মাধবপুর লেক ভ্রমণে

মাধবপুর লেক ভ্রমণে

ভ্রমণ আগস্ট ২০১০

খালেদ আহমদ শিমুল

শ্রীমঙ্গল শহর ছেড়ে যাওয়ার পর পুরোপুরি বোঝা গেল শীত এসেছে। ঠাণ্ডা বাতাসের হিম হিম পুলক অবারিত স্রোতের মতো ছুঁয়ে দিচ্ছিল চোখ, মুখ, হাত, শ্যাম্পু করা চুল। খোলা জিপ ছুটে চলেছে গহিন লাওয়াছড়ার বুক চিরে, গন্তব্য মাধবপুর। যেখানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন মাধবপুর লেক। সকালের মিষ্টি মিষ্টি রোদ কোথাও কোথাও গাছের পাতার চাদোয়া ভেদ করে ফোঁটা ফোঁটা দাগের মত ভেসে আছে কৃষ্ণবর্ণের পিচঢালা রাস্তার ওপর। কোথাও আবার নিরেট কালো, গাছপালার ঘন বুনট ভেদ করে সূর্যালোক ওখানে পৌঁছাতে পারেনি। উঁচু নিচু পথে জিপটি মাঝে-মাঝে দুলোনি খাচ্ছিল। লাওয়াছড়া ছাড়িয়ে ভানুগাছ হয়ে মাধবপুর বাজারে পৌঁছার সামান্য পূর্বে পড়ে মনিপুরী গ্রাম। চলন্ত জিপ থেকে মনিপুরীদের নিপুণ হাতের গড়া সাদা রঙের ছোট ছোট ঘরগুলোর ওপর একপলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিলাম। মাধবপুর বাজার থেকে লেকে যেতে হয় রিকশা করে। তাই আমরা একটি রিকশা নিলাম। দুই পাশে চা-বাগান অনিন্দ্য, সবুজ আর পরিপাটি। মধ্য দিয়ে চলে গেছে হালকা বালুকাময় সাদা রাস্তা। কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। এ পথের বাঁকেই রয়েছে চা-বাগানের ম্যানেজার এবং অ্যাসিট্যান্ট ম্যানেজারের সুদৃশ্য বাংলো। এখান থেকে লেকের দূরত্ব প্রায় ২০০ মিটার। আমাদের রিকশা দুলোনি খেতে খেতে চলেছে সেই পথে। চড়াই-উৎরাই পথের শেষে গন্তব্যস্থলে পৌঁছার পর আমরা নেমে পড়লাম রিকশা থেকে। দূর থেকে তাকালে লেকের স্বচ্ছ-সুন্দর পানি দেখা যায় না। বাঁধের ওপর ওঠার পর মুহূর্তেই উঁচু নিচু পাহাড় উপত্যকার মাঝে ছবির মত সুন্দর মাধবপুর লেক ছুঁয়ে দিল হৃদয়ের গহিনতল। অসংখ্য পাহাড় সারির মাঝে স্ফটিক স্বচ্ছ নীল জল আমাদের দৃষ্টির পরিধি নিয়ে গেল অনেক দূর। শান্ত-স্নিন্ধ দুপুরে পাখপাখালির কিচির-মিচির নীরবতার মাঝে সুরের আল্পনা এঁকে দিচ্ছিল মনের অতলে। সাথে হালকা ফুরফুরে বাতাস, সব মিলিয়ে অপূর্ব। বাঁধের প্রান্ত থেকে লেকের ৭-৮ ফুট অভ্যন্তরে ঢুকে গেছে বাঁশ দিয়ে তৈরি একটি মাচা। এটি তৈরি করা হয়েছে পর্যটকদের বসার জন্য। মাধবপুর চা-বাগানকে পাহাড়ি ঢল থেকে রক্ষার জন্য ১৯৬৫ সালে তৎকালীন বাগান কর্তৃপক্ষ দুই সারি পাহাড়ের মধ্যে বাঁধ তৈরি করেছিলেন। এ বাঁধ তৈরির ফলে অসংখ্য ছোটখাটো পাহাড়ের পাদদেশে পানি জমে সৃষ্টি হয় মনোরম এই লেক। স্থানীয় লোকজন একে বলে থাকেন ‘ড্যাম’। মাধবপুর লেকের দৈর্ঘ্য আনুমানিক আড়াই-তিন কিলোমিটার। লেকের পানিতে নীল নীল আভা ছড়িয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে আছে অসংখ্য নীলপদ্ম। সারা লেকজুড়ে এই নীলপদ্মের রাজত্ব। নীলপদ্মের প্রাচুর্যতার জন্য এই লেকের আরেক নাম ‘লেক অব দ্য লুটাস’ বা পদ্মফুলের লেক। পদ্মফুলেব মাঝে মখমলের মত স্নিগ্ধ সোনালি পুষ্পরেণু। মাধবপুর লেকের দুই পাশের পাহাড়ের সৌন্দর্য দু’রকম। লেকের সৌন্দর্য ভালোভাবে উপভোগ করতে হলে পাহাড় চূড়ায় ওঠতে হয়। বাম দিকের পাহাড়গুলো চা-বাগান এবং ছায়াবৃক্ষ শোভিত। অন্য পাশের পাহাড়গুলো শোভিত ঘনবৃক্ষ ও শন জাতীয় উদ্ভিদে। এই পাহাড়গুলোর উচ্চতা প্রায় ৫০-৬০ ফুট। আমরা লেকের বাম পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। লেকের পাড়ে পাড়ে পাহাড় পাদদেশের মাটি কেটে তৈরি করা হয়েছে সুদৃশ্য ট্রেইল যা এগিয়ে গেছে লেকের কিনারা ছুঁয়ে ছুঁয়ে। আমরা কয়েকজন পর্যটককে সাথে নিয়ে আসা বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে দেখলাম। লেকের পাড়ে আছে বাঁশ ও শন দিয়ে তৈরি সুদৃশ্য ছাউনি। পর্যটকরা ছাউনিতে বিশ্রাম নিয়ে থাকেন। লেকের কিনারা ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনেকক্ষণ বেড়ানোর পর আমরা পাশে পাহাড়ে ওঠার জন্য ঘন চা গাছের ফাঁক-ফোকরের ট্রেইল দিয়ে চূড়ায় উঠে গেলাম। পাহাড়চূড়া থেকে মাধবপুর লেকের মাধুর্য আরো অনন্য ও দৃষ্টিনন্দন হয়ে চোখে ধরা দিল। সময় গড়িয়ে কখন যে বিকেল হতে চললো বুঝতেই পারিনি। এবার ফেরার পালা। পাহাড় থেকে নিচে নেমে এসে তারপর ফিরতি পথে চলা শুরু করলাম অপরূপা মাধবপুর লেক পেছনে ফেলে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