বৃষ্টির দিনে মামাবাড়ি

বৃষ্টির দিনে মামাবাড়ি

গল্প খাতুনে জান্নাত কণা জুলাই ২০২৩

: ফাতিহা, তুমি কি বৃষ্টিতে ভিজতে বাইরে যাবে? 

: হ্যাঁ - হ্যাঁ যাবো তো। কিন্তু, আম্মুকে বলে আসতে হবে। অরণী, চলো আমরা আম্মুদেরকে বলে বৃষ্টিতে ভিজতে যাই।

: আম্মু কি রাজি হবে?

: মামাবাড়ি বেড়াতে এসেছি। এখানে খুব বেশি বকা দেবে না মনে হয়। চলো, চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ি।

বের হওয়ার সময় ওদের মামী দেখে ফেললেন। জানতে চাইলেন, 

: দুই খালাতো বোন মিলে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

: মামী, আমরা একটু বৃষ্টিতে ভিজবো। এখন তো শুধু বৃষ্টিই হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে না। এই টিপটিপ বৃষ্টিতে আমরা একটু ঝিরির ওখানে গিয়ে কতটুকু পানি বাড়লো দেখে আসবো।

: ফরিদাকে তাহলে সাথে নিয়ে যাও। ওকে এখানকার সবাই চেনে। তোমরা কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরবে। তা না হলে তোমাদের আম্মুদের কাছে আমাকে কৈফিয়ত দিতে দিতে নাজেহাল হতে হবে। একজন গোসল করতে ঢুকেছেন, একজন নামাজ পড়ছেন। তারা তোমাদের খোঁজ করার আগেই ফিরে এসো। 

: জি আচ্ছা মামী।

ফরিদা ওদের সমবয়সী। ওকে সাথে নিবে ভেবেছিল। ফরিদাকে বলার আগেই মামী ওকে আসতে দিয়েছেন দেখে খুব আনন্দ হলো।

এর আগে অরণী, ফরিদা আর ফাতিহা মিলে ছোটো ছোটো কাগজের নৌকা বানিয়ে রেখেছিল। আসার সময় ওগুলো ফ্রকের আড়ালে ঢেকে নিয়ে এসেছে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে দেখে ঝিরির পানিতে ওরা নৌকাগুলো ভাসিয়ে দিলো। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ওগুলো সহজে ভিজে ডুবে যাবার ভয় নেই। হালকা পায়ে নেচে নেচে ওরা খানিকক্ষণ গান গাইল। যে যার স্কুলে শেখা বৃষ্টি দিনের গান। নৌকাগুলো ভিজে চুপচুপে হয়ে এক সময় ডুবে গেল। যেহেতু, বৃষ্টি হচ্ছে, তাই লোকজন খুব একটা চোখে পড়ছে না। মাঝে মধ্যে দু’একজন গারো পল্লী থেকে আসা মহিলা পাশের রাস্তা দিয়ে, পিঠে করে বারোমাসি শিমুল আলু, কলা আর পাহাড়ে চাষ করা সবজি নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছে। বিকেলে যে বাজার বসে, সেখানে এগুলো বিক্রি করবে। ওদের কাপড় পরার ধরন দেখে ফাতিহারা অবাক হয়। শাড়ি পরলেও সেটা ওরা খুলে গায়ে জড়িয়ে পরে না। ভাঁজ করে বুকের ওপর গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখে। গলায় আর নাকে, হাতে, কানে নানা রকম গহনা। মাথার চুলগুলো ছোটো একটা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা। ঠিক গোসলের পর অরণীদের বাড়ির বড়ো মেয়েরা যেভাবে গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে রাখে, তেমনি।

শিমলা আলু বলে পরিচিত আলু এই ঝিনাইগাতীর পাহাড়ের কোলঘেঁষা গ্রামে এসেই অরণী আর ফাতিহা খেয়েছিল। জাপানি কার্টুনে দেখেছে ওরা মিষ্টি আলুকে সুইট পটেটো বলে। ডোরেমন আর সিনচেন কার্টুনে অনেক পর্বে দেখেছে। অরণী মনে মনে ভাবে, এই শিমুল গাছের মতো দেখতে ছোট্ট গাছগুলোর শিকড়ে বেড়ে উঠা আলুকে ওরা তাহলে কী নামে ডাকবে? এখানে ধানক্ষেত আখক্ষেতের মতো এইসব আলুর ক্ষেত অনেক। যা ওরা নিজেদের গ্রামের বাড়ির এলাকায় কোথাও চাষ হতে দেখেনি। ওরা দেখল বৃষ্টির মাঝেই একজন লুঙ্গি পরা লোক কাঁধের লাঠিতে রক্তাক্ত মরা শেয়াল ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একটু দূরের ঝোপের ভেতর থেকে লোকটাকে ওরা বেরিয়ে আসতে দেখেছে। পিঠে ঝুলানো লম্বা একটা গোল মুখের বাঁশের তৈরি সরু ঝুড়ির ভেতর কয়েকটা তীর, বগলে আটকানো ধনুক। ফরিদা ফিসফিস করে বলল,

