বোনাস

বোনাস

তোমাদের গল্প অক্টোবর ২০১৪

 নূর নবী জনী

[dropcaps round="no"]লোকটা ধনুকের মত কুজো হয়ে গেছে। সিজদা থেকে উঠে শীর্ণকায় লোকটা ঘুরে আমার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার নামাজে দাঁড়াল। ইনি ফোরকানের বাবা। চেহারাটা দেখলেই মনের মধ্যে কয়েকটা ছবি ভেসে ওঠে। অজান্তেই দৃষ্টি ঘৃণায় ভরে ওঠে। পাঠকাঠির মত কুজো এই লোকটির এক সময় অসম্ভব দাপট ছিল। নিজের জমিতে অন্যের গরু ঢুকলে, বর্ষার দিনে কারো পুইট্টা জাল বা লেইতা বড়শি পাওয়া গেলে অথবা অন্য কারো জমির কচুরিপানা জোয়ারের পানিতে তার জমিতে এলেও গোটা তল্লাট মাথায় তুলতো। আর তার ছেলে? ছেলে নয় যেন রাজপুত্র! তেনার নাম ফোরকান। খামখেয়ালিপনা যেন তার শাহি অভ্যাস। তো রাজপুত্র তার শাহি বাহনটা (ট্রাক্টর) নিয়ে যখন জমি চষতেন, তখন এলাকার ছোট ছোট বালক-বালিকারা ঠোঙা নিয়ে আসত মেশিনের ঘায়ে মরে ভেসে ওঠা মাছ কুড়াতে। আর ঠিক তখনই শাহজাদা ফোরকান তার তরবারিটা (বাঁশের টুনি) উঁচিয়ে হুঙ্কার ছাড়ত। আর রাজা সাহেব (ফোরকানের বাপ) জমির পাশে বসে বালক-বালিকাদের চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করতেন। ছোটবেলায় আমারও মাঝে মধ্যে ঐ বালকদের সাথে তার উচ্চবাচ্য শোনার সৌভাগ্য (!) হয়েছে। সে যাই হোক অনেক দিন পর দেখা। এখন সে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এটা বলা যাবে না যে, এখন সে অনেক সচ্ছল। বরং তার উল্টো। তার সেই (রাজপুত্র) ছেলে ফোরকান বাবার জমাজমি বিক্রি করে বেশ কয়েকটা ব্যবসায় হাত দিয়েছিল। অলসতা আর উদাসীনতা তাকে কোনখানেই টিকে থাকতে দেয়নি। এখন একটা কারখানায় কাজ করে সে। কিন্তু সংসারের খরচে তার সামান্য কিছু যোগ হয়। বেতনের সবই জুয়ার পেছনে খতম। ফোরকানের বউ দুই সন্তানের আহার জোগাতে এর ওর বাসায় কাজ করে। বউয়ের বুদ্ধিমত্তায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেতন থেকে কিছু সংসারের কাজে খরচ করতে বাধ্য হয় ফোরকান। তাও এই হলুদের গুঁড়া, মসল্লা, শাক-পাতা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। ফলে পরিধানের বস্তুতো দূরে থাক, অন্নের জোগারই ঠিকমত হয় না সংসারে। আবার রুকুতে গেল ফোরকানের বাপ। ধনুক কিছুটা সোজা হলো মনে হয়। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। একবার আমার ছোটভাইকে লাঠি নিয়ে তাড়িয়ে এসেছিলেন। মনে হয় চিৎকার করে কুজোটাকে কয়েক ঘা শুনিয়ে দেই। কিন্তু লাভ কী? অতীতকে টেনে তুললে কষ্টই পেতে হয়। মসজিদ থেকে বের হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। কাল ঈদ। সবার মত ফোরকানের ছেলেমেয়ে দুটোও বাবার পথের দিকে তাকিয়ে আছে। লাল-নীল জামা হাতে বাবা কখন ফিরবে। আজ ফোরকানের বউ বেশি খাটুনির কাজ পেয়েছে। পারিশ্রমিকও একটু বেশি। ঈদের দিন ছেলেমেয়েদের নিয়ে একটু ভালো-মন্দ খাওয়া যাবে এই আশায়। ফোরকানের কারখানায় আজ বোনাস দেবে। দুই সন্তান অলি আর কলির জন্য দুটো জামা কিনবে বলে ঠিক করেছে সে। এবারের টাকাটা জুয়োর টেবিল ছোঁবে না। এই সিদ্ধান্ত তাও ঐ বউয়ের জন্য। এই মহিলার বুদ্ধির সাথে ফোরকান কখনোই পেরে ওঠেনি। কারখানার প্রায় সকল শ্রমিকেরই ফোরকানের মতো দিনাতিপাত হয়। বেলা ২টা থেকে রাত দশটা অব্দি ডিউটি। তারপর ঈদের বাজার নিয়ে ঘরে ফেরা। কারখানায় মালিক আসবেন রাত ৮টায়। এমনই খবর ছিল শ্রমিকদের কাছে। কিন্তু হঠাৎ সন্ধ্যার পর জানা গেল মালিক নাকি গতকাল রাতে সপরিবারে সিঙ্গাপুরে চলে গেছেন। ঈদ নাকি সেখানেই কাটাবেন তিনি। সুতরাং আজ বেতন-বোনাস কিছ্ইু দেয়া হবে না। খবরটা শুনে সহ¯্রাধিক শ্রমিকের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তাদের কারো ছেলেমেয়ের পরনে ঈদে আর নতুন জামা জুটবে না। অঝোরে অশ্রু নেমে এলো সবার মতো ফোরকানেরও চোখ বেয়ে। আজ কেমন যেন অলি-কলিদের জন্য মনটা হু হু করে উঠলো। সন্তানদের একটা জামা কিনে দেবারও তার সামর্থ্য নেই। চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল বুকের ওপর। এ অশ্রু জুয়োর টাকার জন্য নয়। অলি-কলিদের প্রশ্ন, ‘বাবা, আমাগো লাইগ্যা কইলাম লাল জামা আনবা।’ এর উত্তর কী দেবে সে? এমন সময় ক্ষুব্ধ কিছু শ্রমিক চিৎকার করে গালাগাল দিতে লাগলো মালিককে। ঠিক তখনই প্রচণ্ড শব্দে কয়েক স্থানে ভাঙচুরের শব্দ হলো। ফোরকানসহ বেশ কজন দ্রুত মিল ছেড়ে গেটের বাইরে বেরিয়ে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যে কারখানার ভেতরে আগুন জ্বলে উঠলো। ছুটে এলো দমকল কর্মীরা। কয়েক মুহূর্ত পর এলো পুলিশের একটি ভ্যান। জোর করে ফোরকানসহ বাইরে দাঁড়ানো কয়েক ডজন লোককে ভ্যানে উঠালো। ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগের দায়ে মামলা করা হলো তাদের বিরুদ্ধে। টানাপড়েনের সংসারের এসব কর্তা, অর্থাভাবে যারা সংসার চালাতে পারে না। বিনা উকিলে কাঠগড়ায় দাঁড়ালে তাদেরকে বিচারক কী বিচার করবেন? সেটা এখন কারো চোখে নেই। কাল ঈদ। প্রিজন ভ্যানের চাকাগুলো ঘুরছে। ফোরকানের কানে বাতাসে ভেসে আসছে অলি-কলিদের উৎ[/dropcaps]সাহী কণ্ঠস্বর, ‘বাবা, আমার লাল জামা।’

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