বোকাইকে কেউ বুঝি ডাকলো

বোকাইকে কেউ বুঝি ডাকলো

গল্প সেপ্টেম্বর ২০০৯

ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ

খুব বকুনি খেল আজ বোকাই। [caption id="attachment_166" align="alignright" width="245" caption="বোকাইকে কেউ বুঝি ডাকলো"]বোকাইকে কেউ বুঝি ডাকলো[/caption] ও পড়াশোনায় ভালো, দু-একবার পড়ে যে কোন কবিতা দিব্যি মুখস্থ বলে দিতে পারে। ঝটপট অঙ্ক কষতে পারে ও বকুনি খাবে কেন? তাও কিনা রিনি ম্যাডামের কাছে? যার মুখে সারাক্ষণ মিষ্টি হাসি মাখামাখি হয়ে থাকে। ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে খুব হাসে ও। চোখ একটুও ভিজে ওঠে না ওর। তিতির, অন্তু, দীপু অবাক হয়ে যায়। বোকা বলেই তো বোকাই কাঁদে না। তা কিন্তু নয়। ওরই দোষ। শর্টস-শার্ট-টাই স্কুল ড্রেসের সব কিছু ঠিকঠাক আছে, পায়ের সাদা কেডস মলিন হয়ে আছে সে খেয়াল একটুও করেনি। সত্যিই তো ওর দোষ। শুধু শুধু ও কাঁদবে কেন? সহজে কাঁদে না ও। খুব শক্ত ধাঁচের বোকাই। দাদুই ওকে অমন করে তৈরি করেছেন। উনি বলেন, ছেলেদের খুব কষ্ট সহ্য করতে হয়। কখনো কাঁদবে না। কাঁদবে বুলি, ও মেয়ে তো কান্না ছাড়া ঝুলিতে ওর আছেই বা কি! বুলি নাকি সুরে বলে, ও মা দেখে যাও দাদু কী বলে। হাসতে থাকেন দাদু। এই তো তুমি সানাইবাঁশি বাজানো শুরু করেছ, বুলি কুলি রেগে বলে, আমার কি সানাইবাঁশি আছে যে বাজাব? দাদু বলেন, তোমার কান্নার নামই তো সানাইবাঁশি দাদু। সেদিন দাদু-নাতিতে খুব হেসেছে বুলিকে নিয়ে। দাদু শিখিয়েছেন বুলি কাঁদবে কাঁদুক, তুমি কখনো কাঁদবে না। তাইতো ম্যাডামের বকুনি খেয়েও বোকাই কাঁদেনি। জুতোর দিকে খেয়াল রাখা নিশ্চয়ই ওর উচিত ছিল। তবে ওর কি মন খারাপ হয় না? খু-উ-ব হয়। দাদুর ওপর ভীষণ রাগ হয় এক একদিন। এই তো গেল বছরের কথা। শীত পড়লেই দাদু শাল-সোয়েটার-জাম্পার-মাফলার গায়ে জড়িয়ে জবুথবু হয়ে বসে থাকেন। বোকাইকেও তা করতে হবে। আরে বাবা- তোমার যা ভালো লাগে- আমার তা নাও লাগতে পারে, এ কথাটা কিছুতেই বোঝানো যায় না দাদুকে। শীত হোক, গরম হোক, বৃষ্টি হোক, ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর হোক সকাল-বিকেল হাঁটাহাঁটি করতেই হবে দাদুকে। ছুটির দিনে সঙ্গী করে নেন বোকাইকে। না দাদু, আমি আর একটু ঘুমোই। এতো সকালে কেউ কি বাইরে বেরোয়? বেরোয় না আবার। তোর মতো ঘুমকাতুরে ক’টা আছে রে  এ্যাঁ! বোকাইর মাথায় মাংকি ক্যাপ, গায়ে ইয়া মোটা উলের জাম্পার, পরনে উলের প্যান্ট, গলায় মাফলার, পায়ে জুতো মোজা তো আছেই। পাশের