মিনহাজের অভিযান

মিনহাজের অভিযান

উপন্যাস সেপ্টেম্বর ২০১৩

কাজী মুহাম্মদ সোলাইমান ঘড়ির দিকে আবার তাকাল মিনহাজ। এখন রাত একটা। তারপর সবার দিকে তাকাল। কারো চেহারা দেখা যাচ্ছে না। অথচ তার আশে পাশে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। আশরাফ, সাব্বির, আলম, শিহাব ও মাহবুব। তাতুম মিনহাজকে আবার সর্তক করল, ঘড়ির বাতিও জ্বালানো যাবে না। দু মিনিট পর হাতের পেন্সিল ব্যাটারিটা জ্বালাল তাতুম নিজেই। বাটির উপর পড়ে থাকা স্বর্ণগুলো চিকচিক করে উঠলো। সবগুলো স্বর্ণ আবার নেড়েচেড়ে দেখল সে। তোমরা বসে পড়ো। আদেশ দিলো তাতুম। তারা নিঃশব্দে মাটির শয্যায় বসে পড়লো। মন্ত্র পাঠ শুরু করল তাতুম। তার মন্ত্র পাঠের শব্দ ভেসে আসতে লাগল তাদের কানে। উত্তেজনায় কেঁপে উঠল মিনহাজ। তার বুকের তন্ত্রিগুলো আনন্দে নাচানাচি করছে। ‘‘আর কিছুক্ষণ পর আমরা বিশাল ধনের মালিক হয়ে যাবো। এত অল্প বয়সে লাখপতি! কী বেকুব আমাদের বাবা-মায়েরা। তারা কোন ঝুঁকি নিতে কেন চায়নি, আমি এখনো ভেবে পাচ্ছি না? তারা কি কখনো পড়েনি, ঝুঁকি নাইতো, অর্জন নাই? অন্তত দাদুর তো পড়ার কথা, অথচ তিনিও শুধু বাধা দিয়ে গেছেন।’’ ভাবতে ভাবতে তাতুমের মন্ত্র পাঠ শুনতে লাগলো মিনহাজ। অর্থগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করলো। না, কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। হয়ত সে অন্য কোন ভাষায় মন্ত্র পাঠ করছে। মন্ত্র পাঠ বন্ধ হলে আবার কিছুক্ষণ চুপ থাকলো তাতুম। ‘তোমাদের কেউ নাড়াচাড়া করেছে।’ সে বললো। ‘না তো, আমাদের কেউ নাড়াচাড়া করেনি।’ জবাব দিলো মিনহাজ। ‘অবশ্যই করেছে।’ তার দৃঢ় কণ্ঠ ভেসে আসলো। ‘আমার মন্ত্র পাঠ ব্যর্থ হয়েছে। কত বারই না বললাম, নড়াচড়া সম্পূর্ণ নিষেধ।’ হাতের পেন্সিল ব্যাটারিটা আবার জ্বালাল সে। স্বর্ণগুলো এই মৃদু আলোতে আবার চিক চিক করে উঠলো। ব্যাটারির আলো দিয়ে সবাইকে দেখে নিয়ে আবার কড়া নির্দেশ জারি করলো, ‘একটু ও নড়াচড়া করা যাবে না। আমাকে আবার নতুনভাবে সবকিছু শুরু করতে হচ্ছে।’ মন্ত্র পাঠ শুরু করল সে। আবারো ভাবনার উষ্ণ জগতে নিজেকে সপে দিলো মিনহাজ। বৃহত্তর কোনকিছু পেতে হলে বৃহত্তর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আজ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার দ্বারপ্রান্তে তারা। সবাই যখন এতগুলো স্বর্ণ তার হাতে দেখবে আমাকে নিয়ে কি না নাচানাচি করবে? সবাই আমাকে ডাকবে, সোনালী বালক। তাতুমের ডাক শুনে তার সম্বিত ফিরে আসলো। ‘কে আমার সাথে যাবে?’ ‘আমিই যাব।’ লাফিয়ে উঠলো মিনহাজ। ‘তুমি দারুণ সাহসী, তোমাকে আমার দরকার। বিপদ দেখলে ভয় পাবে না তো?’ ‘কী ধরনের বিপদ?’ জানতে চাইল মিনহাজ। ‘ওরা কি এমনে ছেড়ে দেবে? তারা কখনো বাঘ, কখনো সিংহ, কখনো সাপের রূপ ধরে তোমাকে ভয় দেখাবে। তোমার দায়িত্ব হবে, ভয় না পাওয়া। যদি একটুও ভয় পাও, তবে বিপদ। নিশ্চিত মৃত্যু।’ শুনে সত্যি ভয় পেল মিনহাজ। তার মনোবল ভেঙে গেছে। কারো যদি মনোবল নষ্ট করা যায়, তাকে আর যুদ্ধ করে পরাস্ত করতে হয় না, এমনিতে ভেঙে পড়ে। ভয়ে মিনহাজ যেতে অস্বীকার করলো। তাতুম খুবই হতাশ হল। তার দু’নাকের ছিদ্র দিয়ে বড় নিঃশ্বাস বের হবার শব্দ হল। সবাই সে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল। ‘আর কেউ রাজি আছ?’ আবার জানতে চাইল সে। আশরাফ চুপ। সাব্বির চুপ। আলম চুপ। মাহবুব চুপ। শিহাব ও চুপ। ‘আমাকে একাই যেতে হবে। জানতাম সব কষ্ট আমাকে সহ্য করতে হবে। ’ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সে। এবার নতুন নিদের্শনা জারি করলো। ‘তোমরা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক। সাবধান, হাত মুষ্টিবদ্ধ করাও যাবে না। আমি না আসা পর্যন্ত তোমাদের এভাবে থাকতে হবে। না হলে ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারে। সাবধান! আবার বলছি, সাবধান।’ সবাই মাটিতে শুয়ে পড়লো। তাতুম নতুন করে মন্ত্র পাঠ শুরু করেছে। তার এগিয়ে যাওয়াটা বুঝা যাচ্ছে মন্ত্র পাঠ হতে। শব্দগুলো ক্রমশ দূর হতে দূরবর্তী হচ্ছে। মফিজুর রহমানের ঘুম ভেঙে গেল। দেয়াল হাতড়ে সুইচ চালু করল সে। টেবিলে রাখা জগের দিকে তাকাল। কোন পানি নেই তাতে। পানির খুবই তৃষ্ণা পেয়েছে। মিনহাজের কক্ষের দিকে তাকিয়ে ডাক দিলে, মিনহাজ মিনহাজ... কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবার ডাকল, মিনহাজ... মিনহাজ... কোন সাড়াশব্দ নেই। বিছানা ছেড়ে উঠে মিনহাজের দরজায় টোকা দিল। ... এবারও একই অবস্থা। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, শিকল লাগানো। আতঙ্কিত হয়ে উঠল মফিজুর রহমান। ছেলেটা আজ আবারও বাইরে চলে গেল। ততক্ষণে সেখানে এসে পৌঁছেছে মালেকা। তার পিছনে পিছনে মিনাও। তারা তিনজন টর্চ হাতে বেরিয়ে গেল মিনহাজকে খুঁজে বের করতে। গতবার যখন এ ঘটনা ঘটেছিল, তখন পুরো পাড়া জুড়ে হৈ চৈ পড়ে গিয়ের্ছিল। শেষে তাদের সবাইকে পাওয়া গিয়েছিল মাহবুবদের ঘরে। সেখানে গিয়ে মাহবুবের মাকে ডাকা হল। দেখল মাহবুবও নেই। বাড়ির সবখানে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। কাউকে পাওয়া গেল না। তাদের চেঁচামেচিতে আরো কয়েকজন এসে জড়ো হলো সেখানে। সবখানে খোঁজা হচ্ছে তাদের, কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ভয়ে কেঁদে দিল মিনা। ডাক দিলো, ‘ভাইয়া, ভাইয়া।’ মালেকাও কান্না দমিয়ে রাখতে পারছে না। সন্তানের জন্য তার বুকে শোকের পাথার উপচে পড়ছে। ক্রমশ অনেক লোক এসে জড়ো হলো। সবার হাতে টর্চ। যতই সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, সবার উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ততই বেড়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল পাড়ার অনেকগুলো ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরে ঘরে উঠল কান্নার রোল। সবাই পুকুর, ঝোপজঙ্গল, গাছের শাখায় শাখায় টর্চ মেরে তাদের খুঁজতে লাগল। না, কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আতঙ্কে অনেকে আজান দেয়া শুরু করল। মফিজুর রহমান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত ২টা ৩০ মিনিট। সকাল হবার বাকি এখনো অনেকÑ কয়েকজন মিলে চলে গেল পাশের পাড়ায়। ওখানে একজন তান্ত্রিক থাকে। রফিক। তাকে নিয়ে এল তারা। সে এসে একটা বই খুলল। বইটা হরেক রকম নকশায় ভরপুর। বিচিত্র সব নকশা। এটা তাবিজের কিতাব। রফিক বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে একটা পাতায় থামল। সবার চোখ তার দিকে চেয়ে আছে। সে এক গ্লাস পানি চাইল। মফিজর রহমানের এবার মনে পড়লো, তার গলা শুকনো। পানি পান করা দরকার। পানি আনা হলে মফিজুর রহমান প্রথমে পান করার পর বাকিটা রফিকের দিকে এগিয়ে দিলেন। মন্ত্র পড়ে মাটির উপর একটা নকশা এঁকে তার উপর পানি ছিটিয়ে দিল রফিক। মিনাকে বসাল সে নকশার সামনে। মনে মনে কী যেন পড়ে ফুঁক দিলো মিনার চোখে। মিনার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল। রফিক মিনার কাছে জানতে চাইল, ‘তারা এখন কোথায়?’ মিনা জবাব দিল, ‘তারা সবাই পাড়ার বাইরে একটা মাঠে ঘুমিয়ে আছে। তাদের সামনে বিপদ। এমনকি মৃত্যুর আশঙ্কাও আছে।’ মিনার কথা শুনে সবাই কেঁদে উঠল। রফিক মিনার চোখে আবার পানি ছিটিয়ে দিলে মিনা চোখ খুলল। তৎক্ষণাৎ সবাই উল্লুক ভিটার দিকে দৌড় দিলো তাদের খোঁজে। দুই. মিনহাজ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে, ভাবল মফিজুর রহমান। তাকে খুব বিষণœ দেখাচ্ছে। তার পুরো মুখমণ্ডল ঘন মেঘের কালো চাদরে আবৃত। যেন এক্ষুনি বৃষ্টি হবে। কিছুক্ষণ পর তার দু’চোখ হতে বেরিয়ে আসতে লাগল কান্নার বৃষ্টি। সে বৃষ্টিতে তার কষ্ট মোড়ানো হৃদয়টা হালকা হবার পরিবর্তে আরো মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। উদ্বেগ উত্তেজনার শীতল শিহরণ তার শিরায়-উপশিরায় বয়ে যাচ্ছে। সে দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছে, মিনহাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। ধ্বংসের সবগুলো লক্ষণ ফুটে উঠেছে তার আচরণে। স্কুল পালানো তার কাছে ডাল-ভাত। শিক্ষকদের হাতে অনেকবার মার খেয়েছে সে। তবুও থামেনি। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুটিকে সে সমানে অপচয় করে। যার দাম কোটি টাকার উপরে। তাকে অনেকবার প্রশ্ন করা হয়েছে, ‘তুমি কি পৃথিবীর সবচে’ মূল্যবান বস্তুটি কী জান?’ মিনহাজ এখনো এই উত্তর খুঁজে বের করতে পারেনি। ইশারা ঈঙ্গিতে বস্তুটি তার হাতে তুলে দিতে চেয়েছে মফিজুর রহমান, কিন্তু লাভ হয়নি। পৃথিবীর সবচে’ মূল্যবান বস্তুটি কী, মিনহাজ জানে না, জানতে চায়ও না। এখনো তাকে বুঝালো যায়নি ঐ বস্তুর গুরুত্ব। নাতিকে অনেকবার উপদেশ দিয়েছে সে। তাকে অনেকভাবে বুঝাতে চেয়েছে সে আরাধ্য বস্তুটির কথা, যাকে পৃথিবীর সমস্ত শক্তি দিয়েও ধরে রাখা যায় না। পুরো শক্তিকে দুমড়ে মুচড়ে সে তার চলার পথ করে নেয়। মিনহাজের বন্ধুমহল নিয়ে শিক্ষকেরা ঘোর আপত্তির কথা তাকে জানিয়েছে অনেকবার। ভাবতে ভাবতে ধ্যানমগ্ন হয় মফিজুর রহমান। তাকে ভাবতে হচ্ছে কীভাবে মিনহাজকে সঠিক পথে আনা যায়। ক্রমশ নীরব হয়ে আসছে মফিজুর রহমান। একটা পথ বের করে আনতে হবে এভাবে। পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানের উৎস হলো এই ধ্যান। জ্ঞানের পথ অর্ধেকে থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু ধ্যানের পথ থমকে দাঁড়ায় না। এ ধ্যান হতে নতুন নতুন জ্ঞান বের হয়ে আসে। ভাবনার জগতে মফিজুর রহমান এত বেশি নীরব নিশ্চল হয়ে গেলো যে, যেন বজ্রাহত মৃত ব্যক্তি। ‘ইউরেকা, ইউরেকা। পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি।’ চিৎকার দিলো মফিজুর রহমান। ‘দাদু তোমাকে ডাকছে ভাইয়া।’ মিনা বিছানায় শুয়ে থাকা মিনহাজকে বলল। শুনে মুখ বিকৃত করল মিনহাজ। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে উঠে দাদার কক্ষের দিকে যাত্রা করল। দাদু এক্ষুনি একগাদা উপদেশ দিবেন। এটা তার জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। উপদেশগুলো শুনতে শুনতে তার কান ঝালাপালা। দাদুর কক্ষে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করল, ‘দাদু, ডাকছেন কেন?’ ‘কেন ডাকব আর, একটা মুমূর্ষু লোককে বাঁচানোর জন্য।’ ‘আমি কি মুমূর্ষু?’ আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলো মিনহাজ। ‘মুমূর্ষু নয়তো কী? যে আত্মহত্যার চেষ্টায় লিপ্ত তাকে আর কী বলা যায়? শোন, আকাশ হতে নেমে আসা বিপর্যয় এড়ানো যায়, কিন্তু আত্মসৃষ্ট বিপদ এড়ানোর পন্থাটা কী?’ ‘মানুষ কি বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে?’ নম্র সুরে প্রশ্ন করল মিনহাজ। ‘তুমি এমন একটা প্রশ্ন করলে যাতে স্পষ্ট বুঝা যায়, তুমি কত পিছিয়ে আছ। একজন মানুষের বুদ্ধিমত্তা যাচাইয়ের মাধ্যম হচ্ছে, তার কৃত প্রশ্ন।’ ‘আমি কী বিপর্যয় তৈরি করছি?’ ‘তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না, তোমার বিপর্যয়টা কী? তুমি কি ঠিকমত লেখাপড়া করছ?’ ‘দাদু ঐ সব লেখাপড়া আমাকে দিয়ে হবে না। হাবিব স্যার গতকালও বলেছে, আমার মাথায় নাকি কিছু নাই। একদম খালি।’ ‘ওহ!’ দুঃখের একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল দাদুর বুক থেকে। চোখ দুটো বন্ধ করলেন তিনি। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলা শুরু করলেন, ‘জাতি শিক্ষকদের কাছ থেকে এমন কথা প্রত্যাশা করে না। যে এমন কথা বলতে পারে, নিশ্চয়ই সে শিক্ষক হবার উপযুক্ত না। শিক্ষকতায় আসার পর অন্তত তাদের উচিত ছিল, আইনস্টাইন, বাফুন প্রভৃতি ব্যক্তির জীবনী পড়া। আইনস্টাইন সম্পর্কে শিক্ষকেরা মন্তব্য করেছিল, তার মাথায় গোবর ছাড়া আর কিছুই নাই। তাকে স্কুল হতে বহিষ্কার করেছিল। বিজ্ঞ মাতা সন্তানের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন। তিনি সন্তানের সম্ভাবনাকে বুঝতে পেরেছিলেন। অলস বাফুনের স্মরণ শক্তি ছিল কম। আর্থিক অবস্থা ছিল ভাল। ছিল সাংঘাতিক রকমের অলস। বাফুন সিদ্ধান্ত নিলেন অলসতা তাড়িয়ে দেবেন। ভৃত্য যোশেফকে বললেন, ‘আমাকে উঠিয়ে দিতে পারলে- প্রতিদিন একটাকা পুরস্কার।’ প্রথম দিন যোশেফ তাকে উঠাতে গিয়ে তার কিল ঘুষি খেয়ে আর কাজ করল না। জেগে ওঠার পর বাফুন তাকে তিরস্কার করলেন। দ্বিতীয় দিন বাফুন অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে ঘুম হতে উঠলো না। দুপুরে আবার যোশেফকে তিরস্কার করলেন। তৃতীয় দিন যোশেফ কোন কথা না শুনে বাফুনের বিছানায় পানি ঢেলে দিল। বাফুন উঠে গেলেন। যোশেফ পুরস্কার পেল। সেই বাফুন প্রতিদিন নয় ঘণ্টা করে চল্লিশ বছর পরিশ্রম করেছেন। একদিনও নষ্ট করেননি। অনেকগুলো বই লিখেছেন। প্রতিটি বই কয়েকবার লিখেছেন। এমন কি একটা বই এগার বার পর্যন্ত লিখেছেন।’ ‘যদি তাই হয়, তাহলে আমার সমস্যাটা কী?’ জানতে চাইল মিনহাজ। ‘তুমি।’ জবাব দিলেন দাদু। ‘আমি আমার সমস্যা? কিভাবে?’ ‘কারণ, তুমি তোমাকে চিনতে পারনি।’ দাদু জবাব দিলেন। ‘কী যে বল না দাদু। আমি আমাকে ভাল করেই চিনি। আমি মিনহাজ। আমার বাবার নাম আব্দুল আলিম। মায়ের নাম মালেকা। আমার দাদুর নাম মফিজুর রহমান। দাদীর নাম রায়হানা ও বোনের নাম মীনা।’ দাদু হেসে বললেন, ‘তোমার এ পরিচয় সবাই জানে। এ জানাটা যদি আসল জানা হতো সক্রেটিস কখনো বলতেন না “নিজেকে জানো”। এই আত্মজ্ঞান পৃথিবীর সবচে’ জটিলতম কর্ম।’ মিনহাজ অবাক। সে বুঝতে পারলো না, কিভাবে নিজেকে জানাটা পৃথিবীর জটিলতম কাজ। প্রত্যেক মানুষ তার সম্পর্কে খুব ভালো করে জানে। সে অনেকক্ষণ চুপ থাকে। দাদুর প্রতি তার সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। তারপর প্রশ্ন করলো, ‘নিজেকে জানা সবচে’ কঠিন কাজ কিভাবে, দাদু?’ ‘তোমার কাছে আমি এ প্রশ্নটি আশা করেছিলাম। তুমি ঠিক প্রশ্নটি করেছ। এখন তোমাকে ব্যাখ্যা দেব। শোন তবে। তুমি সহজে অন্যের দোষ খুঁজে পাবে অথবা জানতে পারবে, তার কোন গুণ কেমন। তার কোন স্বভাব ক্ষতিকর। তার দাঁত কেমন, নাক কেমন ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজেরগুলো খুঁজতে যাও, তখন বুঝতে পারবে, কত কঠিন এক কাজ। অণুবীক্ষন যন্ত্র দিয়ে খুঁজলেও তোমার কোন দোষ খুঁজে পাবে না। মনে হবে, তুমি এক অফুরন্ত গুণের আধার। তোমার গুণগুলো অতুলনীয়। এজন্য চোরকে চোর বললে সে অসন্তুষ্ট হয়। এটা চরিত্রের মন্দ দিক সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতার ফসল। চরিত্রের আরেকটা দিক সম্পর্কেও তুমি সহজে জানতে পারবে না। সেটা হলো, প্রত্যেক মানুষই অনন্য মানুষ, প্রত্যেকের মধ্যে অফুরন্ত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। মানুষের মূল দায়িত্ব হলো সে সম্ভাবনাকে বের করে আনা। তুমি শুনে অবাক হবে, মানুষের মত সক্ষমতার একটি এটমিক মস্তিষ্ক তৈরি করতে পনের শত কোটি (১৫০০,০০০০,০০০০,০০০০,০০) টাকার বেশি প্রয়োজন হবে। এ টাকা দিয়ে দশ হাজার কোটি কম্পিউটার কেনা সম্ভব। মানুষের মস্তিষ্ক একটি শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার। আমরা নিজেকে চিনি না। চিনতে পারি না। চিনলে আমরা কখনো বলতাম না, আমার মস্তিষ্ক ভোঁতা। আমি জানতাম, প্রতি সেকেন্ডে দশটি নতুন তথ্য ধারণ করতে পারি মস্তিষ্কে। মানুষ পুরো জীবনে তার মস্তিষ্কের ১০-১২% ব্যবহার করে। বলা হয়, আইনস্টাইন তার মস্তিষ্কের ২৫% ব্যবহার করেছিল। আমাদের স্মরণশক্তি লোহার মত। কেউ যদি লোহাকে খোলা প্রান্তরে কয়েকদিন ফেলে রাখে, মরিচা পড়ে যায়। লোহার ব্যবহার তার শক্তিকে ধরে রাখে। কবি বলেছেন, ঝড়ভঃধিৎব ড়ৎ যধৎফধিৎব অষষ নধংবফ ড়হ নৎধরহধিৎব ঝড়, নৎঁংয ঁঢ় ুড়ঁৎ নৎধরহ. এখন বলো, আমরা আমাদের চিনি কি না? যদি আমি নিজে উত্তর প্রদান করি, তবে উত্তর হবে, চিনি না। আমরা জানি না যে, প্রত্যেক মানুষই মহামানুষ। নিজেকে না চেনার কারণে প্রত্যেক মানুষ সেই মহামানুষকে নিয়ে কবরে চলে যায়।’ রাতের প্রথম প্রহর। রিশাদ তাদের বাড়ির নলকূপে গিয়েছে হাত মুখ ধোয়ার জন্য। সে নানার বাড়ি হতে কিছুক্ষণ আগে ফিরে এসেছে। একটা ঢিল এসে পড়লো নলকূপের পাশে। একটু ভয় পেল রিশাদ। কিছুক্ষণ পর আরেকটি ঢিল এসে আঘাত করলো নলকূপটিকে। ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাল রিশাদ। চাঁদনি রাতে অনেক দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কাউকে দেখতে পেল না রিশাদ। তার লোমকুপগুলো ভয়ে খাড়া হয়ে গেল। সে পালিয়ে যেতে চাইল। এমন সময় দূর হতে অট্টহাসি ভেসে আসল কর্ণকুহরে। ডান-বাম সামনে পিছন হতে। ভীত রিশাদ চিৎকার দিয়ে বাড়ির পথ ধরল। বেশি দূর যেতে পারল না রিশাদ। পড়ে গেল মাটিতে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল সন্তান ফিরছে না দেখে রিশাদের মা বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সে ডাক দিল, রিশাদ... রিশাদ... কোন সাড়া শব্দ নেই। ক্ষণে ক্ষণে অনেকক্ষণ ডাকল সে। না, রিশাদের কোন সাড়া শব্দ নেই। যেখানে পাব, রিশাদকে কান ধরে নিয়ে আসব, ... এমন প্রতিজ্ঞা নিয়ে যখন সে একটু এগিয়ে আসলো, দেখে মাটিতে কী যেন পড়ে আছে। ভয় পেলেও সাহস হারায়নি। চর্ট মেরে দেখল রিশাদের শার্ট। দ্রুত এগিয়ে কাছে গিয়ে যখন বেহুশ রিশাদকে দেখল তৎক্ষণাৎ রি... শা... দ... বলে সজোরে চিৎকার দিল। চিৎকার শোনামাত্র