বোবা কান্না

বোবা কান্না

গল্প আগস্ট ২০১১

প্রফেসর চেমন আরা....
আরব ভাই এইমাত্র শামিলকে সঙ্গে নিয়ে সুদূর লন্ডনের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন। সারা ঘরজুড়ে শূন্যতা অনুভব করছি আমি। বিছানার ওপর তার পাল্টে যাওয়া লুঙ্গিটা এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। বিছানার চাদর ও বালিশের ওয়ার সবকিছুর মধ্যে তার মনের অস্থিরতার আবছা ছায়া দেখতে পাচ্ছি। খাটের নিচে স্যান্ডেল জোড়াটা তেড়া-বে্যঁকা হয়ে পড়ে আছে। পড়ার টেবিলের ওপর দামি বই পত্তর অনেক। কিন্তু বড্ড অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে। টেবিলের ওপর পাতানো চাদরটা ঝুলে আছে মাটি পর্যন্ত। তার ফেলে যাওয়া অগোছালো এলোমেলো লুঙ্গি-গেঞ্জির মধ্যে তার গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়। সব কিছুর মধ্যে শামিলের চেহারাটা বারবার আমার চোখের আয়নায় ভেসে উঠছে। এই মুহূর্তে ঘরের কোনো জিনিসের মধ্যে আমার হাত দিতে ইচ্ছে করছে না। এই অগোছালো এলোমেলো বিছানা বালিশের ওয়ার, পড়ার টেবিল বড় পরিচিত মনে হচ্ছে আমার। মন বলছে এগুলো এমনি থাকুক। এগুলোর মধ্যেই শামিলের কথা মনে পড়বে। তার অগোছানো স্বভাবের জন্য সে কত বারই না আব্বা-আম্মার বকা খেয়েছে। এই অগোছালো স্বভাবের জন্য বাড়ির সবারই নালিশ ছিল তার বিরুদ্ধে।
অথচ এই মুহূর্তে এসবের মধ্যে আমি যেন শৈশবের বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা শামিলকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। বুকের মধ্যে একটা রিনরিনে ব্যথা অনুভব করছি।
আব্বা-আম্মা সবাই চলে গেছেন এয়ারপোর্টে শামিলকে বিদায় জানাতে। বাড়িতে বিষণ তার হাহাকার। চোখ আমার অশ্রুসিক্ত হয়ে আসছে। আব্বা-আম্মা আমাকে এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য বলেছেন কিন্তু আমি যাইনি, শামিলের বিদায়দৃশ্য সহ্য করতে পারবো না বলে।
শামিল আমার ছোট ভাই। বয়সে সে আমার অনেক ছোট। বাবা সরকারি চাকরি করেন। আমি আর শামিল পিঠাপিঠি না হলেও এক সঙ্গে বড় হয়েছি সরকারি আজিমপুর কলোনির বাড়িতে। বিকেল বেলা কলোনির মধ্যে যখন ছায়া নামে তখন শামিল গিয়ে সমবয়সী ছেলেদের সাথে খেলতো। আমি আমাদের সামনের সিঁড়িতে বসে ওর খেলা দেখতাম। এই সময় আমার সমবয়সী কলোনির বান্ধবীরাও এসে আমার পাশে বসতো। আমরা মাঠে নামতাম না বটে তবে ওখানে বসে গল্প গুজবে বিকেলটা কাটাতাম আনন্দে।
সেই হারানো দিনগুলো যেন হঠাৎ এক ঝলক বিদ্যুতের মতো মনের মধ্যে ভেসে উঠলো এই মুহূর্তে। আমাদের বাসার কাছেই কলোনির মধ্যে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছিল। স্কুলের নাম ‘লিটল এঞ্জেলস কিন্ডারগার্টেন’। স্কুলটি ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য হলেও শিক্ষিকারা ছিলেন সব অভিজ্ঞ ও মানসম্পন্ন, শিক্ষণে পারদর্শী, মায়ের মতো মমতাময়ী এবং পেশার প্রতি আন্তরিক। শামিলের মানস গঠন ও লেখাপড়ার ভিত রচনায় এই স্কুলের শিক্ষিকাদের ভূমিকা প্রচুর। এই স্কুলেই শামিলের বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। শামিল যেদিন প্রথম স্কুলে যাবে সেদিন যেন আমাদের সবার মনে সাজ সাজ একটা রব পড়ে গিয়েছিল। শামিলের সেকি উৎসাহ। আব্বা ওর জন্য নতুন ব্যাগ কিনে এনেছেন। নতুন বই-খাতা, রাবার, পেন্সিল তার ব্যাগে ভরে দেয়া হয়েছে। স্কুলের পোশাক, সাদা হাফ প্যান্ট, হাফ শার্ট, আর সাদা ক্যাডস জুতোয় দারুণ স্মার্ট লাগছিল শামিলকে। আমি তাকে তৈরি করে দিয়েছিলাম। আম্মা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন স্কুলে। লেখাপড়া খেলাধুলায় অসাধারণ মেধার অধিকারী শামিল সহজেই স্কুলের সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল। কাসে প্রথম হওয়া ছাড়াও যে কোনো কাজে শ্রেণিশিক্ষিকা তাকে ডাকতেন। তার ওপর থাকতো নেতৃত্বের ভার। অল্প বয়সে তার প্রতিটি কাজ কর্মে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যেতো। সে যখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে তার শ্রেণিশিক্ষিকা তাকে বাংলায় বর্ষা ঋতুর ওপর একটি রচনা দিয়েছিলেন, বাড়ি থেকে লিখে আনার জন্য। রচনাটি লেখার সময় আমি তাকে একটু আধটু সাহায্য করেছিলাম। রচনাটি খুব ভালো হয়েছিল। যেদিন রচনাটি ফেরত পেল সেদিন কী খুশি তার! স্কুল থেকে ফিরেই ব্যাগটা বিছানার ওপর রেখে আমার কাছে ছুটে এসে বলেছিল, জান বড় আপু, নুরজাহান আপা কাসের সবাইকে আমার রচনাটি পড়িয়ে শুনিয়েছেন, আমি নাকি খুব ভাল লিখেছি।
আমাদের দুই ভাই-বোনের মধ্যে হঠাৎ আম্মা এসে উপস্থিত হলেন, হাতে রান্না করার খুন্তি। তৈরি রান্না বা অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের সবকিছুর তদারকি করতেন। শামিলের রচনা পড়ে আম্মাও খুব খুশি।
লিটল এঞ্জেলস স্কুল থেকে শামিল পঞ্চম শ্রেণী পাস করেছে প্রথম স্থান অধিকার করে। এই স্কুল থেকে তার বিদায় নেবার পালা। বাবা-মার ভীষণ চিন্তা এখন কোথায় তাকে ভর্তি করানো যায়। সন্ধানও পাওয়া গেল তখনকার সময়ের একটা ভাল স্কুলের। নাম গভ. ল্যাবরেটরি স্কুল। প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ, নীতিনিষ্ঠ প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকমণ্ডলীর যৌথ উদ্যোগে ও আন্তরিকতায় ছেলেদের মেধা ও মনন বিকাশের সহায়ক ভূমিকা রেখে সমগ্র ঢাকা শহরে স্কুলটি তখন সুনাম অর্জন করেছিল। শামিল প্রবল প্রতিযোগিতা ডিঙিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হল। তখন আমি মাধ্যমিকের বেড়া ডিঙিয়ে ইডেন কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের মানবিক শাখার ছাত্রী। চারদিকে অশান্ত পরিবেশ। মিছিল, হরতাল,  স্লোগানে মুখরিত ঢাকা নগরী। স্কুল, কলেজ এবং স্বাভাবিক জীবনের বিপন্ন চেহারা। আব্বা অফিসে যান এবং গম্ভীর মুখে বাসায় ফিরেন। আব্বা-আম্মা