ভূমিকম্পের ভেতর বাহির

ভূমিকম্পের ভেতর বাহির

বিজ্ঞান মে ২০১১

ভূ-অভ্যন্তরের চুপচাপ, শান্ত মাটি বলা নেই-কওয়া নেই হঠাৎ আড়মোড়া ভেঙে বসলেই সর্বনাশ। মুহূর্তেই প্রবল এক ঝাঁকুনিতে দালানকোঠা-গাছপালা ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়। বিপুল পরিমাণ শক্তির আকস্মিক নির্গমনের কারণে ‘সিসমিক ওয়েভ’ নামের যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, তারই বহিঃপ্রকাশ ভূমিকম্প। সিসমোমিটার বা সিসমোগ্রাফ নামক যন্ত্রের সাহায্যে ভূমিকম্প মাপা হয়। মাত্রাটি প্রকাশ করা হয় রিখটার স্কেলে। এই স্কেল অনুযায়ী, ৩ বা এর কম মাত্রার ভূমিকম্পকে নিরাপদ এবং ৭ বা এর বেশি মাত্রার ভূমিকম্পকে খুবই বিপজ্জনক হিসেবে ধরা হয়। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৫। ১৯৬০ সালের ২২ মে চিলিতে হয়েছিল ওই কম্পন। সম্প্রতি জাপানে সংঘটিত ৯ মাত্রার ভূমিকম্পটিকে জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক এবং পৃথিবীর ইতিহাসে ষষ্ঠ শক্তিশালী ভূমিকম্প হিসেবে ধরা হচ্ছে। ভূমিকম্পের কারণে যে কম্পন সৃষ্টি হয়, তার প্রাবল্য মাপা হয় মারকেলি স্কেলে। ভূমিকম্পের গভীরতা যত কম হবে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ততটাই বেড়ে যাবে। ভূমিকম্প তার ক্ষণিকের উপস্থিতি বেশ ঘটা করেই জানান দিয়ে যায়। ভূমিকম্পের সময় মাটির বুকে চিড় কিংবা খাদ, কখনো বা ভূমিধস এবং আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতও দেখা দিতে পারে। সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় বড় আকারের ভূমিকম্প হলে সমুদ্রতলের মাটি সরে গিয়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ সুনামি, ঠিক যেমনটি হয়েছে জাপানে। উৎস পৃথিবীর গভীরে কিছু এলাকা আছে যেগুলো মাত্রাতিরিক্ত ভূমিকম্পপ্রবণ। এসব এলাকা ‘ফললাইন’ নামে পরিচিত। এখানে ফাটল ধরার কারণে সৃষ্টি হয় বিধ্বংসী ভূমিকম্পের। ফললাইন তিন ধরনের - সাধারণ, উল্টো এবং ঘর্ষণ বিচ্যুতি। ভূ-অভ্যন্তরের কঠিন দুটো স্তরের মাঝে বিচ্যুতি ঘটলে হয় সাধারণ ফল, দুটো স্তর সঙ্কুচিত হলে ঘটে রিভার্স তথা উল্টো ফল, আর পাশাপাশি সরে গেলে ঘটে স্ট্রাইক স্লিপ তথা ঘর্ষণ বিচ্যুতি। এ ছাড়া আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, ভূমিধস ও খনিতে বিস্ফোরণের কারণে ভূমিকম্প হতে পারে। মাটির নিচে প্রথম যেখানে ফাটল দেখা দেয়, সেটাকে বলা হয় ভূমিকম্পের কেন্দ্র বা হাইপোসেন্টার। আর এর ঠিক ওপরে পৃথিবীপৃষ্ঠের অংশটিকে বলা হয় এপিসেন্টার বা উপকেন্দ্র। অনেক সময় একটি বড় ভূমিকম্প আঘাত হানার পর ছোট আকারের বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প পরপর আঘাত হানতে পারে। বড় আকারের ভূমিকম্পটি মেইনক, আর ছোট আকারের কম্পগুলোকে বলা হয় আফটারশক। পরিণতি মাত্রা ছাড়ানো ভূমিকম্পের আক্রোশের সর্বশেষ শিকার জাপান। সুনামি, বাড়িঘর ধ্বংস, মানুষের মৃত্যু এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় বিপর্যয় তো আছেই, সেই সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে নিউক্লিয় চুল্লির বিস্ফোরণ। শুধু তা-ই নয়, এই ভূমিকম্পের কারণে দেশটির কোস্টলাইন তথা উপকূলীয় রেখাও সরে গেছে বেশ খানিকটা। সেই সঙ্গে সরে গেছে পৃথিবীর অক্ষরেখাও। বিশেষজ্ঞরা জানান, সমুদ্রের নিচে মাটি সরে যাওয়ায় পৃথিবী তার অক্ষরেখা থেকে কমপক্ষে ৮ সেন্টিমিটার সরে গেছে। এর ফলে কমে