: এরা সাঁওতাল। শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে। চলো আমরা বাড়িতে যাই। দেখেছো, ঝিরির পানি কেমন বেড়ে যাচ্ছে? পায়ের গিরা পর্যন্ত ছিল। এখন হাঁটুর কাছাকাছি চলে এসেছে। এক ঘণ্টার মধ্যেই কোমর ছাড়িয়ে যাবে। এখন জোয়ারের সময় তো। তাই এমন হচ্ছে। পানি বাড়ার আগেই আমাদের যেতে হবে। এই পানিতে বেশ স্রােত থাকে। প্রায় তিন হাত প্রশস্ত এই ড্রেনের মতো জায়গাটা তখন সরু একটা খাল মনে হবে। অরণী তো সাঁতার জানে না। আর আমরা সাঁতার জানলেও এত স্রােতের পানিতে সাঁতার কাটতে গিয়ে ভেসে যাবো। চলো চলো। 

ওরা আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির পথ ধরল। এখন ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বড়ো বড়ো ফোঁটায় ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফেরার সময় ওদের বেশ ঠান্ডা লাগছিল। আষাঢ় মাসে এমনিতেই খুব গরম আবহাওয়া থাকে। কিন্তু বৃষ্টি হলেই সব কিছু কেমন বদলে যায়। ফরিদাদের কদম গাছের নিচু হয়ে থাকা ডাল থেকে ওরা কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে নিলো।

: মামা বলছিলেন কাল আমাদের গজনীর পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাবেন। সেখানে পাহাড়ে উঠে অনেক দূরের জায়গা দেখা যায়। ভারতের গ্রামগুলো নাকি ওখানেই?

: হ্যাঁ, এর আগে তো তোমরা গিয়েছিলে। কিন্তু তখন আরো ছোটো ছিলে তাই খুব বেশিকিছু মনে নেই। রাবার বাগানও আছে। আমরা মাঝে মধ্যেই বেড়াতে যাই। ঐ যে দূরে, ছাইরঙা মেঘের মতো দেখতে পাচ্ছো, ওটাই তো গারো পাহাড়। 

: পাহাড়টাকে দূর থেকে এত সুন্দর লাগে দেখতে! 

অরণী আর ফাতিহা দু’জনেই মুগ্ধ চোখে বৃষ্টি ভেজা দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইল। ফরিদার তাগাদা পেয়ে এবার ওরা বাড়ির পথে দৌড়াতে লাগল। 

পরদিন আর ওদের গজনী অবকাশ কেন্দ্রে যাওয়া হলো না। বৃষ্টিতে একটু বেশি সময় ভেজার কারণে, তিনজনই সর্দি জ্বরে কাবু হয়ে পড়েছে। অরণী আর ফাতিহাকে ওদের আম্মু খুব করে বকেছেন। মামা ভয় পাচ্ছিলেন, বাচ্চাগুলো আবার কোভিড নাইন্টিনের খপ্পরে না পড়ে। ডাক্তারের পরামর্শে ওদের খুব ভালো খেয়াল রাখছিলেন। আল্লাহর রহমতে ফাতিহাদের জ্বর তিন দিনেই ভালো হয়ে গেল। জ্বর সম্পূর্ণ সেরে গেলে, মামা ওদের গজনীর অবকাশ যাপন কেন্দ্রে ঘুরতে নিয়ে গেলেন। সারাদিন ধরে ওরা রাবার বন, মাটির নিচের কৃত্রিম সুড়ঙ্গ পথ, লেকের পানিতে ময়ুরপঙ্খী নৌকা আর ইঞ্জিন নৌকায় ঘুরে বেড়াল। উঁচু টাওয়ারে উঠে, চারপাশের পাহাড়, বন আর দূর সীমান্তের ভারতীয় গ্রামগুলো দেখতে পেল। দূরবীন চোখে লাগিয়ে দেখলে দৃশ্যগুলো খুব কাছের মনে হচ্ছিল। ডাইনোসর, হাতি এসবের বড়ো বড়ো স্ট্যাচু ঘুরে দেখল। পার্কের ভেতরের দোলনায় দোল খেয়ে, দৌড়-ঝাঁপ খেলে, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল। মামা বাড়ি থেকে বেশ সহজেই ওখানে গাড়িতে করে যাওয়া যায়। অথচ আম্মুর কাছে শুনেছে, এক সময় এখানকার রাস্তাগুলো খুব বেশি ভালো ছিল না। তাই, কেউ পাহাড় দেখতে চাইলে মামাবাড়ি থেকে তাকে পাঁচ মাইল রাস্তা হেঁটে, গজনী পাহাড়ে যেতে হতো। মামা এখানে অনেক বছর ধরে থাকছেন। ফাতিহারা যতক্ষণ পার্কে ছিল, ততক্ষণ আকাশে মেঘের আনাগোনা থাকলেও বৃষ্টি হয়নি। যখন ওরা বাড়ি ফিরে এলো, তার কিছুক্ষণ পরেই শুরু হয়ে গেল ঝুম বৃষ্টি। ফরিদা-অরণী-ফাতিহা খুব খুশি হলো। ভাগ্যিস, আজ ওদের আর বৃষ্টিতে ভিজতে হয়নি। তাহলে তো বড়োরা পুরো পার্কে না ঘুরেই ওদেরকে নিয়ে বাড়ি চলে আসতেন। আসলে আল্লাহ যা করেন, মঙ্গলের জন্যই।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