এবং কলোনির কারো মুখে কোনো হাসি নেই, প্রশান্তি নেই। সন্ধ্যা হলে কলোনির মাঠে আগের মতো ছেলেপেলেরা হৈ-হুল্লা করে না। অফিস ফেরত কর্মচারীদেরও গল্পের বৈঠক বসে না। কী এক অশুভ আলামত যেন সারা কলোনি পাড়াকে রাহুগ্রস্ত করে রেখেছে। যেসব প্রবীণ ও বৃদ্ধরা ভারত স্বাধীন হবার পর পূর্ব পাকিস্তানে এসে নতুন করে স্বাধীন দেশে বসবাস করবেন বলে আশার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের মনে ও মুখে অমানিশার আঁধার। এরই মধ্যে শামিলের পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। প্রথম গ্রেডে স্কলারশিপ পেয়েছে সে। কিন্তু তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া  নেই। বাবা তার ফলাফল দেখে খুশি কিন্তু মনে অপরাধ বোধে পীড়িত। কারণ তার এই বৃত্তি দেয়ার পেছনে তারা তেমন মনোযোগ দিতে পারেননি। নিজেই নিজের মতো করে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিল। যাক-গে সে সব কথা।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে। সব স্কুল কলেজ বন্ধ। আমি আর শামিল বন্ধ অবস্থায় ঘরে বসে দিন কাটাচ্ছি। আত্মীয়-স্বজনদেরও আসা-যাওয়া নেই, কোনো খোঁজ-খবর নেয়া যাচ্ছে না। এমনকি কলোনি পাড়াতে যারা আছেন তারাও সহজভাবে কেউ কারো সাথে মিশছে না। কেমন যেন একটা সহজ অবাধ মেলামেশার মধ্যে ছন্দপতন হয়েছে। দেশ যে একটা বির্পযয়ের মুখে সবাই বুঝি। কিন্তু শামিল তো এতোকিছু বুঝে না। যদিও অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে সে একটু বেশি বুদ্ধিমান ও পরিবেশ সচেতন। সে আম্মার কাছে বায়না ধরে, আম্মা আমি কমিউনিটি সেন্টারে টেবিল টেনিস খেলবো। আপনি আমাকে ঘরে আটকে রাখেন কেন? আম্মা তাকে বুঝিয়ে বলেন, এখন তোমার কোনো বন্ধুই টেবিল টেনিস খেতে আসবে না। দেখ না চারদিকে মিলিটারি ঘুরছে। শামিল চুপচাপ হয়ে কতক্ষণ বসে থাকে তারপর আমার কাছে এসে বলে চল বড় আপু আমরা লুডু খেলি। কতক্ষণ লুডু, কতক্ষণ কেরাম, মাঝে মাঝে ছবি আঁকা, বুদ্ধির খেলা, বড় বড় মনীষীর জীবনী বই পড়া কত কিছুই না করছি আমরা সময় কাটানোর জন্য। আম্মাও দুপুর বেলা শুয়ে শুয়ে আমাদের নবী-রাসূলের জীবন কাহিনী শোনাতেন।
বড় মেয়ে আমি। মাঝে মাঝে আম্মার কাজে সাহায্য করতে হতো। ছোট ছোট কাপড় চোপড় ধুতে হতো। রান্না ঘরের কাজেও মাকে সাহায্য করতে হতো বলে সময় কাটানো আমার জন্য তেমন কোনো কষ্টকর হয়নি। শামিলের জানার আগ্রহ সবকিছুতেই প্রবল। আব্বার কাছে সে জানতে চায় খালি খালি লোকজন মিছিল করে কেন? আমাদের স্কুল বন্ধ কেন? আব্বা তাকে অবস্থার প্রেক্ষিত বুঝাতে চেষ্টা করেন।
ঢাকায় থাকা নিরাপদ নয় বলে আববা আমাদের মামার সাথে আম্মার গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। মনটা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। শামিলও খুব বেশি খুশি। পরের দিন আমরা চলে গেলাম মামার বাসা যুগীনগরে। ওখান থেকে মামা-মামী ও মামাতো ভাই সাথে একেবারে চাঁটগায়ে নানার বাড়ি চলে গেলাম। ওখানে কয়েকদিন খুব মজায় ছিলাম আমরা। বিরাট বিশাল এলাকা নিয়ে আমার নানার বাড়ি। এতো বড় এলাকায় শুধু নানারা চার ভাইয়ের চারটি ঘর। মসজিদ, গোরস্তান, পাঁচ পাঁচটা দীঘি, বাড়ির সামনে পেছনে বিশাল বাগ-বাগিচা সব মিলে বাড়ির শাহি চেহারা। ঐ গ্রামের মধ্যে এতো বড় বাড়ি আর কারো নেই।
খোলামেলা পরিবেশ, সঙ্গে মামী, শহিদু, জিন্নাহ আর পাড়ার সব সমবয়সী ছেলেপেলেদের পেয়ে শামিলকে আর পায় কে। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ভাত খাওয়ার সময় না হলে ওদের টিকিটিও দেখা যায় না। ঘরে নানী মামী আর আমি অস্থির হয়ে যাই শামিলের জন্য। হঠাৎ করে যদি শামিল পুকুরে পড়ে যায়? সে তো সাঁতার জানে না। মামা তাগাদা দেন তোরা নতুন জায়গায় এসে যেভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিস অসুখ বিসুখ হলে বর্তমান অবস্থায় ঔষুধ কিনতেও পারবো না। খুব সাবধান পুকুরের দিকে যাবি না। নানী শামিলকে বলে তুমি নানু ওদের মধ্যে অনেক ছোট, বেশি রোদে থাকলে অসুখ হয়ে যাবে। আম্মু তোমার সঙ্গে আসে নাই। তোমার মামী এতো জনকে কিভাবে সামলাবে? আমি তো অসুস্থ। শামিল কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ ঘরে বসে থাকে। এক সময় বেরিয়ে পড়ে বন্ধুদের ইশারা পেয়ে।
আমারও খুব ভাল লাগছে কলোনির বদ্ধ বাসা থেকে মুক্ত পরিবেশে এসে। মার চাচাতো বোনদের সঙ্গে জমিয়ে ফেলেছি এই কয়েকদিনে। নানীর রাঁধুনি গুলনী বুর রান্না যে কী মজা না খেলে কেউ বুঝতে পারবে না। সব নিয়ে দিব্যি আছি। আব্বা আম্মা আর ঢাকার কথা বেমালুম ভুলে গেছি। এখানে রাজনীতি নিয়ে আলাপ করার মতো কেউ নেই। নানী একা থাকেন কাজের লোকদের নিয়ে রেডিও টেডিওর খবর রাখেন না। এরই মধ্যে মামা একদিন আসরের নামাজ শেষে ঘরে ফিরলেন মলিন চেহারা নিয়ে। নানীকে বললেন, মা এখানে বোধ হয় আমাদের থাকা আর নিরাপদ নয়। ওসমানিয়া গ্লাস ফ্যাক্টরিতে বিহারি-বাঙালিদের মধ্যে ভীষণ গণ্ডগোল লেগেছে। যে কোনো সময় আর্মি আসতে পারে। দেখলাম বাঙালি কয়েজন কলেজ পড়–য়া ছেলে বিহারি কয়েজনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। ওদের সবার বুকে কুরআন শরীফ বাঁধা। দেশের অবস্থা বেশি ভাল বলে মন হচ্ছে না। নানী বলেন, তুই যদি নিরাপদ মনে করিস এদের নিয়ে চলে যা তোর নানা বাড়ি পটিয়ায়। মামা প্রথমে নানীর কথা শুনে কিছু বললেন না। কী যেন ভাবলেন, শেষে নিরুপায় হয়ে নানীকে দেখাশোনা করার জন্য উত্তরপাড়া থেকে একটা চৌকিদার রেখে সবাইকে নিয়ে একদিন পায়ে হেঁটে রওনা দিলেন পটিয়ার দিকে। পটিয়া যেতে পথে কালুঘাটে ব্রিজ পার হতে হয়। ঠিক ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই কোথা থেকে যেন হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াল আর্মি ভর্তি একটি জিপ। দু-একজন নেমেই মামার বুকের কাছে স্টেনগান তাক করে একজন আর্মি জিজ্ঞেস করে ‘তুম কোন হে’ বাঙালি অর মুসলিম? মামা কলকাতায় পড়াশোনা করতেন, ভাল উর্দু জানেন। চোশত উর্দুতে ওদের সঙ্গে কী যেন বলাতে আর্মি দু’জন জিপ গাড়িতে উঠে চলে গেল।
