মুক্তির চেতনা

মুক্তির চেতনা

গল্প সালেহ মাহমুদ এপ্রিল ২০২৩

অনেক বেলা হয়ে গেছে। আমি বিছানায় শুয়ে-বসে ছটফট করছি। কিছুই ভাল্লাগছে না।

পত্রিকা পড়েছি এক ঘণ্টা হয়ে গেলো। সবগুলো নিউজের হেডলাইনে একবার চোখ বুলিয়েই আমার পত্রিকা পড়ার কাজটা শেষ হয়ে যায়। আর ভালো লাগে না। প্রতিদিন একই নিউজ। নিউজের চেহারা সেই একই রকম- রাজশাহীতে কিশোরীর আত্মহত্মা। রংপুরে পরকীয়ার বলি স্বামী...। দিনাজপুরে বিরোধী দলের সমাবেশস্থলে সরকারি দলের সভা আহ্বানের প্রেক্ষিতে সভাস্থলে ১৪৪ ধারা জারি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিভাবান কলেজছাত্র নিহত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি ছাত্রসংগঠনের অতর্কিত হামলায় প্রতিপক্ষের দুই ছাত্রনেতা নিহত, আহত অর্ধশতাধিক। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা। নাজিরপুরে ৫ টাকার জন্য রিক্সাওয়ালা খুন। সৈয়দপুরে পুত্রের হাতে পিতা নিহত...। 

এই একই রকম খবর প্রতিদিন পড়তে পড়তে এখন আর ভাল্লাগে না। মনে হয় কিছু একটা পরিবর্তন দরকার, খুব দরকার। সেই পরিবর্তনের প্রত্যাশা আমার ভেতর এত প্রকট হয়ে উঠেছে যে, আমি আর স্থির থাকতে পারছি না। 

আমার স্ত্রী রান্নাঘরে নাস্তা তৈরি করছে। বড় মেয়ে তড়িঘড়ি করে নাস্তা সেরে স্কুলে চলে গেছে। ছেলের স্কুল ডে শিফটে, আমার ভয়ে সকালের ঘুম দিতে না পেরে এই রুম ওই রুম করছে। কোথায় একটু পড়তে বসবে- তা না। ঘুর ঘুর করে সময় নষ্ট করাতেই যেন ওর আনন্দ। আমি সবকিছু দেখেও কিছুই বলছি না। কত আর বলব, প্রতিদিন একই প্যানর প্যানর করতে আর ভাল্লাগে না। 

স্ত্রী রুমে ঢুকে আমাকে শোয়া দেখে একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলো। কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো- খারাপ লাগছে নাকি তোমার, শুয়ে আছ যে?

না, খারাপ লাগছে না। অস্থির লাগছে, কি করব বুঝতে পারছি না। এই দেখ না, আজকের পত্রিকার নিউজও ঠিক গতকালের মতো। শুধুমাত্র পত্রিকার তারিখটাই ভিন্ন, দেখো, দেখো...। বলে পত্রিকাটা বাড়িয়ে দেই তার দিকে। 

আমার স্ত্রী পত্রিকাটা হাত দিয়ে সরিয়ে দেয়। এক রকম বিরক্ত হয়ে বলে- আবারো সেই একই কথা বলছ তুমি। তুমি রাজনীতিবিদ হলে নাকি! তোমাকে দেশ নিয়ে এত ভাবতে কে বলছে? বাচ্চাদের স্কুলের বেতন দিতে হবে, বুয়ার বেতন, বাড়িভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল দিতে হবে কালকের মধ্যেই। সেই হিসাব আছে তো?

স্ত্রীর কথা শুনে আমার বিরক্ত লাগে। আরে আমি কোথায় ভাবছি দেশ নিয়ে, আর তুমি কিনা এই সামান্য টুকটাক সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছ। আসলে তুমি এমএসসি পাস করেছ খামোখাই। তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। বাজারের কথা বলতে তো ভুলেই গেছ, নাকি!

আমার কথা শুনে স্ত্রী রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে মুখ ঝামটা মেরে ওঠে। এই, তুমি আমার পড়াশোনা নিয়ে টিজ করছো কেন? আমি কি সাধে ঘরকন্যা করি। তুমিই তো আমাকে চাকরি করতে দিলে না। বলো, চাকরি কি আমি করতে চাই নি? উহ্্ আমার বীর পালোয়ান রে। উনি বললেন, তোমার চাকরির কি দরকার। আমিই তো সব খরচাখরচের সামাল দেব। তুমি শুধু ঘর সামলাবে আর বাচ্চাদের মানুষ করবে। কই এখন কি করছো তুমি? ঘরে এখন নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা কেন? বল।

এই রে সেরেছে, গোখরার লেজে পাড়া দিয়ে ফেলেছি। আমি এবার প্রমাদ গুনি। তড়াক করে লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠেই শার্ট গায়ে চড়াতে চড়াতে বলি, কই বাজারের ব্যাগ দাও। বাজারটা সেরে আসি। আর আজ রাতেই তোমার সব খরচাপাতির টাকা দিয়ে দেব, ঠিক আছে?