বাড়ি থেকে ডু¹ু বলে, কিরে বোকাই, ইয়া বড় ফুটবল সেজে যাচ্ছিস কোথায়? সমবয়সী বন্ধুর কাছে লজ্জার আর সীমা নেই। দাদু কি আর ওসব বোঝে? ডু¹ু তো এ নিয়ে বেশ মজার এক ছড়া বানিয়ে ফেলে ‘ভোরের হাওয়ায় নড়ছে দ্যাখো উলের পুঁটুলি/ অবাক হয়ে ডু¹ু দ্যাখে এ যে বোকাইর ঝুলি’। গোটা শীতকালটা বোকাইকে শুনিয়ে গানটি গেয়েই কাটাল ডু¹ু। চুপচাপ তা শুনতে হলো ওকে। ওর কি খারাপ লাগে না? লাগেত, খুব খারাপ লাগে। ডু¹ু তো দিব্যি সকস আর টাইট ব্লেজার পরে হাঁটে। দারুণ স্মার্ট লাগে ওকে। আর আমাকে? কী জবুথবু লাগে নিজেই বুঝতে পারে বোকাই। জামাকাপড়ের বোঝা নিয়ে ও আর চলতেই পারে না। তবু শীত এলেই গায়ে ওসব চাপাতেই হবে। সর্দিকাশির জীবাণু নাকি এখানে-ওখানে ওঁৎ পেতে বসে থাকে। একটু সুযোগ পেলেই হালুম-হুলুম করে জাপটে ধরবে বোকাইকে। ভাগ্যিস এখন গরমকাল, তাই শুধু চকরা বকরা গেঞ্জি পরেই কাটিয়ে দিচ্ছে। দুই. স্কুল থেকে ফিরে সেদিন কী আনন্দ! রিনি ম্যাডাম যে জুতোর জন্য সবার সামনে বকুনি দিয়েছেন তাও বেমালুম ভুলে যায়। বাড়িতে খুব রাঁধাবাড়া হচ্ছে। বিছানায় গ্যাঁট হয়ে বসে আছে নীলাপিসি। তার মানে কুমিল্লা থেকে পিসি এসেছে, দু’চারদিন থাকবে। পিসির পেটে যেন গল্পের ঝুলি সাঁটা রয়েছে, গল্পো শুরু হয় তো চলতেই থাকে এর আর শেষ নেই। বুলি, পিসির মেয়ে অথৈ-এর সাথে লুকোচুরি খেলে দিনভর কাটিয়ে দেয়। সন্ধ্যে হলেই দু’ভাই-বোন জাপটে ধরে পিসিকে। পিসি, গল্প বলো, গল্প বলো। গল্পের ঝুড়ি উজাড় করে দেয় পিসি। বলে, কিরে- ক’টা বাজে? ওমা এগারোটা? চল চল শুতে যাই। বোকাই বলে, কোথায় এগারোটা পিসি? ঘড়ির কাঁটা যে এক ঘণ্টা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে । আসলে এখন দশটা বাজে। ওহ, তাই বল। নতুন করে ছোট পিসির আবার গপ্পো শুরু হয়। মামদো ভূতের ছানাপোনাগুলো মিয়াবাড়ির রাঙাবউয়ের ইলিশ মাছ ভাজির গন্ধ পেয়ে কেমন পাগল হয়ে উঠল। ছুটে গিয়ে ওরা হাজির হয় মিয়াবাড়িতে। রাঙাবউ মাছ ভেজে আর কূল পায় না। গরম ভাজি হাতে নিয়ে ভূতের ছানাপোনাগুলো টপাটপ গিলে ফেলে, ফের হাত বাড়ায়। বুলি বলে, ভূতের গপ্পো তো অনেক শুনলাম, এবার নিজের গপ্পো বলো না। নিজের গপ্পো? গালে হাত দিয়ে একটু ভেবে পিসি বলে, তাহলে শোন আমাদের গাঁয়ের পূর্বদিকে একটা বাঁশের সাঁকো আছে, বুঝলি? বাঁশের সাঁকো, বাঁশের সাঁকো সে আবার কী! বোকাইয়ের মগজের ভেতর মৌমাছির মতো গুণগুণ করতে থাকে শব্দ দু’টি বাঁশের সাঁকো, বাঁশের সাঁকো। জানিস বাঁশের সাঁকোর একটা দিক বেশ খানিকটে ভাঙা ছিল। সেটা