বিশুদ্ধ পরিবেশের জন্য চাই বৃক্ষ

বিশুদ্ধ পরিবেশের জন্য চাই বৃক্ষ

গল্প নাবিউল হাসান জুলাই ২০২৩

ঢাকা শহরের ব্যস্ততম ফকিরাপুল এলাকায় অনেকগুলো সরু গলি। দুই পাশে ছাপাখানা আর অফিস স্টেশনারির দোকানগুলো লোকে গিজগিজ করছে। এর মাঝ রাস্তা দিয়ে অসংখ্য লোকের ভিড় ঠেলে লোহার হাতলওয়ালা ঠেলাগাড়ি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আজিম উদ্দিন। ঠেলাগাড়ি চালানোর কাজ করেই সংসার চালান তিনি। পুরান ঢাকার বাংলাবাজার থেকে কিনে আনা কাগজগুলো ফকিরাপুল ছাপাখানায় নিয়ে আসতে বংশাল-গুলিস্তানের রাস্তায় বিভিন্ন গতির গাড়ি প্রতিযোগিতার মুড নিয়ে এগিয়ে চলে। ঠেলাগাড়িতে অনেক লোড নিয়ে গায়ের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে দুইজনে মিলে এগিয়ে আসতে হয়। একজন সামনের গতিপথ কন্ট্রোল করেন আরেকজন পেছন থেকে সহযোগিতা করেন। রাস্তায় ছুটে চলা বড়ো গাড়ির পেছন থেকে ধেয়ে আসা ধুলোবালি ধোঁয়ার ঝাঁকের মতো নাকে মুখে ঢুকে যায় ওদের। এর মধ্যে আবার অসহ্য গরমের তীব্রতায় শরীরে বয়ে যায় ঘামের ফোয়ারা। উড়ে আসা ধুলোবালি সেই ঘামের সাথে মিশে হয় কাদা। মাথার উসকো খুশকো চুলগুলোতে ধুলোবালি মিশে পাটের সুতলির আকার ধারণ করে। দুপুরের খাবার সময় নামকাওয়াস্তে হাতমুখ ধুয়ে খাবার গ্রহণ আর মাঝে মধ্যে ময়লা শরীরেই পানি পান করা তাদের নিত্যদিনের ঘটনা। সারাদিন ঠেলাগাড়ি নিয়ে ছুটাছুটি করার কারণে পরিষ্কার হয়ে এসব সামলানোর সুযোগ নেই। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে আসেন আজিম উদ্দিন। তাঁর স্ত্রী রোকসানা পারভীন মানুষের বাসায় বুয়ার কাজ করে। টিনশেডের একটি ভাড়া বাসায় ঠিকমতো পানি, বিদ্যুৎ আর গ্যাসের সাপ্লাই নেই। এর মধ্যেই কষ্ট করে দিন কাটাতে হয় তাদের। তাদের ছেলে রিফাত হোসেন ক্লাস ফোরে আর মেয়ে আসমিনা আক্তার টুতে পড়ে। ঢাকা শহরের যেকোনো স্কুলে লেখাপড়া করানোর খরচ অনেক বেশি। কিন্তু আজিম উদ্দিনের স্বপ্ন তার সন্তানরা লেখাপড়া শিখে বড়ো মানুষ হবে; একদিন তাদের দুঃখের দিন শেষ হবে। মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া শিখে অভাবের কারণে আজিম উদ্দিন আর এগুতে পারেনি। ঢাকায় পাড়ি জমাতে হয়েছে তাকে। এখন সন্তানদের ওপর কিছু আশা আর কিছু সম্ভাবনা নিয়ে তাদের পথচলা। সন্তানরা ভালো কিছু করতে পারলে নিজেদের চাওয়ার কিছু নেই। এজন্য সমস্ত কষ্টকে সাদরে বরণ করে নেয় তারা।

