মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং নির্ভরতা । ড. মুহা: রফিকুল ইসলাম

মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং নির্ভরতা । ড. মুহা: রফিকুল ইসলাম

ক্যারিয়ার গাইডলাইন ডিসেম্বর ২০১৮

প্রিয় বন্ধুরা! আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। আমাদের সামনে বিজয়ের মাস তথা ডিসেম্বর মাস এসে উপস্থিত হলো। দেখতে দেখতে এগারোটি মাস অতিক্রম করে বারোতম মাসে আমরা উপস্থিত হয়েছি। বিগত মাসসমূহের হিসাব করলে তোমরা তোমাদের জীবনে অনেক অর্জন খুঁজে পাবে। আবার খুব ভালো করে চিন্তা করলে দেখবে অনেক কিছু অনর্জিত। বিগত সময়ে প্রিয় কিশোর পত্রিকার যত নিবন্ধ পাঠ করেছ, তখন অনেক কিছু করতে ইচ্ছা হয়েছে এবং করি করি করে পুরো বছর পার হলো কিন্তু করা আর হয়ে ওঠেনি। তবে সময় কিন্তু বসে নেই। যারা যে ক্লাসে অধ্যয়ন করতে তারা আর এক ধাপ সামনে চলে এসেছো বা আসবে। আরো যদি গভীরভাবে ভাবো, দেখবে অনেকের অনেক প্রিয়জন দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন। তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং বুঝতেই পারছো সময় বেড়েছে। আমরা আস্তে আস্তে আমাদের শেষ দিকে গমন করছি।

বন্ধুরা ডিসেম্বর মাস আমাদের জন্য গৌরবের, এ মাসে আমরা স্মৃতিকাতর হই। আমরা তাদেরকে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি এবং দোয়া করি যারা স্বাধীনতার জন্য জীবনদান করেছেন। যাদের এ অসম্ভব ত্যাগের বিনিময়ে দীর্ঘ নয় মাস সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ স্বাধীনতা অর্জন করলো তাদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম।

বন্ধুরা, এ বিজয়ের জন্য সে সকল ব্যক্তিকে অত্যন্ত নির্ভীক হতে হয়েছিলো এবং দেশ বাঁচানোর জন্য দীপ্ত শপথ গ্রহণ করতে হয়েছিলো। সে জন্য তারা সকল বাধা দু’ পায়ে দলে এ দেশকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে, এ স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলা। সে জন্য আমরা কী করতে পারি? কোন কাজ করলে সবধরনের স্বাধীনতা রক্ষা করা যায়, তার চেষ্টা করা।

প্রিয় ভাই-বোনেরা, আমরা আমাদের সাধ্যমত সব কিছু করবো, এর পাশাপাশি মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করব এবং তার ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করবো। এ রহমত এবং নির্ভরতা ছাড়া সফল হওয়া সম্ভব নয়। কথিত আছে, ‘এক বিয়াই সাহেব বললো : বিয়াই আগামীকাল বাজারে যাবো মান্নত পুরা করার জন্য ছাগল ক্রয় করতে। বিয়াই বললেন, তা বিয়াই সাহেব ইনশাআল্লাহ বলেন। তখন বিয়াই বললো : পকেটে টাকা ইনশাআল্লাহ আবার কী জন্য? বিয়াই বাজারে গেলেন। এক সুযোগে চোর পকেট কেটে নিলো। তখন বিয়াই বললেন: পকেটে টাকা থাকলেও ইনশাআল্লাহ বলতে হয়!’ কেননা নিজের কাছে সব কিছু থাকলেও অনেক সময় সফল হওয়া যায় না।

প্রিয় বন্ধুরা, জীবনে সফলতার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি বা আয়োজন থাকলেও মহান আল্লাহর নির্দেশনা ছাড়া কিছুই হয় না। তিনি আল কুরআনের সূরা আর আনআমের ৫৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন-

তাঁরই কাছে আছে অদৃশ্যের চাবি, তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না। জলে-স্থলে যা কিছু আছে সবই তিনি জানেন। তাঁর অজ্ঞাতসারে গাছের একটি পাতাও পড়ে না। মৃত্তিকার অন্ধকার প্রদেশে এমন একটি শস্যকণাও নেই যে সম্পর্কে তিনি অবগত নন। শুষ্ক ও আর্দ্র সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিখিত আছে।

অত্র আয়াতের আলোকে বলা যায় আমাদের সব কিছু ঠিক থাকার পরও আল্লাহ অনুগ্রহ না করলে সফল হওয়া সম্ভব নয়। সফলতা কাকে বলে? এর পরিচয় দেয়া সহজ নয়। নানা জনের কাছে সফলতার রঙ নানা রকম। তবে ইহকাল ও পরকালে যারা সফল হতে চায় তারা নিন্মোক্ত কাজগুলো করতে পারে।