তো আর দেখতে পাইনি। প্রথমে আমি ওপর থেকে ঝুপ করে নিচে পড়লাম, আমার ওপরে পড়ল ময়না, তার ওপরে পড়ল টুটু। হাসতে হাসতে মা গড়িয়ে পড়ে পিসির ওপর। বাবাও গল্প শুনে হাসতে থাকেন। মুখে বলেন, কী কাণ্ড কী কাণ্ড বলো ত। বাঁশের সাঁকোটা ঠিকঠাক করা হলোই না। চার পাঁচ দিন পর পিসি আর অথৈ চলে গেলে পর বাসা আবার আগের মতো নিঝুম হয়ে যায়। বুলির বারবি ডল আর ওর টেডি বিয়ার আগের মতো সাজানোই রয়েছে। সব ঠিক আগের মতো, কিন্তু পিসি এসে বোকাইয়ের মনটাকে একেবারে উতলা করে দিয়ে গেছে। বাঁশের সাঁকো, মামদো ভূতের ছানাপোনা, শ্যাওড়া গাছের পেতনি কিছুই তো দেখা হলো না বোকাইয়ের। এ জন্য আজকাল খুব মন খারাপ থাকে ওর। ঢাকায় থাকে ও, নামি স্কুলে পড়ে কিন্তু এখানে তো বাঁশের সাঁকো নেই, মামদো ভূত, জোনাকি, শ্যাওড়া গাছের পেতনি কিছুই নেই। এগুলো কি কখনোই দেখবে না বোকাই? এ ভাবনাটিই সারা দিন-রাত মন জুড়ে বসে থাকে। গাঁয়ে একবার যেতে পারলে বেশ হতো! এর মাঝেই সুযোগ এসে গেল। দিন পনেরোর জন্য দেশের বাইরে যাবেন বাবা, অফিসের কাজে। জায়গার নাম বার্লিন। বোকাই ওরা এ ক’দিন দেশের বাড়িতে থাকবে। গাঁয়ের নাম বোয়ালজুর। কী অদ্ভুত নাম! তবে নিশ্চয়ই না-দেখা জিনিসগুলো সেখানে দেখতে পাবে। বাবা খুব ব্যস্ত। নানা কাজের ফাঁকে সুবিধা অসুবিধের কথা বলছেন। আমেরিকা-ইংল্যান্ডে গেলে তো কোন অসুবিধে নেই। ইংরেজিতে সব চালিয়ে নিই। জার্মান দেশে কিন্তু তা হওয়ার জো নেই। সব জার্মান ভাষায় বলতে হবে। ভাষা না জানলে খুব মুশকিল। ইঙ্গিতে-ইশারায় চালিয়ে নিতে হবে। বাবা চলে গেলেন বার্লিনে, মা-বুলি আর বোকাই বোয়ালজুরে রইল। তবে ওরা তো একা নয়, বাড়িভর্তি লোকজন, বিশাল বাড়ি অগণিত গাছপালা, শান বাঁধানো ঘাট, পুকুর, মেঠোপথ-কত কিছু রয়েছে। বোকাই বুলি সমবয়সীদের সাথে ঘুরে বেড়ায়। বোকাই শুধু মাকে বলে,  মা, ওমা বুলি আমার সাথে আসে কেন বলো ত! নাকি সুরে সানাইবাঁশি বাজিয়ে বুলি বলে, তুমি সব দেখবে, আমি দেখব না! ছোট বোনের কথার রেশ বোকাইর মনে থেকেই যায়। গাঁয়ের সব দেখলাম, কোথায় সব দেখা হলো! কিছুই তো হয়নি। পিসির বলা- মামদো ভূতের ছানাপোনা, শ্যাওড়া গাছের পেতনি, কেঁদো ভূত, গেছো ভূত ওরা সব কোথায় লুকিয়ে গেল? ওদের তো দেখতে পায়নি সে, কোনদিন কি দেখতে পাবে কে জানে! তবে হ্যাঁ অনেক কিছু শিখেছে সে। পুকুরের কাদাপানিতে যেখানে অল্প পানি থাকে সেখানে সমবয়সীদের সাথে দাপাদাপি করে বোকাই। শাপলা তুলে আনে। গাঁয়ের ছেলে আনু একদিন বলে, চলো চলো বোকাই, আজকে গামছা দিয়ে