পাশের বাসা থেকে হাউমাউ কান্নার শব্দ আর কিছু লোকের চিৎকারে চমকে ওঠে রিফাতরা। শহীদ চাচার ছেলে মিলন গত ৩ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি ছিল। আজ হাসপাতালেই মারা যায় সে। লাশ এখানে না এনে সরাসরি গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। এজন্য মিলনের আত্মীয়-স্বজনরা কান্নাকাটি করতে করতে দ্রুত গ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর মৃত্যুর খবর হতবাক করে সবাইকে। ক্লাস ফাইভে পড়–য়া টগবগে কিশোর মিলন ভাইয়ার এভাবে চলে যাওয়া অনেক বেদনার। রিফাতের বিষন্ন মন পড়ার টেবিলে ধরে রাখতে পারছে না। বাবা আজিম উদ্দিন তাকে অনেককিছু বুঝিয়ে শান্ত থাকার পরামর্শ দেয়। “পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে আর মানুষ নিজেই বিপদ ডেকে আনছে। যারা প্রকৃতি ধ্বংস করছে ওরা তো বিপদে পড়ছে না, বিপদে পড়ছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলো।” বাবার এই কথাটুকু ভীষণভাবে চিন্তিত করে রিফাতকে। সে তার বাবার কাছে জানতে চায় এর মর্মার্থ। আজিম উদ্দিন সারাদিন পরিশ্রমের পরও সময় পেলেই কার্তিক দাদার সেলুনে যান পত্রিকা পড়ার জন্য। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি জানার জন্য পত্রিকা পড়ার পাশাপাশি ছেলে মেয়ের বইসহ অন্যান্য বই মনযোগ দিয়ে পড়েন। পড়াশোনার প্রতি তার প্রবল আগ্রহের কারণে তার সন্তানদের আলাদা প্রাইভেট পড়াতে হয় না। যেকোনো বিষয় তিনি নিজেই তাদের বুঝিয়ে দেন। পরিবেশ নিয়ে রিফাতের চিন্তার বিষয়টিও তিনি বুঝানোর চেষ্টা করেন- আমরা পৃথিবীর বাতাস থেকে নিঃশ্বাস নেই। আমাদের ফুসফুস এই বাতাসের যে অক্সিজেনটুকু গ্রহণ করে তা আবার বাইরে কার্বন ডাই-অক্সাইড আকারে বের করে দেয়। অন্যদিকে গাছপালারা বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে বাতাসে অক্সিজেন সরবরাহ করে। কিন্তু অগণিত মানুষের ভিড়ে এই ঢাকা শহরে কতগুলো মানুষ আর কতগুলো গাছপালা? মানুষের তুলনায় গাছপালা এত কম যে, মানুষের নিঃশ^াস নেওয়ার বাতাসটুকুও বিষাক্ত হয়ে আছে। ঢাকা শহরে গাজীপুরের জাতীয় উদ্যান থেকে কিছু অক্সিজেন আসলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। গোটা বাংলাদেশের মানুষ ও পশুপাখিদের জন্য দেশের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু দেশে এখন ৭ শতাংশ বনভূমি আছে কি না সন্দেহ। কারণ মানুষ যেভাবে গাছ কাটছে সেভাবে গাছ রোপণ করছে না। লোকজন বাড়িঘর নির্মাণ, শিল্প-কারখানার কাঁচামাল আর জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রতিদিন বন ধ্বংস করে। অনেক সময় দুষ্ট লোকজন বনভূমিতে আগুন ধরিয়ে দেয় কাঠ সংগ্রহ করার জন্য। এভাবে মানুষ ইচ্ছেমতো পরিবেশকে দূষিত করছে। হাজার হাজার যানবাহনের ধোঁয়া, শিল্প কারখানার অপরিকল্পিত বর্জ্য বাতাসকে করছে বিষাক্ত। প্রতিনিয়ত ঢাকার চারপাশে জলাশয় এবং জলাভূমিগুলো ভরাট করে বড়ো বড়ো বিল্ডিং বানানো হচ্ছে। কিন্তু গাছপালা শোভিত বাগান করার ব্যাপারে লোকজন উদাসীন। ফলে শিশু, বৃদ্ধ এবং হৃদরোগীর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ময়লা আবর্জনার স্তূপ পরিবেশের পাশাপাশি পানিও দূষিত করে। আজ বড়ো বড়ো রাস্তাগুলোর ধারে যদি বড়ো বড়ো গাছপালা থাকতো তাহলে আমাদের ধুলোবালি খেতে হতো না। গাছের ছায়ায় গাড়ি চলতো আর শীতল বাতাসের পরশ শরীরে লেগে আমরা মজার সাথে কাজ করতাম। তিনি নিজের প্রতিদিনের কাজগুলোর রুটিন তুলে ধরেন। ফকিরাপুলের ঘিঞ্জি এলাকায় হাজার মানুষের অক্সিজেনের সাপ্লাই না থাকায় অসহ্য গরমে মানুষ রোগাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত গাড়ির আওয়াজে হার্টের রোগীদের করুণ অবস্থা এবং বিশুদ্ধ বাতাসের অভাবে হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। আর বাতাসে এখন প্রয়োজনের তুলনায় কম অক্সিজেন থাকার কারণে পৃথিবীর ওজন স্তরে ফাটল ধরা শুরু হয়েছে, যার কারণে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে পৌঁছে সৃষ্টি করছে বিপর্যয়। অনিয়ন্ত্রিত বন্যা, খরা, জলোচ্ছাস ও বিভিন্ন ধরনের ঘূর্ণিঝড় বাড়ছে। বর্তমানে অনেক দেশে এসিড বৃষ্টিও হচ্ছে। এভাবে বাতাসে যদি কার্বন ডাই-অক্সাইড বাড়তে থাকে আর পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের গড় তাপমাত্রা যদি ২ ডিগ্রি সে. বৃদ্ধি পায় তাহলে সাগরের বরফ গলে উঁচু হয়ে ওঠবে পানি। অন্যদিকে বহু কোটি টন কয়লার ধোঁয়া আর ধুলোবালি যদি সূর্যের আলোকে পৃথিবীতে পৌঁছতে বাধা দেয় তবে তার ফলাফল কত ভয়াবহ হবে চিন্তা করা যায়? 