আমার বিছানা ছাড়া দেখেই স্ত্রীর রাগটা একটু পড়ে যায়। তবুও ফোঁস ফোঁস করতেই থাকে। গরম গলায়ই বলে, নাস্তা হয়ে গেছে, সেরে যাও, নয়তো আবার হোটেলে ঢুকে বাজারের হাতটান ফেলে দেবে। তোমাকে আমি চিনি না। সংসার খরচের কথা বললেই ভেজা বেড়াল সেজে যাও। উল্লুক কোথাকার।

স্ত্রী রান্নাঘরে চলে যায়, আর আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। যাক অল্পতে বাঁচা গেল। ভাগ্য ভালো ঘরের নাস্তাটা কপালে জুটল। আমি ধীরে সুস্থে বাথরুম সেরে ট্রাউজার পরে বাজারের জন্য তৈরি হয়ে নেই।


বাজার সেরে গোসল- টোসল করে ড্রয়িং রুমে এসে বসে থাকি অন্তুর জন্য। গতকাল ছেলেটা বলেছিল বিশেষ প্রয়োজনে আমার সাথে কথা আছে। আমি ওকে বাসায় আসতে বলে দিয়েছি। ছেলেটা এখনো আসছে না। ঘড়িতে দশটা ছুঁই ছুঁই করছে। আমি অস্থির হয়ে আবারো পত্রিকা হাতে নিয়ে বসি। আলগোছে চোখ বুলাতে গিয়ে একটা নিউজে আটকে যায় চোখ। 

পত্রিকার প্রথম পাতার মাঝখানের তিন কলামের নিউজ- 

সাইবার যুদ্ধে ভারত হেরে গেছে। বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে জানানো হয়, গত দুদিন যাবৎ ভারতীয় হ্যাকাররা বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি- বেসরকারি কিছু সাইট হ্যাকিং করতে শুরু করলে বাংলাদেশী হ্যাকাররা তার জবাবে ভারতীয় সাইট হ্যাকিং করা শুরু করে। সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে বাংলাদেশী হ্যাকাররা এ পর্যন্ত প্রায় ২০ সহস্রাধিক ভারতীয় সাইট হ্যাক করেছে। বাংলাদেশী হ্যাকাররা এই সাইবার যুদ্ধ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। 

নিউজটা পড়েই আমি লাফিয়ে উঠি। চিৎকার করে ডাক দেই- মুমুর মা মুমুর মা ... তাড়াতাড়ি এদিকে আসো।

আমার এমন অতর্কিত ডাক শুনে দৌড়ে আসে আমার স্ত্রী। কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে বলে, কী ব্যাপার? এত ডাকাডাকি করছো কেন? বাড়িতে ডাকাত পড়েছে নাকি?

আরে না না। আরে দেখোই না কি সাংঘাতিক নিউজ। বাংলাদেশের সোনার ছেলেরা এবার ভারতকে হারিয়ে দিয়েছে। এই দেখ, এই নিউজটা পড়। বলেই আমি পত্রিকাটি বাড়িয়ে দেই ওর দিকে।

সাগ্রহে পত্রিকাটি হাতে নিয়ে নিউজটি পড়তে থাকে মুমুর মা। আর আমি লক্ষ্য করি ওর চেহারায় একটা খুশির ঝলক বয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে। আমি খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠি ওর প্রতিক্রিয়া দেখে। আমি সোৎসাহে বলে উঠি- দেখেছো ছেলেদের কাণ্ড। বিজিবি আর আর্মি যা পারেনি তা এই পুঁচকে ছেলেগুলো কি অনায়াসে তা করে ফেললো। এবার একটা কিছু হবে, দেখে নিও।

নিউজটা পড়তে পড়তে তার চেহারায় ভাবান্তর হয়। কপাল কুঞ্চিত হতে থাকে। কুঞ্চিত হতে হতে তিন ভাঁজ পড়ে যায় কপালে। আমি শঙ্কিত হয়ে পড়ি, কি এমন ঘটল যে ও চিন্তিত হয়ে গেলো? আমি উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকি আমার স্ত্রীর দিকে আর ওর ভাবান্তর লক্ষ্য করতে থাকি। নিউজটা পড়া শেষ করে খুব চিন্তিত মুখে সে তাকায় আমার দিকে।

আচ্ছা বলতো, এই ছেলেগুলোর কী হবে?