সফল হওয়ার জন্য কয়েকটি বিশেষ কাজ :

মহান আল্লাহ প্রদত্ত এবং নির্দেশিত পথে চলা। ২. তাকওয়াভিত্তিক জীবন যাপন করা ৩. কোন সময় সুদ এবং ঘুষের লেনদেন না করা। ৪. ধৈর্যশীল হওয়া ৫. শত্রুর প্রতিরোধে সতর্ক থাকা। ৬. দীনের পথে অবিচল থাকা ৭. মদ পান, জুয়া খেলা, ধূমপান এবং লটারির মাধ্যমে ভাগ্য গণনা করা থেকে বিরত থাকা। ৮. অধিকতর মন্দ কাজ না করা ৯. মহান আল্লাহর কোন নিদর্শনকে মিথ্যা না বলা ১০. মহান আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা না বলা ১১. জাদু-টোনায় বিশ্বাসী না হওয়া ১২. কোন অবৈধ নারীর আহবানে সাড়া না দেয়া ১৩. সালাত আদায় করা ১৪. সালাতে বিনয় ও নম্রতার নীতি অবলম্বন করা ১৫. বেহুদা কাজ থেকে বিরত থাকা ১৬. গান-বাজনা থেকে বিরত থাকা ১৭. আল্লাহর সাথে শিরক (অংশীদার স্থাপন) না করা। ১৮. নিজের দৃষ্টি অবনত রাখা এবং সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসহ লজ্জাস্থানের সংরক্ষণ করা ১৯. ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য আল্লাহর কাছে তওবা ইসতিগফার করা এবং মাফ চাওয়া ২০. নিকট আত্মীয়ের পাওনা পূরণ এবং গরিব মিসকিনদের দান করা ২১. কৃপণতা পরিহার করা ২২. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির (স্মরণ) করা ২৩. মনকে পূত-পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখা। ২৪. সময় অপচয় না করা ২৫. সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করা ২৬. সবসময় অন্যের কল্যাণ কামনা করা ২৭. মানবসেবা তথা পরোপকার করা।

বন্ধুরা এতো কাজ! পারা যাবে? হ্যাঁ যাবে। একদিনে বা একই বয়সে বা এক সময়ে এসব কাজ করার দরকার হবে না। বরং তোমাদের যার যা প্রয়োজন, তা গ্রহণ করলেই যথেষ্ট। তোমাদের সফলতার জন্য আমাদের আন্তরিক দোয়া ও ভালোবাসা নিরন্তর।

প্রিয় পাঠকবৃন্দ, জীবনে সফলতার জন্য নির্ভরতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা সবাই আমাদের পরিবার, আব্বা অথবা আম্মার ওপর নির্ভর করি। কিন্তু যে শিশু বা কিশোর পিতা-মাতা ছাড়া বেড়ে ওঠে, তার কথা একবার কল্পনা করে দেখ? অথবা যাদের আল্লাহর রহমতে পিতা-মাতা আছেন, যদি না থাকতেন তাহলে কেমন হতো? মনে করো ‘একজন লোক অসহায় হয়ে আরেকজনের কাছে একটু আশ্রয় প্রার্থনা করলো। রাত্রে আশ্রয়দাতা আশ্রিতের সব কিছু কেড়ে নিয়ে তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করলো, তাহলে কেমন আশ্রয় হবে এটা? অর্থাৎ তার আশ্রয়স্থল তাকে ধ্বংস করে ফেললো তাই না? এ জন্য যেখানে সেখানে যার তার নিকট আশ্রয় নেয়া যাবে না। বরং মহান আল্লাহর কাছেই আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। তিনি সূরা নাসের ১-৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘বলুন আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি মানুষের পালনকর্তার কাছে, মানুষের অধিপতির কাছে এবং মানুষের মাবুদের কাছে।’ তিনি সূরা আশ শুরার ৭২ নম্বর আয়াতে আরো বলেন,

মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং নির্ভরতা । ড. মুহা: রফিকুল ইসলামতোমরা তোমাদের রবের কথায় সাড়া দাও সেই দিনটি আসার আগেই আল্লাহর পক্ষ থেকে যাকে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। সেই দিন তোমাদের জন্য কোন আশ্রয়স্থল থাকবে না এবং তোমাদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য চেষ্টাকারীও কেউ থাকবে না।

মহান আল্লাহর প্রতি নির্ভর বা তাওয়াক্কুল করলে সব ব্যাপারে সফলতা পাওয়া এবং সকল কাজ সহজ হয়ে যাওয়া অনিবার্য। মহান আল্লাহর ঘোষণা-

