বেলুন বন্দী ঈদ
গল্প আগস্ট ২০১২
আল মাহমুদ.. এক বিচিত্র আলসেমির মধ্য দিয়েই দিনটা কেটে গেল আনাসের। দিনটা যদি অন্য কোনো দিন হতো, তাহলে কথা ছিল নাÑ ঈদের দিন বলে কথা! এই দিনে কেউ এভাবে কাটিয়ে দিতে পারে? কিন্তু আনাস সেটাই করল। সকালে ঈদের নামাজের প্রস্তুতি পর্বটা যা একটু তাড়াহুড়ো। সারা গায়ে সাবান ঘষে প্রচুর ফেনা তৈরি করে গোসল, নতুন জামা-কাপড় পরার প্রতিযোগিতা ও আতর-গোলাপ ম ম করা কিছুটা সময় পার করে। আনাস বরাবরই বাঁধনমুক্ত এক কিশোর। সে কারণেই ওর মন চাচ্ছে এখন দূরে কোথাও চলে যেতে। হাঁটতে হাঁটতে অচেনা কোনো গাঁয়ে হারিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। তাহলে সারাদিনে কেউ আর খুঁজে পেত না। একটু পরেই বাড়িতে লোকজন আসা শুরু করবে। লোকের ভিড় ওর একদমই ভালো লাগে না। ঢাকা শহরে এই নিয়ে তিনটি ঈদ করছে ও। এর আগের ঈদগুলো গ্রামেই কাটিয়েছে। সে ঈদগুলো বহু বর্ণিল হতো। আনাসের একটা নেশা ছিলÑ ঈদের দিন সকালে ঈদগাহে দু’রাকাত ওয়াজিব নামাজ পড়েই ছুটে যেত তিতাসের পাড়ে। ওর প্রিয় তিতাস নদী। কুলুকুলু সুর তুলে বয়ে যায় স্বচ্ছ জলরাশি। একটু তফাতে দেখা যায় পানি ওখানটাতে ফেনা সৃষ্টি করছে। ছুটে যায় ও। কী সুন্দর! পানি ওখানটাতে ঘুরছে, আর তাতেই সৃষ্টি হয়ে চলেছে সাদা ফেনা। ওদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটো চকচক করে ওঠে ওর। হারিয়ে যায় যেন কোনো ভাবুক রাজ্যে। আনাস এমনই। রাত করেই ঘুমিয়েছিল আনাস। চোখে তখনও রাজ্যের ঘুম। এরই মাঝে কাকডাকা ভোরে কে এক সৌম্য চেহারার প্রবীণ ওকে জাগিয়ে বললেন, ‘এই ওঠ, আজ ঈদ না?’ আনাস লাফ মেরে বিছানায় উঠে বসে। আর মুহূর্তের মধ্যে ওর নাকে লাগল ঈদুল ফিতরের গন্ধ। মেহেদী, আতর ও ফিরনির সুবাস মাখানো একটা প্রভাতবেলা যেন ওর ছোট্ট বুকটাকে ভরিয়ে তোলে। যে প্রবীণ ওকে জাগিয়েছিলেন তার মুখে রহস্যময় খুশির ঝিলিক। এমনিতে তিনি হাসেন কম। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তার সারা মুখে, অবয়বে সংযমের চিহ্ন ফুটে বেরুচ্ছে। কিন্তু কোনো নির্মমতা বা কঠোরতা নয়। কারণ তার চোখ দু’টি রমজান মাসব্যাপী কুরআন পাঠের সজল কোমল আভায় নরম হয়ে আছে। আনাস তাকে ‘আব্বা’ বলে ডাক দিয়ে উঠল। তিনি পুনরুক্তি করে বললেন, ‘আজ ঈদ না বোকা! আজ খুব ভোরে উঠতে হয়। ঈদগায় যাবি না? তাড়াতাড়ি গোসল সেরে নে। আয়, আমি কাপড় পরিয়ে দিচ্ছি।’ খুব ভোরে গোসল। পুকুরে লাফিয়ে পড়ে কিছুক্ষণ দাপাদাপি। ভেজা শরীর নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে নতুন কাপড় পরা। মাথা আঁচড়ানো। সুরমায় দু’চোখ কালো করা। আচকান ও রুমি টুপিতে দারুণ এক উচ্ছ্বাস উপছে পড়ছে। প্রথমে ঘরে ঢুকলেন ছোট চাচা। তারপর মামুরা। নানা এলেন সবার শেষে। এসেই তাড়াহুড়ো লাগিয়ে দিলেন, ‘আরে, তোমরা এখনও বেরিয়ে পড়নি? বড় ভাই সাহেব, এখনও বেরোননি বুঝি? তোমরা এগোও, আমি বড় ভাই সাহেবকে নিয়ে আসছি।’ আনাসরা হেঁটে হেঁটে বণিকপাড়ার মধ্য দিয়ে ঈদগার দিকে রওনা দিল। মাঠে গিয়েই বাড়ি থেকে মামু-চাচাদের বয়ে আনা রঙবেরঙের জায়নামাজ, সুজ্নি ও বিছানায় বসে পড়ল ও অন্যদের সাথে। একটু পরেই শুরু হলো মাওলানা সাহেবের খুত্বা। বেশি বুঝতে পারে না ও, কিন্তু কী মধু যেন বর্ষণ করে চলেছে সেই পবিত্র কণ্ঠস্বর। নামাজ শেষ হলে বিশাল মাঠব্যাপী শুরু হলো কোলাকুলি। পারস্পরিক বুক মেলানোর চেষ্টা করছে সবাই। এরপর বাড়ি ফিরে শুরু হলো ঈদের সেলামি আদায়ের পালা। অন্য ভাইবোনেরা ব্যস্ত হয়ে যায় বয়সে বড় সবাইকে কদমবুসি করার জন্য। যত বেশি লোককে কদমবুসি করা যাবে, সেলামির পরিমাণ বাড়বে। সেই সেলামির টাকা জমিয়ে কেনা হবে শখের কোনো জিনিস। ও-ও অন্যদের চাপে পড়ে কখনও কখনও কদমবুসিতে অংশ নেয়। যে টাকা হাতে আসে, তা জমিয়ে রাখে। ঈদের পর দোকানপাট খুললে কিনে ফেলে ছড়ার কোনো বই। তারপর সারা বিকেল সেটা পড়া। হ্যাঁ, আনাস নিজেও ছড়া লেখে। লেখে আর লুকিয়ে রাখে অন্য বইয়ের মাঝে। একটা খাতা আগেই শেষ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় খাতাটাও শেষের পথে। এভাবেই কেটেছে ওর আগের ঈদগুলো। কিন্তু শহরের এখনকার ঈদে ও তেমন মজা পায় না। তাই তো মনটা কেমন কেমন করতে থাকে। আনাস এই মাত্র ঈদগাহ থেকে ফিরল। ফিরেই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল, জামা-কাপড় না খুলেই। বড় আপুটা ‘হেই হেই’ করে তেড়ে এলো। আপু বলল, ‘সে কিরে, শুয়ে পড়লি যে বড্ড? আয় আয়, সেমাই খাবি।’ বড় আপু চলে যাচ্ছিল। কিন্তু আনাস উঠছে না দেখে আবারও দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘শরীর খারাপ লাগছে?’ ‘না।’ ছোট্ট করে জবাব দিল আনাস। ‘তাহলে? শুয়ে পড়লি কেন?’ আনাস এবার চুপ থাকল। বড় আপুও নাছোড়বান্দা। কাছে গিয়ে আনাসের বাহু ধরে টানল, ‘ঈদের দিনে এভাবে শুয়ে থাকতি পারবি না। সবাই কেমন আনন্দ করছে, ওই দেখ, নূরীরা সব দলবেঁধে পাড়া বেড়াতে যাচ্ছে।’ ‘তাতে আমি কী করব?’ আনাসের কণ্ঠে কেমন নিস্তেজ একটা ভাব। থমকে দাঁড়াল বড় আপু। আনাসকে ছেড়ে দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল নিষ্পলকে। ‘অমন করে তাকিয়ে আছো কেন?’ আপুর দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে বলল আনাস। ‘কী হয়েছে তোর?’ আপুর কণ্ঠটাও কেমন জানি থমথমে। ভাইয়ের মন খারাপের রেশ বুঝি ওর মনেও দাগ কেটেছে। ভাইবোন তো, এমনটাই তো হওয়া স্বাভাবিক! ‘আমাকে দশটা টাকা দেবে?’ তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করে আনাস। ‘দশ টাকা? দশ টাকা দিয়ে তুই কী করবি?’ ‘একটা বেলুন কিনব।’ হেসে দেয় বড় আপু। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে সে হাসি। আনাসের মুখটা আরও পানসে হয়ে যায়। মুখ নিচু করে ফেলে। বড় আপু ওর মুখটা নিজের দিকে টেনে নেয়। বলে, ‘এই জন্য মন খারাপ? দাঁড়া, দিচ্ছি।’ বলে পাশের ঘরে ঢোকে আপু। একটু পরেই এসে আনাসের হাতে একশ টাকার একটা নোট গুঁজে দেয়। বলে, ‘পাগল ভাইটি আমার!’ গালটা একটু টেনে আদর করে চলে যায় নিজের কাজে। আনাস ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ে। আসলে টাকাটা বড় ব্যাপার ছিল না, বড় আপু কিছুতেই শুনতে চাচ্ছিল না, তাই বলেছে। কিন্তু এখন ও বেশ বিপদেই পড়ে গেল। এই টাকা নিয়ে ও কী করবে? কী করা যায়? ভাবতে লাগল। চট করে একটা বুদ্ধিও মাথায় চলে এলো। বেরিয়ে পড়ল ও হাসিমুখে। ঈদগাহ থেকে ফেরার পথেই দেখে এসেছিল বেলুন বিক্রেতাকে। ওখানেই ছুটে গেল আনাস। কিন্তু কই, বেলুন বিক্রেতাকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না! মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেল ওর। মনমরা হয়েই বাড়ি ফিরছিল ও। ইচ্ছে করছিল মাটির সাথে মিশে যেতে। কোত্থেকে হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এলো তুহিন। আনাসের সহপাঠী। একই মহল্লায় থাকে। ‘কি রে, কোথায় ছিলি এতক্ষণ? সেই কখন থেকে তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।’ বলল তুহিন। আনাস একবার মুখ তুলে মুচকি একটা হাসি দিয়ে আবার মুখ নিচু করে ফেলল। তুহিন ওকে হাত ধরে থামিয়ে দিল। বলল, ‘এই, কথা বলছিস না কেন?’ ‘আমাকে একটা বেলুন কিনে দিবি?’ মুখটা তুলে করুণ চোখে তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল আনাস। ‘বেলুন? কী করবি বেলুন দিয়ে? কাউকে গিফট দিবি?’ আনাস মুখে কিছু না বলে উপর-নিচ মাথা নাড়ল। তুহিন বলল, ‘চল, জাফর চাচার দোকানে বেলুন আছে।’ জাফর চাচা নামাজ পড়ে এসেই দোকান খুলেছেন। ঈদের দিনে এই সময়টাতে তাকে দোকান খোলা রাখতে হয়। অনেকেই এই সময় টুকিটাকি জিনিসপত্র কেনে। গ্যাস দিয়ে ফুলিয়ে রঙবেরঙের বেলুন ঝুলিয়ে রেখেছেন জাফর চাচা। বরং ঝুলিয়ে রেখেছেন না বলে উড়িয়ে রেখেছেন বলা যায়। কারণ, ঝুলিয়ে রাখলে তার গতি থাকে নিচের দিকে, কিন্তু বেলুনগুলোর সবার গতি উপরের দিকে। বাতাসে দুলছে ওগুলো। ঈদের দিনটাতে ওরাও বুঝি আনন্দ করছে। বেশ কালারফুল দেখে দুটো বেলুন কিনল ওরা। ‘কাকে গিফট করবি বেলুন?’ জিজ্ঞেস করল তুহিন। ‘আমার সাথে গেলেই দেখতে পাবি।’ বলে রওনা দিল আনাস। তুহিন ওর পিছু নিল। আনাস সোজা ওদের বাড়িতে গেল। গিয়ে বসল নিজের ঘরে। আম্মা রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন। আব্বা বারান্দায় বসে সেমাই খাচ্ছিলেন। দু’জনকেই ডাকল আনাস। আব্বা ও আম্মা এলে আনাস নিঃশব্দে বেলুন দুটো তাদের দিকে বাড়িয়ে ধরল মুখটা নিচু করে রেখে। আব্বা-আম্মা একে অন্যের দিকে তাকালেন। তারপর একসাথে হেসে দিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। আনাসের চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। আনন্দে ওর কান্না চলে আসছে। পাশে দাঁড়িয়ে তুহিন হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছল। আনাস আব্বা-আম্মার বাহু বন্ধনে থেকেই বলল, ‘ঈদ মোবারক আব্বু-আম্মু।’ আব্বু ও আম্মু পর্যায়ক্রমে ছেলের কপালে চুমু খেতে লাগল। ইতোমধ্যে দরোজার কাছটাতে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে।
আরও পড়ুন...