ভজার কীর্তি

ভজার কীর্তি

তোমাদের গল্প জানুয়ারি ২০১৫

আব্দুল্লাহ আল মোনায়েম#

সেকেন্ড পিরিয়ড শেষ হয়েছে। থার্ড পিরিয়ড শুরু হবে। ক্লাসে তখন কোন মাস্টার মশাই নেই। এখনই আসবেন। ছাত্ররা টানটান হয়ে অপেক্ষা করছে পরের শিক্ষকের জন্য। দুই পিরিয়ডের মাঝে যে সময়টুকু ক্লাস ঘরে কোনো শিক্ষক থাকেন না, ছাত্ররা সেইটুকু সময় নিজেদের মধ্যে কথা বলে হাল্কা হয়ে নেয়। সেটাই রেওয়াজ। তবে আজকের গুঞ্জনটা বেশ চড়া। বিশেষত পেছনের বেঞ্চিগুলোয়। সামনের বেঞ্চে গুডবয়রা বসে, খানিক সন্ত্রস্তভাবে। বিন্দুবাসিনী বিদ্যামন্দিরের ক্লাস নাইন সেকশন ডি-র ছেলেদের ভেতর এই চাপা উত্তেজনার কারণ আজ এক নতুন স্যারের আগমন ঘটবে। মাস্টার মশাইটি সবে জয়েন করেছেন এই স্কুলে। ইতোমধ্যেই অন্যান্য ক্লাসে কয়েকটি পিরিয়ড নিয়ে তিনি নাকি রীতিমত জাঁদরেল হিসেবে নাম করে ফেলেছেন। খবরটা পৌঁছে গেছে এই ক্লাসেও। আধ মিনিট বাদে নতুন স্যার ব্যোমকেশ বাবুর আবির্ভাব হলো নাইন ডি-তে। ঝপ করে থেমে গেল ছেলেদের কলরব, দরজার কাছে এক মুহূর্তে থমকে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে ক্লাসের দিকে একবার তাকিয়ে নতুন স্যার ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলেন। ছাত্ররা উঠে দাঁড়াল। তারা জরিপ নেয় নতুন স্যারকে। নতুন মাস্টার মশাইটি গম্ভীর বদন। শ্যামবর্ণ। লম্বা বেশি নয়। তবে বেশ গাঁট্টাগোট্টা। মাঝবয়সী, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। গোল ফ্রেমের চশমার পেছনে তার কেমন রাগী রাগী চোখ, লোমশ ভুরু, বুরুশ গোঁফ আর ঘন কালো চুল দেখেই অনেক ছেলের বুকের ভেতর গুড়গুড়িয়ে ওঠে। পিরিয়ডটা আবার পাটিগণিতের। সোজা ব্যাপার নয়। আগের স্যার নিতাই বাবু ছিলেন নরম ধাতের মানুষ। তাকে নিয়ে কখনও ছেলেদের উদ্বেগের কারণ ঘটেনি। এখন নতুন স্যারটি আবার কেমন হবেন কে জানে। নতুন স্যার চেয়ারে বসে ছেলেদের ইঙ্গিত করলেন-‘বস।’ ছেলেরা বসে পড়ে। কাঁধের ব্যাগ থেকে একখানা পাটিগণিত বই বের করে সামনের টেবিলে রাখলেন স্যার। বড় কড়া নজরে ছেলেদের ওপর চোখ বুলাতে থাকলেন। ক্লাসে টুঁ শব্দটি নেই। সামনের বেঞ্চের ছেলেরা কাঠ। ‘ইউ! ’ আঙুল তুলে ভারি গলায় হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন নতুন স্যার। ‘শার্টের কলার তুলেছ যে? বেশি লায়েক হয়েছ, না?’ স্যারের তর্জনীর লক্ষ ফোর্থ বেঞ্চের শ্যামাপদ, ‘কী নাম তোমার? স্ট্যান্ডআপ্।’ শ্যামাপদ অপ্রতিভ মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আজ্ঞে, শ্যামাপদ।’ ‘ব্যস, শুধু শ্যামাপদ? পদবি নেই বুঝি?’ ঝাঁঝিয়ে নতুন স্যার। ‘আজ্ঞে দত্ত।’ ঢোক গিলে জবাব দেয় শ্যামা। ‘নামাও কলার। আমার ক্লাসে এসব বেয়াদবি চলবে না,’ হুকুম দেন স্যার। শ্যামাপদ তাড়াতাড়ি তার শার্টের কলার টেনে নামাল। তার এই কলার তোলা পোজের জন্য ছেলে মহলে তার কত খাতির বেড়েছে! সেটা যে এই স্যারের এমন বিষ নজরে পড়ে যাবে কে জানত! শ্যামাপদ অত সহজে নিস্তার পায় না। নতুন স্যার গোঁফ ফুলিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘লাস্ট অ্যানুয়ালে অঙ্কে কত পেয়েছ?’ ‘আজ্ঞে, ছেচল্লিশ,’ মিনমিন করে শ্যামাপদ। ‘ওঃ, তাতেই বাবুর একেবারে কলার উঠে গেছে। ষাট পেয়ে গেলে তো হ্যাট কোট চড়াতে। সিট্-ডাউন।’ সেই প্রচন্ড ধমকে আঁতকে উঠে শ্যামাপদ ধপ করে বেঞ্চের উপর বসে পড়ল। শ্যামাপদের মতো ডানপিঠে ছেলের এমন হেনস্তা দেখে ক্লাস শুদ্ধ ছেলেরা ঘাবড়ে গেল। যে কোনও নতুন স্যার এলে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে অর্থাৎ কিঞ্চিৎ বেকায়দায় ফেলতে ক্লাসের দুষ্টু ছেলেরা কিছু মতলব ভেঁজে রাখত। কিন্তু আজ ব্যোমকেশ স্যারের দাপট দেখে ভয়ে সেসব প্লান শিকেয় উঠল। নতুন স্যারের রাগ যায় না। নিজের মনেই গজগজ করে চললেন, ‘আজকালকার ছেলেগুলো গোল্লায় গেছে। এই যে পাটিগণিত শিখছ, তার উৎপত্তি কোথায় জানো? আমাদের ভারতবর্ষে কয়েক হাজার বছর আগে। সেই সুপ্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি তোমাদের শ্রদ্ধা নেই। কেবল ট্যাঁসগিরি করছো। ফিরিঙ্গিদের নকলে কলার তুলছো! ছি.. ছি..।’ শ্যামাপদ ভাবল, খুব বেঁচেছি। সে এক ফেমাস মুম্বাই হিরোর নকলে কিছু দিন যাবৎ এই স্টাইল শুরু করেছে। ভাগ্যিস স্যার ধরতে পারেনি। নতুন স্যার উত্তেজিত ভাবে ছেলেদের সম্বোধন করে বক্তৃতার ঢঙে বলেন, ‘নিজের দেশের খবর, নিজের পূর্ব পুরুষদের খবর রাখবে। বিলেতে শুনেছি, বাপ-মায়ের খোঁজ রাখে না। এটা কি সভ্যতা? জানো তোমাদের বয়সে আমি সাতপুরুষের নাম বলতে পারতাম।’ ‘গুল।’ একদম পেছনের বেঞ্চ থেকে অস্ফুট সেই শব্দটি নতুন স্যারের কান ঠিক ধরতে পারে না। তবে সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসে গুঞ্জন শুনে স্যার জিজ্ঞেস করেন, ‘এ্যা, কী বললে?’ ভজার মারাত্মক মন্তব্যটি চাপা দিতে শ্যামাপদ চোখ বিস্ফারিত করে তড়িঘড়ি বলে উঠল, ‘সত্যি স্যার, সাত পুরুষ ? গর্বিত কণ্ঠে স্যার জানালেন, ‘আলবত সত্যি।’ উৎসাহিত হয়ে তিনি এবার বললেন, ‘আচ্ছা দেখি পরীক্ষা করে তোমাদের দৌড় কদ্দূর? পূর্ব পুরুষদের নাম বলতে হবে। পিতা, তার পিতা, এমনি করে। জানি, সাতপুরুষ ইমপসিবল্। তবু দেখি কে কতটা পারো!’ ‘ইউ স্ট্যান্ড। তোমার থেকে শুরু করি।’ প্রথম বেঞ্চের ডান দিকের প্রথম ছেলেটিকে নির্দেশ দেন স্যার। সেকেন্ড বয় ফারদিন বেচারা ভড়কে গিয়ে বাবার পরে তার দাদার নামটাই মনে করতে পারল না। বাবার নাম বলেই তোতলাতে লাগল। নতুন স্যার হুকুম দিলেন, ‘দাঁড়িয়ে থাকো। মিনিমাম তিন পুরুষ, আই মিন ঠাকুরদা অবধি নাম না বলতে পারলে দাঁড়াতে হবে। ছি, ছি, লজ্জা করে না। নেকস্ট।’ এক এক করে পাঁচটা বেঞ্চ শেষ হলো। দেখা গেল যে প্রায় অর্ধেক ছেলের ভাগ্যেই দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি জুটেছে। ‘হোপলেস’! নতুন স্যারের কণ্ঠ থেকে রাগ এবং তাচ্ছিল্য ঝরে পড়ল। আসলে নতুন স্যারের খুর দৃষ্টির সামনে পড়ে অনেক ছেলেরই বাপের নামের পরেই গুলিয়ে যায়। যেমন অয়ন বাবার নাম বলে বিড়বিড় করতে লাগল, ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ ধমকে ওঠেন স্যার ‘শুধু আল্লাহর নাম নিলেই হবে। নিজের মগজ না কাজে লাগালে নিজের নামটাও বেমালুম ভুলে যাবে।’ সে হতাশ করুণ নয়নে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘থাক, থাক, ঢের হয়েছে।’ নতুন স্যার হাত তুলে নাম বলা থামিয়ে দেন। সারা ক্লাসের ওপর নিতান্ত বিরক্ত দৃষ্টি হেনে স্যার গলা খাঁকরি দিয়ে যেন একখানা লেকচার দেবার জন্য প্রস্তুত হন। এমন সময় একটি হাত ওঠে। একদম পেছনের বেঞ্চ থেকে। স্যার জিজ্ঞেস করেন, ‘ইউ, তুমি কিছু বলবে ?’ সামনের দিকে সব বেঞ্চের ছেলেদের ঘাড় পেছনে ঘোরে। তাদের সবার চোখে বড় বড় হয়ে ওঠে। ‘হ্যাঁ স্যার।’ হাত তোলা ছেলেটি উঠে দাঁড়ায়। স্যার দেখলেন, গোলগোল ফর্সা প্যান্ট-শার্ট পরা সরল চাউনি, একটু যেন ক্যাবলা টাইপের একটি ছেলে। নরম গলায় তিনি বললেন,‘কী ?’ ছেলেটি একবার কানের পাশটা চুলকে নিয়ে জানালো, ‘স্যার আমি পারি। সাতপুরুষের নাম বলতে পারি। এ্যা পারো। বেজায় অবাক হয়ে নতুন স্যার বললেন, আচ্ছা, কী নাম তোমার? ছেলেটি উত্তর দেবার আগেই ঘরের নানা কোন থেকে অনেকগুলো কণ্ঠে রব ওঠে, ভজা, ভজা। ‘এ্যা’ ভজা !’ নতুন স্যারের ভ্রু কুঁচকে যায়। ছেলেটি ভারি কুণ্ঠিত ভাবে জানায়, ‘ওটা স্যার আমার ডাক নাম। আমার ভালো নাম পুলক চন্দ্র ঘোষ।’ ‘ও! তা বেশ। তোমার পূর্বপুরুষদের নাম বল, শুনি।’ অনুমতি দেন স্যর। ভজা ডান হাতের আঙুলের কর গুনে গুনে থেমে থেমে শুরু করে, ‘গিরিশচন্দ্র ঘোষ, বঙ্কিম চন্দ্র ঘোষ, জগদীশ চন্দ্র ঘোষ, গোষ্ঠ চন্দ্র ঘোষ, সুভাষ চন্দ্র ঘোষ, বিধান চন্দ্র ঘোষ, শ্রীতারক চন্দ্র ঘোষ। তস্য পুত্র পুলক চন্দ্র ঘোষ...’ নিজের বুকে ডানায় বুড়ো আঙুলের একটি টোকা মেরে ভজার ক্ষান্ত দেয়। ভজার প্রথম চার পুরুষ অবধি নতুন স্যার তালে তালে মাথা নাড়ছিলেন। তারপরেই সারা ক্লাসে খুক্ খুক্ ধ্বনির প্রাদুর্ভাব তার কেমন খটকা লাগল। অন্য ছেলেগুলো যেন মাথা নিচু করে হাসি চাপছে। আর নাম বলা শেষ করা মাত্র চাপা হাঁচি কাশি ভয়ানক বেড়ে গেল। ভজা কিন্তু নির্বিকার। সে হাসি মুখে গর্বের সঙ্গে নতুন স্যারের দিক চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বুঝি কিঞ্চিৎ প্রশংসা লাভের আশায়। কিন্তু প্রশংসা ভজার ভাগ্যে জুটল না। নতুন স্যারের কপালের জটও খুলল না। তিনি বাকি ছেলেদের রকম সকম দেখে সন্দিগ্ধ সুরে প্রশ্ন করলেন ভজাকে, ‘কী হে, ঠিক বললে তো? বাংলার সব বিখ্যাত লোকদের নাম দেখছি তোমার পূর্বপুরুষদের নাম।’ ভজা নিতান্ত নিরীহভাবে জবাব দিল, আজ্ঞে স্যার, যদ্দূর মনে পড়ে অনেকদিন আগে শোনা। ক্লাসে চাপা হাসির একটা ঢেউ ফের চাগিয়ে ওঠে। নতুন স্যার মাঝের বেঞ্চের একটা ছেলেকে ধমকালেন, ‘এ্যাই, হাসছো কেন ? অমনি মন্টু দাঁড়িয়ে উঠে বেগে মস্তক আন্দোলন করে প্রতিবাদ জানাল, ‘কই স্যার, হাসছি না তো। কাশি আসছিল।’ ‘কাশি? হুম।’ স্যারের কথার সুরে ঘোর অবিশ্বাস। যা হোক এই নিয়ে আর ব্যোমকেশবাবু জল ঘোলা করলেন না। একটুক্ষণ গুম মেরে থেকে তিনি ভজা ওরফে পুলক চন্দ্র ঘোষকে বসতে নির্দেশ দিলেন। একটু ক্ষুণœ ভাবেই যেন বসে পড়ে ভজা। ব্যোমকেশবাবুর মনে প্রবল সন্দেহ দানা বাঁধল। ভজা নামে ওই ছেলেটা কি তাকে ঠকিয়েছে? বানিয়ে বানিয়ে বলেছে ওর পূর্বপুরুষদের নাম? এর সত্যি মিথ্যা যাচাই করা খুব কঠিন। ওর বাড়িতে তাহলে জিজ্ঞেস করতে হয়। সেটা ভালো দেখায় না। এই ভজা ছেলেটি সম্বদ্ধে বরং একটু খোঁজ নিতে হচ্ছে। ব্যোমকেশবাবু অঙ্কের বই খুললেন বটে, তবে দায়সারা ভাবে ক্লাস শেষ করলেন। সেদিনই ব্যোমকেশবাবু টিচার্স রুমে ‘ভজা’ সম্বদ্ধে খবর নিতে গিয়ে চমকে গেলেন। অন্য শিক্ষকেরা বললেন, ‘কে? ভজা? ডেনজেরাস ছেলে মশাই। ওকে বেশি ঘাঁটাবেন না।’ ভজার পূর্বপুরুষের নাম নিয়ে আর সন্দেহ রইল না ব্যোমকেশবাবুর। ভজা যে তাকে কিভাবে বোকা বানিয়েছে সেটা আর ভাঙালেন না টিচার্স রুমে। মনে মনে তিনি ফুঁসতে থাকলেন, বসো, দেখাচ্ছি মজা। এমন ঢের বিচ্ছু ছেলেকে আমি শায়েস্তা করেছি। এরপর থেকে নতুন স্যার ব্যোমকেশবাবু ভজার জীবন একেবারে অতিষ্ঠ করে তুললেন। সপ্তাহে দুটো পাটিগণিত ক্লাস। ব্যোমকেশবাবু এসেই চাইতেন, ‘হোম টাস্ক এনেছ?’ যে ছেলে হোম টাস্ক আনত না তাকে বেশ কয়েকটা রাম গাঁট্টা খেতে হতো স্যারের হাতে। ভজা বেশির ভাগ দিনই হোম টাস্ক করে উঠতে পারত না। ফলে তার ভাগ্যে শাস্তিটা ছিল প্রায় বাঁধাধরা। অন্য ছেলেদের তুলনায় ভজার মাথায় গাঁট্টাটা যেন কিছু বেশি বার এবং কিঞ্চিৎ বেশি জোরেই পড়ত। যদি ভজা বা দৈবাৎ হোম টাস্ক করেও আনত, ব্যোমকেশ স্যার ভজাকে বোর্ডে তুলতেন কোনও পুরনো অঙ্ক কষতে। ভজা বেশির ভাগ সময় তা পারত না। ফলে সে দিনও গাঁট্টার হাতে থেকে তার রেহাই নেই। অর্থাৎ ব্যোমকেশবাবুর ক্লাসে ভজাকে প্রায় প্রত্যেক দিনই মার খেতে হতো। নিয়মিত পড়া করার মতো সময় কোথায় ভজার? হাজারটা কাজ তার। নাইন ডি অথবা বিন্দুবাসিনী বিদ্যামন্দিরের সঙ্গে কারও ম্যাচ থাকলে ভজার সাপোর্ট মাস্ট। ভজা পাড়ার ক্লাবের সঙ্গে অন্য পাড়ার টিমের ম্যাচেও মাঠে লাইনের ধারে ভজাকে দেখা যেত। ভজা নিজে তেমন খেলতে পারে না বটে, কিন্তু নিজেদের টিমকে নানান কায়দা করে জেতাতে ওস্তাদ ভজা। তার দলবল নিয়ে মাঠের ধার থেকে নিজেদের টিমকে গলা ফাটিয়ে উৎসাহ জোগাবে। বিপক্ষ প্লেয়ারদের টিটকিরি কেটে খেলার মেজাজ নষ্ট করে দিবে। রেফারিকে ভয় দেখিয়ে ঘাবড়ে দেবে যাতে ভজাদের টিমের হয়ে টেনে খেলাতে বাধ্য হয়। এমনি নানান ফন্দি। বিপক্ষ দলের দুর্বলতা কী কী তার সুলুক সন্ধান ঠিক করে জেনে ফেলে ভজা। এই তো কিছুদিন আগে ভবানীপুর স্কুলের সঙ্গে ফুটবল ম্যাচে বিন্দুবাসিনী স্কুল জিতে গেল ¯্রফে ভজার বুদ্ধির জোরে। একটা মারাত্মক গোপন খবর বের করে ফেলে ভজা। ভবানীপুরের দুর্ধর্ষ গোলকিপার গাবুর নাকি ভীষণ কুকুরের ভয়। কারণ একবার তাকে কুকুরে কামড়েছিল। ভজার দল ভবানীপুর স্কুলের গোল পোস্টের পেছনে ভিড় করে রইল। আর ভবানীপুরের গোলের কাছাকাছি বল এলেই ঘাউ ঘাউ করে কুকুরের ডাক ডাকতে থাকে। গাবু সেই ডাক শুনে কেবলই চমকে চমকে পিছনে তাকায়, এমনি একবার আনমনা হবার ফলেই নেহাতই দুর্বল একটা কিক গাবুর হাত ফস্কে গোলে ঢুকে যায়। আর ওই গোলেই হারল ভবানীপুর স্কুল। ভবানীপুর নালিশ জানিয়েছিল বিন্দুবাসিনী স্কুলের সাপোর্টারদের বিরুদ্ধে কিন্তু ফল হয়নি। কুকুর ডাকের গভীর রহস্য বোঝেন নি রেফারি। সুতরাং তিনি নালিশে কান দেননি। স্কুলে বা পাড়ায় যে কোনোও ফাংশন ভজাকে না হলে চলে না। চাঁদা তোলা, প্যান্ডেল সাজান সব কিছুতে ভজা তার দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আবার ভজার কোনও বন্ধুর গায়ে অন্য ছেলে হাত দিয়েছে বা পেছনে লেগেছে শুনলে তার বদলা না নেয়া অবধি ভজার শান্তি নেই। এসব ছাড়াও তার আরও কত ঝক্কি। এত সামলে কি পড়াশুনায় সময় খরচ করা যায় ? ওই পরীক্ষার ঠিক আগে ক’টা দিন আদা জল খেয়ে লেগে কোনও রকমে উতরে যায় ক্লাসে। বাড়িতে কিন্তু ভজার ওপর শাসনের কমতি নেই। পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো না করার দরুন এবং বাড়িতে ভজার নামে নালিশ করলেই বাপদাদাদের বকুনি আর চড়চাপড় জোটে ভজার বরাতে। সে সব অবশ্য ভজা মোটেও পরোয়া করে না। গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে ব্যোমকেশবাবুর পাল্লায় পড়ে মালুম হচ্ছে যে এবার ভজা জব্দ হয়েছে। প্রথম দিনে স্যারকে বোকা বানানোর জেরটা যে এতদিন ধরে চলবে, কেউ তা ভাবেনি। দুদিন ভজা ব্যোমকেশবাবুর ক্লাস কামাই করল। ব্যোমকেশ স্যারও কম যান না। খবর নিয়ে জানলেন যে ভজা ওই দু’দিন অন্য ক্লাস করেছে, শুধু তাঁর ক্লাস ফাঁকি মেরেছে। পরের ক্লাসে বাগে পেয়ে তিনি গাঁট্টা সহযোগে ভজাকে শাসালেন, ‘এরকম ফের করলে তোমার বাবার কাছে কমপ্লিন পাঠাব।’ শুনেই ভজার আক্কেল গুড়–ম। উরিব্বাস, এ যে বাঘের মুখ থেকে সিংহের খাবার। ভজার প্রচন্ড রাশভারি বাবা অকারণে ক্লাস ফাঁকি দেওয়াকে অতি জঘন্য অপরাধ বলে গণ্য করেন। এমন কী ফেল করার চেয়েও। জানলে ভজাকে আর আস্ত রাখবেন না। ভজা তাই ও পথ ত্যাগ করল। অন্তু দুইদিন ধরে লক্ষ্য করছিল যে ভজা কী নিয়ে জানি ঘোঁট পাকাচ্ছে। পাড়ায় অন্তু ভজার সামনের বাড়িতে থাকে। দু’জনে পরম বন্ধু। তবে অন্তু ভালমানুষ প্রকৃতির পড়–য়া ছেলে। দু’জনে এক সঙ্গে ফুটবল ক্রিকেট ইত্যাদি খেলে। পরস্পরের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত। কিন্তু