ভিন গ্রহের প্রাণী   -মুহাম্মাদ দারিন

ভিন গ্রহের প্রাণী -মুহাম্মাদ দারিন

উপন্যাস ফেব্রুয়ারি ২০১৮

এক.
সূর্যটা এখন পশ্চিম দিগন্তে। ডুবতে আর পনেরো-ষোলো মিনিট মতো বাকি। ডুবার আগে সে তার রূপ ছড়িয়ে দেবে পশ্চিম আকাশে। রূপটা এখনও ভালোভাবে ছড়ায়নি। এই অল্প সময়ের মধ্যে আমাকে যেতে হবে আরো তিন কিলোমিটার পথ। তাই সাইকেলটা একটু জোরে চালাচ্ছি। শহুরে পরিবেশ ধীরে ধীরে পার হচ্ছি। রাস্তার দু’ধারে এখন গ্রাম্য আবহ শুরু হয়েছে। রাস্তাও ফাঁকা। রাস্তার দু’পাশে এখন বেশ কিছু দোকানপাট। পাকা দোকানও আছে, আবার কাঠের তৈরি টঙ দোকানও আছে।
রাস্তার বাম পাশের একটা পাকা দোকান থেকে চকোলেট আর চুইংগাম কিনলাম। দোকানিকে দাম দিয়ে একটা চুইংগাম ছিঁড়ে মুখে পুরে আবার চলতে শুরু করলাম।
দোকানপাট ছাড়িয়ে এসেছি। দু’পাশে এখন শুধু ধানের ক্ষেত। ক্ষেতে অবশ্য এখন ধান নেই। কেটে নিয়ে গেছে। শুধু গোড়ার নাড়াটুকু অবশিষ্ট আছে।
আরো কিছুদূর এগোলাম এই পাকা রাস্তা ধরে। এখন রাস্তার দু’পাশে বাড়িঘর শুরু হয়েছে। কিছু সামনে ইউসুফ স্যারের দোকান। দোকানের সামনে আসতেই সাইকেল থেকে নেমে স্যারকে সালাম দিলাম, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
স্যার দোকানেই বসে ছিলেন। উত্তর দিলেন, ‘ওয়ালাই কুমুস সালাম। তা কোথায় চললিরে তুরান?’
‘মামাবাড়ি।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম।
‘আর দাঁড়াতে হবে না। সোজা চলে যা।’ পশ্চিম দিকে হাত দিয়ে দেখালেন। ‘রাস্তা-ঘাট এখন ভালো না।’ বললেন স্যার।
‘তাহলে যাই স্যার।’ বলে গজ পাঁচেক সামনে হেঁটে যেয়ে মুখ থেকে চুইংগাম ফেলে একটা চকোলেট মুখে পুরে আবার সাইকেল চালাতে লাগলাম।
ইউসুফ স্যার হলো মামাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের স্যার। বিকালে তিনি সময় কাটানোর জন্য এই শখের দোকানে বসেন। আমি মামাবাড়ি থেকে ঐ প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি। ক্লাসে ভালো ছাত্র হওয়ায় স্যার আমাকে ভালোভাবে চেনেন।
এবার আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষার পরের এই অবসর সময় মোটেও পার হতে চাচ্ছে না। শুয়ে-বসে, খেলা করে আর গল্পের বই পড়ে মোটেও পার হতে চাচ্ছে না এই সময়গুলো। মামাবাড়ি চলেছি ছুটি কাটাতে।
আমাদের বাড়ি হতে মামাবাড়ি দশ-এগারো কিলোমিটার দূর হবে। আমাদের বাড়ি শহরের পূর্বদিকে শহরতলিতে আর মামাবাড়ি শহরের পশ্চিম দিকে শহরের নিকটবর্তী গ্রামে। আমি ক্লাস ফোরে পড়া অবস্থায় সাইকেল চালিয়ে মামাবাড়ি যাই। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
মামাবাড়ি শুধু সময় কাটাতে চলেছি তা কিন্তু নয়। মামাতো ভাই শাহিন আমাকে চিঠি দিয়েছে জরুরি ভিত্তিতে ওদের বাড়িতে যেতে। বেশ কয়েকদিন ধরে ওই গ্রামের সব হাঁস-মুরগি, পায়রা বেমালুম গায়েব হয়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে কেউ বলতে পারছে না। শত চেষ্টা করেও গ্রামবাসী বের করতে পারেনি এর কারণ।