বস্তুত যারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে, সে নিশ্চিত, কেননা আল্লাহ অতি পরাক্রমশালী, সুবিজ্ঞ। (সূরা আনফাল ৪৯) তিনি আরো বলেন : ‘হায়! যে মজলুমরা সবর করেছে এবং যারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে কাজ করছে তারা যদি জানতো (কেমন চমৎকার পরিণাম তাদের জন্য অপেক্ষা করছে)। (সূরা আন নাহল : ৪২) মহান আল্লাহর প্রতি নির্ভরকারীদের আরো নিশ্চয়তা প্রদান করে বলেন: যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে চলবে, আল্লাহ তার জন্য কঠিন অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সৃষ্টি করে দেবেন এবং তাকে ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক প্রদান করবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য তিনি যথেষ্ট। (সূরা আত তালাক আয়াত : ২,৩)

প্রিয় বন্ধুগণ! সফলতার জন্য স্রষ্টার এ নিশ্চিত ওয়াদাসমূহ বৃথা হতে পারে কি? কখনই নয়। তাহলে ব্যর্থতা কেন? এর উত্তর খুব সহজ। ‘মনে করো স্যামসাং কোম্পানির একটি ‘মোবাইল’কে তুমি অ্যাপল কোম্পানির গাইডলাইন দিয়ে অপারেট করলে, তাতে কি মোবাইল চালানো যাবে? অবশ্যই না। কারণ, মোবাইল স্রষ্টা যেভাবে অপারেট করতে বলেছেন, সেভাবে অপারেট করা হয়নি। তাহলে দোষ তার, যে অপারেট করছে। মোবাইলের নয়। যদি মোবাইলটা গাইড অনুযায়ী চালানো হয়, তবেই তা ব্যবহারের উদ্দেশ্য সফল হবে এবং মানুষের উপকারে আসবে। ঠিক তেমনি স্রষ্টা মহান আল্লাহ আমাদের কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন; সে অনুযায়ী চললে সফলতা অনিবার্য। মহান আল্লাহ সূরা ইবরাহিমের এগারো নম্বর আয়াতে বলেছেন, “আর আল্লাহর ওপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিত।” সূরা আলে ইমরানে ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন, “অতঃপর তুমি যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা কর।”

প্রিয় কিশোর বন্ধুরা, আমরা যখন কোন কিছু অর্জন করার জন্য চেষ্টা করি, তখন সর্বপ্রথম কার কাছে যাই? আমাদের ধারণা অনুযায়ী যাকে যোগ্য মনে করি তার কাছে, তাই না? কিন্তু একবারও কি সর্বপ্রথম মহান স্রষ্টার কাছে বলি? না সর্বশেষে বলি? আমরা অধিকাংশ মানুষ আসল রবকে ভুলে নকল রবের কাছে চলে যাই। এটা সম্পূর্ণ অনুচিত। আমাদের এটা ত্যাগ করতে হবে।

তবে যারা প্রথমেই মহান আল্লাহর প্রতি ভরসা করে, তাদের জন্য রাসূল সা: খুব বড় সুসংবাদ শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা যদি আল্লাহ তাআলার ওপর তাওয়াক্কুল তথা ভরসা করার মতো ভরসা করতে তাহলে তিনি তোমাদের ঐরূপ রিজিক দিতেন, যেমনিভাবে পাখিদেরকে দিয়ে থাকেন। পাখিগুলো সকালবেলা বাসা থেকে খালি পেটে বের হয় এবং বিকেলে পেট পূর্ণ করে ফিরে আসে। (তিরমিজি)

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, বছর শেষে সবাই যেমন ব্যবসার হিসাব মিলায়, আমাদেরও হিসাব মিলানো উচিত, ‘কী পরিকল্পনা ছিলো, আর কতটুকু বাস্তবায়ন হলো? তারপর ২০১৯ সালের জন্য একটি সুন্দর পরিকল্পনা গ্রহণ করো যাতে পূর্বের লসগুলো রিকভার করা যায়। পরিশেষে জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে নিজ স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা করবে যাতে দুনিয়া এবং পরকালেও সফল হওয়া যায়। এর সাথে সাথে তোমরা সবসময় নিম্নের দর্শন মেনে চলবে -

‘ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলতেন, “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছেই আত্মসমর্পণ করেছি। আপনার ওপরই ঈমান এনেছি। আপনার ওপরই তাওয়াক্কুল (ভরসা) করেছি। আপনার দিকেই মনোনিবেশ করেছি। আপনার জন্যই তর্ক করেছি। হে আল্লাহ! আপনার সম্মানের মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করছি আর আপনি ছাড়াতো কোনো উপাস্য নেই- যেন আমাকে পথভ্রষ্ট না করেন। আপনি চিরঞ্জীব সত্তা, যিনি মৃত্যুবরণ করেন না। বরং মানুষ ও জিন মৃত্যুবরণ করে।” (বুখারি ও মুসলিম)
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