ভজার নানান ডান পিটেমি ও দুষ্টুমিকে অন্তু সভয়ে এড়িয়ে চলে। স্কুলে অন্তু বসে ফার্স্ট বেঞ্চে, ভজা বসে লাস্ট বেঞ্চে কয়েকটি মহা ধুরন্ধর চেলা চামু-া নিয়ে। দু’ ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে আর টিফিনের সময় ভজা তা সাগরেদদের সঙ্গে কী সব গুজগুজ ফিসফিস করছে। পরের দিন থার্ড পিরিয়ডে পাটিগণিত ক্লাস। ব্যোমকেশবাবু চক ডাস্টার হাতে যথারীতি গটগট করে ক্লাসে ঢুকলেন, বসলেন চেয়ারে। তখন শীতকাল স্যারের গায়ে পাঞ্জাবির ওপর জহর কোর্ট। আর তার বাঁ কাঁধে ঝোলানো একটি কাশ্মিরি শাল। সাদা রঙের, চমৎকার কারুকার্য করা। কেউ কোনও দিন তাঁকে শালখানাকে খুলে গায়ে জড়াতে দেখেনি। অমনি নিখুঁত ধবধবে পাট করা অবস্থাতেই শালটি সর্বদা স্যারের কাঁধে শোভা পায়। ব্যোমকেশ স্যার হোম টাস্কের খাতা চাইলেন সামনে টেবিলে সেগুলি জমা পড়ল। ভজা খাতা দিল না। স্যার ভজাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি হোম টাস্ক করনি?’ ভজা কাঁচুমাচু ভাবে জানায়, ‘না স্যার।’ ‘কেন?’ স্যারের চোখে মুখে ঝড়ের আভাস। ভজা বলল, ‘সময় পাইনি স্যার।’ ‘কী রাজকার্য ছিল শুনি?’ স্যারের গলা কঠোর হয়। ‘স্যার, পাড়ার একজনের অসুখ করেছে। তাই তার জন্য ডাক্তার ডাকা, ঔষুধ আনা, এই সব করতে করতে...’ ভজা মাথা চুলকোয় ‘কেন আর কেউ ছিল না কাজ করার? স্যার জেরা চালান। ভজা জানায়, ‘ছিল স্যার। তবু হেল্প করতে গিয়েছিলাম। পাড়ার লোক।’ ব্যোমকেশ স্যার খিঁচিয়ে ওঠেন- ‘জগবন্ধু, অজয় ওরাও তো তোমার পাড়ায় থাকে শুনেছি। ওরা হোম টাস্ক করল কী করে ?’ ভজা অভিযোগের সুরে বলে, ‘ওরা স্যার একটু থেকেই পালিয়ে এসেছে।’ ‘ও ! আর তোমার ঠায় বসে থাকতে হলো ! যত পড়া না করার ছুতো।’ স্যারের মেজাজ চড়ে। ভজা ফস্ করে ভারি বিজ্ঞের মতো বলে বসল, ‘স্যার, মানুষকে দুর্দিনে সাহায্য করতে গিয়ে হোম টাস্ক না করা কি বড় অপরাধ? সেদিনই বাংলা স্যার যে বললেন, ‘সেবা ধর্মই মানুষের সবচেয়ে বড় কর্তব্য।’ ব্যস, একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন ব্যোমকেশবাবু। হুঙ্কার দিলেন, ‘বটে। আবার ডেঁপোমি হচ্ছে?’ ভজা যেন ভারি দ্বন্দ্বে পড়ে অতি নিরীহ স্বরে জানতে চাইল, ‘কেন স্যার, ভুল বলেছি ? সেদিন তাই তো বললেন বাংলা স্যার।’ ‘ক্ষিপ্ত ব্যোমকেশবাবু চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠে চেঁচালেন, ‘ভুল কি ঠিক দেখাচ্ছি। এস, এদিকে কাম-অন।’ ভজা খুব চিন্তিত মুখে ধীরে সুস্থে ব্যোমকেশস্যারের কাছে গিয়ে বিড় বিড় করল, ‘সেবা ধর্ম, না হোম টাস্ক? কোনটা বেশি ইমপর্টেন্ট ? কে জানে?’ ভজার শেষ বাক্যগুলো অবশ্যই স্যারের কানে পৌঁছল। ‘রাসকেল ! ইয়ার্কি হচ্ছে?’ স্যারের গর্জনে গোটা ক্লাস কেঁপে উঠল। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি বাঁ হাতে খপ্ করে ভজার চুলের মুঠি পাকড়ে ডান হাতে ভজার গালে কষলেন প্রচন্ড এক থাপ্পড়। পরেই তিনি গাঁট্টা তাক করছেন পরের ডোজ হিসেবে। কিন্তু আগেই একটা সাংঘাতিক কান্ড ঘটে গেল। ভজা একবার মাতালের মতো টাল খেয়ে ধড়াম করে সটান আছড়ে পড়ল মেঝেতে। স্যারের গাঁট্টা আর লক্ষ্য আঘাত হানার সুযোগ পেল না। শূন্যেই আড়ষ্ট হয়ে যায় উদ্যত হাতখানা। তার মুখ হাঁ, চক্ষু বিস্ফারিত, চশমাটা কোনো ক্রমে নাকের ডগা আঁকড়ে ঝুলছে। গোঁফ খাড়া একবারে ‘থ’ হয়ে তিনি তাকিয়ে রইলেন মাটিতে লম্ববান ভজার দিকে। প্রথমেই পেছনের বেঞ্চে কয়েকজন ছেলে লাফিয়ে এসে ভজাকে ঘিরে ধরল। তাদের ফাঁক দিয়ে বাকি ছেলে উঁকি মারল ভজাকে দেখতে। ভূপাতিত ভজা গোঁ গোঁ করতে করতে বার কয়েক ছটফট করে হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। তার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠতে লাগল। চোখ বোজা, মনে হচ্ছে বেঁহুশ। ছেলেদের আর্ত রব উঠল, ‘ভজা মরে যাচ্ছে স্যার, ভজা মরে যাচ্ছে।’ ব্যোমকেশ বাবু দিশেহারার মতো দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক দেখতে দেখতে থাকেন, ‘এ্যা।’ ব্যস, কয়েক মিনিটে সারা স্কুল রটে গেল যে ব্যোমস্যার ভজাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন। বাঁধভাঙা ¯্রােতের মতো অন্য ক্লাসের ছেলেরা হুড়মুড়িয়ে ছুটে এসে ভিড় জমালো নাইন ডি-এর দরজায়। শুধু ছাত্ররা নয়, কয়েক জন টিচারও এসে জুটলেন সেখানে। সবাই ভজাদের ক্লাসে ভেতর ঢুকতে চায়। মারের চোটে ভজা পটল তুলেছে-এ কী যে সে ব্যাপার? কিন্তু নাইন ডি-র ছেলেরা, বিশেষ করে ভজার সাগরেদরা দরজা আটকে দাঁড়ালো, বলল, ‘না।’ না বেশি ভিড় নয় এ ঘরে। দম আটকে যাবে। না, ভজা এখনও মরেনি। তবে কেস খুব সিরিয়াস। সহসা ব্যোমকেশবাবুর কাঁধের শাল টান পড়ে ‘একী, একী! তিনি আঁকড়ে ধরেন। ভজার লাস্ট বেঞ্চের এক দোস্ত টুনু শালের অপর প্রান্ত টানতে টানতে বলে, ‘স্যার, শালটা দিন। ভজার মাথায় জল দিতে হবে। এটা ভিজিয়ে আনি।’ ‘না, না, শাল নষ্ট হয়ে যাবে।’ ব্যোমকেশবাবু শাল ধরে রাখেন। ‘স্যার, একটা জীবনের চেয়ে কি একটা শালের দাম বেশি? দিন দিন স্যার শিগ্গিরি। দেখছেন না ওর কন্ডিশন। আর তো কিছু নেই ভেজাবার,’ বলতে বলতে টুনু হেঁচকা টান মারে শালে। ব্যোমকেশবাবুর অপরাধী মন জোর হারিয়ে ফেলে। তাঁর মুঠো আলগা হয়। শাল বেরিয়ে যায়। টুনু বারবার ভেজানো শাল নিংড়াল ভজার মুখে। এবার ভজা চোখ মেলে হাতের এক ঝটকায় ভিজে শালখানা সরিয়ে দিয়ে ঠেলে উঠে বসল। তারপর ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চার ধারে তাকাতে তাকাতে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করল, ‘আমি কোথায়? আমার কী হয়েছে?’ সহসা দরজার কাছে ভিড়টা দু-ফাঁক হয়ে গেল। মাঝখান দিয়ে হেডমাস্টার হন হন করে ঘরে ঢুকে ভজার সামনে থমকে দাঁড়ালেন। অন্য দর্শকরা তটস্থ হয়ে একটু দূরে সরে যায়। হেডস্যারকে দেখেই ভজার ঘাড় এক পাশে হেলে পড়ে। থমথমে মুখে তীক্ষœ চোখে ভজাকে অল্পক্ষণ নজরে করে মন্তব্য করলেন, ‘যাক, সেন্স ফিরেছে।’ এর পর তিনি ভজাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন বোধ হচ্ছে ?’ ‘ব্যথা করছে?’ হেডমাস্টার মশাই গম্ভীরকণ্ঠে ব্যোমকেশবাবুকে বললেন, ‘আপনি একবার আসুন আমার সঙ্গে।’ তিনি গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। পেছনে পেছনে ব্যোমকেশবাবু। ভজা তেমনই মেঝেতে বসে নিজের শার্ট দিয়ে মাথা মুখ মুছতে লাগল আর আড়চোখে বারকয়েক টুনুকে দেখল। এরপর থেকে ব্যোমকেশবাবুর শিক্ষা হয়ে গেল। তিনি আর কোনও দিন ভজার গায়ে হাত তোলেননি, ওকে পড়াও ধরতেন না। হোমটাস্ক না আনলেও চোখ বুজে থাকতেন। পারতপক্ষে তার দিকে নজরই দিতেন না। এর প্রায় বছর বিশেক বাদের কথা। সন্ধ্যা বেলা। ‘স্যার, স্যার..।’ কারো কণ্ঠ শুনে ব্যোমকেশবাবু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসেন উঠোনে। সেই তেজী চেহারা আর নেই। বয়সের ভারে একটু ঝুঁকে পড়েছেন। রোগা হয়ে গেছেন। মাথায় পাতলা চুল সব সাদা। গোঁফ পাকা। পরনে মলিন পরিচ্ছদ। কেমন বিষন্ন চেহারা। টিপ করে স্যারের পায়ে ফের পেন্নাম ঠুকে তার পায়ের কাছে বসে পড়েন ভজা। স্যারের পায়ের কাছে একটি প্যাকেট রেখে দিয়ে বলল, ‘আমি ভজা স্যার, আমাকে ক্ষমা করে দেন, আমি সেদিন ভান করেছিলাম।’ ব্যোমকেশবাবু আকাশ থেকে পড়েন, ‘আপনি’ মানে তুমি...?’ ‘কানাডায় আছি স্যার। এই দিন পনেরো দেশে এসেছি। আবার ফিরে যাব। আমি স্কুলে গিয়েছিলাম স্যার আপনাকে খুজতে।’ ব্যোমকেশবাবু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ‘না বাবা, আমি এখন রিটায়ার করেছি।’ ‘তুমি কানাডায় কী কর বাবা?’ কৌতূহলী ব্যোমকেশবাবু জিজ্ঞেস করেন। ‘আজ্ঞে চাকরি। ওখানে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে কাজ করছি। স্কুল ফাইনাল পাস করেই চলে যাই কানাডায় কাকার কাছে।’ ‘..আমাকে ক্ষমা করে দেন স্যার, আমি সেদিন মার থেকে বাঁচতে ভান করেছিলাম..।’ ‘না-না, ঠিক আছে,’ ব্যোমকেশবাবু ভজার মাথায় হাত রাখেন। আর ভাবেন, যে ভজা অঙ্কে এত কাঁচা ছিল। সে-ই এখন ইঞ্জিনিয়ার ! ‘এই সামান্য উপহারটুকু কিন্তু নিতে হবে স্যার। নইলে বড় দুঃখ পাবো।’ ভজা প্যাকেটটা তুলে একটা টুলে রাখে। ভজা বিদায় নেয়। ব্যোমকেশবাবু উপহারের প্যাকেটটা খোলেন। একটি অতি চমৎকার কাশ্মিরি শাল আর কাগজে মুড়ানো একটা টাকার বান্ডেল। শালটা অনেকটা তাঁর বহু পুরনো হতশ্রী শালটার মতো দেখতে। তবে এটা ঢের বেশি দামি। এতটা বছর পর ব্যোমকেশবাবু ভজাকে ক্ষমা করতে পারলেন। আসল ঘটনা জানার পর ব্যোমকেশবাবু ভজার প্রতি দুর্বল হয়েছিলেন, কিছুটা মায়াও লেগেছিলো। তবে ব্যোমকেশবাবু ভজাকে আশীর্বাদ করতে ভুলেননি।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