মিনহাজের অভিযান

মিনহাজের অভিযান

উপন্যাস নভেম্বর ২০১৩

কাজী মুহাম্মদ সোলাইমান

গত সংখ্যার পর রিশাদকে পাওয়া যাচ্ছে না। দুপুরে সে ভাত খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। এখন রাত আটটা। সবখানে খোঁজা হয়েছে। কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে সব খানে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে। রফিকের খোঁজে অনেকে দৌড়ে গিয়ে জানতে পারল, সে তার এক আত্মীয় বাড়ীতে বেড়াতে গেছে। রিশাদের মায়ের রিশাদ, রিশাদ আর্তনাদ পুরো বাড়ী প্রকম্পিত করে তুলছে। অনেকে টর্চ মেরে গাছের শাখায় শাখায় তাকে খুজতে লাগল। কেউ কেউ পুকুরে নেমে গেল জাল হাতে। এদিক ও দিক খেপ মেরে দেখছে, যদি মৃত পাওয়া নাই। ভয়ে সবাই অস্থির। তবে কি রিশাদকে শেষ পর্যন্ত জীন পরী তুলে নিয়ে গেছে? নাকি ছেলেধরা নিয়ে গেছে? বাড়ীর প্রতিটি আনাচে কানাচে খোঁজে ও যখন তাকে পাওয়া গেল না, কয়েকজন টর্চ হাতে উল্লুক ভিটায় চলে আসল। টর্চের আলো জ্বেলে জ্বেলে যখন তারা আসতে লাগল, দেখা গেল কারা যেন পালিয়ে যাচ্ছে। তারা আরও কাছে এসে দেখতে পেল, রিশাদ মাটির উপর শুয়ে আছে। তার হাত পা, চোখ-মুখ শক্ত করে বাঁধা। রিশাদের সব বন্ধন খুলে দেওয়া হল। উঠে দাঁড়াল সে। মফিজুর রহমান জানতে চাইল, ‘রিশাদ, কারা তোমাকে এভাবে বেঁধে রেখেছে?’ রিশাদ বলল, ‘আমি বলব না। বললে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ সবাই বলল, বল রিশাদ, তোমার আর ভয় নেই। ওরা পালিয়ে গেছে। রিশাদ চিৎকার করে বলল, না আমি বলব না। তোমাদের মধ্যে তারা মিশে আছে। ঐ তো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কিছু দেখতে পেল না।

দশ. আলমের বাবার মন খারাপ। অনেক টাকা ব্যয় করে সে বিভিন্ন ফসলের বীজ লাগিয়েছিল উল্লুক ভিটায়। ক্ষেতের কিছু অংশ গুপ্তধন অনে¦ষণকারীদের দ্বারা নষ্ট হয়েছিল। চূড়ান্ত ফলাফলে বলা যায়, ভাল ফসল হয় নি। সব শ্রম ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার হাহুতাশ করছিল আলমের বাবা। এমন বাজে ফলাফলের জন্য সে দোষারূপ করতেছিল গুপ্তধন অšে¦ষণকারীদেরকে। ঐ পথ দিয়ে বাজারে যাবার সময় তার অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়াল মফিজুর রহমান। ‘তোমার এ অবস্থা কেন?’  মফিজুর রহমান আলমের বাবাকে প্রশ্ন করল। ‘এ অভিশপ্ত ভিটা আমার সর্বনাশ করল।এত কষ্ট করে ফসল লাগালাম, কোন লাভ হলো না।’ কি কষ্ট করেছ? আমি দেখলাম রেডিমেড জমিতে তুমি হঠাৎ ফসল লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছ। শেষ পর্যন্ত তাই করেছ। এভাবে কি সফলতা পাওয়া যায়? সাফল্য দৈবক্রমে পাওয়া যায় না। সফলতা বিরামহীন ও পরিকল্পিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আসে। যে সফলতা না পেয়ে তুমি হাহুতাশ করছ, তা তোমার ইচ্ছার তালিকায়ও ছিল না। মানুষ যা সহজে পায়, তা সহজে হারায়। তুমি যদি এখানে পরিকল্পিত ভাবে কিছু করতে, নিশ্চয় কোন একটা ফল পেতে। এখন তুমি নিজেও জান না, কেন তুমি ব্যর্থ হয়েছ? ‘চাচা, যারা গুপ্তধনের জন্য এখানে চষে বেড়িয়েছে, তারা আমার সর্বনাশ করেছে।’ বলল আলমের বাবা। ‘তোমার কথার সাথে আমি একমত হতে পারলাম না আলমের বাপ। ওরা তোমার ক্ষতি করতে যাবে কেন? ওরা তোমার চোখ খুলে দিয়েছে। তাদের বদৌলতে তুমি পরিত্যক্ত ভিটায় চাষাবাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছ। স্কুলে পাস করতে হলে যেমন লেখাপড়া জানতে হয়, তদ্রুপ কৃষিতে সফল হতে হলে, কৃষির জ্ঞান থাকতে হয়। এ জ্ঞান নাই বলেই তুমি ব্যর্থ হয়েছ। তুমি আগামী বৎসরের জন্য ভাল করে প্রস্তুতি নাও, দেখবে মাটি হতে গুপ্ত ধন বের হয়ে তোমাকে ধরা দিচ্ছে। ‘কি যে বলেন চাচা, আমি গুপ্তধন খোঁজছি না।’ ‘তুমি বুঝতেছ না যে, তুমি গুপ্তধন খুঁজছ।’ ‘কিভাবে?’ উত্তর খুব সহজ। তুমি তো চাও ভাল ফলস হোক। এই যে ফসল তা মাটিতে লুক্বায়িত। যে সম্পদ লুকায়িত তাই গুপ্তধন। তুমি পরিকল্পিতভাবে কাজ কর, প্রকৃত গুপ্তধন তোমার পদ চুম্বন করবে। আলমের বাবাকে উপদেশ দিয়ে বাজারের দিকে পা বাড়াল মফিজুর রহমান।