মামী আমাদের সব ভাইবোনদের নিয়ে ভয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে রাস্তার একধারে দাঁড়িয়েছিলেন। ওরা চলে গেলে আমাদের ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এলো। পয়দল যাচ্ছি আমরা। আমাদের সাথে আরো অনেক যাত্রী যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খুঁজে। এতদূর হাঁটার অভ্যাস আমাদের নেই। রাস্তাঘাটও ভাল নয়। পথে পথে ইট সুরকি ভাঙা কোথাও বা শুধু কাকর বিছানো। পা টন টন করে ছিঁড়ে যাচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই, সন্ধ্যার আগেই নানীর বাবার বাড়িতে পৌঁছতে হবে। শামিল এসে বারবার আমাকে বলে, আপু আর পারছি না। তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? কোন কথা না বলে শুধু বলি ভাই লক্ষ্মীটি, একটু কষ্ট কর, শহিদু আর জিন্নাহর সাথে একটু জোরে জোরে হাঁট। পথে খাওয়ার জন্য ফাস্কে পানি ও কিছু বেলা বিস্কুট নিয়েছিলেন মামী। ব্যাগ খুলে সবার হাতে দিয়ে বলল, ছেলেরা তোমরা দৌড় দাও কে আগে যেতে পারে দেখি। যে আগে যাবে তার জন্য পুরস্কার আছে। কিন্তু বেচারারা বেশিদূর যেতে পারে না। কিছু দূর গিয়ে থমকে যায় আমরা আবার তাদের ধরে ফেলি। দলে দলে আরো লোকজন যাচ্ছে। এক সময় আমরা ঢুকে পড়ি পটিয়া পুলের কাছে। এমন সময় দেখা গেল আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে প্লেন উড়ছে। সবার মুখ কালো হয়ে গেল। মামা বললেন, এইগুলো আর্মি প্লেন। বোধ হয় কোথাও সৈন্য নামাচ্ছে। মামাকে চিন্তিত মনে হলো। মামী বুদ্ধি দিলেন চল আমরা কিছুক্ষণ পুলের নিচে গিয়ে বসে থাকি। প্লেন চলে গেলে হাঁটা যাবে। শামিলের মুখটা শুকিয়ে চুপসে গেছে। আমার গায়ের সাথে গা ঘেঁষে বারবার বলছে আপা, তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমি আম্মার কাছে যাব। আমার ভয় হচ্ছে। মামা, মামী, শহিদু, জিন্নাহ সবার চেহারা মলিন, কারো কোনো কথা নেই। শামিল ছোট হলেও বিপদ কিছুটা আঁচ করতে পারছে। নীরবে সেও হাঁটে। সন্ধ্যার একটু আগে আগে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যস্থলে। সেই সকাল দশটায় হাঁটা দিয়েছি এখন বেলা পাঁচটা। শ্রান্ত-কান্ত মামা ঘরে ঢুকেই জুতা খুলে সাবেকি আমল থেকে নানার জন্য হাতিনায় পাতা একপাশে রাখা খাটটার ওপর ধপ করে বসে পড়লেন।
আমাদের আসার খর পেয়ে বাড়ির সবাই দৌড়ে এলেন। আবার আদর যতœ ও নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার মধ্যে কয়েকদিন কাটলো। শামিলও খুব খুশি, এখন আর আব্বা-আম্মার কথা বলে না। আমার নানা বাড়ি শুধু সীমানা বড়, কিন্তু মানুষজন নেই বললেই চলে। কিন্তু মার নানার বাড়ি এসে দেখি তা নয়। নানারা অনেক ভাই। বাড়িও বিশাল। আর্মিদের ভয়ে শহর থেকে অনেক আত্মীয়স্বজন এসে ভিড় করেছে এখানে একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, যুবক-যুবতী বয়স্ক পুরুষ মহিলারা মিলে প্রায় ষাট সত্তরজন। বাড়ির মহিলারা আশাপাশের পাড়াপড়শির সাহায্য নিয়ে দু’ফা চুলায় বড় বড় ডেকে ভাত, ডাল ও তরকারি রান্না করছেন। পাটি বেতের তৈরি লম্বা ছব বিছায়ে ছেলেপুলেরা ঘুমাচ্ছে। অনেকে দোয়া দরুদ পড়ছেন। কারো চোখে কোনো ঘুম নেই। সবার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। কখন কী হয় বোঝা যাচ্ছে না। আল্লাহ যদি রক্ষা করে তো আমরা ঢাকা ফিরে যেতে পারবো। শহিদু, জিন্নাহ, শামিল এরা সবাই ছোট। এদের নিয়ে যত চিন্তা। মামী আমাকে বলেন, তুই শামিলকে একটু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা কর। তোর মায়ের অনুপস্থিতি ওর মনের ওপর যেন আছর করতে না পারে।
এতোবড় বাড়ির এতোসব মানুষজন যেন ঝিমিয়ে পড়েছেন। কারো মুখে হাসি নেই, আনন্দ উল্লাস নেই। যন্ত্র তাড়িত হয়ে তারা যেন চলাফেরা করছে। পুরুষেরা সবাই বেশির ভাগ সময় মসজিদের লাগোয়া পুকুরে শান বাঁধানো ঘাটে বসে কাটান। রেডিওতে কান লাগিয়ে আকাশবাণী শোনেন।
বাড়ির হাতিনায় মাগরিবের সময় পাটি বিছিয়ে বাড়ির সব ছেলেমেয়েকে একত্র করে ময় মুরব্বিরা দোয়া পড়বে বলে- লা ইলাহা ইল্লা আন্তা....... যোয়ালিমিন। আমি শামিলকে বললাম তুমিও যাও, ওদের সঙ্গে দোয়া পড়। শামিল পড়তে চায় না, জিজ্ঞেস করে কেন ওরা দোয়া পড়ে? বুঝিয়ে বললাম এ হচ্ছে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার দায়া। এই দোয়া পড়লে আমরা খুব তাড়াতাড়ি ঢাকা যেতে পারবো। ঢাকার কথা শুনে সে খুব তাড়াতাড়ি করে পড়তে গেল। সঙ্গে শহিদু, জিন্নাহ, আম্মার মামাতো ভাই হারুও।
এখানে এসেছি বেশ কয়েকদিন হল। কবে যে ঢাকায় ফিরে যাব কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শামিলকে আর সান্ত্বনা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সে প্রায়ই মুখ লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে এবং বলে আমাকে আম্মার ছবি দেখাও। আব্বা-আম্মাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছা। ওর কাতরতা ও অসহায়তায় আমিও মাঝে মাঝে ঠিক থাকতে পারছি না। তুবও ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেই বলি সোনা ভাই আমার রাস্তাঘাট সব বন্ধ খুললেই ঢাকা চলে যাব আমরা। তখন আব্বা-আম্মাকে দেখবে।
এর পরের দিনই পটিয়া বাজারে বোমা পড়ে। মার নানীর বাড়ির দোতলা গুদাম ঘর মনে হয়েছিল যেন গুদামটি ভেঙে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। মামা কোথায় ছিলেন জানি না। মামী শহিদু জিন্নাহকে নিয়ে ঢুকে বসেছিলাম খাটের তলায়। আমার মামী খুব সহজ সরল মেয়ে, মনটাও মমতায় ভরা। তবুও সেদিন ভীষণ অভিমান হয়েছিল মামীর ওপর শামিলকে সঙ্গে রাখেননি বলে। পরে বোমার ভয় কেটে গেল। সবাই এক জায়গায় আবার জড়ো হই। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলো মামা অনেক চেষ্টা তদবির করে রিলিফের প্লেনে করে আমাকে আর শামিলকে ঢাকা পাঠিয়ে দিলেন।
