বীথির ভাবনা

বীথির ভাবনা

তোমাদের গল্প আগস্ট ২০১০

হেলাল আরিফীন

আকাশে মেঘ ডাকছে। বিজলি চমকাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নামবে। বীথি জানালা খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

রাত দশটা। জাফর সাহেব কী একটা বই পড়তে নিয়ে খুব বোর ফিল করছিলেন। টেবিলে বইটা রেখে তিনি বীথির রুমে গেলেন। বীথি তখনও তন্ময় হয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। জাফর সাহেব মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন। এখন আকাশ টুকরো টুকরো হয়ে নেমে আসতে শুরু করেছে। সোডিয়াম বাতির আলোয় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কেমন এক রঙ ছিটিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ বাবার উপস্থিতি টের পেল বীথি। মুখ ঘুরিয়ে বাবার দিকে মায়াময় দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকিয়ে বীথি বলল, আব্বু তুমি? কখন এসে দাঁড়িয়েছ?

জাফর সাহেব মেয়ের পরিপাটি চুলগুলোয় হাতের স্পর্শ বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, তোর মেঘ-বৃষ্টি দেখতে ভাল লাগে, তাই নারে? হ্যাঁ, খুউউব। আর কী দেখতে ভালো লাগে? আকাশের জোছনা, ফুল, পাখি, ঝরনা, নদী, নদী পাড়ের কাশফুল। আর? আরও দেখতে ভাল লাগে সারি সারি নারকেল গাছ, আমাদের গ্রামের বাড়ির পুকুর। পুকুরে ফুটন্ত শাপলা। আর কী দেখতে ভাল লাগে? তোমাকে দেখতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। আর ... আর কী মা মণি? হঠাৎ কেমন অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকাল বীথি। অনেকক্ষণ। ওর চোখ সরছে না। যেন বহুদিন পরে বাবাকে ও প্রাণভরে দেখছে। অথবা বাবার ভেতরে আর কাউকে দেখার চেষ্টা করছে। মেয়ে এভাবে তার দিকে তাকালে তিনি যেন কী দেখতে পান। কোথায় যেন হারিয়ে যান তিনি। কার যেন মুখ উঁকি দেয় বীথির মুখের আড়ালে। জাফর সাহেব ভাঙাচোরা গলায় বললেন, হঠাৎ তোর কী হল মা মণি? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

বীথির কণ্ঠ বিদীর্ণ করে হঠাৎ চাপা কান্না বের হয়ে এল। কান্নার সাথে ভেজা কিছু শব্দও বীথির বুক চিরে বেরিয়ে এল। আম্মুকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে আব্বু। খুব দেখতে ইচ্ছে করে। তুমি আমার আম্মুকে এনে দাও। জাফর সাহেব মেয়ের মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিলেন। সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেন। মেয়ের দুই চোখের অশ্রু বারবার মুছে দিলেন। কিন্তু বীথির কান্না আর থামে না। ডুকরে ডুকরে কাঁদতেই থাকে বীথি। সকালের সোনালি রোদের আলোকচ্ছটা জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে বীথির মুখের ওপর এসে পড়েছে। বীথি তখনও ঘুমিয়ে। অবশ্য আজ ঘুম থেকে ওঠার এত তাড়াও নেই। ক্লাস নেই, প্রাইভেট নেই, যাকে বলে একদম নির্ঝঞ্ঝাট সকাল। কাজের মেয়ে রহিমা টেবিলে নাশতা সাজিয়ে রেখেছে। জাফর সাহেব গিয়ে বীথির কপালে আলতো হাত রেখে বললেন, মা মণি, ওঠ। এত বেশি ঘুমোলে শরীর খারাপ করতে পারে। বীথি ঘুমকাতুরে গলায় বলল, আব্বু, কেন ডিস্টার্ব করছ? আমি আরও ঘুমোবো। আরও ঘুমোবে! বুয়া টেবিলে নাশতা দিয়েছে। উঠে পড়, প্লিজ! তাছাড়া, আজ ছুটির দিন তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে বেরুব। বীথি ঘুম জড়ানো গলাতেই বলল, আমাকে নিয়ে কোথায় যাবে আব্বু? এই শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে কোথাও! সত্যি-ই-ই! এক ঝটকায় উঠে বসল বীথি। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, অনেক দূরে কোথায় নিয়ে যাবে আব্বু? ওখানে গেলে কি আম্মুকে খুঁজে পাবো? কোন্ কথার পিঠে যে বীথি এখন কী কথা বলে ফেলে তার কোন ঠিক নেই। জাফর সাহেবের চোখ ভিজে এল। অকারণেই চোখ থেকে চশমাটা খুলে কিছুক্ষণ হাতে নিয়ে রইলেন। তারপর স্নেহার্দ্র গলায় বললেন, সব সময় এত আম্মু আম্মু করিস কেন? আম্মু বলিস আর আব্বু বলিস, আমিই তো তোর সব। ব্রেডে জেলি মেখে মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন জাফর সাহেব। রহিমা এসে বলল, সাব, দুপুরের জন্য কী রাঁধব? শুধু তোমার জন্য যা হয় একটা কিছু রেঁধো। আমরা আজ সারা দিনই বাইরে থাকব। বীথি মিষ্টি হেসে বলল, বুয়া আজ তোমার রান্না করার কোন দরকার নেই। তুমিও চল আমাদের সাথে। কোথায় যামু আম্মাজান? কোথায় আবার? আমরা যেখানে যাবÑ সেখানে যাবে। না আম্মাজান, আমি যামু না। আমার ডর করে। ডর কেন করবে? আমাদের সাথে যেতে তোমার আবার ডর কিসের? যাও, হাত মুখ ধুয়ে ভাল শাড়ি টারি কিছু পরে আস। না, আম্মাজান। আমি যামু না। এই শহরে কোথাও যাইতে আমার ভাল লাগে না। বীথি বোয়ার দিকে রাগত চোখে তাকাতেই জাফর সাহেব বিরক্তির গলায় বললেন, আহা, ওর সাথে তুই অমন করছিস কেন? ও কেন আমাদের সাথে বেড়াতে যেতে চাইবে? কেন চাইবে না? সব কেনর উত্তর হয় না মা মণি। তাড়াতাড়ি নাশতা সেরে রেডি হয়ে নে। আমি আসছি। বীথির কিশোরী মনটা বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে কোথায় যেন বারবার হারিয়ে যাচ্ছে।