পুর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বান্দরবান গেল মিনহাজ, শাহীন ও আশরাফ। এবার তাদেরকে চূড়ান্ত অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তারা প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করেছে। কোন শক্তি এবার তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। তারা আদনানের বাড়ী পৌঁছে জানতে পারল, আদনান বাড়িতে নাই। সে স্কুলের জুন খেলায় অংশ নেবার জন্য অনুশীলনে গেছে। আদনানের মা মেহমানদেরকে বসতে দিয়ে নাস্তা তৈরি করতে চলে গেলেন। শাহীনও তার পিছনে পিছনে রান্নাঘরে গিয়ে বসল। ‘খালাম্মা, আমাদের জন্য কিছু করতে হবে না। আমাদের হাতে অনেক কাজ।’ শাহীন বলল। ‘তোমরা আমার মেহমান, করতে হবে না বললেই হলো। তোমার মা কেমন আছে?’ ‘ভাল।’ ‘গতবারও তোমরা তিনজন এসেছিলে এবারও সে তিনজনই এলে। কারণটা কি?’ শাহীন কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর বলল, ‘একটা কাজ আছে খালাম্মা।’ আদনানের মা নাস্তা নিয়ে এসে বারান্দায় পরিবেশন করল।

তাতুমের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হল তারা। বাড়ির বারান্দায় ঘন্টা খানেক বসল। তাতুমের কোন সাড়া শব্দ নাই। তার সহকারী মালেককেও দেখা যাচ্ছে না। ভিতর হতে মাঝে মধ্যে কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। ‘ব্যাপারটা কী?’ প্রশ্ন করল মিনহাজ। ‘আমিও তো কিছু বুঝছি না।’ জবাব দিল আশরাফ। তারা আরো ঘণ্টাখানেক সেখানে বসে বসে অতিবাহিত করার পর তাতুম বেরিয়ে এসে তাদের পরিচয় জানতে চাইল। এতে তারা আরো আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেল। পরিচয় দেবার পরও তাদেরকে চিনতে পারল না তাতুম। শেষে জানতে চাইল কী উদ্দেশ্যে তাদের আগমন। তারা তখন তাদের এলাকার গুপ্তধন, গতবারের এখানে আগমন, গর্ত খনন সব খুলে বলল। তাতুম তাদেরকে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কি জান গুপ্তধন কী?’ মিনহাজ বলল, ‘যে ধন গুপ্ত বা লুক্বায়িত আছে, তাই গুপ্তধন।’ শুনে হেসে দিল তাতুম। বলল, ‘তোমাদের ব্যাখ্যাটা সঠিক, কিন্তু তোমাদের চেষ্টা-প্রচেষ্টা ভুল। একটা মানুষ যখন পৃথিবীতে আগমন করে, পৃথিবীর ছোঁয়া লাগামাত্র তীব্র চিৎকারে কেঁদে ওঠে সে। তখন তার চরম অসহায় অবস্থা। মাতৃস্নেহের ছায়ায় ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে শিশুটি। ধীরে ধীরে সে উপুড়, হামগুড়ি, সর্বশেষ হাঁটতে শিখে। তারপর সে দৌড়তে, খেলতে শিখতে শিখতে এক সময় লেখা পড়ার উপযোগী হয়ে উঠে। বাবা-মা তাকে স্কুলে পাঠায়। ধীরে ধীরে সে আরো বেড়ে উঠতে থাকে। বাবা মা সবকিছু উজাড় করে দেয় তার জন্যে। মাতা-পিতার এসব প্রচেষ্টা, এ চাওয়ার অর্থ কি তোমাদের জানা আছে? ‘তারা চায় যে, আমরা শিক্ষিত হই।’ জবাব দিল মিনহাজ। ‘তোমরা শিক্ষিত হলে তাদের লাভ কী? তোমাদের লাভ কী? তোমরা শিক্ষিত হচ্ছ মানে, তোমরা নিজেদেরকে চিনতে পারছ। তোমাদের মধ্যে যে অফুরন্ত সম্ভাবনা আছে, তা বিকাশিত হচ্ছে। এ সম্পদটাই হচ্ছে তোমাদের গুপ্তধন। তোমরা যে সম্পদের পিছনে দৌড়াচ্ছ, তা এক মিথ্যা মায়া। এর মাধ্যমে তোমাদের সময় ক্ষয় হচ্ছে। তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছ। তোমাদের উচিত প্রকৃত গুপ্তধন বের করে নেয়া। তোমরা জাতির ভবিষ্যৎ। তোমরা যদি নিজেরা অন্ধকারে হাবুডুব খাও, জাতিকে পথ দেখাবে কিভাবে? মরীচিকার পিছনে দৌড়ে কোন লাভ নেই। এতে সময়ের অপচয় হবে, কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফল হবে শূন্য।’ ‘আমাদের হাতের কাছে যা আছে, তা আমরা হারাতে চায় না। এটা পাওয়া মাত্র আমরা আমাদের অভিযান গুটিয়ে ফেলব।’ শাহীন বলল। শোন, তোমার হাতের কাছে যা আছে, তা হল সময়। তুমি সময়ের সদ্ব্যবহার কর, এতে জাতি উপকৃত হবে। একটা দিন অপচয় করাতে শুধু তোমার ক্ষতি নয়। তোমার নিজের দিন কর্মবিহীন যাওয়াতে তোমার যেমন ক্ষতি হল, তেমনি জাতি তোমার নিকট হতে ঐ দিন কিছু ফেল না। জীবনে এমন একটা দিন অতিবাহিত করলে, যা খুব খারাপ। তুমি গুপ্তধন পাওয়া হতে একদিন পিছিয়ে গেলে। তোমাদের মধ্যে যে সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে তা কোটি টাকার গুপ্তধন। তোমরা কেন সে মহামূল্যবান গুপ্তধনকে অস্বীকার করে  তথাকথিত গুপ্তধনের পিছনে দৌড়াচ্ছ?’ তারা নিরাশ হয়ে তাতুমের বাড়ি হতে ফিরে আসতে লাগল। তারা যখন পাহাড় ছেড়ে বাস স্টেশনে পৌঁছে দেখে, আদনান কার সাথে কথা বলছে। তাদেরকে দেখে আদনান বাড়ির পথ ধরল। ‘শাহীন, তোর খালাত ভাই এমন করছে কেন? সে এবং তাতুম মিলে কি সব কিছু নিয়ে গেল নাকি?’ মিনহাজ বলল। ‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ জবাব দিল শাহীন।

