মিতুর জ্যোৎস্না রাত

মিতুর জ্যোৎস্না রাত

গল্প সেপ্টেম্বর ২০১০

আবদুল্লাহ আল হোসাইন গভীর রাত, এখন আর কেউ জেগে নেই, সকলে গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। চারদিকে কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না, মাঝে মাঝে দুই-একটা কোকিলের ডাক ছাড়া। মানুষের কোলাহল বন্ধ হয়ে গেছে আরো অনেক আগেই। প্রচণ্ড গরম। বিদ্যুৎ না থাকায় রুমটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন। মশাও বেশ রেগে আছে, যেন তাদের কোন দাবি-দাওয়া মেনে নেয়া হয়নি। মিতু দরজা খুলে আকাশের দিগন্তে তাকালো। আকাশের দিগন্তে চাঁদের আলোকচ্ছটা তার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিলো। ছোটবেলা (যখন তার বয়স ৪-৫ বছর) একবার হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে ভীষণ কান্না শুরু করে দিলো, তাকে নিয়ে জ্যোৎস্নার আলোতে ঘুরতে। তখন সকলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বিভিন্ন দোয়া-কালাম পড়তে লাগলো। তারপরও কোন কাজ হলো না। অবশেষে তার বাবা তাকে নিয়ে জ্যোৎস্নার আলোতে বের হলেন। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর কবরস্থানের নিকট দিয়ে অতিক্রমকালে একটি কালো কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে ভীষণ ভয় পেয়েছিলো। সেই রাতের ভয়ে তার অনেকদিন যাবৎ অসুস্থতায় ভুগতে হয়েছিলো। তারপর থেকে তার মা কখনো তাকে একাকী বাইরে যেতে দেননি। আজ মা-বাবা থেকে অনেক দূরে, কতদিন কেটে গেলো একটিবারের জন্যও বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ মেলেনি। প্রতিবার বাড়ি থেকে আসার সময় মা বারবার বলে দেন চিঠি লিখতে। অন্তত এক মাস পর একবার আসতে বলেন। এবার বাড়ি থেকে আসার সময় মা মিতুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তারপর তার পিছু পিছু অনেক দূরে চলে আসলেন। মিতু অনেক দূরে গিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, মা একটি বাড়ির কোণে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। এই যে দাঁড়িয়ে আছেন যতক্ষণ না সে চোখের আড়াল হবে ততক্ষণ যাবৎ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন। অনেক দূর থেকেও মায়ের হলুদ শাড়িটা দেখা যাচ্ছিল। সাথে ছোট ভাই অনু ছিলো। মিতু তাকে বললো, মাকে নিয়ে বাড়িতে চলে যা। সে বললো, ভাইয়া আপনি বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর মা কয়েকদিন কারো সাথে কথাবার্তা বলেন না। এমনকি ঠিকমত খাওয়া-দাওয়াও করেন না। সারাক্ষণ শুধু একাকী থাকেন। এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে মিতুর চোয়ালদ্বয় বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো, সে বুঝতেই পারেনি। ঐ রাতে সে আর ঘুমুতে পারলো না। পরদিন বিকেল বেলা বন্ধুদের সাথে নদীর পার গিয়েছিলো ঘুরতে। তারা সকলে নদীর তীরে সবুজে সমারোহ একটি জায়গায় বসে গল্পট করছিলো। ঋতুরাজ বসন্ত, চারদিকে গাছপালাগুলো নতুন সাজে সজ্জিত। বসন্তের একটি আকর্ষণ কোকিল এসে সবাইকে তার আগমনবার্তা জানিয়ে দেয়। দীপ্তিমান প্রকৃতি চতুর্দিকে তার সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিয়েছে। আকাশের নীল আভা প্রকৃতির সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। দূর আকাশে মাঝে মাঝে দুই-একটা চিল উড়তে দেখা যাচ্ছে। এমন পরিবেশে কথা বলার ইমেজই আলাদা। কিছুক্ষণ পর দিনের শেষ বেলায় সূর্যটা আঁচল দিয়ে মুখখানি ঢেকে নিলো। আর চতুর্দশী চাঁদটা আকাশের দিগন্তে উঁকি দিয়ে হাসতে লাগলো। মিতুর ছোটবেলা থেকেই জ্যোৎস্নার আলো দেখার অভ্যাস। এখনো তার জ্যোৎস্না দেখার সাধ একটুও হ্রাস পায়নি। ছোটবেলা বাবার সাথে কত বার জ্যোৎস্না দেখেছে। অনেকদিন পর আজ হঠাৎ জ্যোৎস্না দেখার সাধ জাগলো। বন্ধুদেরকে বললো, কেউ রাজি হলো না। পরিশেষে একাকী জ্যোৎস্না দেখার মনস্থ করলো। মানুষের কোলাহলের মাঝে মজা লাগবে না। তাই রাত ১টার পর মেস থেকে