প্রতিবেশীরা সবাই বেরিয়ে আসে কী হয়েছে দেখার জন্য। তারা ধরাধরি করে বেহুশ রিশাদকে বাড়িতে নিয়ে আসল। অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হল তাকে। সকালের দিকে চেতনা ফিরে পায় রিশাদ। সবাই জানতে চাইল, কেন এমন হয়েছিল, রিশাদ? রিশাদ বললো, ভূত আমাকে আক্রমণ করেছিল। পাড়াতে জ্বীন-ভূতের আসর বসেছে। পর পর সংঘটিত কয়েকটি ঘটনা দ্বারা এ বিষয়টি স্পষ্ট হল। পর রাত্রিতে মিনা বাইরে এসে দেখে, তাদের ছাদে কী যেন দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে ঐ বস্তুটি টিনের উপর হতে গাছে গিয়ে ওঠে। ভয়ে মুর্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল তার। আরো অনেকে অনেক কিছু দেখেছে। এসব ঘটনার সূত্র ধরে পাড়ায় তাতুমের আগমন। অনেক খোঁজ করে তাকে আনা হয়েছে। সে এসে আলমদের বাড়িতে উঠল। একটি পিতলের বাটি সামনে রেখে মন্ত্র পাঠ করে ফুঁ দিলে তা আয়নার রূপ পরিগ্রহ করল। উপস্থিত সবাই হতবাক। সে আয়নাটা আলমের হাতে দিল। ‘তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছ?’ তাতুম আলমের কাছে জানতে চাইল। ‘কিছুই দেখছি না।’ জবাব দিল আলম। ‘ভাল করে থাকাও।’ তাতুম আলমকে আদেশ দিলো। আলম অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল আয়নার দিকে। তারপর চিৎকার দিয়ে বলল, ‘ঐ তো, সোনার থালা দেখা যাচ্ছে। রাশি রাশি সোনা।’ তাতুম আলমের হাত থেকে আয়নাটি নিয়ে উপস্থিত সবাইকে লক্ষ করে বলল, ‘এখানে জ্বীনদের উৎপাত বৃদ্ধির কারণ হলো ঐ সোনাগুলো। ঐগুলোর উপর তাদের নজর পড়েছে। ঐ সোনাগুলো মোহন জমিদারের। প্রায় দুশো বছর আগে মারা গেছে নিঃসন্তান মোহন জমিদার। মরার আগে মন্ত্র পড়ে সোনাগুলো ঐখানে রেখে গিয়েছে। জ্বীনেরা সেগুলো নিতে চায়। মন্ত্রের কারণে তারা কব্জা করতে পারছে না। এখন যে ঐগুলো উদ্ধার করতে পারবে সে মালিক হবে। তবে শর্ত হলো, জ্বীনদের খুশি করতে হবে।’ বিকেলে গুরুত্বপূর্ণ সভায় বসল মিনহাজ, আশরাফ, রিশাদ, শাহীন, মাহবুব, সাব্বির ও শিহাব। তাদের আলোচ্য বিষয় স্বর্ণগুলো উদ্ধার করা। পাড়ার সব মুরব্বিরা এটাকে ‘জাদুকরের ভেলকি’ আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছে। মিনহাজ বলল, এটা কিছুতেই জাদুকরের ভেলকি হতে পারে না। এটা যদি জাদুকরের ভেলকি হয়, তবে বালু দীঘির ঘটনাও মিথ্যা। গ্রামের এ পার্শ্বে ঐ দীঘিটি অবস্থিত। কথিত আছে, জ্বীনেরা একরাতেই ঐ বিশাল দীঘিটি খনন করে গুপ্তধন উদ্ধারের জন্য। সকালে গ্রামের মানুষ ঐ দীঘিটি দেখে অবাক হয়ে গেল। একদিনে এ বড় দীঘি কোত্থেকে এলো? এক মাইলের কম না। কারো বাড়িতে বিয়ে, জেয়াফত, মেজবান ইত্যাদি অনুষ্ঠান থাকলে লোকেরা দীঘির পাড়ে গিয়ে বলে আসতো। পরদিন সকালে দেখা যেত, প্রয়োজনীয় সব জিনিস দীঘির পানিতে ভেসে আছে। কাজ শেষে ঐ জিনিসগুলো দীঘিতে রেখে আসতো। এক অনুষ্ঠানে কেউ একটা বাটি চুরি করে ফেলে। এরপর হতে দীঘিতে ঐ সব জিনিস ভেসে ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত নিলো এ কাজটি তাদেরকেই করতে হবে। বুড়োদের দিয়ে হবে না। তারা একটি কমিটি গঠন করলো সভায়। এ কাজে কমিটি সবার সাহায্য নিয়ে এগিয়ে যাবে। কমিটি আলমকে নিয়েই কাজ শুরু করবে। কমিটির নাম দেওয়া হল “অপারেশন হিডেন ট্রেজার”। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা মাঠে নেমে গেল। তিন. ‘সফলতা কোন সাধারণ ব্যাপার না। কেউ সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়ালো, আর সিঁড়ি তাকে টেনে তুলে ফেলল, এরকম কখনো ঘটেনি, ঘটবেও না। এটা আলাদিনের প্রদীপের মতও না। তুমি প্রদীপ ঘষা দিলে আর অমনি চেরাগের জ্বীন এসে বলল, কী চাই জাহাপনা? উপরে উঠতে হলে তাকে অবশ্যই সিঁড়ি বেয়ে উঠার ঝুঁকি নিতে হবে। যে যত উপরে উঠতে চায়, তার ঝুঁকিও তত বড় হবে। এককথায়, সাফল্য কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়। পুকুরে না নেমে সাঁতার শেখা যায় না। যেহেতু, আমরা বিশাল ঝুঁকি নিতে যাচ্ছি, আমাদের উচিত কারো পরামর্শ গ্রহণ করা।’ রিশাদ বলল। ‘হ্যাঁ, তা করা ব্যতীত আমাদের অন্য কোন পথ নাই।’ মিনহাজ তার সাথে একমত হলো। আরো বলল, ‘এ ক্ষেত্রে আমরা দাদার পরামর্শ নিতে পারি। অনুপ্রেরণামূলক কথাবার্তা বলতে দাদা খুব পারঙ্গম। এই বৃদ্ধ বয়সে এসেও তার মধ্যে তারুণ্যের চপলতা আছে।’ ‘হ্যাঁ, তাই করতে হবে।’  শাহীন জবাব দিল। সাব্বির সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, ‘সব ঠিক আছে। কিন্তু যেন দাদু আমাদের উদ্দেশ্যের কথা জানতে না পারে। তিনি জানলে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।’ সবাই চলে আসল দাদার কাছে। দাদা চেয়ারে বসে ডায়েরি পড়ছিলেন। দাদার প্রিয় ডায়েরি। দাদা এখান থেকে নানা বিষয় প্রায়শ মিনহাজকে শুনান। এতগুলো ছেলে একসাথে সাফল্য নিয়ে পরামর্শ নিতে এসেছে শুনে দাদু খুব উৎফুল্ল­ হয়ে ওঠেন, ‘সফল হতে গেলে কী কী দরকার, তোমরা তা জানতে চাও শুনে আমার খুব ভাল লাগছে। তবে তার আগে তোমাদের কাছে একটা প্রশ্ন করব। তোমরা যদি এর জবাব দিতে পার, তবে আমি তোমাদের সাফল্যের সূত্রাবলী বর্ণনা করব।’ মিনহাজ বলল, ‘কী প্রশ্ন বলুন।’ ‘পৃথিবীতে কোটি টাকার গুপ্ত সম্পদটা কী?’ দাদু প্রশ্ন করলেন। সবাই পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। কেউ বলতে পারছে না। মিনহাজ মনে মনে ভাবল, দাদা সম্ভবত এই গুপ্তধনের কথা বলছে। দাদু প্রকাশ্যে গুপ্তধনের বিরোধিতা করলেও তার অন্তরে গুপ্ত লোভ বিদ্যমান। ভাবতে ভাবতে শিউরে উঠল সে। সবাই একই কথা মনে মনে জপে যাচ্ছে, দাদাও গুপ্তধন চায়। তারা কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে দাদা বলে উঠলেন, ‘কি তোমরা উত্তর দিতে পারবে না? তোমরা যদি উত্তর দিতে না পার, আমি কিভাবে সফল হবার পথ তোমাদের দেখাব? এতে আমার ওয়াদা ভঙ্গ হবে।’ ‘একজন মুর্মূষকে বাঁচানোর জন্য ওয়াদা ভঙ্গ করা যায়।’ বলল মিনহাজ। ‘কে মুমূর্ষ?’ জানতে চাইলেন দাদা। ‘কেন, আমরা সবাই। যেহেতু আমরা সফলতার পথ চিনি না।’ ‘ঠিক আছে। যদি তাই হয়, তবে সাফল্যের পথ-নির্দেশিকা আমি তোমাদের সামনে উপস্থাপন করছি। জীবনে সফল হওয়াটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার না। অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল হচ্ছে সাফল্য। সফলতার প্রথম শর্ত হলো লক্ষ্য স্থির করা। লক্ষ্যবিহীন নৌকা যেমন কূলে ভীড়তে পারে না, তদ্রƒপ জীবনে লক্ষ্য উদ্দেশ্য না থাকলে সে জীবন এগিয়ে যেতে পারে না। এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে আমরা স্বপ্ন বলে অভিহিত করি। যে জীবনে কোন স্বপ্ন নাই, তা মূল্যহীন। জেনে রেখো, ঘুমের ঘোরে মানুষ যা দেখে তা স্বপ্ন নয়, স্বপ্ন তাই যা মানুষকে জাগিয়ে রাখে। তোমার স্বপ্ন যদি তোমাকে কাজে অনুপ্রাণিত না করে, তবে সে স্বপ্ন মূল্যহীন। সফলতার এ পথ মসৃণ নয়। এর প্রতিটি কদমে কদমে ছড়িয়ে আছে কাঁটা। যার স্বপ্ন যত বড়, তার পথটা তত বিপদসঙ্কুল। পুকুর পাড়ি দেবার বিপদ ও মহাসাগর পাড়ি দেবার বিপদ এক নয়। এ বিপদগুলো তোমাকে ধ্বংস করার জন্য নয়। এগুলো তোমার জন্য পরীক্ষা। তারা দেখতে চায়, তুমি যে জিনিসটা প্রত্যাশা করছ, তা তুমি পাবার যোগ্য কি না? যারা সফল তারা লড়াই করে এ প্রতিকূলতাগুলোকে পরাস্ত করেছে। যারা পরাজিত তারা প্রতিকূলতা দেখে পিছিয়ে গেছে। উদ্দেশ্যের প্রতি শুধু অবিচল থাকলে চলবে না। এর জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন সাধনা। গরমের অত্যাচার হতে মুক্তি পেতে বাতাসের দিকে সরে যাও, শীতের তীব্রতা হতে মুক্তি পেতে যদি কাঁথার উমে বসে থাক, সৌন্দর্য্যে বিভোর হয়ে যদি হা করে তাকিয়ে থাকো, ভীত হয়ে পিছিয়ে যাও, পিচ্ছিল দেখে সরে যাও, অন্ধকার দেখে দাঁড়িয়ে থাকো, হতাশায় মুষড়ে যাও, আনন্দে বিভোর হও, দুর্গন্ধে নাক সিঁটকাও, সুবাস পেয়ে নাক ডুবাও, বাক্যবানে বিদ্ধ হও, হিংসায় সিদ্ধ হও, পাহাড় দেখে থমকে দাঁড়াও, কম্পন দেখে শুয়ে যাও, লোভে বশীভূত হও, স্নেহ বা প্রেমে মজে যাও, অল্প পেয়ে তৃপ্ত হও, রোগে শোকে কুঁকড়ে যাও, প্রতারিত হয়ে পিছিয়ে যাও, সাহায্য পেয়ে অন্ধ হও, মানসিকভাবে দৃঢ় না হওÑ তবে তোমার নিরবিচ্ছিন্নতা নষ্ট হবে। কথিত আছে, বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের সময় এডিসন দশ হাজার বার ব্যর্থ হয়েছিলেন। এক বন্ধু বিস্মিত হয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিল, এত ব্যর্থ হবার পরও তোমার চেষ্টা চালিয়ে যাবার অর্থ কী? এডিসন অধিকতর আশ্চর্য হয়ে বলেছিলের, ‘কে বলল যে আমি ব্যর্থ হয়েছি? বরং দশ হাজারটা পথ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। কোন পথে গেলে কাজ হবে তা আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর কটা পথই বা বাকি আছে? তাদের কোন একটাতে কাজ হতেই হবে। এখন আমি সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি বলতে পারো।’ তাই ব্যর্থতা থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে। যারা ব্যর্থতা থেকে অনুপ্রেরণা নেয়া দূরে থাক, ব্যর্থ হওয়ার আশক্সক্ষায় শুরুতেই ঝিমিয়ে পড়ে, তাদের সাফল্যের আশা করাটা বোকামি ছাড়া আর কিছু না। এসব কিছুর ভিত্তি হলো আপন দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি হলো মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি, যা মানুষকে পরিচালিত করে। এ ক্ষেত্রে আমার ছোটকালের একটা কথা তোমাদের বলতে পারি। একবার আমরা মাঠে ফুটবল খেলছিলাম একটা পুরনো বল দিয়ে। খেলার বিরতির সময় একজন একটা নতুন বল নিয়ে এলো। আমরা নতুন বল নিয়ে খেলতে গিয়ে দেখি কাজ হচ্ছে না। আমাদের একজন মন্তব্য করলো, বাজে বল। আমি বললাম, বল নতুন বা পুরানো এটা ব্যাপার না। দেখতে হবে এর ভিতরে কিছু আছে কি না। বলটাতে বাতাস ঢুকানো হল। দেখা গেলো এটা দারুণ একটা ফুটবল। এই বাতাস হলো অন্তর্নিহিত শক্তি। কোন মানুষের মধ্যে যদি অন্তর্নিহিত শক্তি না থাকে, তবে বাইরের শক্তি তাকে আর কত পরিচালিত করতে পারে? দাদু প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে একমাস সময় দিচ্ছি আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার জন্য।’ সবাই বলল, ‘আচ্ছা দাদু।’ অপারেশন হিডেন ট্রেজার কমিটির ৩য় বৈঠক। সব সদস্য উপস্থিত। তাদের আলোচ্য বিষয় কাজ শুরু করা। কাজ শুরু করতে হলে যে জিনিসটা প্রথমে প্রয়োজন তা হলো তাতুমকে খুঁজে বের করা। তাতুম কোথা হতে এসেছে কেউ জানে না। হয়তো মুরব্বিদের কেউ জানে। কিন্তু কে জানে, সে কথাও এ কমিটির কারো জানা নেই। হয়তো দাদু তার সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু তার কাছ থেকে এ তথ্য আদায় করা যাবে না। মিনহাজ সবার মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করে দিল যাতে পাড়ার সব মুরব্বিদের জিজ্ঞাসা করা যায়। কাউকে যাতে দু’বার জিজ্ঞাসা করা না হয়, সে জন্য প্রত্যেকের হাতে আলাদা আলাদা তালিকা দেওয়া হল। প্রত্যেকে তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদেরকে জিজ্ঞাসা করবে, অন্য কাউকে নয়। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় টাকা। টাকা ছাড়া সব ফাঁকা। ‘আমাদের কেউ কোন চাকরি বা ব্যবসা করি না, এত টাকা পাব কোথায়?’ আশরাফ বলল। ‘তুই প্রথমেই বোকার মত প্রশ্ন করলি।’ রিশাদ তাকে ধমক দিল। ‘কেন? কেন?’ ‘আমরা যদি টিফিনের টাকাগুলো বাঁচায়, এক সপ্তাহে কয়টাকা হয় খেয়াল করেছিস? একজনের যদি হয় ৬০ টাকা, আটজনের হয় ৪৮০ টাকা। শোন, ব্রিটেনের একটা গ্রামের লোকদের অভ্যাস ছিল, কেউ যদি বিপদে পড়ে তাকে সবাই এক পেনি করে দিত। একবার গ্রামে ঘুর্ণিঝড়ে এক গরিব লোকের বাড়ি বিধ্বস্থ হয়েছিল। সবাই তাকে এক পেনি করে প্রদান করল বাড়ি ঠিক করার জন্য। কিছুদিন পর এক বিদেশী গিয়েছিল ঐ গ্রামটি দেখার জন্য। সে ঐ লোকটির বাড়ি খুঁজে সনাক্ত করতে পারছিল না। কারণ, তার বাড়িটি ছিল সবচে’ নতুন। এ ভাবে যদি আমরা দশে মিলে সঞ্চয় করি, লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হতে পারব। এখন থেকে টাকার মূল সূত্রটি আমরা অনুসরণ করলে হবে।’ ‘মূল সূত্রটা কী?’ জানতে চাইলো মিনহাজ। ‘অর্থ সঞ্চয় কর, যখন প্রয়োজন সবচে’ কম। অর্থ ব্যয় কর, যখন চাহিদা সবচে’ বেশি। এভাবে সঞ্চয় গড়ে ওঠে। অর্থ মধ্যপন্থা বুঝে না। মধ্যপন্থায় সঞ্চয় হবে না। আমরা আগামীকাল হতে টিফিনের টাকা জমা করা শুরু করব। মিনহাজ তুই সবকিছু তদারকি করবি।’ পরে একটা নির্বাচন হলো। সবাই ভোটার, সবাই প্রার্থী ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত উক্ত ভোটে মিনহাজ সভাপতি নির্বাচিত হল। অপারেশন হিডেন ট্রেজার কমিটি শুক্রবারে তাদের পরবর্তী বৈঠকের তারিখ ঘোষণার মাধ্যমে বৈঠক শেষ করল। সোমবার। অপারেশন হিডেন ট্রেজার কমিটির ‘জরুরি বৈঠক’ ডাকা হয়েছে। সবাই উপস্থিত। সবার চেহারায় উদ্বেগের ছাপ। আলম ভয়ঙ্কর খবর নিয়ে এসেছে। তারা চরম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। বুঝতে পারছে না কী করতে হবে। সবাইকে অন্ধকারে রেখে কে বা কারা গুপ্তধন নিয়ে গেছে? আলম যেখানে গুপ্তধনের কথা বলেছে, সেখানে আজ সকালে দেখা গেছে অনেকগুলো গর্ত। আলম বলল, ‘আমার মনে হয় এতে রিশাদ জড়িত।’ মিনহাজ জানতে চাইল, ‘কিভাবে বুঝলি?’ সাব্বির বলল, ‘রিশাদ গতকাল থেকে অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলে বেড়াচ্ছে। সে বলছে, গুপ্তধনের এ কাহিনীটা একটা মিথ্যা ফাঁদ। আমি সেই ফাঁদে পড়তে চাই না। ওর মা নাকি ওকে বলেছে, উল্লুক ভিটার বয়স দুইশ’ বছরের বেশি। তাদের এক পূর্বপুরুষ বাড়ি করার জন্য  উক্ত ভিটে ভরাট করেছিলেন। পরে আরো ভাল জায়গা পাওয়ায় তিনি ওখানে আর বাড়ি করেননি। রিশাদ আরো বলছে, গুপ্তধন হলো একজন মানুষের সুপ্ত সম্ভাবনা। আমার মনে হচ্ছে এসব কথা বলে, সে আমাদের মনোযোগ নষ্ট করে তার উদ্দেশ্য হাসিল করে ফেলেছে। সে তো বুদ্ধির রাজা। কাকে কিভাবে সাইজ করতে হয়, তার ভাল করে জানা আছে। কাল রাতেও তাদের বাড়িতে সবাই ছিল। আজ দেখলাম তালা-মারা।’ মিনহাজ বললো, ‘রোগ-শোক-মৃত্যু এসব কারণেও তো তারা ঘর ছাড়তে পারে।’ ‘তাদের ঘর ছাড়া ও উল্লুক ভিটার গর্ত হয়েছে একই সময়ে। এতে কী বুঝা যায়?’ সাব্বির বলল। ‘ঠিক আছে, আমরা আগামী শুক্রবার পর্যন্ত দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিব।’ মিনহাজ বলল। শুক্রবার। অপারেশন হিডেন ট্রেজার কমিটির বৈঠক। বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনাপূর্বক তারা বুঝতে পেরেছে, এখনো কেউ গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারেনি। উল্লুক ভিটায় প্রতিদিন গর্তের সংখ্যা বাড়ছে। তার মানে এখনো খোঁজাখুজি চলছে। তবে কারা এ কাজ করছে বুঝা যাচ্ছে না। এবারও রিশাদকে সন্দেহের তালিকা হতে বাদ দেওয়া যায়নি। কারণ তার পরিবারের কেউ এখনো ফিরে আসেনি। সবাই সিদ্ধান্ত নিল, তারা একটা অভিযান পরিচালনা করবে, যারা একাজ করছে তাদের পাকড়াও করার জন্য। আজ রাত হতে উল্লুক ভিটায় অভিযান পরিচালনা করা হবে। চার. রাত ১২.০১ মিনিট। টেবিল ঘড়ির ক্রিং ক্রিং শব্দে জেগে উঠল মিনহাজ। হাতের কাছে থাকা ছোট টর্চটি জ্বালিয়ে মৃদু এলার্মটি বন্ধ করলো সে। বাতি জ্বালানো যাবে না। দাদু যদি টের পেয়ে যান, সব শেষ হয়ে যাবে। চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে উঠে হুক খুলে বাইরে দাঁড়ায় মিনহাজ। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বুঝে নিল, দাদু টের পায়নি। তিনি নিদ্রামগ্ন। ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল মিনহাজ। আশরাফ, আলম, মাহবুব, শাহীন, সাব্বির শিহাব তার জন্য অপেক্ষা করছে। ‘রিশাদের খবর কী?’ জানতে চাইল মিনহাজ। ‘এখনো তাদের বাড়িতে তালামারা। কেউ ফিরে আসেনি।’ শাহীন বলল। তারা যাত্রা শুরু করল। লক্ষ্য উল্লুকভিটা। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে উল্লুক ভিটার দিকে, মৃদু চাঁদের আলো ভেদ করে। পাড়ার শেষ সীমানা অতিক্রম করতে করতে সবার দৃষ্টি পড়ল ভিটার দিকে। মৃদু আলোতে কারা যেন কাজ করছে। এরা আরো চুপে চুপে অগ্রসর হতে লাগল। এমন সময় মিনহাজ অনুভব করল, পিছন হতে কে যেন আসছে। ভয়ে শরীরের সব লোমকুপ উত্থিত হলেও সাহস হারাল না সে। পিছনে ফিরে দেখে রিশাদ। ‘রিশাদ তুই?’ মিনহাজ জানতে চাইল। ‘মাকে ফাঁকি দিয়ে চলে আসলাম।’ রিশাদ হাসছে। ‘আসলি কখন? গিয়েছিলি কোথায়? জানলি কী করে আমরা এখানে?’ ‘এইসব হিসাব পরে। এখন চল ঐ চোরদের ধরি।’ রিশাদকে দেখে অবাক হলেও কেউ কথা বাড়াল না। সবাই চুপি চুপি অগ্রসর হতে লাগল। তারা ভিটার কাছাকাছি পৌঁছতেই ঐ বাতিটা নিভে গেলে তারা আরো অবাক হয়ে যায়। আটজন সবাই ভিটের চারদিক ঘিরে অবস্থান নিল গুপ্ত খননকারীকে ধরার জন্য। দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করে নিশ্চিত হল ঐ লোকগুলো পালিয়ে গেছে। তারা যখন উল্লুক ভিটায় উঠল, তাদেরকে অবাক করে দিয়ে রিশাদ অন্ধকারের মধ্য দিয়ে চলে যেতে লাগল। সবাই পিছনে পিছনে অনেক দূর পর্যন্ত গেলেও রিশাদ ফিরে থাকায়নি। রিশাদের এ আচরণে সবাই ক্ষুব্ধ হলেও হতবাক। সে গভীর রাতে একা কিভাবে আসল? আর কিভাবে চলে গেল একা? তার এমন আচরণের হেতু কী? আলম বলল, ‘হয়ত যারা খনন কাজ করছে তাদের সাথে রিশাদের যোগসাজস আছে।’ এই নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও তারা সিদ্ধান্তে আসতে পারে নিরিশাদের বিষয়ে। তারা ফিরে আসার সময় রিশাদের বাড়ির দিকে যেতে যেতে দূর হতে লক্ষ্য করলো রিশাদ দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। এরা কাছে আসতে আসতে সে আবার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কাছে এসে দেখতে পেল, তাদের বাড়িটা আগের মতই থালাবদ্ধ অর্থাৎ কেউ ফিরে আসেনি। তাহলে রিশাদ? পুরো গ্রামে হৈ চৈ পড়ে গেছে। সবাই গেছে প্রাণীটাকে দেখার জন্য। এমন অদ্ভুত দর্শন প্রাণী কি আসলে থাকতে পারে? কিন্তু চোখের সামনে যা দাঁড়ানো তা বিশ্বাস না করে উপায় কি? এটা পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাণী, কিন্তু সবচেয়ে খাট। সবচেয়ে দ্রুততম প্রাণী, কিন্তু সবচেয়ে ধীর গতিসম্পন্ন। এটা সব ছোট ছোট জিনিস খায়, আর বড় বড় জিনিস নির্মাণ করে। এক হাজার রশি দিয়ে গ্রামবাসীরা এটাকে বেঁধে রাখল। সবাই সিদ্ধান্ত নিল, এটাকে গ্রাম ছেড়ে যেতে দেয়া হবে না। সেটি সব রশি ছিঁড়ে পার্শ¦বর্তী গ্রামে চলে গেল। ঐ গ্রামের লোকেরা এটিকে বেঁধে রাখার ব্যাপারে আরো কঠোর হল। তারা দুই হাজার রশি দিয়ে প্রাণীটাকে বেঁধে রেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে বাড়ি ফিরল। কিন্তু আটকে রাখা গেল না প্রাণীটাকে। সব রশি ছিঁড়ে চলে গেল। তৃতীয় গ্রামের লোকেরা তিন হাজার রশি দিয়ে বেঁেধ রাখল। কিন্তু তারাও ব্যর্থ হল। এ সময় এক বৃদ্ধ লোক এগিয়ে এল। যিনি তার কর্মকাণ্ডের জন্য সবার কাছে পরিচিত। অনুশোচনা করলেও সে বলল, রশি দিয়ে নয়, পৃথিবীর সমস্ত শক্তি দিয়েও এটা বেঁধে রাখা যাবে না। বৃদ্ধের কথা শুনে সবাই অবাক। তাহলে উপায়? তাদের প্রশ্নের জবাবে সে বলল, তোমরা এটাকে আটকে রাখতে পারবে না, তবে যদি এটা ব্যবহার করতে পার, তোমরা উপকৃত হবে। তারা জানতে চাইল, এটা ব্যবহার করার পদ্ধতি কী? তখন বৃদ্ধ লোকটি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, এ প্রাণীটি আমাদের জন্ম এবং মৃত্যুর কারণ। সে যত এগিয়ে যাবে, তত আমরা মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাব। আবার এটাকে আটকে রাখাও যাবে না। এরচে’ বরং আমরা এর পিঠে সওয়ার হয়ে যায়। অনুসরণ করি তার প্রতিটি মুহূর্ত। তবে জীবন কর্মময় হবে। মিনহাজকে গল্প বলতে বলতে দাদা মফিজুর রহমান থামলেন। ‘দাদা, এ প্রাণীটা কোথায় পাওয়া যায়?’ প্রশ্ন করল মিনহাজ। ‘কেন? এ প্রাণীটা পৃথিবীর সর্বত্র পাওয়া যায়। তবে শুনলে আরো অবাক হবে, তবুও বলতে হয়, জন্মের পর হতে এ প্রাণীটা এক মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম নেয়নি। আর নেবেও না। যে ব্যক্তি তাকে কাজে লাগাতে পেরেছে, সে ব্যক্তিকে ঐ প্রাণীটা গুপ্তধন দিয়ে সাহায্য করেছে। আর যে তাকে কাজে লাগাতে পারেনি, ঐ প্রাণীটা ঐ লোকটিকে গিলে খেয়ে ফেলেছে। এর জন্য ‘অপারেশন হিডেন ট্রেজার’ কমিটি গঠন করারও দরকার হয়নি আজ পর্যন্ত।’ দাদুর মুখে অপারেশন হিডেন ট্রেজার কমিটির নাম শুনে চমকে উঠল মিনহাজ। দাদু জানল কী করে? ভিতরে ভিতরে ঘামতে শুরু করল সে। নিশ্চয় দলের ভিতর গুপ্তচর আছে। কে সে গুপ্তচর? রিশাদ ছাড়া কেউ এ কাজ করতে পারে না। কিন্তু রিশাদ তো কয়েকদিন হল নানার বাড়িতে গেছে। গতরাতে রিশাদকে দেখা গেলেও তা ক্ষণিকের জন্য। অনেকটা অলৌকিক। ভিতরের প্রতিক্রিয়া এড়াতে মিনহাজ আবার দাদুকে প্রশ্ন করল সে প্রাণীটি সম্পর্কেÑ ‘এ প্রাণীটি পৃথিবীর সর্বত্র থাকলেও তাকে দেখলাম না কেন?’ ‘তোমার সে চোখ নাই, দেখবে কী করে?’ জবাব দিল দাদু। দুদিন পরের কথা। তহবিল সংগৃহীত হয়েছে, তবে পর্যাপ্ত নয়। সবাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে কাজ শুরু করবে কিনা? এই নিয়ে সভায় বসেছে তারা। সবাই এসেছে, রিশাদ এখনো আসেনি। তার ব্যাপারে সবাই সন্দিহান। মিনহাজের দৃঢ় বিশ্বাস এ ব্যাপারে রিশাদ দাদাকে বলেছে। তবে নিশ্চিত নয়। তাই রিশাদের দরকার ছিল এ রহস্য উদ্ঘাটন করার জন্য। গত পরশুর ঘটনাটাও তাকে জিজ্ঞাসা করে, এমন করার কারণ কী জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল। কিন্তু সে আসেনি। মিনহাজ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বাদ দাও তার কথা। পৃথিবীটা কারো জন্য বসে থাকে না। এখানে শূন্যস্থান বলে কিছুই নাই। কেউ যখন দায়িত্ব পালন হতে পিছিয়ে যায় বা এগিয়ে না আসে, অন্য কেউ এসে সে শূন্যস্থান পূরণ করে। আমরাও বসে থাকব না। এখন আমরা আমাদের আলোচনায় আসি কিভাবে কাজ করব।’ ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথায় বলেছ। এখন আমাদের উচিত কাজ শুরু করা। কি...ন্তু?’ কথা বলছিল আশরাফ। ‘কিন্তু একটা ভয়াবহ শব্দ। দ্বিধাগ্রস্থ ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ। কোন রকম সংশয় মনের মধ্যে রেখে কাজ করতে যাওয়াটা বোকামি। মনে রেখ, ব্যর্থ হলে হতাশা গ্রাস করতে পারে, কিন্তু চেষ্টা না করলে জীবনটাই ধ্বংস হয়।’ বলল মাহবুব। মাহবুবের কথা শেষ হতে না হতেই রিশাদ এসে উপস্থিত। তাদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ না করে তারা সভা চালিয়ে যেতে লাগল। শিহাব আরো যোগ করল, ‘মাহবুব ঠিক কথায় বলেছে। আমাদের মধ্যে কেরানী মানসিকতা থাকা উচিত হবে না। আমাদের মধ্যে ব্যবস্থাপকীয় মানসিকতা থাকতে হবেÑ সংশয়বাদী মন নিয়ে কোন কাজ করা যায় না। পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানীরা উড়োজাহাজ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু দুইজন সাইকেলের কারিগর সফল হয়েছে শুধুমাত্র সংশয়মুক্ত মনোবল থাকার কারণে। আমাদেরকে মনোবল ঠিক রেখে এগুতে হবে। আমরা মনোবল অটুট রেখে সামনে এগিয়ে যাব। আমরা যদি পরাজয়কে বরণ করে না নিই, তবে কেউ আমাদেরকে পরাজিত করতে পারবে না।’ ‘সব ঠিক আছে, তবে আমার মনে হচ্ছে আমরা অলিক স্বপ্নের পিছনে দৌড়াচ্ছি। বিনা শ্রমে কোন কিছু পাওয়ার লোভ মানুষকে ফাঁদে ফেলে। শ্রমের দ্বারা যা অর্জিত হয় তাই আসল পাওয়া। আমরা ধনী হবার সংক্ষিপ্ত পথ ত্যাগ করে বাস্তববাদী হলে,...’ রিশাদ কথা শেষ করতে পারল না। ‘রাখ, তোর বাণী শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। একটা জিনিস হাতের মুঠোয় আছে, আর তুই আবোল তাবোল বলছিস।’ মিনহাজ তার কথায় বাঁধা দিল। ‘আরে না, গুপ্তধনের জন্য যে মাতলামী হচ্ছে, তা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। প্রতারকরা কাউকে না কাউকে ফাঁদে ফেলে সর্বনাশ করবে। আমার মনে হচ্ছে আমরা তার শিকার হতে যাচ্ছি।’ বলল রিশাদ। ‘তুই এগুলো কী বলছিস? মাথা ঠিক আছে তো? তুই তো জ্বীনের মত হয়ে গেছিস? রাত বিরাতে অন্ধকার পথ দিয়ে হেঁটে চলে যাস। ঐ তান্ত্রিক তো একদিনও এখানে আর আসল না। সে ফাঁদ ফেলবে কেন?’ শাহীন বলল। ‘এসব কী বলছিস? আমি রাত বিরাতে অন্ধকারে হাঁটি মানে? পাগলের প্রলাপ বকছিস কেন? আমি একটু অন্ধকার হলে বাড়ি থেকে বের হই না। আর ফাঁদ?’ বলল রিশাদ। ‘সে রাতের কথা ভুলে গেছিস?’ বলল মিনহাজ। ‘কোন রাতে, কী হয়েছিল?’ জানতে চাইল রিশাদ। ‘বুঝেও না বুঝার ভান করছিস? পাগলামী করছিস কেন?’ মাহবুব বলল। ‘তোর কথা আমাদের ভালো লাগছে না। তুই তো তাদের দলে যোগদান করেছিস, যারা গুপ্তধন খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে রাতদিন দৌড়াচ্ছে।’ মিনহাজ তাকে ব্যঙ্গ করে বলল। এ কথা শোনার পর রিশাদ ওখান থেকে উঠে চলে গেল। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সাব্বির বলল, ‘আমরা আজই কাজ শুরু করব। আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার সুযোগ নাই। আমাদেরকে আর বসে থাকলে চলবে না। মুমূর্ষু রোগী আর প্রতিযোগীদের জন্য প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরাও প্রতিযোগিতায় নেমে গেছি। আমাদের দরকার এখন কাজ শুরু করা। মনে রাখতে হবে, হাজার হাজার তত্ত্বকথার চেয়ে এক তোলা কাজ অনেক উত্তম।’ কথা শেষ করল সাব্বির। সাব্বিরের বক্তব্যের জন্য সবাই তাকে ধন্যবাদ জানাল। তার কথা সবাইকে অনুপ্রাণিত করেছে। কমিটি সিদ্ধান্ত নিল, তারা আজ হতে কাজ শুরু করবে। আরো দু’তিনটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা সভা শেষ করে চলে যাচ্ছে এমন সময় দেখা গেল রিশাদ অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মিনহাজ ডাক দিল রিশাদ, ‘রিশাদ।’ মিনহাজের ডাক শুনার পর সে হাঁটা শুরু করল। শাহীন বলল, ‘দেখ, বিশ্বাসঘাতক চলে যাচ্ছে। ‘এমন করছে কেন রিশাদ? তার উদ্দেশ্য কী?’ প্রশ্ন করল আলম। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বান্দরবান যাচ্ছে তিন জনÑ মিনহাজ, শাহীন ও আশরাফ। কমিটির বাকিরা জড়ো হয়েছে তাদের এগিয়ে দিতে। এমনকি রিশাদও সেখানে এসে উপস্থিত। রিশাদকে যে কোন প্রকারে এখান হতে সরাতে হবে। নতুবা তাদের মিশনের তথ্য গোপন থাকবে না। তাই সবাই অস্বস্তিতে আছে। এ সময় মায়ের ডাক শুনে চলে যায় রিশাদ। সে কিছুদূর যাওয়ার পর তারা লোকাল গাড়িতে উঠল। সে গাড়িতে করে সাতকানিয়া আসার পর বান্দরবানের গাড়িতে ওঠার জন্য টিকিট কিনল। তারা গাড়িতে উঠে বসল। সিটে বসার পর মিনহাজ দেখল, পাশের সিটে কে একজন মাথা নিচু করে ঘুমাচ্ছে। তার সন্দেহ হলো। কেমন যেন পরিচিত পরিচিত মনে হচ্ছে। লোকটার ঘুম ভেঙে গেলে হাই তুলতেই তাদের বুক দুরু দুরু কেঁপে উঠল। মিনহাজ চিৎকার করে উঠল, ‘তুই!’ পাঁচ. সারি সারি পাহাড় আর বন্ধুর পথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সবাই। মাঝে মাঝে বন এত ঘন কালো যে, মনে হয় রাত্রি নেমে এসেছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। এবড়ো থ্যাবড়ো পথ বেয়ে যেতে যেতে নানা গল্প করছে। আদনান তাদেরকে একটা চমৎকার গল্প শোনাল। এক সামরিক অফিসার তার সাগরেদদেরকে তীরবিদ্যা শিক্ষা দিচ্ছিল। সে একটা গাছের উপর কাঠের পাখি রেখে এক শিষ্যের হাতে তীর-ধনুক দিল। শিষ্যটি পাখিটিকে লক্ষ করে তীর ধরল। অফিসার জানতে চাইল, কী দেখছ? শিষ্যটি জবাবে বলল, আমি গাছের পাতা, গাছের ডাল, আকাশ, আর পাখিটি দেখতে পাচ্ছি। গুরু শিষ্যটাকে বলল, থাম। এরপর অন্য শিষ্যের হাতে ধনুকটি দিল। শিষ্যটি পাখিটির প্রতি তীর নিশানা করল। অফিসার তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী দেখতে পাচ্ছ তুমি?’ শিষ্যটি বলল, ‘আমি শুধু পাখির চোখ দেখতে পাচ্ছি।’ অফিসার তাকে তীর ছুড়ার আদেশ দিল। তীরটি পাখিটিকে আঘাত করল। এটাই হল সফলতার মন্ত্র। আমাদেরকে লক্ষ্যের প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি রাখতে হবে। আমরা যদি আবেগের বশে, প্রতীকূলতার কারণে, বা খেয়াল খুশির গোলাম হয়ে জীবনের লক্ষ্যকে অবহেলা করি, তবে কক্ষপথে ফিরে আসা খুব কষ্টসাধ্য হবে। কথা বলতে বলতে তারা একটা ছোট ঝর্ণার নিকট এসে পৌঁছল। চারিদিকে পাহাড় ঢাকা পথে ছোট্ট ঝর্ণার উপস্থিতি দারুণ নয়নাভিরাম। দেখে শাহীন থমকে দাঁড়ায়। শাহীন বলল, ‘এখানে গোসল করতে হবে, না হলে জীবনটা সার্থক হবে না।’ আদনান জবাবে বলল, ‘লক্ষ্যপানে যাবার পথে আমরা যদি সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিভোর হয়ে যায় তবে আর এগিয়ে যাওয়া যাবে না। ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে পারি। এতে সতেজতা আসবে আর সৌন্দর্যে বিভোর হলে দুর্বলতা আসবে। এটাই ধ্বংসের কারণ।’ আর কথা না বাড়িয়ে তারা হাঁটতে লাগল। তাদের যাত্রা আরো অনেক দূরে। দুপুরের সূর্য পশ্চিমে হেলে যেতে শুরু করেছে। আদনানের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। (চলবে)

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