আজ বার্ষিক পরীক্ষার ফল বের হবে। এ নিয়ে চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে মিনহাজ। সে একা স্কুলে যেতে চায়, কিন্তু দাদা নাছোড়বান্দা। তার সাথে দাদুও স্কুলে যাবে। শেষ পর্যন্ত দুজনে স্কুলে রওয়ানা হল। স্কুলে পৌঁছামাত্র প্রধানশিক্ষক তাদেরকে ডেকে তাঁর কামরায় নিয়ে গেলেন। প্রথমে মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছো?’ মিনহাজ চুপ করে রইল। প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘আমি ভালো করে বুঝেছি, তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওনি। তোমার পরীক্ষার ফলাফল দেখে আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি সে চোরের সন্ধান পাওনি। সে তোমার নিকট হতে অনেক কিছু চুরি করে নিয়ে গেছে।’ ‘আমার কাছ থেকে ঐ চোর চুরি করেছে?’ প্রশ্ন করল মিনহাজ। ‘হ্যাঁ, তোমার কাছ থেকে।’ ‘কিভাবে?’ ‘সে তোমার সব নিয়ে গেছে। এর পরিণতি হলো, তুমি পরীক্ষায় ফেল করেছ।’ ‘আমার নাতি পরীক্ষায় ফেল করেছে?’ মাথায় দুহাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো মফিজুর রহমান। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ‘আপনি এমন করছেন কেন? এত অল্পতে ভেঙ্গে পড়লে কি চলবে?’ ‘আমি আমার ছেলেকে কী জবাব দিব? আমার নাতি এখনো সোনার খোঁজে আছে।’ ‘মিনহাজ,’ প্রধান শিক্ষক বলতে লাগলেন, ‘তথাকথিত গুপ্তধন না খুঁজে নিজে সোনা হয়ে যাও, সর্বত্র তোমার মূল্যায়ন হবে। এক টুকরো সোনা যদি একশত বছর নোংরা কাঁদার মধ্যে থাকে, তবুও তার স্থান হবে গলায়। এভাবে সমাজে তোমার মূল্যায়ন হবে। তুমি মানুষ হও।’ ‘আমি তো মানুষ।’ বলল মিনহাজ ‘সবাই মানুষ, কিন্তু তোমাকে সত্যিকার মানুষ হতে হবে। তুমি দুধের মত না হয়ে, পনিরের মত হতে চাও। যদি দুধ পানির মধ্যে ফেলে দাও তা মিশে যাবে। যদি পনিরকে পানির মধ্যে ছেড়ে দাও, তা মিশবে না। উভয়ই দুধ। প্রক্রিয়াজাত করার পর পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। তুমিও মানুষ, অন্যান্য মানুষের সাথে প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে পার্থক্য সৃষ্টি করতে হবে। সবাই মানুষ, এটা অস্বীকার করার জোঁ নেই। কিন্তু একজন মানুষের সাথে যদি গরু, ছাগল, ভেড়ার জীবনের সাথে পার্থক্য না থাকে, তবে তাকে মানুষ বলা সমীচিন নয়। গরু, ছাগল, ভেড়ার জীবন একটা নির্দিষ্ট চক্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তোমার জীবন ও যদি একটা চক্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তোমার আর গরুর মধ্যে পার্থক্য কী? তুমি ফেল করেছ, হতাশ হবার কিছু নাই। এটা তোমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত। নতুন উদ্যমে কাজ শুরু কর, দেখবে সফল হচ্ছ। যদি নয়বার ব্যর্থ হয়ে দশবার ফিরে আসো, তবে তুমি সফল হবেই। এটাই সফলতার সংজ্ঞা। তাই বলা হয় সাফল্য হচ্ছে ৯৯% ব্যর্থতা। মিনহাজ বলোতো তোমার সমস্যাটা কী?’ তিনি জানতে চাইলেন। ‘হাবিব স্যার বারবার বলে আমার মাথায় নাকি কিছুই নাই।’ ‘হাবিব স্যার যদি এরকম বলে থাকে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করব। তোমার মাথায় সব ঠিক আছে। আল্লাহ সবাইকে সমান মেধা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সমস্যা হচ্ছে ব্যবহার বিধিতে। যে যার মেধাকে যত বেশি ব্যবহার করে, তার মেধার উজ্জ্বলতা তত বাড়বে। ব্যবহার কম হলে, মরিচা আক্রান্ত হবে। হাবিব স্যার এ কথা বলাতে তোমার মধ্যে হয়ত কিছুটা নিরুৎসাহিতা সৃষ্টি হয়েছে। কারো ঠুনকো কথায় যদি তোমার একটা বছর নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সর্বনাশ। সাধনা করে যাও, তুমি সফল হবে। তুমি যদি এবার পাস করতে সপ্তম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে। ফেল করাতে তোমাকে ষষ্ট শ্রেণীতে থাকতে হচ্ছে। তোমার জীবনের একটা বছর নষ্ট হল। জীবনে উত্থান পতন থাকবেই। এই জন্য হতাশ হওয়া যাবে না। হতাশাকে দু’পায়ে দলে এগিয়ে যেতে হবে। এটা হলো সফলতার মৌলিক সূত্র। পরিশ্রম করে যাও, সফল হবে। তুমি কি এখন চোরটাকে সনাক্ত করতে পেরেছ?’ ‘না স্যার।’ জবাব দিল মিনহাজ। ‘আরে বেকুব, সময়, সময়। সময়ের মূল্য বুঝে যদি যাও কাজে, প্রতিষ্ঠিত হবে তুমি জগতের মাঝে। সময় হচ্ছে এক নীরব ঘাতক। বরফের মত তা ক্ষয়ে যাচ্ছে। তোমার জীবনকেও ক্ষয়ে দিচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্ত হচ্ছে এক একটা জীবন। সময় নষ্ট করা মানে জীবন নষ্ট করা। আমাদের দেশে একটা কথা আছে, বারটার ট্রেন কয়টায় আসে? এটা আমাদের সময় সম্পর্কে অসাবধানতর ফসল। জীবনকে পরিমাপ কর। তুমি বুঝতে পারবে, তুমি কী হারাচ্ছ? কেউ যদি ষাট বছরের জীবন পায় তার জীবনের মোট ঘণ্টা হলো ৫,২৫,৫৮৫। সংখ্যাটা খুব বড় মনে হলেও মোটেই বড় নয়। শৈশবের অপরিপক্কতার মধ্যে তার পাঁচ বছর চলে যায়। বাকি থাকে পঞ্চান্ন বছর। মানুষের পরিমিত ঘুমের পরিমান ৭ ঘণ্টা। এক বছরে ঘুমায় ২৫৫৫ ঘণ্টা বা ১০৬ দিন। আমরা যদি দুপুরের বাড়তি ঘুম সহ অন্যান্য ঘুম ধরি, ধরতে পারি একজন মানুষ এক বছরে ঘুমান ১২১ দিন অর্থাৎ বৎসরের তিন ভাগের এক অংশ। এ হিসেবে ঘুমের মধ্যে মানুষ কাটায় ১৯ বছর, বাকি থাকে ৩৬ বছর। দাত ব্রাশ, টয়লেট, গোসল, খাওয়া, পত্রিকা পাঠ, টিভি দেখা, কাপড় পরা, যাতায়াত, আড্ডা, চা-নাস্তা, যানজট, বিশ্রাম ইত্যাদিতে দৈনিক তিন ঘণ্টা ব্যয় হলে ১ বছরে ব্যয় হয় ১০৯৫ ঘণ্টা (যা ব্যস্ত মানুষের হিসাব, যারা টিভি দেখার সুযোগ পায় না) বা ৪৬ দিন, অর্থাৎ ৮ বছর। থাকে ২৮ বছর। তুমি যদি সময়কে না বুঝ, জীবনকে বুঝতে পারবে না। সময় খোদার পক্ষ হতে পবিত্র আমানত। এটার সদ্ব্যবহার না করা মানে নিজেকে ধ্বংস করা। তুমি কি এখন হতে ঠিক মত লেখাপড়া করবে?’ ‘জি স্যার, এবার আর ভুল হবে না।’ জবাব দিল মিনহাজ। তার এ জবাব শুনে দাদুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। তারা ফিরে গেল বাড়িতে।

এগারো. তুমুল বির্তক হচ্ছে, রিশাদকে নিয়ে নয়। এবার বির্তকের বিষয়বস্তু শাহীন। সবার সন্দেহের আঙ্গুল এখন তার দিকে। অঙ্গুলি তার দিকে নিদের্শিত হওয়াই স্বাভাবিক। কিছুক্ষণ আগে সে চলে গেছে ঝগড়া করে। তাদের বিতর্কের বিষয়বস্তু ছিল গুপ্তধন। শাহীন গুপ্তধন নিয়ে তার নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে, আমি তোমাদের দলে আর নাই। আমরা একটা মিথ্যা স্বপ্নের পিছনে দৌড়াচ্ছি, আর নিজের গুপ্তধনকে অবহেলা করছি। যেন রিশাদের আরেকটি রূপ। ‘নিজের গুপ্তধন মানে?’ আশরাফ প্রশ্ন করেছিল। ‘নিজের মধ্যে থাকা প্রতিভা। আমরা যদি আমাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারি তবে, কত গুপ্তধন আমাদের হাতে আসবে তার ইয়ত্তা নেই। ভাগ্যের চাবিটি আমাদের হাতে, তাতে আমরা জং ধরিয়ে রেখেছি।’ জবাব দিল শাহীন। ‘তোর গুপ্তধন নিয়ে তুই থাক। রিশাদ নয়, আমরা তোকে বুঝতে পারিনি।’  মিনহাজ বলল। সাব্বির বিতর্কের অবসান ঘটাতে বলল, ‘এখন ঐ সব বাদ দাও, আমরা আমাদের শেষ চেষ্টা করি। অতীতের জন্য অনুশোচনা করে নিজেকে ধ্বংস না করে বর্তমানকে কাজে লাগাও, এতে ভবিষ্যৎটা সুন্দর হবে।’ ‘আমার মনে হচ্ছে, সবকিছু ওরা নিয়ে গেছে। আমাদের ঐ সোনা পাওয়ার আগ্রহ ছিল, কিন্তু ঠিক সময়ে কাজ শুরু না করাতে সব হারালাম। সে জন্যই বলে, সময়ের এক ফোড়, অসময়ের দশ ফোড়। এখন দেখি দশ ফোড় নয়, হাজার ফোড় দিলেও লাভ হবে না। আমাদের সময় জ্ঞান নাই বলে, আমরা ব্যর্থ হলাম। আজ হতে সব বাদ। এখন দরকার সময়মত লেখাপড়া করে নিজেকে মানুষ করা।’ বলল মাহবুব। ‘আমরা যদি তাকে লোভনীয় প্রস্তাব দেই, তখন বুঝতে পারবো, ব্যাপারটা কী? আসলে কি সব হাওয়া হয়ে গেছে? ওদের ধরা সহজ নয়। সে যদি এত চতুর না হয়। এত জনকে ফাঁকি দিল কিভাবে?’  শিহাব হতাশ মনে বলল। ‘রাখ ওসব ভারী কথা।’ মিনহাজ বলা শুরু করল। ‘এখন আমরা কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করে দেখি আসলে সব খোয়া গেছে কি না? যদি মনে হয় যে তা এখনো ঐ গুপ্তধন উদ্ধার হয়নি, তবে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। এই এক সপ্তাহ আমরা সবগুলো খুঁটে খুঁটে দেখব। যদি তা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে আমরা অভিযানে নামব। না হলে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করব।’ তারা কতকগুলো পূর্ণ সিদ্ধান্ত নিল। শাহীন ও রিশাদকে নজরদারীতে রাখা, উল্লুক ভিটায় কোন গুপ্ত তৎপরতা হচ্ছে কি না দেখা। ইত্যাদি, ইত্যাদি। পরবর্তী বোরবারে পুনরায় বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নিয়ে চলমান সভাটি শেষ করল অপারেশন হিডেন ট্রেজার কমিটি।