বের হলো, তখনো মাঝে মাঝে দুই-একজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছিলো। সে যেই মেসে থাকে সেই মহল্লাটা ঘনঘন বাড়িঘরের কারণে পরিবেশটা তত শান্ত নয়। শান্ত পরিবেশে জ্যোৎস্না দেখার মজাই অন্যরকম। তাই সে এই মহল্লা উপেক্ষা করে সামনের মহল্লায় চলে গেলো। ঐ মহল্লাটা তার মহল্লা অপেক্ষা অনেক শান্ত। কিছু দূর পর পর একটি বাড়ি। লোকজনের চলাচলও সেদিকটায় অনেক কম। এখন রাত ২টা। চারদিকে মানুষের কোন আনাগোনা নেই। মনে হয় অনেক আগেই লোকজন ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন আর কেউ জেগে নেই। মিতু রাতের নিস্তব্ধতায় জ্যোৎস্নার সাথে হারিয়ে গেলো। আরো কিছুক্ষণ সামনে অগ্রসর হওয়ার পর জনশূন্য রাস্তাটায় একাকী চলতে গিয়ে তার হৃদয়ে একটা ভয়ের উদ্রেক হলো। তারপরও সে নির্ভীক চিত্তে সামনে অগ্রসর হতে লাগলো। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলো, একটি চিপা গলির তিন রাস্তার মোড়ে পাঁচটা কালো কুকুর বসে আছে। আর একটি কুকুর দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ্য করে চুপিসারে কী যেন বলছে। মিতু ভয়ে ভয়ে সামনে অগ্রসর হলো। তাকে দেখে কুকুরগুলো তাদের কথা বন্ধ করে তার প্রতি তীè দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মিতু ছোটবেলা শুনেছিলো কুকুররা নাকি জ্যোৎস্না রাতের আলোকচ্ছটায় আনন্দে মেতে ওঠে। তাই সে কৌতূহলবশত কুকুরগুলোকে জিজ্ঞেস করলো, জ্যোৎস্না রাতে তোমাদের কেমন আনন্দ হচ্ছে? হঠাৎ এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে কুকুরগুলো কড়া দৃষ্টিতে তার প্রতি তাকালো। পরক্ষণে মিতু দেখতে পেল কুকুরগুলোর লেজ একেবারে সোজা হয়ে গেছে। ছোটবেলা তার দাদীর মুখে বলতে শুনেছিলো, কুকুররা যখন ভীষণ রেগে যায় তখন তাদের লেজ একেবারে সোজা হয়ে যায়। তাই আর কথা না বাড়িয়ে কুকুরগুলোকে পশ্চাতে ফেলে সামনে অগ্রসর হলো। কিছু দূর সামনে গিয়ে পেছন ফিরে দেখলো, কুকুরগুলো জড়ো হয়ে তার প্রতি ক্ষিপ্ত নজরে তাকিয়ে আছে। এমন সময় বিকট শব্দ করে কুকুরগুলোর পেছনের গলি দিয়ে চলে যাচ্ছিল। তখন একটি উঁচু শরীরবিশিষ্ট লোক কালো পোশাক পরিহিত অবস্থায় কুকুরগুলোর দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। লোকটার মাথার উপরিভাগ দেখা যাচ্ছিল না। চেহারাটা অনেক বড় আর এমন বিকৃত দেখা যাচ্ছিলো, যাকে মানুষ বলা যায় না। তখন অদৃশ্য থেকে কে যেন মিতুকে বলছিলো, তোমার জন্য এখন দাঁড়িয়ে থাকা কল্যাণকর নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালাও। এ যাবৎ মিতু যেন স্বপ্নের রাজ্যে ছিলো, হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে আর পেছন ফিরে তাকালো না। দৌড়ে ঐ গলিটি অতিক্রম করে একটা ফুটপাথে গিয়ে উঠলো। সেখানে ২ জন লোক বস্তা গায়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছিলো। মিতু হাঁফাতে হাঁফাতে তাদেরকে বললো, ভাই আপনাদের কাছে এক গ্লাস পানি হবে? একজন ঝাঁজালো কণ্ঠে উত্তর দিলো, দেখতাছ না এইখানে পানি আইব কইত্তাইক্কা। দ্বিতীয়জন উত্তর দিলো, ঐ দোকানটার পাছে একটা যাঁতাকল আছে। এতক্ষণে মিতু বমি করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। সকাল বেলা জ্ঞান ফিরে পেয়ে হাসপাতালে গেলো ভর্তি হতে। সেখানে গিয়ে টিকেট কাউন্টারে বললো, ভাই আমি ভীষণ অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি হতে চাই। টিকেট মাস্টার দৌড়ে গিয়ে একজন ডাক্তার নিয়ে আসলেন। ডাক্তার এসে রোগের কথা জিজ্ঞেস করলে মিতু বললো, গতকাল রাতে জ্যোৎস্না দেখতে গিয়ে ভূত দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছি, যার কারণে এখনো পর্যন্ত ... এ কথা বলেই মিতু জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। তারপর ডাক্তার সাহেব তড়িঘড়ি করে ভর্তি করালেন হাসপাতালে। সেখানে এক মাস যাবৎ ডাক্তারদের সেবায় সুস্থ হয়ে মিতু বাড়ি ফিরলো।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