সেজো মামার ছেলে শাহিন। বয়সে আমার থেকে এক-দেড় বছরের ছোট হবে ও। তবুও দু’জন আমরা একই সাথে লেখাপড়া করি। ও চিঠি দিয়েছিলো। ও লিখেছিলো, ‘অদ্ভুত এক কান্ড ঘটছে আমাদের গ্রামে। বিষয়টা বড়ই রহস্যঘেরা। চলে আয়। দেখি দু’জন মিলে এর সমাধান করতে পারি কি না? চিঠি পাওয়া মাত্রই চলে আসবি।’ তাই আমার এই যাত্রা।
শাহিনের চিঠি পেয়েছি দুপুরে। তারপর খেয়ে দেয়ে একটু বেলা পড়তেই আমি রওয়ানা হয়েছি সাইকেল নিয়ে। কিন্তু আমি ও শাহিন কোনো গোয়েন্দা নই। তারপরেও দেখা যাক এই রহস্যের সমাধান করতে পারি কি না?
রাস্তার দু’পাশে এখন ধানক্ষেত। এখানেও ধান নেই। রাস্তা বেশ নির্জন। রাস্তার ডান পাশ দিয়ে দু’জন লোক হেঁটে পূর্বদিকে যাচ্ছে। তারা আমার দিকে একদৃষ্টিতে কেমন ভাবে যেন তাকাচ্ছে। তাই দেখে আমার কলিজার পানি শুকিয়ে গেল। অমনি মনে পড়লো স্যারের সেই সতর্কবাণী, ‘রাস্তা-ঘাট এখন ভালো না।’
যদিও আমার কাছ থেকে ওদের নেয়ার কিছু নেই। তবুও... কেমন জানি ভয় ভয় লাগতে লাগলো। তাই সাইকেলটা আরো জোরে চালিয়ে কিছুদূর এগিয়ে একটু থেমে বাকি দুটো চকোলেট একবারে মুখে পুরে দিলাম। ভয়ের সময় নার্ভকে ঠিক রাখার জন্য আমার এই চকোলেট খাওয়া।
এই জায়গাটার নাম জামতলা। এখানে রাস্তাটা দু’দিকে চলে গেছে। বাম দিকেরটা এই পাকা রাস্তা। ওটা এঁকে বেঁকে চলে গেছে বহু দূরে ছুটিপুরের দিকে। ছুটিপুরের ওপাশেই নাকি বর্ডার এলাকা। যদিও আমার যাওয়া হয়নি ওদিকে। আর সোজা অর্থাৎ পশ্চিমমুখী রাস্তাটা ইট বসানো। যাকে হেরিং বলে। তবে রাস্তার অবস্থা করুণ।
আমি পশ্চিমমুখী রাস্তাটায় চললাম। এই রাস্তায় আমার মামাবাড়ির পথ।
ইটের এই করুণ রাস্তায় সাইকেল চালাতে যেয়ে টের পাচ্ছি যে আমার চোখ পর্যন্ত লাফাচ্ছে। কাজেই আমার চলার গতি কমাতে হলো।
দু’পাশের ফাঁকা ধানক্ষেত দেখে চলতে চলতে এক সময় হাটে এসে পৌঁছলাম। এই হাটের নাম বকুলতলার হাট। গ্রামের মোড় নামেও পরিচিত এই জায়গাটা। এখানে সপ্তাহে তিনদিন হাট বসে। শুক্র, সোম ও বুধবারে হাট হয়। আজ শুক্রবার। সুতরাং হাট পুরোদমে চলছে। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁক-ডাক, চিৎকার- চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে।
এই হাটে গরু আর ছাগল বাদে সব কিছু পাওয়া যায়। হাটের গুঞ্জন একসময় পেছনে ফেলে এলাম।
সূর্য এখন তার রূপ পুরোপুরি ছড়াচ্ছে। অর্ধেকের বেশি ডুবে গেছে। ডুবতে আর মাত্র দুই কি তিন মিনিট বাকি।
আরো কিছুদূর এগিয়ে এই হেরিং রাস্তা থেকে নেমে ডান পাশের বাড়িতে ঢুকলাম। এটাই আমার গন্তব্যস্থল মামাবাড়ি।
[এরপর আগামি সংখ্যায়]
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