মিনহাজ এই স্কুলে আর যাবে না। সে জুনিয়র ছাত্রদের সাথে আর ক্লাশ করবে না। মফিজুর রহমান তাকে অনেক বুঝিয়েছে। সে কিছু বুঝতে চায় না। তার বক্তব্য একটাই ঐ স্কুলে আর যাবে না। শেষ পর্যন্ত মফিজুর রহমান তার কাছে আত্মসমর্পন করে, তাকে নিয়ে এলো শহরে। চিন্তা করলো, নাতি যদি পাড়ার দুষ্ট চক্রের নিকট কাছ হতে আলাদা হয়ে যায়, তবে তার মাথা হতে সব ভূত পালিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে শাহীন তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তাকে তার বাবা শহরে পাঠিয়ে দিয়েছে। রিশাদ প্রথম হতে তার ভুলের ব্যাপারে সচেতন ছিল। আনন্দলহরী স্কুল। ধীরে ধীরে মিনহাজ গিয়ে সভাকক্ষে ঢুকে চেয়ার টেনে বসল। বিশেষ ক্লাসের আয়োজন করা হয়েছে ছাত্রদের নিয়ে। বিষয় “এসো কুড়িয়ে তুলি কোটি টাকার গুপ্তধন, বদলে ফেলি জীবনের রং।” প্রণোদনার ক্লাস এটি। শিরোনামটা পড়ে হেসে দিল মিনহাজ। সে যখন শিরোনামটি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে ছিল, হঠাৎ চমকে উঠল সে। কখন তার পাশে শাহীন এসে বসেছে, খেয়াল ও করেনি। ‘কী ব্যাপার মিনহাজ, ঐ শিরোনাম দেখে কি পাগল হয়ে গেলি?’ শাহীন তাকে বিদ্রƒপের সুরে বলল। ‘তুইও এই স্কুলে ভর্তি হলি?’ কথার জবাব এড়াতে চাইল মিনহাজ। সকাল দশটায় অনুষ্ঠান শুরু হল। প্রধান শিক্ষক তার বক্তব্যে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, ‘শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে আমাদেরকে মানুষ করা। আমরা প্রকৃতিতে দেখতে পাই, প্রাণীদের জন্মের সাথে সাথে সহজাত বুদ্ধির খুব দ্রুত বিকাশ ঘটে। হাঁসের বাচ্চা জন্মের সাথে সাথে পানিতে সাঁতার কাটতে পারে। গরুর বাছুর দৌড়াতে পারে। তারা তৎক্ষণাৎ তাদের ভাল মন্দ বুঝতে সক্ষম হয়। কিন্তু তাদের এ বিকাশ দ্রুত থমকে যায়। তাদের মধ্যে বুদ্ধির তারতম্য দেখা যায় না। মানুষের জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার জীবনে আত্মবিকাশের পথ কখনো রুদ্ধ হয় না। সে জন্য শিক্ষার কোন সমাপ্তি নাই। এর পরিধি জন্মলগ্ন হতে আরম্ভ করে মৃত্যু পর্যন্ত। এমনকি একজন লোক মৃত্যুর পরও মানুষের শিক্ষার অন্যতম উৎস হতে পারে, যদি ঐ মানুষ পৃথিবীকে সেরূপ কিছু দিয়ে যায়। একবার এক জ্ঞানী মৃত্যু সময় উপস্থিত হলে তাকে দেখার জন্য এলাকার বিখ্যাত জ্ঞানীগণ গেলেন। তাদের মধ্যে এমন এক বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হলো, যা ঐ মৃত্যুপথ যাত্রী জ্ঞানী লোকটির জানা ছিল না। সে আলোচনা শুনার পর ঐ মুমূর্ষ জ্ঞানীটি বলল, শোকরিয়া, মৃত্যুর আগে একটা জ্ঞান শিখলাম। আমাদের জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা এমন হওয়া উচিত। তুমি যত জানবে, তোমার আত্মবিশ্বাস তত বাড়বে। তুমি যদি কিছু না জান, তবে তুমি হবে আত্মবিশ্বাস শূন্য। আত্মবিশ্বাস না থাকলে, সবকিছু তাসের ঘরের মতো উড়ে যায়। যদি কারো মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া যায়, তাকে যুদ্ধ করে পরাজিত করার দরকার হয় না। সে এমনিতেই আত্মসমর্পন করে। মানুষের জীবনে উন্নতির জন্য দরকার, কৌশলগত দক্ষতা। মানসিক দক্ষতা। জ্ঞানগত দক্ষতা। এই সব দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তোমাদের উচিত কিছু অনুপ্রেরণামূলক ও কিছু শিক্ষামূলক বই পাঠ করা। এসব বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে খাওয়া। আর ডায়েরিতে নিজের মত করে টুকে রাখা। জীবনে এগিয়ে যাবার জন্য দরকার আত্ম-চালিত হবার ক্ষমতা। তোমরা তোমাদের মেধার দ্বারা তা অর্জনে নিবেদিত হও। তোমরা হাতের কাছে সব সময় দুটি নথি রাখবেÑ প্রধান নথি। নিয়ন্ত্রক নথি। প্রধান নথি হবে বিভিন্ন উক্তির, কথা, ইতিহাস, শিক্ষার সংকলন। নিয়ন্ত্রক নথি হবে তোমার জীবনের বিভিন্ন দিকের সংকলন। এভাবে তুমি বিভিন্ন দিক হতে প্রাপ্ত আত্মোন্নয়নের নিদের্শিকাগুলো সংকলন করে নিজের উন্নতি সাধন করতে পারবে।’ সাঈদ স্যারও তার বক্তব্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিদের্শনা দিলেন। তিনি তার বক্তব্যে বললেন, ‘আমরা অনেক কথা শুনি আর অনেক কথা বলি। কথা বলা, কথা শুনা, নোট করে রাখা, সব কিছুর উর্ধ্বে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাস্তবায়ন। এ সত্যটাকে আমরা আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করব। আমরা আমাদের কর্মের ক্ষেত্রে ঘঅঞঙ হবো না, অঘঞ হবো। আমি  ঘঅঞঙ এবং অঘঞ-এর গল্প বলছি। একবার এক বাংলাদেশী আমলার সাথে একজন জাপানি কথা প্রসঙ্গে বলল, আপনারা হলেন ঘঅঞঙ সদস্য, আমরা হলাম অঘঞ. বাংলাদেশী বলল, আপনি ভুল বলছেন, আমরা ঘঅঞঙ সদস্য না। জাপানি বলল, আপনারা অবশ্যই ঘঅঞঙ সদস্য। ঘঅঞঙ মানে হলো ঘড় অপঃরড়হ, ঃধষশ ড়হষু আর অঘঞ হলো, অপঃরড়হ, ঘড় ঃধষশ। আমরা ঘঅঞঙ সদস্য না হয়ে অঘঞ হবো। আমরা যদি কাজের ব্যবস্থাপনা করতে না পারি, অন্তত অব্যবস্থাপনা যাতে না করি। তোমাদেরকে স্যারদের প্রদত্ত উপদেশগুলো মেনে চলার কাজ এখনি শুরু করতে হবে। তোমাদেরকে জানতে হবে গতকালটা ইতিহাস হয়ে গেছে, আগামীকাল হচ্ছে সম্ভাবনা, আজকের দিনটি শুধু সত্য। এখন হতে এসো কাজে লেগে যাই। দেশটাকে সুন্দর ভাবে সাজাই। আমরা আজ হতে প্রতিটি মুহূর্তকে সদ্ব্যবহারের ব্যাপারে সজাগ হব। কারণ, আমরা যদি সময় নষ্ট করি, সময় ও আমাদেরকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে। সময় এমন এক গুপ্তধন, যাকে আমরা প্রতিনিয়ত দূরে ঠেলে যাচ্ছি।’ শাহীন মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘গুপ্তধন কী এখন বুঝতে পেরেছ?’ মিনহাজ নীরব থাকল। কিছুক্ষণ পর মুখ ঘুরিয়ে দেখে, শাহীন নাই। তার আসনে বসে আছে অপরিচিত একজন। ভয়ে শরীরে সব লোমকুপ জেগে উঠল মিনহাজের। মিনহাজ মনে মনে বলল, এতক্ষণ যাকে দেখলাম সে কে? এসব কী হচ্ছে?