গেছে দিনের দৈর্ঘ্য। পৃথিবীর নিজ অক্ষের চারপাশের ঘূর্ণনের গতি বেড়ে যাওয়ার কারণেই এমনটা হয়েছে। আর অক্ষরেখার আগের জায়গা থেকে সরে যাওয়াই এই গতি বেড়ে যাওয়ার কারণ। ২০০৪ সালের সুনামিতেও পৃথিবীর অক্ষরেখা প্রায় ৩ ইঞ্চি সরে গিয়েছিল। দিনের দৈর্ঘ্যে পরিবর্তন ঘটে ৬ দশমিক ৮ মাইক্রোসেকেন্ড (১ মাইক্রোসেকেন্ড = ১ সেকেন্ডের ১০ লাখ ভাগের এক ভাগ)। ২০১০ সালে চিলির ভূমিকম্পে পৃথিবীর অক্ষরেখা সরে যায় ৩ ইঞ্চি। তাতে দিনের দৈর্ঘ্য কমেছিল ১ দশমিক ২৬ মাইক্রোসেকেন্ড। ২০১১ সালের ভূমিকম্প ও সুনামিতে জাপানের প্রধান দ্বীপ হনশু সরে গেছে ৮ ফুট। ২০০৪ সালের সুনামিতেও সরে গিয়েছিল কিছু দ্বীপ। সুমাত্রার কয়েকটি দ্বীপ তো ২০ মিটার পর্যন্ত সরে গিয়েছিল! এবার দেখা যাক সম্প্রতি জাপানে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পে সেখানে ভূ-তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও এর আগের পারমাণবিক দুর্ঘটনার বিষয়গুলো কেমন ছিল।

পারমাণবিক চুল্লি-বয়েলিং ওয়াটার রিঅ্যাক্টর সিস্টেম চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক চুল্লিতে আরো একটি বড় ধরনের দুর্যোগ প্রত্যক্ষ করল বিশ্ববাসী। ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর বিস্ফোরিত হলো জাপানের ফুকুশিমার দাইচি নিউক্লিয়ার প্লান্ট। চেরনোবিল দুর্ঘটনার মাত্রা ছিল ৭। আর ফুকুশিমার ৪। নিউক্লিয় চুল্লিতে পরমাণুর ভাঙনের ফলে প্রচুর শক্তি তৈরি হয়। এ উত্তাপে পানি বাষ্পে পরিণত হয়ে টারবাইনের চাকা সচল রাখে। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় ইউরেনিয়াম। উচ্চচাপে বদ্ধ প্রকোষ্ঠে মুদ্রার সমান ইউরেনিয়াম খণ্ড একটির পর একটি রড আকারে সাজানো থাকে। শৃঙ্খল বিক্রিয়া অনিয়ন্ত্রিত হলে অল্পসময়ে নির্গত নিউট্রন ও শক্তির পরিমাণ সীমার বাইরে চলে যায়। পারমাণবিক চুল্লির কাজ হলো, এ বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে রেখে ওই তাপ দিয়ে বাষ্পীয় চাপ তৈরি করে টারবাইন ঘোরানো। তাতেই তৈরি হয় বিদ্যুৎ। এ জন্য ইউরেনিয়াম দণ্ডের ফাঁকে কিছু ক্যাডমিয়াম দণ্ডও বসানো হয়। এগুলো নিউট্রন শোষণ করে বিক্রিয়ার গতি নিয়ন্ত্রণে রাখে। বিক্রিয়ার পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখতে এসব জ্বালানির রড পানিতে ডোবানো থাকে। কিছু ক্ষেত্রে এই শীতলীকরণে ব্যবহৃত হয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও তরল ধাতু। কিন্তু ফুকুশিমার ওই শীতলীকরণ প্রকোষ্ঠ কাজ না করায় অতিরিক্ত তাপে গলে যায় তেজস্ক্রিয় বস্তুর ধারক ও গরম পানির বয়লার। এরপর একযোগে দুটোই বিস্ফোরিত হয়। চুল্লি- বিপর্যয় যুগে যুগে পারমাণবিক চুল্লি একদিকে যেমন শক্তির অবিরাম প্রবাহ নিশ্চিত করেছে, তেমনি সামান্য ভুল ডেকে এনেছে মাত্রা ছাড়া বিপদ। ইতিহাস ঘেঁটে তেমনি কিছু পারমাণবিক দুর্ঘটনার কথা এখানে তুলে ধরা হলো - ইদাহো ফলস, ১৯৬১ : পারমাণবিক শক্তির প্রাথমিক যুগের পরীক্ষামূলক চুল্লি ছিল যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনী পরিচালিত ইদাহো ফলস প্লান্ট। ১৯৬০-এর ডিসেম্বরে টুকটাক সারাইয়ের জন্য কারখানা সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হলো। ১১ দিন পর ১৯৬১ সালের ৩ জানুয়ারি শুরু হলো খুলে দেয়ার প্রস্তুতি। জোরেশোরে চুল্লির মাঝে নিয়ন্ত্রণ রড টেনে তুলতে গিয়ে হঠাৎ প্রয়োজনের চেয়ে বেশি উপরে উঠে গেল। পারমাণবিক ভাঙনে