বাবার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে রিফাত জিজ্ঞাসা করে- এই অবস্থা থেকে কি আমাদের ফিরে আসার কোনো উপায় নেই?

বাবা বললেন, অবশ্যই আছে। পৃথিবীর মানুষগুলোকে সচেতন হতে হবে। বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। প্রত্যেক বাড়ির আশেপাশে, পুকুরধারে, জলাশয় কিংবা নদীর কিনারে, স্কুলের আঙিনার চারপাশে, রাস্তাঘাটের দুইধারে। অনাবাদি ও খালি জমিতে বনায়ন গড়ে তুলতে হবে। যত গাছ কাটা প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক গুণ রোপণ করতে হবে। সমস্ত আবর্জনা সুন্দরভাবে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে জৈবসারে রূপান্তর করে ফসল ও গাছপালায় প্রয়োগ করতে হবে। রাসায়নিক বর্জ্যের ব্যাপারে সচেতন হয়ে সবাই মিলে যদি পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব দেয় তবে অবশ্যই আমাদের পৃথিবীটা বাসযোগ্য হবে এবং মানুষ নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারবে। 

রিফাত সিদ্ধান্ত নেয়- এই বিষয়ে স্কুলের স্যারসহ সব বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করে এবার প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানোর প্রতি সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে। নিজেদের স্কুলের আশেপাশে ও বাসার মালিকের কাছে অনুমতি নিয়ে বাসার পাশে গাছ লাগাতে হবে। গ্রামের বাড়িতেও কিছু গাছ লাগানোর জন্য ছোটো চাচাকে ফোন দেবে সে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