ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

স্মরণ সেপ্টেম্বর ২০১৩

ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম

বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, ধ্বনিতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, গবেষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একজন কীর্তিমান মহান পুরুষ। মাতৃভাষার প্রতি জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসা। ব্যক্তিগত জীবনে নিরহঙ্কার ও সাদামাটা এই মানুষটি বাংলাদেশের অহঙ্কার। তিনি তাঁর গোটা জীবনব্যাপী বাংলাভাষা, ভাষাতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করে একে একটি মজবুত ভীতের ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হন। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রথম যুক্তিপূর্ণ লেখনী উপহার দেন এবং এ মহান ভাষার বিরোধিতাকারীদের স্বরূপ উন্মোচন করেন। ‘মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি সব মানুষের পরম প্রিয় ও শ্রদ্ধার বস্তু’ এ অমর বাণীর যিনি উদ্গাতা তিনি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ ও পণ্ডিত জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার পেয়ারা গ্রামে এক প্রখ্যাত আলেম পরিবারে। পিতার নাম মফিজউদ্দিন আহমদ এবং মায়ের নাম নূরুন্নেছা। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শুরু হয় তাঁর শিক্ষা জীবন। প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করে ভর্তি হন দারুন নেশা। নানা বিষয়, নানা ভাষা জানবার ছিল তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ। স্কুল জীবনেই তিনি আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, উড়িয়া, ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষা ভালোভাবে আয়ত্ব করে ফেলেছিলেন। হাওড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি সংস্কৃতসহ প্রবেশিকা পরীক্ষা কৃতিত্বের সাথে পাস করেন। এরপর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। এখান থেকে পাস করেন এফএ। সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃত নিয়ে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে তিনিই প্রথম সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে পাস করেন। সংস্কৃতে অনার্স পাস করার পর সংস্কৃত নিয়ে এমএ পড়তে চাইলে সংস্কৃত পণ্ডিতগণ তাঁকে পড়াতে অস্বীকার করেন। ফলে তিনি তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯১২ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ঐ সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম ভাষাতত্ত্ব বিভাগ খোলা হয়। আর শহীদুল্লাহ ছিলেন ঐ বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। এরপর তিনি আইন বিষয়ে ভর্তি হন এবং ১৯১৪ সালে আইন বিষয়ে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন। এ সময় তিনি সীতাকুন্ড হাইস্কুলে যোগদানের মাধ্যমে শুরু করেন কর্মজীবন। এরপর পশ্চিম বঙ্গের বশীরহাটে আইনজীবী হিসেবে প্রাকটিস শুরু করেন। তিনি একবার বশীরহাট পৌরসভাব ভাইস চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সহকারী গবেষক হিসেবে যোগদান করেন। এই সময় তিনি বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাসের ওপর বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যামূলক প্রবন্ধ লেখেন, যা সে সময়ে গুণীদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রবন্ধগুলো প্রকাশিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে। এই সময়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ওকালতি ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। স্যার আশুতোষ শহীদুল্লাহকে যে সংক্ষিপ্ত পত্র লিখেছিলেন তা ছিলÑ ইধৎ রং হড়ঃ ভড়ৎ ুড়ঁ, পড়সব ঃড় ড়ঁৎ টহরাবৎংরঃু। এই একটি মাত্র পত্র দিয়েই সেদিন শহীদুল্লাহর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন স্যার আশুতোষ। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং সুনাম অর্জন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ১৯২১ সালে ঢাকা চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯২৬ সালে প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সুযোগ পান এবং ১৯২৮ সালে বৈদিক ভাষা প্রাকৃত ও দোহাকোষ সম্পর্কে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন এবং ভাষাতত্ত্ব নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা ও অধ্যাপনার সুযোগ পান। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘তুলনামূলক ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব’-এর গবেষণায় খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’। এটি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাতাত্ত্বিক গ্রন্থ। এ গ্রন্থে বাংলা ভাষায় অনার্য প্রভাব ও বৈদেশিক প্রভাব সম্পর্কে তিনি সুচিন্তিত আলোচনা করেছেন। তাঁর অপর মূল্যবান গ্রন্থ ‘বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণ’। প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণের অভাব মোচন করার লক্ষ্যে রচিত এ গ্রন্থটি তাঁর ভাষাতাত্ত্বিক অবদানের আরেক উজ্জ্বল নিদর্শন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগ পৃথক হলে তিনি ফ্রান্স থেকে ফিরে এসে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ও রিডার পদে যোগ দেন। রিডার থাকা অবস্থায় ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগীয় প্রধান ও কলা অনুষদের ডীন হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫-৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ সালের ১ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবে বাংলা একাডেমীতে যোগ দেন। ১৯৬১ সালে পুনরায় বাংলা একাডেমীর ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্পের সম্পাদক হন। একই সময় এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি হওয়ারও গৌরব অর্জন করেন। ড, শহীদুল্লাহ বাংলা সালের তারিখ বিন্যাস চূড়ান্ত করেন। ১৯৬৩ সালে বাংলা পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস করার জন্য বাংলা একাডেমী কর্তৃক একটি কমিটি নির্ধারিত হয়। ড. শহীদুল্লাহ এ কমিটির সভাপতি হন। পরে অনেক গবেষণা ও চিন্তাভাবনা করে যে পঞ্জিকা চূড়ান্ত করেন, সেটাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত এবং সর্বমহলে প্রচলিত। তাঁর গবেষণা গ্রন্থের সংখ্যা ৪০টি। এছাড়া তিনি ৪১টি পাঠ্যবইও লিখেছেন। ২০টি বই সম্পাদনা করেছেন। বালা সাহিত্যের ওপর তাঁর লিখিত গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা ৬০টিরও বেশি। ভাষাতত্ত্বের ওপর রয়েছে তাঁর ৩৭টি রচনা। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রথম ইমেরিটাস প্রফেসরের পদ লাভ করেন। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান সম্পাদনা তাঁর জীবনের প্রধান একটি কাজ। জীবনভর ভাষা ও সাহিত্যের ওপর গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’, ফরাসী সরকার কর্তৃক ‘নাইট অব দি অর্ডারস অব আর্ট লেটার্স’ (১৯৬৭) উপাধিতে ভূষিত হন। বাংলাদেশ সরকার ‘একুশে পদক’সহ (মরণোত্তর) বহু পুরস্কার, পদক ও সম্মাননায় ভূষিত করে। ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল সংলগ্ন মুসা খান মসজিদের পশ্চিম পাশে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। তিনি ৮৪ বছর হায়াত পেয়েছিলেন। প্রায় একটি শতাব্দির সূর্যালোক স্পর্শকারী এই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাদেশের গর্ব ও অহঙ্কার।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