আব্বা আম্মাকে দেখতে পেয়ে শামিলের যে কী আনন্দ! আম্মাকে আর ছাড়তেই চায় না।
কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সবার জীবনে কিছুটা স্বস্তি ও নিরাপত্তা ফিরে এসেছে। শামিল ও আমি আবার পড়াশোনায় মন দিয়েছি। মেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল বরাবরের মতো ভাল হয়েছে। খেলাধুলাতেও সে ভাল ছিল। আবার দারুণ উৎসাহ নিয়ে জীবন শুরু করলো। টেবিল টেনিসে জাতীয় পর্যায়ে সে পুরস্কার পেল। কিন্তু কী যেন হলো শামিলের! সে দিন দিন বদলে যাচ্ছে। আগে আম্মার সাথে সে খুব খোলামেলা কথা বলতো মিশতো। আমার সাথেও তার সম্পর্ক মধুর ছিল। আমাকে না হলে তার এক মুহূর্তও চলতো না। সেই শামিল ইদানীং আমাকেই এড়িয়ে চলে। তার সহপাঠী পরিচিত বন্ধুগণ কারো সঙ্গে সে মিশে না। কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে সে নিয়মিত খেলতো, সেখানেও আর যায় না। বন্ধুরা এসে বার বার ডেকে যায়। সে তার ঘর বন্ধ করে সারাদিন শুয়ে শুয়ে ঘুমায় আর দেশ-বিদেশের বই পড়ে। আগে ঘরের বাইরে গেলে বাইরে যা করতো, দেখতো তাই আম্মার সাথে শেয়ার করতো। দেশ-বিদেশের সকল খবর ছিল তার নখদর্পণে। আজকাল কোনো কথার প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর সে দেয় না। মাঝে মাঝে আমার নামে মার কাছে নালিশ দেয়। ইদানীং সে দাড়ি-গোফ রাখা শুরু করে দিয়েছে। বাসার সবাই এখন তার ব্যবহারে ভয় পায়। আম্মা একদিন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কিরে তোর কাস আর পড়ালেখা কেমন চলছে? আম্মার কথায় সে ভীষণ ক্ষেপে গেল। শুধু কলেজে যাওয়া আর কাস করা বুঝেন, আর কিছুতো বুঝেন না। দেশ স্বাধীন হয়েছে খুব খুশি আপনারা। স্কুল-কলেজগুলোতে কী হচ্ছে তার খবর রাখেন আপনারা? কলেজ এখন গোণ্ডা বদমাইশের আড্ডাখানা। শিক্ষকেরা হয়ে গেছেন সব ব্যবসায়ী। এসব কলেজে ছেলেকে পাঠিয়ে পণ্ডিত বানিয়ে কোনো লাভ নেই।
এতো শান্তশিষ্ট স্বভাবের ছেলে মাকে এমন কড়া কথা বলতে পারে আমি ভাবিনি। আম্মা আমি বাসার সবাই ওর সাথে কথা বলতে ভয় পাই। বিশেষ করে আমার সাথে কথা বলা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। যদি হঠাৎ করে তার ভালো মন্দ জানতে চাই তো ভীষণ রেগে ওঠে। আমাকে উত্তর না দিয়ে আম্মাকে গিয়ে বলে আপনার মেয়েকে বলেন আমার ব্যাপারে যেন নাক না গলায়। কান্নায় আমার বুক ভেঙে যায়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। একদিন আমার বাসায় আমার বান্ধবী রিতা এলো। বড়লোকের মেয়ে, চলাফেরা ও পোশাকে ফ্যাশন দুরন্ত। পরনে জিন্সের প্যান্ট আর শার্ট, বব কাট চুল। গল্প করছিলাম ড্রয়িংরুমে বসে। শামিল ওকে দেখেই ঘরে ঢুকে আম্মার কাছে গিয়ে উঁচু গলায় বলে এসব আজব চিড়িয়া কেন আমাদের বাসায়? আরেকদিন দেখলে আমি কিন্তু অপমান করবো। তার ক্ষিপ্ত উচ্চ স্বরে ভয় পেয়ে আমি ড্রয়িং রুমের দরজা বন্ধ করে দিই। ’৭১-এর দিনগুলোতে আমরা যেমন ভয়াবহ অবস্থায় থাকতাম আমাদের বাসার অবস্থা এখন তেমন।
মা ভেতের ভেতরে একে ওকে ধরে পানি ও তাবিজ পড়া চালাতে লাগলেন। লাভের মধ্যে দেখা গেল সে আবার পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠেছে। কলোনির বাসায় জায়গা কম তবু আব্বা-আম্মা তার পড়ার জন্য একটি রুম বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন। ওর ইন্টারমিডিয়েটে পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে, বাসার সবাই খুব খুশি। কিন্তু আগের তো প্রাণোচ্ছল শামিল আর নেই। প্রায়ই পড়ার টেবিলে বসে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কী যেন ভাবে, পরীক্ষার সময় দু’তিন পেপার দিয়ে হঠাৎ করে বিগড়ে গেল। সে পরীক্ষা দেবে না। আব্বা আম্মা জিজ্ঞেস করলেন কেন পরীক্ষা দিবি না? কারণ কী?
পরীক্ষা দিয়ে কী লাভ! সামনে বসে নকল করছে, স্যার দেখেও কিছু বলছেন না। শেষমেশ পরীক্ষাটা দিয়েছে, ফলও ভাল করেছে। কিন্তু তাকে কিছুতেই স্বাভাবিক করা যাচ্ছে না। বাড়ির বাইরে গেলে পুরনো এক গাদা বই কিনে নিয়ে আসে। দুই চারদিন শুয়ে শুয়ে বই পড়ে, কারো সাথে কথা বলে না, মিশেও না।
আমার সাথে কথা বলা সে অনেক আগে থেকেই ছেড়ে দিয়েছে। তবু নিস্তার নেই কিছুদিন থেকে আম্মাকে বলতে শুরু করেছে তাড়াতাড়ি করে বিদায় করে দেন আপনার মেয়েকে। মেয়েদের বেশি পড়ালেখা করার দরকার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কোনো লাইনে ভর্তি হতে বললে সে বলে আমি আর পড়বো না। কার কাছে পড়বো? বাংলাদেশে সত্যিকারে কোনো ভাল মানুষ নেই। ভাল টিচার নেই। শেষের দিকে আব্বার সঙ্গে কথা বলাও ছেড়ে দিল। শুধু প্রয়োজনে আম্মার সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু পড়াশোনার কথা বললে ক্ষেপে যায়। অথচ বাইরের লোকজনের সাথে ঠিকই মেলামেশা করছে। তার শাণিত যুক্তি তর্কের মারপ্যাঁচে কেউ কথা বলে সুবিধা করতে পার না। তারা ভাবেন শামিলকে বাড়ির লোকেরা বোঝে না।
শামিলকে নিয়ে বেশ বিব্রত অবস্থায় আছেন আব্বা আম্মা। কোথাও ভর্তি হওয়ার জন্য তাকে কিছুতেই রাজি করানো যাচ্ছে না। এমন করে তার একটা সেশন নষ্ট হয়ে গেল। দ্বিতীয় সেশনও যায় যায়। আমাদের এক ফুফাতো ভাই বেড়াতে এসেছেন লন্ডন থেকে। শামিলের সব খবর শুনে খুব মন খারাপ করলেন। শামিলের সঙ্গে কথা বললেন- তোমার এখানে পড়তে ইচ্ছা না হলে আমাকে বল আমি বিদেশে পড়ার অবস্থা করে দেব। শামিল শেষ পর্যন্ত তার চেষ্টায় বিদেশে পড়ার জন্য রাজি হয়ে গেল। আজ তার ফাইট। আমাদের সবার মনকে, ঘরকে শূন্য করে দিয়ে সে উড়ে গেল অন্য ঠিকানায়। বোবা কান্নায় আমার বুক ভারী হয়ে আসছে বার বার। শামিলকে এভাবে বিদায় দিতে হবে ভাবিনি কখনো।