মাছ ধরি। গামছা দিয়ে আবার মাছ ধরা যায় নাকি! বলে কী আনু! আনু বলে কেন, গামছা দিয়ে অনেক কিছু করা যায় তো বোকাই। কবিতায় আছে না ‘গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে’ এই দ্যাখো গামছাটা চওড়া করে পানি তোলে এই দ্যাখো গায়ে ঢেলে দিলাম। সত্যি তো গামছা দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। বেশ মজা তো! ঢাকার বাথরুমে বোকাই ভেজা শরীর নকশা করা টাওয়েল দিয়ে মোছে। ওসব সে জানবে কী করে? অনেকক্ষণ ওরা গামছা দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরে আবার ছেড়েও দেয়। বেশ মজার খেলা, টলটলে পুকুরের পানি খেলা করতেই ওদের ভালো লাগে। আনু যে কবিতাটি বলল তা কি বোকাই জানে? সে পড়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। ও জানে ‘বা বা ব্ল্যাকশিপ হ্যাভ ইয়ু এনি উল’ তোমার কি উল আছে! কিংবা ‘রেইন রেইন গো অ্যাওয়ে লিটল জনি ওয়ান্টস টু প্লে’ মেঘ তুমি দূরে চলে যাও, লিটল জনি খেলতে চায়। কিন্তু এমন মিষ্টি কবিতা তো সে পড়েনি, ‘গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।’ ভাবতে গিয়ে ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায় বোকাইয়ের। তিন. হঠাৎ করে শোরগোল শোনা যায়। কারা যেন ছুটে এদিকেই আসছে। হইহই রইরই ছুটে আসছে সব চেনা মানুষ, শাড়ির আঁচল লুটিয়ে মা কাঁদছে। বুলিকে পাওয়া যাচ্ছে না রে বোকাই। বাহ। বুলি এখানে আসবে কেন? এখানে তো সব ছেলে। আনু, তিনু, হিমু ওরা। হঠাৎ একটু দূরে নজরে পড়ে বুলি জামার এক কোণ পুকুরে ভাসছে। খাবি খাচ্ছে বুলি। পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ক’জন। বুলিকে পুকুর থেকে তুলে আনে ছোটকা। বড়কাকু চ্যাঁচাতে থাকে,  সাঁতার জানে না, পুকুরে কোনদিন গোসল করে না তুই একা একা কেন এলি বুলি? মায়ের কোলে চড়ে আদর খেয়ে যেতে যেতে বুলি বলে, বোকাইদাদা রোজ পুকুরে গোসল করে, আমি করব না? বড় কাকু বোকাইর কান ধরে বাড়িতে হিড়হিড় করে নিয়ে যায়। দ্যাখো, দ্যাখো দেখলে কি মনে হয় ও শহরের ছেলে! মনে হয় ও ঢাকায় থাকে? ছি: ছি:, সকালে উঠে পড়াশোনা করবে, মাথা আঁচড়ে জুতো পরে ভালো জামা গায়ে দিয়ে ফিটফাট থাকবে তা নয়। মনে হয় যেন গরু চরাচ্ছে। হাতে একরাশ শাপলা ফুল, ভিজে প্যান্ট, কাদামাখা শরীর নিয়ে ও ভাবতে থাকে যদি শহরের মতোই থাকি তো গাঁয়ে এলাম কেন? এই বুলিটাই যতো নষ্টের গোড়া। আরে বাবা, পারিস না তো কিছুই তো আমাদের পিছু পিছু এসে চুপ করে পুকুরে নামতে গেলি কেন। শুরু হয় বোকাইর