বারো. বিশ্বাসঘাতক চক্রের সন্ধান পেয়েছে মিনহাজ। ঐ চক্রটি শাহীন, রিশাদ বা আদনানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠেনি। এ চক্রটি গড়ে উঠেছে তাদের মাধ্যমে, যাদের নিয়ে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ করেনি মিনহাজ। ধরা পড়েছে হঠাৎ করে। শহর থেকে মিনহাজ সরাসরি বান্দরবানে যাচ্ছিল। সাতকানিয়া হতে এমন কয়েকজন গাড়িতে উঠল তাদেরকে দেখে মিনহাজ হতভম্ব হলেও বুদ্ধি হারায়নি। গাড়িতে মাথা নিচু করে নিজেকে আড়াল করল সে। ওরা বান্দরবানের গাড়িতে উঠল কেন? তাদের উদ্দেশ্য কী? মনে মনে ভাবল মিনহাজ। বান্দরবান এসে গাড়ি থামলে তারা নেমে পড়লো। ওরা কিছুদূর যাওয়ার পর বাস হতে নেমে এলো মিনহাজ। উদ্দেশ্যে চুপি চুপি তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করা। কিন্তু বিধি বাম। শিহাবের নজরে পড়ে যায় মিনহাজ। মিনহাজকে দেখে বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে গেল শিহাব। সাথে সাথে সাব্বির, মাহবুবও। ‘আরে মিনহাজ! তুই এখানে?’ জানতে চাইল শিহাব। ‘তোরা এখানে কেন?’ পাল্টা প্রশ্ন করল মিনহাজ। ‘এদিকে বেড়াতে আসলাম, এ আর কি, বিশ্বটাকে দেখা।’ বলল মাহবুব। ‘সত্যি বলছিস?’ মাহবুবের কাছে জানতে চাইল মিনহাজ। ‘যদি তাই হয় তবে, সবাই মিলে দেখি।’ ‘তুই কেন এসেছিস মিনহাজ? তুই তোর কাজে যা।’ বলল সাব্বির। ‘আমার কোন কাজ নেই, তোরা যখন এসেছিস, আমি তোদের নিয়ে ঘুরব।’ বলল মিনহাজ। প্রথমে গোপন করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নিল। সাব্বির জানাল, তারা তাতুমকে ম্যানেজ করে ফেলাতে সে মিনহাজদের সাথে আর যেতে রাজি হয়নি। শিহাব বলল, ‘আমরা কয়েকটা অভিযান চালিয়েছি, কিন্তু সব ব্যর্থ হয়েছে। তাতুম বলেছে, এবার চূড়ান্ত পদ্ধতিটা অবলম্বন করলে সুফল পাওয়া যাবে। তা জানতে বান্দরবান এসেছি।’ মিনহাজ তাদেরকে ক্ষমা করে দিল। মিনহাজসহ সবাই মিলে গেল তাতুমের আস্থানায়। তাতুম জানাল, আমি জ্বীনদের সাথে কথা বলেছি। তারা তেমন বেশি কিছু চায় না, তাদের দাবি শুধু আড়াইশ গ্রামের মতো সোনা। এগুলো ফেলে সব দাবি তারা ছেড়ে দিবে। দেখ তারা চায় মাত্র আড়াইশ গ্রাম, বিনিময়ে আমাদেরকে দিবে প্রায় দশ কেজির মত সোনা। তোমরা কি রাজি?’ ‘এত স্বর্ণ আমরা কোথায় পাব? এতো অনেক টাকার স্বর্ণ।’ মাহাবুব বলল। মিনহাজ বাধা দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি রাজি। আমি ব্যবস্থা করব। আপনি কখন যাচ্ছেন বলেন?’ তাতুম ক্যালেন্ডার দেখে বলল, ‘পরশু অমাবস্যার রাত। অমাবস্যা মানে জ্বীনদের রাজত্ব। তোমরা ঐ দিনের জন্য প্রস্তুতি নিতে পার।’ সিদ্ধান্ত হল, পরশু অমাবস্যার রাতে অভিযান চালাবে। রাত ঠিক একটা হতে শুরু হবে তাদের অভিযান। তারা সবাই খুশি মনে বাড়িতে ফিরে আসল।