আরব ভাই এইমাত্র শামিলকে সঙ্গে নিয়ে সুদূর লন্ডনের উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন। সারা ঘরজুড়ে শূন্যতা অনুভব করছি আমি। বিছানার ওপর তার পাল্টে যাওয়া লুঙ্গিটা এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। বিছানার চাদর ও বালিশের ওয়ার সবকিছুর মধ্যে তার মনের অস্থিরতার আবছা ছায়া দেখতে পাচ্ছি। খাটের নিচে স্যান্ডেল জোড়াটা তেড়া-বে্যঁকা হয়ে পড়ে আছে। পড়ার টেবিলের ওপর দামি বই পত্তর অনেক। কিন্তু বড্ড অযতœ অবহেলায় পড়ে আছে। টেবিলের ওপর পাতানো চাদরটা ঝুলে আছে মাটি পর্যন্ত। তার ফেলে যাওয়া অগোছালো এলোমেলো লুঙ্গি-গেঞ্জির মধ্যে তার গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়। সব কিছুর মধ্যে শামিলের চেহারাটা বারবার আমার চোখের আয়নায় ভেসে উঠছে। এই মুহূর্তে ঘরের কোনো জিনিসের মধ্যে আমার হাত দিতে ইচ্ছে করছে না। এই অগোছালো এলোমেলো বিছানা বালিশের ওয়ার, পড়ার টেবিল বড় পরিচিত মনে হচ্ছে আমার। মন বলছে এগুলো এমনি থাকুক। এগুলোর মধ্যেই শামিলের কথা মনে পড়বে। তার অগোছানো স্বভাবের জন্য সে কত বারই না আব্বা-আম্মার বকা খেয়েছে। এই অগোছালো স্বভাবের জন্য বাড়ির সবারই নালিশ ছিল তার বিরুদ্ধে। অথচ এই মুহূর্তে এসবের মধ্যে আমি যেন শৈশবের বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা শামিলকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। বুকের মধ্যে একটা রিনরিনে ব্যথা অনুভব করছি। আব্বা-আম্মা সবাই চলে গেছেন এয়ারপোর্টে শামিলকে বিদায় জানাতে। বাড়িতে বিষণœতার হাহাকার। চোখ আমার অশ্রুসিক্ত হয়ে আসছে। আব্বা-আম্মা আমাকে এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য বলেছেন কিন্তু আমি যাইনি, শামিলের বিদায়দৃশ্য সহ্য করতে পারবো না বলে। শামিল আমার ছোট ভাই। বয়সে সে আমার অনেক ছোট। বাবা সরকারি চাকরি করেন। আমি আর শামিল পিঠাপিঠি না হলেও এক সঙ্গে বড় হয়েছি সরকারি আজিমপুর কলোনির বাড়িতে। বিকেল বেলা কলোনির মধ্যে যখন ছায়া নামে তখন শামিল গিয়ে সমবয়সী ছেলেদের সাথে খেলতো। আমি আমাদের সামনের সিঁড়িতে বসে ওর খেলা দেখতাম। এই সময় আমার সমবয়সী কলোনির বান্ধবীরাও এসে আমার পাশে বসতো। আমরা মাঠে নামতাম না বটে তবে ওখানে বসে গল্প গুজবে বিকেলটা কাটাতাম আনন্দে। সেই হারানো দিনগুলো যেন হঠাৎ এক ঝলক বিদ্যুতের মতো মনের মধ্যে ভেসে উঠলো এই মুহূর্তে। আমাদের বাসার কাছেই কলোনির মধ্যে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছিল। স্কুলের নাম ‘লিটল এঞ্জেলস কিন্ডারগার্টেন’। স্কুলটি ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য হলেও শিক্ষিকারা ছিলেন সব অভিজ্ঞ ও মানসম্পন্ন, শিক্ষণে পারদর্শী, মায়ের মতো মমতাময়ী এবং পেশার প্রতি আন্তরিক। শামিলের মানস গঠন ও লেখাপড়ার ভিত রচনায় এই স্কুলের শিক্ষিকাদের ভূমিকা প্রচুর। এই স্কুলেই শামিলের বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। শামিল যেদিন প্রথম স্কুলে যাবে সেদিন যেন আমাদের সবার মনে সাজ সাজ একটা রব পড়ে গিয়েছিল। শামিলের সেকি উৎসাহ। আব্বা ওর জন্য নতুন ব্যাগ কিনে এনেছেন। নতুন বই-খাতা, রাবার, পেন্সিল তার ব্যাগে ভরে দেয়া হয়েছে। স্কুলের পোশাক, সাদা হাফ প্যান্ট, হাফ শার্ট, আর সাদা ক্যাডস জুতোয় দারুণ স্মার্ট লাগছিল শামিলকে। আমি তাকে তৈরি করে দিয়েছিলাম। আম্মা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন স্কুলে। লেখাপড়া খেলাধুলায় অসাধারণ মেধার অধিকারী শামিল সহজেই স্কুলের সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল। কাসে প্রথম হওয়া ছাড়াও যে কোনো কাজে শ্রেণিশিক্ষিকা তাকে ডাকতেন। তার ওপর থাকতো নেতৃত্বের ভার। অল্প বয়সে তার প্রতিটি কাজ কর্মে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যেতো। সে যখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে তার শ্রেণিশিক্ষিকা তাকে বাংলায় বর্ষা ঋতুর ওপর একটি রচনা দিয়েছিলেন, বাড়ি থেকে লিখে আনার জন্য। রচনাটি লেখার সময় আমি তাকে একটু আধটু সাহায্য করেছিলাম। রচনাটি খুব ভালো হয়েছিল। যেদিন রচনাটি ফেরত পেল সেদিন কী খুশি তার! স্কুল থেকে ফিরেই ব্যাগটা বিছানার ওপর রেখে আমার কাছে ছুটে এসে বলেছিল, জান বড় আপু, নুরজাহান আপা কাসের সবাইকে আমার রচনাটি পড়িয়ে শুনিয়েছেন, আমি নাকি খুব ভাল লিখেছি। আমাদের দুই ভাই-বোনের মধ্যে হঠাৎ আম্মা এসে উপস্থিত হলেন, হাতে রান্না করার খুন্তি। তৈরি রান্না বা অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের সবকিছুর তদারকি করতেন। শামিলের রচনা পড়ে আম্মাও খুব খুশি। লিটল এঞ্জেলস স্কুল থেকে শামিল পঞ্চম শ্রেণী পাস করেছে প্রথম স্থান অধিকার করে। এই স্কুল থেকে তার বিদায় নেবার পালা। বাবা-মার ভীষণ চিন্তা এখন কোথায় তাকে ভর্তি করানো যায়। সন্ধানও পাওয়া গেল তখনকার সময়ের একটা ভাল স্কুলের। নাম গভ. ল্যাবরেটরি স্কুল। প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ, নীতিনিষ্ঠ প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকমণ্ডলীর যৌথ উদ্যোগে ও আন্তরিকতায় ছেলেদের মেধা ও মনন বিকাশের সহায়ক ভূমিকা রেখে সমগ্র ঢাকা শহরে স্কুলটি তখন সুনাম অর্জন করেছিল। শামিল প্রবল প্রতিযোগিতা ডিঙিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হল। তখন আমি মাধ্যমিকের বেড়া ডিঙিয়ে ইডেন কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের মানবিক শাখার ছাত্রী। চারদিকে অশান্ত পরিবেশ। মিছিল, হরতাল,  স্লোগানে মুখরিত ঢাকা নগরী। স্কুল, কলেজ এবং স্বাভাবিক জীবনের বিপন্ন চেহারা। আব্বা অফিসে যান এবং গম্ভীর মুখে বাসায় ফিরেন। আব্বা-আম্মা এবং কলোনির কারো মুখে কোনো হাসি নেই, প্রশান্তি