বন্দিজীবন। ধুলোয় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে গড়াগড়ি খেলা, পুকুরে ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঝাঁপাঝাঁপি করা কিছুই আর করা হয় না। মা, ওমা ঘরে বসে থাকলে কি ভালো লাগে? একেবারে ঢাকার বাসার মতো লাগছে আমার, তুমিই বলো ঘরে বসে থাকলে কি আউট নলেজ বাড়ে? মা রুখুসুখু গলায় বলে, বাঁদরামি ছাড়ো বোকাই। আর ক’দিন শান্ত হয়ে থাকো। তারপর আমরা ফিরে যাব। এখানে তুমি জ্বালিয়ে খেলে- ছোটকা বলে, ঢাকা গিয়ে তো শান্ত হয়ে বসে থাকবে, গাঁয়ে এসেছে একটু ঘুরে দেখবে না এও কি হয়? বাঁশের সাঁকোটা দেখবি না যেটা থেকে তোর ছোট পিসি নিচে পড়ে গেছিল। আবার সেই বাঁশের সাঁকো। সত্যিই তো এটা না দেখলে কি চলে? বাড়িতে ছোটভাই শুধু অন্যরকম বোকাইকে খুব বোঝে। এতদিন বোকাই জেনে এসেছে, মাছ থাকে অ্যাকুরিয়ামে। কুটে রাখার পর থাকে ফ্রিজে। বোয়ালজুর আসার পর জেনেছে, মাছ থাকে পুকুরে। ওরা ডুবসাঁতার দিয়ে খেলা করে। ছোটকাকুর হাত ধরে হাঁটতে কী মজা! দারুণ লাগে। গাড়ি-বাস-রিকশার জ্যাম নেই, ফাঁকা পথ, মানুষের ভিড়ভাট্টা নেই। শান্ত-নিঝুম এই গাঁয়ের পথ। আজ বুলিও এসেছে। ও খুশিতে মাতোয়ারা। বাঁশের সাঁকোর সামনে দাঁড় করিয়ে ছোটকা বলে খালি বাউন্ডুলের মতো ঘুরাঘুরি করলে হবে? খালি জিজ্ঞেস করিস সাঁকো কি, সাঁকো দেখতে কেমন। এসব কি বলে বোঝানো যায় রে? চোখ দিয়ে দেখতে হয়। সাঁকোর ওপর দিয়ে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যায় দু’ভাই-বোন। ইসস্ কী থ্রিলিং ব্যাপার! গাঁয়ে এসে কত কী দেখে গেল বোকাই। মাঠ-ভর্তি ফসল, তার পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে বড় নদী। কত যে খাল-বিল এখানে। পুকুর তো আছেই যেখানে সে আনু-হিমুর সঙ্গে মনের সুখে ঝাপুর-ঝুপুর করেছে। এখানে পিচঢালা পথ নেই, রোদ উঠলে তেতে গরমে হয়ে ওঠে না। এখানে-ওখানে দুর্বাঘাস, বোকাইর পা রাখলে ওর ছোট্ট শরীরটা শীতল হয়ে যায়। আহা হা কী আরাম! ছোটকা বলে, পায়ের জুতা খুলে হাতে নিয়েছিস কেন? কাঁটা ফুটবে তো! না না ছোটকা, তুমি কিচ্ছু বলবে না, আমি খালি পায়ে হাঁটব। দারুণ লাগে। এখানে এই পনেরো দিনে কত কিছু নতুন নতুন দেখল বোকাই। বড়কাকী কাঁসার বিশাল থালায় গরম ভাতে পাতলা মসুর ডাল, কুচানো আলুভাজি আর দু’চামচ ঘি মেখে কতো আদর করে তিন-চার জনকে এক সাথে খাইয়ে দিয়েছেন। এই ধরো ধরো, হাঁ করো বোকাই। বড় হাঁ করো, আর একটু বড়ো। এই তো বুলি, তুমি এখন কী খাবে? হাঁসের ডিম না মুরগির ডিম। কী বললে? মুরগির ডিম