শাহীনের বাড়িতে গেল মিনহাজ। উদ্দেশ্য শাহীন সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া। শাহীনের মা সব কথা শুনে বলল, ‘বাবা মনে হয় তুমি ভুল কিছু দেখেছ। শাহীন তোমার স্কুলে ভর্তি হয়নি।’ ‘কী যে বলেন চাচী। আমি নিজের চোখকে তো অবিশ্বাস করতে পারি না।’ ‘শাহীন ঐ স্কুলে যাবার কথা নয়, মনে হয় তোমার ভুল হচ্ছে।’ আবার বলল মহিলা। ‘সে অনেকক্ষণ আমার পাশে বসেছিল চাচী, পরে আমাকে না বলে চলে গেল। মনে হয় সে আমার উপর ক্ষুব্ধ।’ ‘আমার ছেলে ওখানে যাবার প্রশ্নই আসে না।’ তারা যখন আলোচনায় রত, ঐ সময় সেখানে এসে হাজির হলো শাহীন। সে শহর হতে ফিরে এসেছে। সব শুনে শাহীন হেসে বলল, ‘এটা তোর দৃষ্টির ভুল ছাড়া আর কিছু নয়। আমি ওখানে যাব কেন? আমার ও তোর স্কুলের মধ্যে কমছে কম দশ কিলোমিটার দূরত্ব। কোথায় খাতুনগঞ্জ আর কোথায় বন্দরটিলা। তোদের স্কুল আমি কখনো দেখিনি, নামও শুনিনি।’ ‘তাহলে আমার পাশে এক ঘণ্টা বসে ছিল ওটা কে?’ ভাবল মিনহাজ। একবার রিশাদ, একবার শাহীন, এসব কী হচ্ছে? পাড়ার এ জ্বীন ভূত কি আমাদের শেষ করে দিবে? এদের তাড়াতে কিছু একটা করা দরকার। প্রথমে স্বর্ণগুলো তুলে নিই, তারপর দেখা যাবে। মনে মনে ভাবল মিনহাজ।