বিজয় সরণি রোড ধরে গাড়ি মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলছে। জাফর সাহেব ও বীথি পেছনের সিটে বসেছে। উইন্ড শিল্ডের দিকে মুখটা ঈষৎ কাত করে রেখেছে বীথি। জাফর সাহেব আজকের কাগজের ওপর হালকা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। সিগন্যালে থামতেই এক কিশোরী মেয়ে গাড়ির জানালার সামনে ফুলের মালা বাড়িয়ে দিয়ে মিনতির গলায় বলল, মালা লইবেন আফা? লন না একটা?

বীথি অন্যমনস্ক ছিল। সিগন্যালে গাড়ি কখন থেমেছে টেরই পায়নি ও। মেয়েটির কথায় ও ফিরে তাকালো। ওর বয়সীই হবে। ওর মতই দেখতে। ওরই মত দু’টি হাত, দুটি পা, দু’টি চোখ। বীথির পরনে দামি কাপড় আর ওই মেয়েটির পরনে ময়লা ছেঁড়া সালোয়ার কামিজ। তাছাড়া একটুও পার্থক্য নেই। তবে কেন মেয়েটি রাস্তায় রোদে দাঁড়িয়ে ফুলের মালা বিক্রি করছে; আর বীথি ওর মতই রক্তমাংসে গড়া মেয়ে হয়ে দামি গাড়িতে চড়ে বেড়াতে যাচ্ছে? বীথি মনে মনে উত্তর খুঁজতে চায়। ওর মনটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়!

মেয়েটির গলায় আবারও মিনতি ঝরে পড়ে। একটা মালা লইবেন আফা? লন না একটা মালা। বীথি জানালার কাচ পুরোটাই তুলে দেয় ওপরের দিকে। মেয়েটির হাত থেকে সব মালাই নিয়ে নেয়। বাবাকে টাকা দিতে বলে মেয়েটির গালে হাত বুলিয়ে একটু আদর করে দেয়। সিগন্যাল পোস্টে সবুজ বাতি জ্বলে। গাড়ি পিঁপড়ার মত সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। মেয়েটি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। গাড়ি চলতে থাকে। অনেকক্ষণ। বাবা-মেয়েতে এবার গল্প জমে উঠেছে। হঠাৎ একটি দৃশ্যে চোখ আঠার মতো আটকে থাকে বীথির। কৃত্রিম ঝর্ণার চারপাশে জমে থাকা নোংরা পানিতে কোন এক মা তার শিশু সন্তানকে গোসল করাচ্ছে। অবোধ শিশুটি চিল চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। ওরকম চিৎকার তো করারই কথা, কারণ শ্যাওলা পড়া রোদে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা ওই পানি কখনও কোন শিশুর জন্য আরামদায়ক হতে পারে না। অথচ রাতের বেলায় এই কৃত্রিম শাওয়ারটিই লাল নীল সবুজ আলোর পানির ফোয়ারা ওপর দিকে ছুড়ে দিয়ে নগরবিলাসী মানুষের মনোরঞ্জন করবে। যেসব শিশুর বেবি ফুডের কৌটার যতেœ বড় করা হয়, সুশীতল পানির সাথে জীবাণুনাশক ডেটল মিশিয়ে গোসল করানোর পর বেবি লোশনের আদরে রোজ ঘুম পাড়ানো হয়, সেই সব শিশুদের সাথে এই শিশুটির পার্থক্য কী? বীথির কিশোরী মন উত্তর খুঁজে পায় না। দৃশ্যটা কেমন থিতু হয়ে বসে ওর মস্তিষ্কে। বাবাকে এ সম্পর্কে কিছু বলতেই তিনি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেন মেয়েকে। গাড়ি চলতে থাকে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