খাবে না? ঠিক আছে, তুমিও বড় হাঁসের ডিম খাও। রন্তু  কী বলছো? তুমি খাবে না? না না খেতে হবে তো, কী খাবে তুমি? ঠিক আছে কবুতরের ডিম খাও নাও নাও কী চমৎকার কাটে খাওয়ার সময়। ঠিক যেন গল্প মায়ের আসর। বুকের ভেতর থেকে করুণ নিঃশ্বাস ভেসে আসে বাড়ির পেছনের এক রাশ কলাগাছ ও বুনো ঝোপের ভেতরে জ্বলছে টিপ টিপ জোনাকি পোকা। সেদিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে বোকাইর। আর কখনো এমন দেখতে পাবে না। কাল সকালের বাসে চড়ে ওরা ঢাকায় ফিরবে। বাবা দু’দিন পর ফিরে আসছেন বার্লিন থেকে। বোকাইর তো আনন্দে হেসে ওঠার কথা। কিন্তু একটুও আনন্দ নেই ওর। বোয়ালজুর গাঁয়ে সব হাসি-খুশি যে ও ফেলে যাচ্ছে। চার. কত কিছু বাবা বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছেন। কতো ধরনের চকলেট, জামা-কাপড় গুনে গুনে শেষ করতে পারছে না বোকাই আর বুলি। শুক্রবার বিকেলে বেড়াতে বের হলো ওরা। অনেক ঘুরল, আইসক্রিম খেল। খেলনা আর আজ কেনে না, বাবা বার্লিন থেকে চমৎকার সব টেডি বিয়ার নিয়ে এসেছেন। যমুনা সেতুর ওপরে সন্ধ্যা রাতে দাঁড়িয়ে বোকাই দেখে চমৎকার এক পৃথিবী। হু হু করে বইছে পাগলা হাওয়া। চারপাশ থেকে ঠিকরে পড়ছে ঝকঝকে আলো। কত সেতুই তো রয়েছে। বুড়িগঙ্গা সেতু, কাঁচপুর ব্রিজ, মেঘনা সেতু, ভৈরব সেতু কিন্তু বাঁশ দিয়ে বোনা, মচমচ আওয়াজ করা অন্যরকম সাঁকোটির কথা শুধু মনে পড়তে থাকে ওর ইস্স কী চমৎকার! মজাপুকুরের ছোট্ট মাছগুলো, পাপড়ি ছড়ানো শাপলা ফুল, বাঁশের সাঁকো যেন বলছে খুব তো ঢাকায় ঘুরছ-ফিরছ, আমাদের কথা কি ভুলে গেছ? গাঁয়ের কথা মনে নেই? টিপটিপ করে জ্বলা জোনাকি পোকার কথা মনে আছে তো! হ্যাল্লো বোকাই, কি বললে মনে আছে আমাদের? বাঁশের সাঁকো যেন ডেকে উঠল। বোকাই তুমি আবার গাঁয়ে আসবে না? ছোট্ট ছোট্ট দু’পা ফেলে লাফিয়ে লাফিয়ে আমাকে জাগিয়ে দেবে না? আবার এসো  কেমন? গলার কাছে কান্নার ভেলা যেন আটকে থাকে। মা বলেন, এবার চলো রাত হয়েছে। আবার কোন ছুটির দিনে আসব। মায়ের হাত ধরে যেন ঘোরের মাঝে গাড়িতে গিয়ে ওঠে বোকাই। শোঁ শোঁ করে রাতের আলো-ছায়া চিরে গাড়ি এগিয়ে যায়। বোকাই কখনোও কাঁদে না। ময়লা জুতার জন্য রিনি ম্যাডামের বকুনি খেয়েও সে একটু কাঁদেনি, আজ এই রাতে বহু দূর থেকে পুকুরের ফোটা শাপলা ফুল, মেঠোপথ, হাজারো জোনাকি, বাঁশের সাঁকোটি ওকে ডাকতেই থাকে। কান্না পেতে থাকে ওর। হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে বোকাই।
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