। ওয়াংলি এখন অহংকার নয়, আমার জন্য লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইয়ামামাটোর কথা শেষ হতেই ওয়াংলির মাথার ওপরকার বাতিটা দপ করে জ্বলে উঠলো। তার পাশে দাঁড়ানো ছিলো নিগ্রো কিশোরটি। তাকে একপাশে ঠেলে দিয়ে দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো সে। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলো। ওয়াংলির আচরণে আমরা যখন বিস্মিত চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছি, সে সময় ইয়ামামাটো বললো, ইকুডা প্লিজ ওর পেছনে যাও। কোনো অঘটন ঘটাতে দেখলে আমাকে খবর দেবে। : ইয়েস স্যার। ইকুডা দ্রুত চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলো। ইয়ামামাটো তখন ম্লান হেসে বললো, কি যে হলো কিছু মাথায় আসছে না। গতরাত থেকে তিন তিনবার ওয়াংলির মেমোরি চেম্বার পরীক্ষা করা হয়েছে। চিপগুলো এখনো নিখুঁত আছে। কোথাও কোনো সমস্যা নেইÑএতোদিন কোনো সমস্যাও ছিলো না। শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, হঠাৎ বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওর মেমোরি চেম্বারের রক্ষিত রেকর্ডিং সিস্টেম অকেজো হয়ে গেছে। তাই অতীতে ঘটে যাওয়া অনেক তথ্যই আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। তবে যেটুকু পেরেছি তা থেকে একটি ব্যাপার নিশ্চিত হয়েছি, ওয়াংলি আপনাকে অবিশ্বাস করে। এবার কথা বললেন ডক্টর তুশো। ইয়ামামাটোর কথা শুনতে শুনতে তার কপালের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছিলো। সেই বিন্দুগুলো মুছে নিয়ে ডক্টর তুশো বললেন, ওয়াংলির কবল থেকে তুমি নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছো, সে যে আমাদের জন্য কতো বড়ো সৌভাগ্যের ব্যাপার তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না। এটা আনন্দের ঘটনা। কিন্তু এক বিপরীতে দুঃখিত হবার মতোও ঘটনা আছে। তা কি জানো? ডক্টর তুশোর চোখ স্থির হলো আমার ওপর। আমি বললাম, ঠিক বুঝতে পারছি না স্যার। দুঃখের ব্যাপারটা কি? ডক্টর তুশো বললেন, ওয়াংলি খুব সংবেদনশীল যন্ত্রমানব। হয়তো সে জন্যই কোনো সূক্ষ্ম কারণে সে তার স্মৃতি সংরক্ষণের ক্ষমতা হারিয়েছে। তার ক্ষীপ্রতাও হারিয়েছে। ইয়ামামাটো জানিয়েছে ওয়াংলি কোনোদিনই তার পূর্ণ ক্ষমতা ফিরে পাবে না। এ এক নিদারুণ ক্ষতি। আর সে ক্ষতি ওয়াংলির জন্য যতোটা, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ক্ষতি আমার। সে ক্ষতি হয়তো আর কোনোদিনও... ডক্টর তুশোর কণ্ঠস্বর গাঢ় হতে হতে এক সময় থেমে গেলো। চোখের কোণে দু ফোঁটা পানি এসে জমেছিলো। সেই পানি মুছলেন তিনি। এবার এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটলো ডক্টর তুশোর চেম্বারে। সেখানে তখন যে মানুষগুলো ছিলো, তারা একযোগে ঘুরে তাকালো আমার দিকে। তাদের চোখের ভাষা বলছিলো, ওয়াংলির এ বিপর্যয় আর ডক্টর তুশোর চোখের পানির জন্য আমিই দায়ী! মুহূর্তটা আমার জন্য বিব্রতকর ছিলো। আমার মনে হলো এ প্রসঙ্গে কিছু একটা বলা দরকার, অন্তত আত্মরক্ষার খাতিরে। আমি বললাম, নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে ওয়াংলির এতোটা ক্ষতি করে বসবো, আমি তা বুঝতে পারিনি স্যার। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার কথা শুনে ডক্টর তুশো বললেন, না না, ক্ষমা করার কথা নয়। তুমি যা করেছো, তা হয়তো আমিও করে বসতাম। সবকিছু হিসেব করে করা যায় না। এখানে তোমার কোনো দোষ নেই। আসলে আমি ভাবছি অন্যকথা। : কি কথা স্যার? শঙ্কিত মন নিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি। ডক্টর তুশো বললেন, আসল কথা কি জানো, যন্ত্রমানব হলেও ওয়াংলিকে খুব অনুভূতিশীল করে তৈরি করা হয়েছে। এ ব্যাপারটা হয়তো তোমার জন্য খুব রিক্সি হয়ে দাঁড়াবে। সে হয়তো সব সময় তোমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইবে। তেমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসলে আফসোসের অন্ত থাকবে না। বিশ্বাস করো নিপু, কোনো ভাবেই আমি তোমাকে হারাতে চাই না। ওয়াংলির প্রতিশোধ স্পৃহার কথা শুনে মনে মনে ঘাবড়ে গেলেও কণ্ঠে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বললাম, আমার জন্য ভাববেন না স্যার। এখন থেকে আমি সাবধান হয়ে চলবো। : হা-হা-হা-! শব্দ করে হেসে উঠলেন ডক্টর তুশো। হাসতে হাসতেই বললেন, ওয়াংলির ক্ষমতা সম্পর্কে দেখছি তোমার কোনো ধারণাই নেই! সে যাক, আমি ঠিক করেছি এখন থেকে ওয়াংলিকে তোমার সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করবো। তোমার আর আমার মাঝে যোগাযোগের কাজ করবে ইকুডা। ঠিক আছে, তুমি এখন যেতে পারো। ২৪ জুলাই ১৯৫২ যখন ছোট ছিলাম তখন ছোট কাকু আমাকে অনেক বই এনে দিতেনÑট্রেজার আইল্যান্ড, দ্রুত সি উলফ, মবিডিক, লা মিজারেবল আর রিপভ্যান উইঙ্কেলের মতো বিশ্বসাহিত্যের সব বিখ্যাত বই। কি শিহরণই না ছিলো সে সব বইয়ের পাতায় পাতায়! কিন্তু কে জানতো রিপভ্যান উইঙ্কেলের চেয়েও এক রোমাঞ্চকর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাবো আমি! প্রতিদিনের মতো একটা বইয়ের পাতায় মাত্র চোখ রেখেছি, এমন সময় ডক্টর তুশোর চেম্বারে দেখা নিগ্রো ছেলেটি এসে দাঁড়ালো আমার সামনে। আমি চোখ তুলে তাকাতেই সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে সে বললো, আমার নাম স্যার টিম্বাকু। গতকাল আপনার সঙ্গে প্রভুর চেম্বারে দেখা হয়েছিলো। বললাম, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কি ব্যাপার বলো তো? কোনো কাজে এসেছো, না গল্প করার জন্য? আমার কথা শুনে ছেলেটি দাঁতে জিভ কেটে বললো, ছি ছি, কি যে বলেন! আপনার সঙ্গে গল্প করার মতো যোগ্যতা আছে নাকি আমার! আসলে প্রভু একটা খবর জানাতে পাঠিয়েছেন। তিনি আপনার জন্য সাতাশ নম্বর কেবিনে অপেক্ষা করছেন। অনুগ্রহ করে এক্ষুনি একবার যেতে বলেছেন। একটি কথা স্বীকার না করলেই নয়, ডক্টর তুশো ইদানীং অনেক সহৃদয় হয়ে উঠেছেন আমার ওপর। কিছুটা যেনো ভরসাও করতে শুরু করেছেন। তাই যে কোনো প্রয়োজনে যে কোনো সময় ডেকে পাঠাচ্ছেন আমাকে। এতে নিজেকে সম্মানীতই মনে করছি আমি। টিম্বাকুকে বললাম, চলো আমার সঙ্গে। কেবিনের দরজাটা লক করে এসো। দরজার মুখোমুখি বসে পাইপ টানছিলেন ডক্টর তুশো। আমাকে দেখেই বললেন, টেক ইউর সিট ডক্টর। বিশেষ প্রয়োজনে তোমাকে ডেকেছি। কিছুক্ষণ আগে কথা হয়েছে আমাদের আরেক সহকর্মী বিন্দু বোসের সঙ্গে। ব্যাপারটা খুবই গোপনীয়। তাই দুজনকে আলাদা আলাদা ডাকতে হলো। (চলবে)

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