তেরো. গভীর রাত। গর্ত খনন শেষ। তাতুম সব স্বর্ণ মাটি খুড়ে বের করে এনে মিনহাজকে বলল, ‘এই ধর তোমার সাধনার পূর্ণতা।’ এতগুলো স্বর্ণ একসাথে দেখে সবাই খুশিতে আত্মহারা। খুশিতে তারা নাচতে শুরু করল। তাতুমকে এখান হতে এক কেজি স্বর্ণ দিয়ে দিল মিনহাজ। খুশিতে টগবগ করে উঠলো তাতুম। তাদেরকে ধন্যবাদ দিতে দিতে গাঁটটা গুছিয়ে চলে গেল সে। আশরাফ , মাহবুব, সাব্বির, শিহাব ও আলম সবাইকে নিয়ে একটা বিশাল বাড়ি কিনতে যাচ্ছে মিনহাজ। পথে দেখতে পেল রিশাদ ও শাহীন দাঁড়িয়ে আছে, তাদের পিছনে দাদু। ‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ ?’ দাদু তাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল। ‘কেন দাদু? এই দেখ।’ মিনহাজ স্বর্ণের থলেটি তাদের সামনে খুলে ধরল। ‘এত স্বর্ণ...’ দাদু, রিশাদ ও শাহীন চিৎকার করে উঠল। ‘আপনি তো চেয়েছিলেন, আমরা যেন এ সব না পায়, এখন কে সত্যি?’ দাদুকে বলল মিনহাজ। ‘আর ঐ দু’জনতো কত ষড়যন্ত্র করল আমাদের বিরুদ্ধে।’ সবাই খিলখিল করে হেসে উঠল। তাদের হাসি দেখে কেমন যেন আনমনা হয়ে গেছে এ তিনজন। ‘এখন কোথায় যাচ্ছ?’ দাদু মিনহাজের কাছে জানতে চাইল। ‘একটা বিশাল বাড়ি কিনব। ওখানে থাকবো আমরা, এই কমিটির সদস্যরা।’ তারা চলতে শুরু করল। তাদের পানে হা তাকিয়ে আছে দাদু। যেন তার গালের ভিতর মশা মাছি ঢুকছে আর বের হচ্ছে। তারা এ তিনজনকে টা টা দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় ঘুম ভেঙে গেল মিনহাজের। চিৎকার চেঁচামেচিতে একে একে জেগে উঠল সবাই। আশরাফ, মাহবুব, সাব্বির, আলম ও শিহাব। জেগে দেখে প্রতিবেশীরা দাঁড়িয়ে টর্চ, চেরাগ হাতে নিয়ে। প্রথমে বুঝতে পারেনি মিনহাজ। কী হচ্ছে? সে কোথায় ঘুমিয়ে আছে? চেতনা পুরোপুরি ফিরে আসার পর তারা ছুটল উল্লুক ভিটার দিকে। পিছনে পিছনে প্রতিবেশীরাও। এদিক ওদিক সবখানে তাতুমকে খুঁজল তারা। তার অস্তিত্ব পাওয়া গেল না কোথাও। শুধু পড়ে আছে একটা গাঁট ও কিছু ছেঁড়া ফাঁটা কাপড়। ‘কোথায় সে? সর্বনাশ! সে আমাদের সব নিয়ে পালিয়েছে।’ চিৎকার করে উঠল মিনহাজ। ‘সব মানে ?’ প্রশ্ন করল মুফিজুর রহমান ‘মায়ের সব সোনা...’ ‘বলো কি, ভাইয়া?’ চিৎকার দিল মীনা। ‘হ্যাঁ... দাদু...’ কান্নায় ভেঙে পড়লো মিনহাজ। সে কান্নায় শরিক হয়েছে আশরাফ, সাব্বির, আলম ও মাহবুব। সবার সর্বনাশ ঘটেছে। সম্পদ হারানোর যন্ত্রণায় কেঁদে উঠল মালেকাও। খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সে প্রতারণার কাহিনী। সবাই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তাতুমের খোঁজে। কিন্তু নিরাশ হয়ে ফিরে আসল সবাই। অনেকে মফিজুর রহমানকে পরামর্শ দিল বিভিন্ন স্থানে খোঁজ খবর নিতে মানুষ পাঠানোর জন্য। রাজি হলো না সে। বলল, ‘সে হল প্রতারক, এতগুলো স্বর্ণ পাওয়ার পর সে কোথায় পালিয়ে যাবে তার ইয়ত্তা নাই।’ তিনি মিনহাজকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। মাথা নিচু করে বসে আছে মিনহাজ। ‘মিনহাজ, তুমি কি লাখপতি হতে পেরেছ?’ দাদু তাকে প্রশ্ন করল। ‘দাদু আমার ভুল হয়ে গেছে।’ কান্না করতে করতে জবাব দিল মিনহাজ। ‘শুন, তুমি ভেবেছিলে তুমি খুব বুদ্ধিমান আর আমরা বোকা। এখন কি বুঝেছ? যে নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান মনে করে, সে বড় বোকা। এতদিন তোমাকে অনেক উপদেশ দিয়ে বুঝাতে চেয়েছি, এখন তো আর উপদেশ দিয়ে কিছু বুঝাতে হবে না। সব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছ। তবুও শেষ বারের মত কিছু উপদেশ দিচ্ছি। তোমাকে আমি যে প্রাণীটার কথা বলেছিলাম, ঐ প্রাণীটা আর কিছু না, সময়। হেডস্যার তোমার কাছে যে চোরের পরিচয় জানতে চেয়েছিল তাও সময়। হয়ত তুমি যথাযথভাবে সময়কে ব্যবহার করবে, নয়ত সময় তোমার জীবনকে চুরি করে নিয়ে যাবে। সে নীরব চোর। নীরব ঘাতক। আর এ সময়ই হচ্ছে জীবন। সময়কে সেকেন্ড হিসাব করে সদ্ব্যবহার করতে হবে। এ জন্য তোমার উচিত সময়ের হিসাব রাখা। তুমি একটা রুটিন তৈরি করে জীবনের খোঁজখবর নাও। তখন বুঝতে পারবে, সময় কিভাবে ব্যয় হচ্ছে। তুমি যদি সঠিকভাবে জীবনের হিসাব রাখ, অতি শীঘ্রই প্রকৃত গুপ্তধন খুঁজে পাবে।

সকাল দশটা। মিনহাজ চলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম শহরে। মা-দাদী, মীনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে চলে যাচ্ছে। মফিজুর রহমান তাকে এগিয়ে দিলো। হাঁটতে হাঁটতে তারা রাস্তার উপর এসে গেছে। তাদের দেখে একটি রিকসা এসে দাঁড়ালো সেখানে। রিকসায় উঠতে উঠতে মিনহাজ দাদুকে বলল, ‘দাদু আমার জন্য দোয়া করুন। এবার আমি লেখাপড়ার মধ্য দিয়ে প্রকৃত গুপ্ত-সম্পদ খুঁজে নেব।’ রিকসায় উঠে বসল সে। রিকসা চলতে লাগল সম্মুখ পানে। তাকে বিদায় দিয়ে মফিজুর রহমান বাড়ির পথ ধরল। আসার সময় পিছনে ফিরে দেখে মিনহাজ রিকসার পিছনের পর্দা তুলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মফিজুর রহমান যথাসম্ভব জোরে চিৎকার করে বলল, ‘সময়, সময়...’। (সমাপ্ত)

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