মিতুর স্বাধীনতা

মিতুর স্বাধীনতা

তোমাদের গল্প মার্চ ২০১৫

সাবিকুন্নাহার জেরিন#

বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে হিমেল। পড়াশোনাতে যেমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী তেমনি উদ্ভট সব কান্ড কারখানাতেও সর্বাগ্রে। হবে না কেন! বাবার অঢেল টাকা-পয়সা আর পূর্ণ স্বাধীনতার মধ্যে বড় হয়েছে সে। এ অবাধ স্বাধীনতাই ওকে অনেক সময় ‘খতরনাক’ পরিস্থিতিতে ফেলে বলে মনে করেন অনেকেই। তারপরও ওর বাবা ওকে কোন সময় শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেন না । তিনি মনে করেন প্রত্যেক শিশুকে তার নিজের মত করে বেড়ে উঠতে দেয়া উচিত। তাতে শিশুর মেধা বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে না। তাঁর দর্শন অনুযায়ী হিমেলকেও সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। অর্থনৈতিক ব্যাপারে যেন বাবার দ্বারস্থ হতে না হয় সে জন্য নিজের প্রপার্টির এক অংশের মালিকানা হিমেলকে করে দিয়েছেন। হিমেলই এ অংশের সর্বেসর্বা। ওর কর্মকান্ডের কোন জবাবদিহিতা নেন না ওর বাবা। যতো সমস্যা হয়েছে ওর মাকে নিয়ে। সময় মত গোসল, খাওয়া, ঘুমসহ সব আনুষঙ্গিক কাজে ওর মা ওকে কড়া নজরদারিতে রাখেন। কিছুতেই অনিয়ম করা চলবে না। কোন ব্যাপারে পান থেকে চুন খসলেই সেরেছে! নানা উপদেশের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে হিমেল। একদিকে পূর্ণ স্বাধীনতা, অপরদিকে কড়া নজরদারি। এর মাঝখানে পড়ে হিমেল সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে, কোনটা ভালো ওর জন্য। আপাতদৃষ্টিতে বাবাকে স্বর্গ আর মাকে বিরক্তিকর মনে হয়। এ বিরক্তি কোন কোন সময় রাগারাগির পর্যায়ে পৌঁছায়। একবার তো ঘটে গিয়েছিল বিশাল এক ঘটনা। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মায়ের ওপর অভিমান। ওর মা যতোই বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, ক্ষুধা লেগেছে খাওয়া-দাওয়া করলেই সব রাগ ভালো হয়ে যাবে; ততোই ওর টেম্পারেচার বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে হিমেল। আত্মীয়-স্বজনেরা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল যে, ‘তুমি বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে, অথচ তুমি বাড়ি না থাকলে তাদেরই বা কেমন লাগবে।’ কিছুতেই কোন কাজ হলো না। হিমেল ওর সিদ্ধান্তে অটল। তবে ওর বাবা এ ব্যাপারে কিছুই বলেন না। শেষ পর্যন্ত হিমেলের জিদই বহাল থাকল। নতুন বছরের শুরু থেকে ও চলে এলো হোস্টেলে। এখানে এসে অনুভব করতে পারল মায়ের গুরুত্ব। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। এখন প্রত্যেক কাজ তদারকি করে করানোর কেউ নেই। দৈনন্দিন জীবনের অনেক কাজই বাদ পড়ে যাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়াসহ সকল ব্যাপারে বাড়ির মত সুবিধা তো আর এখানে পাওয়া যায় না। তারপর আবার এই প্রথম বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও স্থায়ীভাবে থাকা। বাড়ির সকলের জন্য অন্তরটা ফেটে যায়। বিশেষ করে মায়ের কথা মনে হলে আর স্থির