নেই। সন্ধ্যা হলে কলোনির মাঠে আগের মতো ছেলেপেলেরা হৈ-হুল্লা করে না। অফিস ফেরত কর্মচারীদেরও গল্পের বৈঠক বসে না। কী এক অশুভ আলামত যেন সারা কলোনি পাড়াকে রাহুগ্রস্ত করে রেখেছে। যেসব প্রবীণ ও বৃদ্ধরা ভারত স্বাধীন হবার পর পূর্ব পাকিস্তানে এসে নতুন করে স্বাধীন দেশে বসবাস করবেন বলে আশার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের মনে ও মুখে অমানিশার আঁধার। এরই মধ্যে শামিলের পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। প্রথম গ্রেডে স্কলারশিপ পেয়েছে সে। কিন্তু তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া  নেই। বাবা তার ফলাফল দেখে খুশি কিন্তু মনে অপরাধ বোধে পীড়িত। কারণ তার এই বৃত্তি দেয়ার পেছনে তারা তেমন মনোযোগ দিতে পারেননি। নিজেই নিজের মতো করে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিল। যাক-গে সে সব কথা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে। সব স্কুল কলেজ বন্ধ। আমি আর শামিল বন্ধ অবস্থায় ঘরে বসে দিন কাটাচ্ছি। আত্মীয়-স্বজনদেরও আসা-যাওয়া নেই, কোনো খোঁজ-খবর নেয়া যাচ্ছে না। এমনকি কলোনি পাড়াতে যারা আছেন তারাও সহজভাবে কেউ কারো সাথে মিশছে না। কেমন যেন একটা সহজ অবাধ মেলামেশার মধ্যে ছন্দপতন হয়েছে। দেশ যে একটা বির্পযয়ের মুখে সবাই বুঝি। কিন্তু শামিল তো এতোকিছু বুঝে না। যদিও অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে সে একটু বেশি বুদ্ধিমান ও পরিবেশ সচেতন। সে আম্মার কাছে বায়না ধরে, আম্মা আমি কমিউনিটি সেন্টারে টেবিল টেনিস খেলবো। আপনি আমাকে ঘরে আটকে রাখেন কেন? আম্মা তাকে বুঝিয়ে বলেন, এখন তোমার কোনো বন্ধুই টেবিল টেনিস খেতে আসবে না। দেখ না চারদিকে মিলিটারি ঘুরছে। শামিল চুপচাপ হয়ে কতক্ষণ বসে থাকে তারপর আমার কাছে এসে বলে চল বড় আপু আমরা লুডু খেলি। কতক্ষণ লুডু, কতক্ষণ কেরাম, মাঝে মাঝে ছবি আঁকা, বুদ্ধির খেলা, বড় বড় মনীষীর জীবনী বই পড়া কত কিছুই না করছি আমরা সময় কাটানোর জন্য। আম্মাও দুপুর বেলা শুয়ে শুয়ে আমাদের নবী-রাসূলের জীবন কাহিনী শোনাতেন। বড় মেয়ে আমি। মাঝে মাঝে আম্মার কাজে সাহায্য করতে হতো। ছোট ছোট কাপড় চোপড় ধুতে হতো। রান্না ঘরের কাজেও মাকে সাহায্য করতে হতো বলে সময় কাটানো আমার জন্য তেমন কোনো কষ্টকর হয়নি। শামিলের জানার আগ্রহ সবকিছুতেই প্রবল। আব্বার কাছে সে জানতে চায় খালি খালি লোকজন মিছিল করে কেন? আমাদের স্কুল বন্ধ কেন? আব্বা তাকে অবস্থার প্রেক্ষিত বুঝাতে চেষ্টা করেন। ঢাকায় থাকা নিরাপদ নয় বলে আববা আমাদের মামার সাথে আম্মার গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। মনটা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। শামিলও খুব বেশি খুশি। পরের দিন আমরা চলে গেলাম মামার বাসা যুগীনগরে। ওখান থেকে মামা-মামী ও মামাতো ভাই সাথে একেবারে চাঁটগায়ে নানার বাড়ি চলে গেলাম। ওখানে কয়েকদিন খুব মজায় ছিলাম আমরা। বিরাট বিশাল এলাকা নিয়ে আমার নানার বাড়ি। এতো বড় এলাকায় শুধু নানারা চার ভাইয়ের চারটি ঘর। মসজিদ, গোরস্তান, পাঁচ পাঁচটা দীঘি, বাড়ির সামনে পেছনে বিশাল বাগ-বাগিচা সব মিলে বাড়ির শাহি চেহারা। ঐ গ্রামের মধ্যে এতো বড় বাড়ি আর কারো নেই। খোলামেলা পরিবেশ, সঙ্গে মামী, শহিদু, জিন্নাহ আর পাড়ার সব সমবয়সী ছেলেপেলেদের পেয়ে শামিলকে আর পায় কে। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ভাত খাওয়ার সময় না হলে ওদের টিকিটিও দেখা যায় না। ঘরে নানী মামী আর আমি অস্থির হয়ে যাই শামিলের জন্য। হঠাৎ করে যদি শামিল পুকুরে পড়ে যায়? সে তো সাঁতার জানে না। মামা তাগাদা দেন তোরা নতুন জায়গায় এসে যেভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিস অসুখ বিসুখ হলে বর্তমান অবস্থায় ঔষুধ কিনতেও পারবো না। খুব সাবধান পুকুরের দিকে যাবি না। নানী শামিলকে বলে তুমি নানু ওদের মধ্যে অনেক ছোট, বেশি রোদে থাকলে অসুখ হয়ে যাবে। আম্মু তোমার সঙ্গে আসে নাই। তোমার মামী এতো জনকে কিভাবে সামলাবে? আমি তো অসুস্থ। শামিল কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ ঘরে বসে থাকে। এক সময় বেরিয়ে পড়ে বন্ধুদের ইশারা পেয়ে। আমারও খুব ভাল লাগছে কলোনির বদ্ধ বাসা থেকে মুক্ত পরিবেশে এসে। মার চাচাতো বোনদের সঙ্গে জমিয়ে ফেলেছি এই কয়েকদিনে। নানীর রাঁধুনি গুলনী বুর রান্না যে কী মজা না খেলে কেউ বুঝতে পারবে না। সব নিয়ে দিব্যি আছি। আব্বা আম্মা আর ঢাকার কথা বেমালুম ভুলে গেছি। এখানে রাজনীতি নিয়ে আলাপ করার মতো কেউ নেই। নানী একা থাকেন কাজের লোকদের নিয়ে রেডিও টেডিওর খবর রাখেন না। এরই মধ্যে মামা একদিন আসরের নামাজ শেষে ঘরে ফিরলেন মলিন চেহারা নিয়ে। নানীকে বললেন, মা এখানে বোধ হয় আমাদের থাকা আর নিরাপদ নয়। ওসমানিয়া গ্লাস ফ্যাক্টরিতে বিহারি-বাঙালিদের মধ্যে ভীষণ গণ্ডগোল লেগেছে। যে কোনো সময় আর্মি আসতে পারে। দেখলাম বাঙালি কয়েজন কলেজ পড়–য়া ছেলে বিহারি কয়েজনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। ওদের সবার বুকে কুরআন শরীফ বাঁধা। দেশের অবস্থা বেশি ভাল বলে মন হচ্ছে না। নানী বলেন, তুই যদি নিরাপদ মনে করিস এদের নিয়ে চলে যা তোর নানা বাড়ি পটিয়ায়। মামা প্রথমে নানীর কথা শুনে কিছু বললেন না। কী যেন ভাবলেন, শেষে নিরুপায় হয়ে নানীকে দেখাশোনা করার জন্য উত্তরপাড়া থেকে একটা চৌকিদার রেখে সবাইকে নিয়ে একদিন পায়ে হেঁটে রওনা দিলেন পটিয়ার দিকে। পটিয়া যেতে পথে কালুঘাটে ব্রিজ পার হতে হয়। ঠিক ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই কোথা থেকে যেন হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াল আর্মি ভর্তি একটি জিপ। দু-একজন নেমেই মামার বুকের কাছে স্টেনগান তাক করে একজন আর্মি জিজ্ঞেস করে ‘তুম কোন হে’ বাঙালি