উৎপাদিত অতিরিক্ত নিউট্রন শোষিত হলো প্রয়োজনের তুলনায় কম। মাত্র চার মিলিসেকেন্ডে এত তাপ উৎপন্ন হলো যে পানি ফুটতে লাগল টগবগ করে। উত্তপ্ত পানির শক্তি সম্পর্কে উপস্থিত তিন হতভাগা অপারেটর জানলেন নতুন করে। চোখের সামনে পানির ধাক্কায় উড়ে গেল চুল্লির উপরিভাগ। গরম পানির প্রবাহ দুজনকে মেঝেতে ফেলে দিল। একজন মারা গেলেন তৎক্ষণাৎ, আরেকজন পরে। তৃতীয়জনকে বর্শার মতো বিঁধিয়ে পানির প্রবাহ ঠেসে ধরল ছাদের সঙ্গে। তেজস্ক্রিয়া নয়, পানির অত্যাচারে মারা গেলেন তিনজন। থ্রি মাইল আইল্যান্ড, পেনসিলভ্যানিয়া, ১৯৭৯ যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভ্যানিয়ার তিন মাইল দক্ষিণে সাসকোহানা নদীতে থ্রি মাইল দ্বীপে ছিল তাদের আরেকটি পারমাণবিক চুল্লি। বলা হয়, এ দুর্ঘটনাই যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক শক্তির ইতিহাসে সবচেয়ে বড়। ১৯৭৯ সালের ২৮ মার্চ চুল্লির একটি জরুরি ভাল্ব তথা প্রকোষ্ঠ দুর্ঘটনাবশত খুলে যায়। ফলে চুল্লির শীতলীকারক পদার্থ বেরিয়ে যেতে থাকে। প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব থাকায় সেখানকার কর্মীদের সমস্যাটা বুঝতেই দেরি হয়ে যায়। অন্যান্য পারমাণবিক প্লান্টের কর্মকর্তারা এসে হাত লাগানোর পর পুরো ব্যাপারটা বুঝতে লেগে যায় পাঁচদিন! আশপাশ এলাকায় বিপদসঙ্কেত দেয়া হবে কি না তা নিয়ে কর্তৃপক্ষও পড়ে ঝামেলায়। প্রথমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে জানালেও পরদিন সকালেই সুর বদলে যায়। তড়িঘড়ি করে পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে এক লাখ চল্লিশ হাজার মানুষকে ছাড়তে হয় ঘরবাড়ি। চেরনোবিল, ইউক্রেন, ১৯৮৬ পৃথিবীর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা ইউক্রেনের চেরনোবিল পারমাণবিক চুল্লির বিস্ফোরণ। এর বিপদের মাত্রা ছিল সাতের মধ্যে সাত। চার নম্বর রিয়েক্টরে চালানো একটি পরীক্ষাই ছিল সব নষ্টের গোড়া। জরুরি শীতলীকরণ ব্যবস্থা কাজ করে কি না সেটা জানাই ছিল উদ্দেশ্য। যান্ত্রিক গোলযোগে চুল্লির ভেতরে প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন হয়। চুল্লির কেন্দ্রে তাপমাত্রা বেড়ে যায় বিপজ্জনকভাবে। প্রথম বিস্ফোরণে ভেঙে যায় জ্বালানি ও নিয়ন্ত্রণ রড। দু-তিন সেকেন্ড পর দ্বিতীয় বিস্ফোরণ। ওটা আরো মারাত্মক। চেইন রিয়েকশন দ্রুততর হতে থাকে। ছড়িয়ে পড়ে তেজস্ক্রিয়া এবং চুল্লির তপ্ত উপকরণ। ২৩৭ জনের শরীরে ভয়াবহ সমস্যা দেখা দেয়, তিন মাসে তাঁদের মধ্যে মারা যায় ৩১ জন। এক হাজার মাইল দূরেও লোকজনকে সরে যেতে বলা হয়। চেরনোবিল দুর্ঘটনা হিরোশিমায় ফেলা আণবিক বোমার চেয়ে চারশ গুণ বেশি তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়েছিল। মিহামা নিউক্লিয়ার প্লান্ট, জাপান, ২০০৪ এ বছরের ফুকুশিমা বিপর্যয়ের আগে জাপানে ভয়াবহতার দিক থেকে তালিকায় সবার ওপরে ছিল মিহামা দুর্ঘটনার নাম। টোকিওর ৩২০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত এ প্লান্টে ২০০৪-এর ৯ আগস্ট পাইপ ভেঙে গরম পানি ও বাষ্প ছড়াতে থাকে। কক্ষের তাপমাত্রা উঠে যায় ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। চারজন সেখানেই মারা যান। আহত হন আরো সাতজন। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা থাকার পরও এরকম দুর্ঘটনার কোনো পূর্বাভাস আঁচ করা যায়নি।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