থাকতে পারে না। কতবার যে লোক-চক্ষুর অন্তরালে কেঁদেছে তার কোন অন্ত নেই। এদিকে ওর মায়েরও একই অবস্থা। নাড়ি ছেঁড়া ধনের জন্য কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছেন। কয়েক দিন পর পরই বাবা-মা এসে দেখে যান তাকে। বিদায় বেলায় মা-ছেলের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। কিন্তু বাবা! হাসি মুখে হিমেলের পিঠ চাপড়ে বিদায় নেন। তবে কিছু দূর গিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করেন। পেছনে দাঁড়িয়ে চেয়ে চেয়ে দেখে হিমেল। আবারও বুকের মাঝে কী যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। তবুও আবেগের কাছে পরাজিত হয় না সে। কিছু দিন পর আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে আসে। হিমেলের সেই পুরাতন অভ্যাস ফিরে এসেছে, রাত জেগে বিভিন্ন বই পড়া। এখানে তো আর বাদসাধার কেউ নেই। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর জন্য কেউ পীড়াপীড়ি করে না। নাওয়া, খাওয়া সব ভুলে ইচ্ছা স্বাধীন মতো লেগে থাকে বইয়ের পোকা। এতে অবশ্য বাহ্যিকভাবে কিছু সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে ওকে। কারণ মৌলিক বিষয়গুলো পাগলের মতো পড়তে গিয়ে ক্লাসের পড়ায় অমনোযোগী হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন ক্লাসে শিক্ষকদের কাছে বকা শুনতে হয়। সহপাঠীদের সামনে অপমানিত হতে হয়। ক্লাস টেস্টে মার্ক কম পায়। এ ধরনের বিভিন্ন বিড়ম্বনা দেখা দেয়। তারপরও হিমেল কিন্তু একটুও বিচলিত হয় না। এ ধরনের উদ্ভট কান্ডকারখানার কারণে অনেকেই ওকে অপ্রকৃতিস্থ মনে করে। গড়ে ওঠে না কোন বন্ধু। খেলাধুলার যোগ্যতাও শূন্যের কোটায়। বন্ধুরা যখন আড্ডা মারে বা খেলে হিমেল তখন কোন বিষয়ে পড়ে বা লেখে। তাতে অবশ্য বিরূপ প্রতিক্রিয়াও পড়ে সহপাঠীদের মাঝে। সবাই ভাবে হিমেল একটা গবেট ছাত্র। সারাদিন পড়ে কিন্তু কিছু পারে না। অথচ হিমেল ক্লাসের পড়ার জন্য কোন সময় বরাদ্দ রাখেনি। কারণ এক এক সময় ওর মাথায় এক এক অদ্ভুত চিন্তা ঘোরপাক খায়। একবার হয়েছে কী! কোথাকার কোন বইয়ে পড়েছে, আগের যুগের মণি-ঋষিরা মহা চেতন অবস্থায় একে অপরের সাথে বায়বীয় মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করত। তারা ইচ্ছা করলে যে কারো মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারত। এর পর থেকে ওর মাথায় ‘মহাচেতন’ ভূত উঠেছে। একেতো নাচুনে বুড়ি তার ওপর ঢোলের বাড়ি। এই ‘মহাচেতন’ ভূতের ঢোলের বাড়িতে হিমেল এ কয়দিনে মনোবিজ্ঞান থেকে শুরু করে আধ্যাত্মিক জগতের মোটা মোটা বই পড়ে শেষ করে ফেলেছে। আজ আবার ঘটেছে আর এক কান্ড! পদার্থবিজ্ঞান ক্লাসে স্যার ‘সভ্যতা বিকাশে বিজ্ঞানের ভূমিকা’ শীর্ষক ঢোল পেটাতে গিয়ে একপর্যায়ে কল্পবিজ্ঞানের জগতে প্রবেশ করেন। আর সেখানেই হয়েছে বিপত্তি। অনেক বিষয় আছে যেগুলো কল্পবিজ্ঞান থেকে বাস্তব বিজ্ঞানে প্রবেশ করেছে, যেমন: আকাশে ওড়া। বর্তমানে মাইন্ড টু মাইন্ড কমিউনিকেশন, ইলেকট্রিক ম্যাগনেটিক ওয়েভ এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি টপিক্সগুলোর জয়-জয়কার। এসব উৎসাহদায়ক বাণী শুনে হিমেলের নাওয়া খাওয়া তো প্রায় বন্ধের দশা। আগের বইগুলোর সাথে এবার যুক্ত হয়েছে, সাইন্স ফিকশন, পদার্থ আর গণিতের সব মজার মজার বই। চলছে অধ্যয়ন আর এক্সপেরিমেন্ট। সারাদিন রুমের মধ্যে কী করে না করে তা বাহিরের মানুষের জানা দুষ্কর। বাহিরের সম্বন্ধে খোঁজ খবরও তেমন একটা রাখেন না। পারিবারিক সূত্রে দেশ-বিদেশের কিছু উচ্চপর্যায়ে ব্যক্তিদের সাথে পরিচয় আছে, তাদের কাছ থেকেই ওর গবেষণার সরঞ্জামগুলো সংগ্রহ করে। যে কোনো সমস্যায় পড়লে বা কোনো অবোধ্য বিষয় সমাধান করতে তাদের কাছেই ধরনা দিতে হয়। কয়েকদিন আগেও একটা পাগলামি করে বসেছিল হিমেল। কোথা থেকে কী পড়ে, ভর দুপুরে ছাদে সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর চোখে অন্ধকার দেখতে থাকে, তার পর মাথার মধ্যে অসংখ্য ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকা শুরু হয়। আরো কিছুক্ষণ পর ধপাস করে পড়ল কংক্রিটের ওপর, মাথার এক পাশ থেঁতলে গেল। ভাগ্য ভালো নিচে পড়েনি। জ্ঞান ফিরল সন্ধ্যার দিকে। মাথার থেঁতলে যাওয়া জায়গাটা চিন চিন করছে। এভাবে অনেকক্ষণ পড়ে থাকার পর আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল। আরও কিছুক্ষণ পর চলে এলো রুমে। এবার আবার শুরু হলো নতুন গবেষণা। সূর্যের দিকে তাকানোর পর সব অন্ধকার হয়ে এলো কেন? কেন মাথার মধ্যে উলট-পালট হয়ে গেল? এবার রসায়ন আর চিকিৎসা বিজ্ঞানও বাদ রাখল না। তারপরও ওর সমস্যার সমাধান হলো না। বড়দের সহযোগিতা নিয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় আর মেডিক্যাল কলেজে হানা দিলো। এরপরও সন্তোষজনক কোন উত্তর পাওয়া গেল না। দেশের বাহিরের বড় ভাইদের সাথে আলোচনা করল। নাহ ! কিছুতেই হিসাব মিলছে না। এভাবে অনুসন্ধান চলতেই থাকল। কিছুদিনের মাথাই সে নিজেই একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। সূর্যের আলোকরশ্মির সাথে এমন কোনো রশ্মি ছিলো যা চোখের রেটিনার সহ্যক্ষমতা থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। যা লেন্সের ওপর পড়ার সাথে সাথে চোখের কার্যক্ষমতা সাময়িকভাবে অকেজো হয়ে গিয়েছিল। আর চোখের সাথে মাথার সম্পর্ক খুব কাছের, তাই মাথার মধ্যেও চক্কর দিয়ে উঠেছিল। কিন্তু এ কোন রশ্মি, যার প্রভাবে এমন হলো? এর নাম, কাজ, ধর্মই বা কী? নানা চিন্তা ওর মাথায় দানা বাঁধে। বিভিন্ন বই ঘাঁটাঘাঁটি করে শেষ পর্যন্ত ওর সকল প্রশ্নের সমাধান মিললো। সূর্যের সবচেয়ে ক্ষতিকর রশ্মি, ‘আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি’, এর সাথে বিশেষ আলোকরশ্মির সংমিশ্রণে নতুন এক রশ্মি উৎপন্ন হয়। যা রেটিনার মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে মস্তিষ্কের সেলগুলো পুনঃবিন্যাস করতে সক্ষম। বাহ মজার একটা জিনিস! হিমেলের আনন্দ আর দেখে কে। তবে সমস্যা হলো, হঠাৎ হঠাৎ এ রশ্মি উৎপন্ন হয়। পরিকল্পিতভাবে এ রশ্মি উৎপাদনের উপায়? অবশেষে এরও সমাধান মিললো। সবচেয়ে ভারি মৌল ‘ইউরেনিয়াম’, সবচেয়ে পরিবর্তনশীল মৌল ‘ফ্রান্সিয়াম’ আর সবচেয়ে তেজষ্ক্রিয় মৌল ‘পোলোনিয়াম’, এদের পরিবর্তিত গঠনের সংমিশ্রণে এক ধরনের সঙ্কর ধাতু তৈরি করা সম্ভব। এ সঙ্কর ধাতুর ওপর ‘ইলেকট্রিক ম্যাগনেটিক ওয়েভ’ ও ‘লেজার রে’ এর বিশেষ কারসাজির মাধ্যমে এমন একটি সেন্সর ডিভাইস তৈরি করা সম্ভব, যার ওপর সূর্যের আলো পড়লে অজানা সেই আলোকরশ্মি উৎপন্ন হবে। আর এ আলোকরশ্মির সাথে ‘আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি’ এর সংমিশ্রণে নতুন সেই রশ্মি উৎপন্ন হয়। হিমেল এর নাম দিয়েছে ‘ডেল্টা রশ্মি’, কারণ এ রশ্মি আলফা, বিটা ও গামা রশ্মি থেকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম। ডেল্টা রশ্মি কারো চোখের ওপর নিয়ন্ত্রিতভাবে ফেলে তার মস্তিষ্কের সেলগুলো প্রয়োজন অনুসারে পুনঃবিন্যাস করা যাবে। এই পুনঃবিন্যস্ত মস্তিষ্ক থেকে ডেল্টা রশ্মি অন্য কারো চোখের রেটিনায় ফেলে ঐ ব্যক্তির মস্তিষ্কের সেলগুলো পুনঃবিন্যাস করে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবে। এ প্রক্রিয়া ইচ্ছা অনুযায়ী স্থায়ী বা অস্থায়ী করা যাবে। তবে পুরো প্রক্রিয়া হতে হবে নির্ভুল ভাবে। সামান্য অসতর্কতার কারণে মস্তিষ্ক ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে। এবার তত্ত্বগুলো বাস্তবে রূপ দেয়ার পালা। সমস্যা হলো, উপাদানগুলো পাওয়া দুষ্কর। অনেকদিন ধরে চেষ্টা করে, দেশের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক কে সাথে নিয়ে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের নামকরা সব গবেষণাগার থেকে উপাদানগুলো সংগ্রহ করল। এসব সংগ্রহের ক্ষেত্রে হিমেলের পারিবারিক পরিচিতিই বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে তৈরি করে ফেললো সেই কাক্সিক্ষত সেন্সর ডিভাইস। এটা খুব হালকা, স্বচ্ছ ও নমনীয় প্লাস্টিকের মত। ক্ষতিকর না হলে চোখের লেন্সের ওপর বসানো যেতে পারে। যে কথা সেই কাজ। ঐদিনই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করল হিমেল। তাদের সাথে ল্যাব থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হলো, এটা তেমন ক্ষতিকর না। কয়েকদিনের মধ্যে সার্জারি করে চোখে বসিয়ে ফেললো ডিভাইসটি। এর পর থেকে হিমেল চোখে ‘আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি’ প্রতিরোধকারী চশমা ব্যবহার করা শুরু করল। চশমা ছাড়া সূর্যের আলোতে গিয়ে কোড অনুযায়ী চোখের পাতা ওঠানামা করে ডিভাইসটি চালু, বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আবার অতিরিক্ত ডেল্টা রশ্মি ডিভাইসে সংরক্ষণ করা যাবে। তবে এ রশ্মি প্রয়োগের ক্ষেত্রে চশমা, আলো কিংবা অন্ধকার কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। শেষ মুহূর্তে এসে হিমেল পড়ল বিপদে। ব্যাপারটা ওদের চারজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ; হিমেল, মেডিক্যাল কলেজের একজন, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন এবং দেশের বাইরের একজন গবেষক। কন্ট্রোলারের রিস্ক হিমেল নিয়েছে, কিন্তু কার ওপর প্রয়োগ করবে? কেউ রাজি হচ্ছে না। কেউ রিস্ক নিতে রাজি না। হিমেল এত দিন ঝোঁকের বসে দুনিয়ার সব কিছু পরিত্যাগ করে এ কাজের পেছনে ছুটেছে। কিন্তু কেন করছে? তার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। এখন চিন্তা করছে এত কিছু করে কী লাভ হলো। শুধু অনুসন্ধিৎসা নিয়ে অযথা কেন এত কিছু করতে গেল! চিন্তাভাবনা করতে করতে মাথায় নতুন একটা আইডিয়া এলো। পৃথিবীতে এক সাম্রাজ্যের পতন হয়, আবার আরেক সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। এভাবে উত্থান-পতন আদিকাল থেকে চলে আসছে। কী কী কারণে একটা প্রতিষ্ঠিত জাতির পতন হয়, আর কী কী গুণের কারণে একটি জাতির উত্থান হয়, তা যদি জানা যায় তাহলে ক্ষুদ্রপরিসরে উত্থান-পতনের কারণগুলো প্রয়োগ করে নতুন ডিভাইজের মাধ্যমে মানুষের অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া জানা যাবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের উন্নতির চরম শিখড়ে পৌঁছানো সম্ভব হবে। প্রথমে বিভিন্ন সভ্যতার পতনের কারণগুলো অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেল, নারীঘটিত ব্যাপারটি অন্যতম। শাসকরা যখন নারী, নেশা ও আর অর্থের মোহে পড়ে যায় তখন তাদের পতন ঘনিয়ে আসে। হিমেল সিদ্ধান্ত নিলো এ ধাপ থেকেই কাজ শুরু করবে। কিন্তু কার ওপরে এ প্রক্রিয়া প্রয়োগ করবে? এ জন্য দরকার বুদ্ধিমান ও চৌকস কাউকে। খুঁজতে খুঁজতে ওরই সহপাঠীদের কয়েকজনকে পেয়ে গেল। যাদের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে, তাদেরকে উপযুক্ত ব্যক্তি বলে মনে হলো। চূড়ান্তভাবে ভেবে নিয়ে ঠিক করল মনিকার ওপর প্রথম এক্সপেরিমেন্ট চালাবে। সমস্যা হলো, বন্ধুদের সাথে তেমন একটা ফ্রি হতে পারেনি হিমেল, বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে। আর এ ব্যাপারটা কারো সাথে শেয়ার করলে তো সে ভাববে, হিমেল পাগলা গারদ থেকে ছুটে এসেছে। তবে সরাসরি না হলেও মনিকাকে সব বিষয় মেসেজের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে বলার চেষ্টা করেছে হিমেল। এতে আবার আরেক বিড়ম্বনা শুরু হলো। মনিকা ভাবল, হিমেল অন্য কারো সাথে প্রয়োজন ছাড়া তেমন একটা কথা বলে না। হঠাৎ করে ওর পেছনে লাগল কেন? তাতে আবার আজব সব কথাবার্তা! এ নিয়ে মনিকা হিমেলের অগোচরে বন্ধুদের সাথে হাসাহাসি করে। তারপরও হিমেল সত্য কথাগুলো বিভিন্ন ভাবে সব বন্ধুকে জানাল। কারণ পরবর্তীতে যাতে কেউ ওকে প্রতারক না বলতে পারে। যদিও ওরা বিষয়টি অন্য দৃষ্টিতে দেখল। দিন গড়াচ্ছে আর ধীরে ধীরে হিমেলের প্রজেক্টও এগোচ্ছে। মেসেজে বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করে আর সাক্ষাতে আই কন্টাকের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জেনে নেয়। এভাবে প্রায় পাঁচ মাস এক্সপেরিমেন্ট চালানোর পর পর্যবেক্ষণ ভান্ডারে বড় একটা অঙ্ক দাঁড়ালো। এদিকে হিমেল ও মনিকাকে নিয়ে বন্ধুদের মাঝে একটা ভুল ধারণা এসে যায়। মনিকাও সে সুযোগটা সৎ ব্যবহার করতে চায়। তাই হিমেল আর দেরি না করে চূড়ান্ত এক্সপেরিমেন্টের দিকে এগোয়। সব বন্ধুর সাথে বসে, নিজেকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করে এবং সকলের সাথে