অর মুসলিম? মামা কলকাতায় পড়াশোনা করতেন, ভাল উর্দু জানেন। চোশত উর্দুতে ওদের সঙ্গে কী যেন বলাতে আর্মি দু’জন জিপ গাড়িতে উঠে চলে গেল। মামী আমাদের সব ভাইবোনদের নিয়ে ভয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে রাস্তার একধারে দাঁড়িয়েছিলেন। ওরা চলে গেলে আমাদের ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এলো। পয়দল যাচ্ছি আমরা। আমাদের সাথে আরো অনেক যাত্রী যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খুঁজে। এতদূর হাঁটার অভ্যাস আমাদের নেই। রাস্তাঘাটও ভাল নয়। পথে পথে ইট সুরকি ভাঙা কোথাও বা শুধু কাকর বিছানো। পা টন টন করে ছিঁড়ে যাচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই, সন্ধ্যার আগেই নানীর বাবার বাড়িতে পৌঁছতে হবে। শামিল এসে বারবার আমাকে বলে, আপু আর পারছি না। তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? কোন কথা না বলে শুধু বলি ভাই লক্ষ্মীটি, একটু কষ্ট কর, শহিদু আর জিন্নাহর সাথে একটু জোরে জোরে হাঁট। পথে খাওয়ার জন্য ফাস্কে পানি ও কিছু বেলা বিস্কুট নিয়েছিলেন মামী। ব্যাগ খুলে সবার হাতে দিয়ে বলল, ছেলেরা তোমরা দৌড় দাও কে আগে যেতে পারে দেখি। যে আগে যাবে তার জন্য পুরস্কার আছে। কিন্তু বেচারারা বেশিদূর যেতে পারে না। কিছু দূর গিয়ে থমকে যায় আমরা আবার তাদের ধরে ফেলি। দলে দলে আরো লোকজন যাচ্ছে। এক সময় আমরা ঢুকে পড়ি পটিয়া পুলের কাছে। এমন সময় দেখা গেল আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে প্লেন উড়ছে। সবার মুখ কালো হয়ে গেল। মামা বললেন, এইগুলো আর্মি প্লেন। বোধ হয় কোথাও সৈন্য নামাচ্ছে। মামাকে চিন্তিত মনে হলো। মামী বুদ্ধি দিলেন চল আমরা কিছুক্ষণ পুলের নিচে গিয়ে বসে থাকি। প্লেন চলে গেলে হাঁটা যাবে। শামিলের মুখটা শুকিয়ে চুপসে গেছে। আমার গায়ের সাথে গা ঘেঁষে বারবার বলছে আপা, তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমি আম্মার কাছে যাব। আমার ভয় হচ্ছে। মামা, মামী, শহিদু, জিন্নাহ সবার চেহারা মলিন, কারো কোনো কথা নেই। শামিল ছোট হলেও বিপদ কিছুটা আঁচ করতে পারছে। নীরবে সেও হাঁটে। সন্ধ্যার একটু আগে আগে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যস্থলে। সেই সকাল দশটায় হাঁটা দিয়েছি এখন বেলা পাঁচটা। শ্রান্ত-কান্ত মামা ঘরে ঢুকেই জুতা খুলে সাবেকি আমল থেকে নানার জন্য হাতিনায় পাতা একপাশে রাখা খাটটার ওপর ধপ করে বসে পড়লেন। আমাদের আসার খর পেয়ে বাড়ির সবাই দৌড়ে এলেন। আবার আদর যতœ ও নিশ্চিন্ত নির্ভাবনার মধ্যে কয়েকদিন কাটলো। শামিলও খুব খুশি, এখন আর আব্বা-আম্মার কথা বলে না। আমার নানা বাড়ি শুধু সীমানা বড়, কিন্তু মানুষজন নেই বললেই চলে। কিন্তু মার নানার বাড়ি এসে দেখি তা নয়। নানারা অনেক ভাই। বাড়িও বিশাল। আর্মিদের ভয়ে শহর থেকে অনেক আত্মীয়স্বজন এসে ভিড় করেছে এখানে একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, যুবক-যুবতী বয়স্ক পুরুষ মহিলারা মিলে প্রায় ষাট সত্তরজন। বাড়ির মহিলারা আশাপাশের পাড়াপড়শির সাহায্য নিয়ে দু’ফা চুলায় বড় বড় ডেকে ভাত, ডাল ও তরকারি রান্না করছেন। পাটি বেতের তৈরি লম্বা ছব বিছায়ে ছেলেপুলেরা ঘুমাচ্ছে। অনেকে দোয়া দরুদ পড়ছেন। কারো চোখে কোনো ঘুম নেই। সবার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ। কখন কী হয় বোঝা যাচ্ছে না। আল্লাহ যদি রক্ষা করে তো আমরা ঢাকা ফিরে যেতে পারবো। শহিদু, জিন্নাহ, শামিল এরা সবাই ছোট। এদের নিয়ে যত চিন্তা। মামী আমাকে বলেন, তুই শামিলকে একটু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা কর। তোর মায়ের অনুপস্থিতি ওর মনের ওপর যেন আছর করতে না পারে। এতোবড় বাড়ির এতোসব মানুষজন যেন ঝিমিয়ে পড়েছেন। কারো মুখে হাসি নেই, আনন্দ উল্লাস নেই। যন্ত্র তাড়িত হয়ে তারা যেন চলাফেরা করছে। পুরুষেরা সবাই বেশির ভাগ সময় মসজিদের লাগোয়া পুকুরে শান বাঁধানো ঘাটে বসে কাটান। রেডিওতে কান লাগিয়ে আকাশবাণী শোনেন। বাড়ির হাতিনায় মাগরিবের সময় পাটি বিছিয়ে বাড়ির সব ছেলেমেয়েকে একত্র করে ময় মুরব্বিরা দোয়া পড়বে বলে- লা ইলাহা ইল্লা আন্তা....... যোয়ালিমিন। আমি শামিলকে বললাম তুমিও যাও, ওদের সঙ্গে দোয়া পড়। শামিল পড়তে চায় না, জিজ্ঞেস করে কেন ওরা দোয়া পড়ে? বুঝিয়ে বললাম এ হচ্ছে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার দায়া। এই দোয়া পড়লে আমরা খুব তাড়াতাড়ি ঢাকা যেতে পারবো। ঢাকার কথা শুনে সে খুব তাড়াতাড়ি করে পড়তে গেল। সঙ্গে শহিদু, জিন্নাহ, আম্মার মামাতো ভাই হারুও। এখানে এসেছি বেশ কয়েকদিন হল। কবে যে ঢাকায় ফিরে যাব কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শামিলকে আর সান্ত্বনা দিয়ে রাখা যাচ্ছে না। সে প্রায়ই মুখ লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে এবং বলে আমাকে আম্মার ছবি দেখাও। আব্বা-আম্মাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছা। ওর কাতরতা ও অসহায়তায় আমিও মাঝে মাঝে ঠিক থাকতে পারছি না। তুবও ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি। মাথায় হাত বুলিয়ে দেই বলি সোনা ভাই আমার রাস্তাঘাট সব বন্ধ খুললেই ঢাকা চলে যাব আমরা। তখন আব্বা-আম্মাকে দেখবে। এর পরের দিনই পটিয়া বাজারে বোমা পড়ে। মার নানীর বাড়ির দোতলা গুদাম ঘর মনে হয়েছিল যেন গুদামটি ভেঙে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। মামা কোথায় ছিলেন জানি না। মামী শহিদু জিন্নাহকে নিয়ে ঢুকে বসেছিলাম খাটের তলায়। আমার মামী খুব সহজ সরল মেয়ে, মনটাও মমতায় ভরা। তবুও সেদিন ভীষণ অভিমান হয়েছিল মামীর ওপর শামিলকে সঙ্গে রাখেননি বলে। পরে বোমার ভয় কেটে গেল। সবাই এক জায়গায় আবার জড়ো হই। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলো মামা অনেক চেষ্টা তদবির করে রিলিফের প্লেনে করে আমাকে আর শামিলকে ঢাকা পাঠিয়ে দিলেন। আব্বা আম্মাকে দেখতে পেয়ে শামিলের যে কী আনন্দ! আম্মাকে আর ছাড়তেই চায় না। কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সবার জীবনে কিছুটা স্বস্তি ও নিরাপত্তা ফিরে এসেছে। শামিল ও আমি আবার পড়াশোনায় মন দিয়েছি। মেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল বরাবরের মতো ভাল হয়েছে। খেলাধুলাতেও সে ভাল ছিল। আবার দারুণ উৎসাহ নিয়ে জীবন শুরু করলো। টেবিল টেনিসে জাতীয় পর্যায়ে সে পুরস্কার পেল। কিন্তু কী যেন হলো শামিলের! সে দিন দিন বদলে যাচ্ছে। আগে আম্মার সাথে সে খুব খোলামেলা কথা বলতো মিশতো। আমার সাথেও তার সম্পর্ক মধুর ছিল। আমাকে না হলে তার এক মুহূর্তও চলতো না। সেই শামিল ইদানীং আমাকেই এড়িয়ে চলে। তার সহপাঠী পরিচিত বন্ধুগণ কারো সঙ্গে সে মিশে না। কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে সে নিয়মিত খেলতো, সেখানেও আর যায় না। বন্ধুরা এসে বার বার ডেকে যায়। সে তার ঘর বন্ধ করে সারাদিন শুয়ে শুয়ে ঘুমায় আর দেশ-বিদেশের বই পড়ে। আগে ঘরের বাইরে গেলে বাইরে যা করতো, দেখতো তাই আম্মার সাথে শেয়ার করতো। দেশ-বিদেশের সকল খবর ছিল তার নখদর্পণে। আজকাল কোনো কথার প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর সে দেয় না। মাঝে মাঝে আমার নামে মার কাছে নালিশ দেয়। ইদানীং সে দাড়ি-গোফ রাখা শুরু করে দিয়েছে। বাসার সবাই এখন তার ব্যবহারে ভয় পায়। আম্মা একদিন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কিরে তোর কাস আর পড়ালেখা কেমন চলছে? আম্মার কথায় সে ভীষণ ক্ষেপে গেল। শুধু কলেজে যাওয়া আর কাস করা বুঝেন, আর কিছুতো বুঝেন না। দেশ স্বাধীন হয়েছে খুব খুশি আপনারা। স্কুল-কলেজগুলোতে কী হচ্ছে তার খবর রাখেন আপনারা? কলেজ এখন গোণ্ডা বদমাইশের আড্ডাখানা। শিক্ষকেরা হয়ে গেছেন সব ব্যবসায়ী। এসব কলেজে ছেলেকে পাঠিয়ে পণ্ডিত বানিয়ে কোনো লাভ নেই। এতো শান্তশিষ্ট স্বভাবের ছেলে মাকে এমন কড়া কথা বলতে পারে আমি ভাবিনি। আম্মা আমি বাসার সবাই ওর সাথে কথা বলতে ভয় পাই। বিশেষ করে আমার সাথে কথা বলা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। যদি হঠাৎ করে তার ভালো মন্দ জানতে চাই তো ভীষণ রেগে ওঠে। আমাকে উত্তর না দিয়ে আম্মাকে গিয়ে বলে আপনার মেয়েকে বলেন আমার ব্যাপারে যেন নাক না গলায়। কান্নায় আমার বুক ভেঙে যায়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। একদিন আমার বাসায় আমার বান্ধবী রিতা এলো। বড়লোকের মেয়ে, চলাফেরা ও পোশাকে ফ্যাশন দুরন্ত। পরনে জিন্সের প্যান্ট আর শার্ট, বব কাট চুল। গল্প করছিলাম ড্রয়িংরুমে বসে। শামিল ওকে দেখেই ঘরে ঢুকে আম্মার কাছে গিয়ে উঁচু গলায় বলে এসব আজব চিড়িয়া কেন আমাদের বাসায়? আরেকদিন দেখলে আমি কিন্তু অপমান করবো। তার ক্ষিপ্ত উচ্চ স্বরে ভয় পেয়ে আমি ড্রয়িং রুমের দরজা বন্ধ করে দিই। ’৭১-এর দিনগুলোতে আমরা যেমন ভয়াবহ অবস্থায় থাকতাম আমাদের বাসার অবস্থা এখন তেমন। মা ভেতের ভেতরে একে ওকে ধরে পানি ও তাবিজ পড়া চালাতে লাগলেন। লাভের মধ্যে দেখা গেল সে আবার পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠেছে। কলোনির বাসায় জায়গা কম তবু আব্বা-আম্মা তার পড়ার জন্য একটি রুম বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন। ওর ইন্টারমিডিয়েটে পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে, বাসার সবাই খুব খুশি। কিন্তু আগের তো প্রাণোচ্ছল শামিল আর নেই। প্রায়ই পড়ার টেবিলে বসে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কী যেন ভাবে, পরীক্ষার সময় দু’তিন পেপার দিয়ে হঠাৎ করে বিগড়ে গেল। সে পরীক্ষা দেবে না। আব্বা আম্মা জিজ্ঞেস করলেন কেন পরীক্ষা দিবি না? কারণ কী? পরীক্ষা দিয়ে কী লাভ! সামনে বসে নকল করছে, স্যার দেখেও কিছু বলছেন না। শেষমেশ পরীক্ষাটা দিয়েছে, ফলও ভাল করেছে। কিন্তু তাকে কিছুতেই স্বাভাবিক করা যাচ্ছে না। বাড়ির বাইরে গেলে পুরনো এক গাদা বই কিনে নিয়ে আসে। দুই চারদিন শুয়ে শুয়ে বই পড়ে, কারো সাথে কথা বলে না, মিশেও না। আমার সাথে কথা বলা সে অনেক আগে থেকেই ছেড়ে দিয়েছে। তবু নিস্তার নেই কিছুদিন থেকে আম্মাকে বলতে শুরু করেছে তাড়াতাড়ি করে বিদায় করে দেন আপনার মেয়েকে। মেয়েদের বেশি পড়ালেখা করার দরকার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কোনো লাইনে ভর্তি হতে বললে সে বলে আমি আর পড়বো না। কার কাছে পড়বো? বাংলাদেশে সত্যিকারে কোনো ভাল মানুষ নেই। ভাল টিচার নেই। শেষের দিকে আব্বার সঙ্গে কথা বলাও ছেড়ে দিল। শুধু প্রয়োজনে আম্মার সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু পড়াশোনার কথা বললে ক্ষেপে যায়। অথচ বাইরের লোকজনের সাথে ঠিকই মেলামেশা করছে। তার শাণিত যুক্তি তর্কের মারপ্যাঁচে কেউ কথা বলে সুবিধা করতে পার না। তারা ভাবেন শামিলকে বাড়ির লোকেরা বোঝে না। শামিলকে নিয়ে বেশ বিব্রত অবস্থায় আছেন আব্বা আম্মা। কোথাও ভর্তি হওয়ার জন্য তাকে কিছুতেই রাজি করানো যাচ্ছে না। এমন করে তার একটা সেশন নষ্ট হয়ে গেল। দ্বিতীয় সেশনও যায় যায়। আমাদের এক ফুফাতো ভাই বেড়াতে এসেছেন লন্ডন থেকে। শামিলের সব খবর শুনে খুব মন খারাপ করলেন। শামিলের সঙ্গে কথা বললেন- তোমার এখানে পড়তে ইচ্ছা না হলে আমাকে বল আমি বিদেশে পড়ার অবস্থা করে দেব। শামিল শেষ পর্যন্ত তার চেষ্টায় বিদেশে পড়ার জন্য রাজি হয়ে গেল। আজ তার ফাইট। আমাদের সবার মনকে, ঘরকে শূন্য করে দিয়ে সে উড়ে গেল অন্য ঠিকানায়। বোবা কান্নায় আমার বুক ভারী হয়ে আসছে বার বার। শামিলকে এভাবে বিদায় দিতে হবে ভাবিনি কখনো।
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