আইকন্টাকের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জেনে নেয়। এর পরবর্তী কিছুদিন দুনিয়ার সব কিছু ছেড়ে বৈরাগ্যের ভেক ধরে হিমেল। এতে কি প্রতিক্রিয়া আসে সব নোট করে রাখে। এক পর্যায়ে হিমেল সমস্ত তত্ত্ব-উপাত্ত একত্রিত করে চূড়ান্ত একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, সফলভাবে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে ঘুণে ধরা সমাজের রোগ ও তার প্রতিকারের উপায়গুলো শনাক্ত করা গেছে। এগুলো সমাজে প্রয়োগ করতে হলে নিজেকে একটা স্টেজে পৌঁছাতে হবে। ইতোমধ্যে কিছু বড় ভুলও করে বসেছে হিমেল। যেমন: বন্ধুদের সব কিছু বলে দেয়া, বিশেষ করে পর্যবেক্ষণের স্বার্থে মনিকার কাছে কোনো কিছু গোপন রাখেনি। তবে শেষের ভুলটা হলো বড়ই মারাত্মক; বিদেশী সেই গবেষক সমস্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞান ম্যাগাজিনে নিজের নামে প্রকাশ করে। তখন এটা নিয়ে সারা বিশ্বে রীতিমত আলোচনার ঝড় বয়ে যায়। বিভিন্ন গবেষণা টিম তার কাছে দলে দলে যেতে থাকে এর ব্যাখ্যা চাইতে। কিন্তু মূল থিওরি হিমেলের কাছে থাকায় এটি বিতর্কিত বিষয় হিসেবেই থেকে যায়। এ দিকে কিছুদিন চশমা ব্যবহার না করায় হিমেলের চোখে ভাইরাস আক্রমণ করে। অনেকদিন চিকিৎসা নেয়ার পরও চোখের কোনো উন্নতি হলো না। শেষমেশ সেন্সর ডিভাইসটি অপসারণ করতে হলো। ডাক্তারের অসাবধানতাবশত ওটা একেবারে অকেজো হয়ে যায়। অনেক দিন অসুস্থ থাকার কারণে পরীক্ষাটাও দিতে পারেনি হিমেল। সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আবার নতুন করে ক্লাস শুরু করে সে। বন্ধুরা এখন ওকে দেখলে দূরে সরে যায়, ভালোভাবে কথা বলে না। হিমেল নিজে থেকে কথা বলতে গেলে ওরা বাঁকা বাঁকা জবাব দেয়। হিমেল কিন্তু মনে মনে হাসে। আর বিদেশী জার্নালগুলোর কাদা ছোড়াছুড়ি দেখে হিমেল আর আবেগ ধরে রাখতে পারে না, উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। বিভিন্ন সময় এসব কথা মনে হলে হঠাৎ হঠাৎ হেসে ওঠে, আশপাশের অপরিচিত লোকগুলো ভাবে ওর মাথায় গন্ডগোল আছে। দশ বছর পরের কথা। হিমেলের নামের আগে পিছে অনেক খেতাব যুক্ত হয়েছে। আর ওর আবিষ্কৃত থিওরির নাম দিয়েছে ‘The Theory of Highperthoughtic Exchange’. পুরাতন বন্ধুদের অনেকেই ওর প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। বিশ্ববাসী এখন ‘The Theory of Highperthoughtic Exchange.’-এর বদৌলতে মাইন্ড টু মাইন্ড কমিউনিকেশন করতে পারে। সুপার কম্পিউটার ছাড়াই বড় বড় সব গাণিতিক হিসাব নিকাশ এবং গবেষণার কাজ নির্বিঘ্নে করে যাচ্ছে। তবে ছোট একটা সেন্সর ডিভাইস ব্যবহার করা হয় চোখের লেন্সের সাথে, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘Highperthoughtic Exchange Device.’ আর এ ডিভাইসের একমাত্র পেটেন্টধারী প্রতিষ্ঠান হলো হিমেল গ্রুপ লিমিটেড। এ হিমেল গ্রুপ হলো, বিশ্বের সমস্ত পরাশক্তির আশ্রয়স্থল। সকল শক্তিধর শাসক হিমেল গ্রুপের কাছে বিভিন্ন খাতে দায়বদ্ধ। কিন্তু হিমেল গ্রুপের একমাত্র স্বত্বাধিকারী আমাদের সেই হিমেল একজন সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