আমি থতমত খেয়ে যাই। অনেকটা স্বগতোক্তি করে উঠি- কি হবে মানে? কিসের কথা বলছো তুমি?

বলছিলাম এই পুঁচকে বাংলাদেশী হ্যাকারদের কথা। এত মেধাবী বাচ্চাগুলো আবেগের বশে যা করেছে তাতো করে ফেলেছেই। কিন্তু আমাদের সরকার কি ওদের এমনি এমনি ছেড়ে দেবে মনে করছো? দিল্লি থেকে এ ব্যাপারে সরকারকে চাপ দিলেই তো সরকার এই পুঁচকে ছেলেগুলোকে ধরপাকড় শুরু করে দেবে। তখন কি হবে? এই অমিত সম্ভাবনাময় ছেলেগুলোর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে না? একবার ভেবে দেখ তো ব্যাপারটা?

আমি স্ত্রীর কথায় বিষম খাই। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা লাগে আমার মনে। আমার ভেতর আবারো সেই খারাপ লাগা ব্যাপারটা চনমন করে ওঠে। তাহলে? তাহলে কি হবে এই সম্ভাবনাগুলোর? এরা কি অঙ্কুরেই বিনাশ হয়ে যাবে? আরো এই ছেলেগুলোকে কাজে লাগালেই তো আমার দেশ অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে। এরা হয়তো একেকজন বিল গেটস কিংবা স্টিভ জবস হয়ে যাবে একটু যত্ন নিলেই। আমি মাথা দোলাই। স্ত্রীকে বলি, না না তুমি যা ভাবছো বিষয়টা সে রকম নয়। সরকার ওদের ঘাঁটাতে যাবে কেন? ওরা তো সরকারের কোন ক্ষতি করছে না। বরং ওরা সরকারের প্যারালাল হয়ে কাজ করছে ফ্রি ল্যান্সারের মতো।


স্ত্রী যেভাবে কথা বলছে তা তো একজন সাধারণ গৃহিণীর কথা নয়। একজন সচেতন রাজনীতিবিদের কথা। অথচ আমি ওকে চিনতেই পারি নি। দেশ নিয়ে সে এত ভাবে? আমি সত্যি সত্যি স্তব্ধ হয়ে যাই। আমার মুখে কোন কথা জোগায় না। হা করে তাকিয়ে থাকি তার দিকে।

আমার বিস্ময়াভিভূত হওয়া তাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করে না। সে গড়গড় করে বলে যায়, দেখো বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। শুধুমাত্র নতুন দেশ লাভের আকাক্সক্ষায় পৃথিবীর কোনো ভূখণ্ড কখনো স্বাধীন হয়নি। আমাদের দেশও না। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে এদেশের মানুষ পাকিস্তান বানিয়েছিল এক বুক স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা দুঃস্বপ্নে পরিণত করলো। এ দেশের মানুষ আবারো রক্ত¯œাত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জন্ম দিলো। সত্যি করে বলতো এখানো কি আমরা প্রকৃত মুক্তি পেয়েছি? সেই কাক্সিক্ষত মুক্তি কি পেয়েছি?

তোমার মত একজন দেশপ্রেমিক স্ত্রীর স্বামী হয়ে আমি আজ গর্বিত। তোমার মত করে তো কখনো ভাবিনি। আমার ভাবনাগুলো ছিল খেইহারা নৌকার মতো। আর তোমার ভাবনাগুলো সমুদ্রের অতল গহ্বর থেকে উঠে আসার মুক্তোদানার মতো। বলো আমাকে কি করতে হবে।

মুমুর মার চোখ থেকে অশ্রুর ধারা নেমে আসে। নিজেকে সংবরণ করে বলে ওঠে, তুমিও তো একজন প্রোগ্রামার। আর কিছু পারো না পারো এই পুঁচকে ছেলেগুলোকে আগে রক্ষা করো। তুমি যার জন্য অপেক্ষা করছো সেই অন্তুও সম্ভবত এই সাইবার আর্মির সদস্য। তুমি এদের সাথে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে এদের সুরক্ষা দেবার ব্যবস্থা করো। আমি তোমার পাশে আছি সব সময়।

আমার স্ত্রীর কথা শুনে গর্বে আমার বুকটা ফুলে ওঠে। আমি এতদিন বুঝতেই পারিনি কত বড় দেশপ্রেমিক সত্তাকে নিতান্ত গৃহবধূ মনে করে এসেছি। আমি দিশেহারা হয়ে যাই। কি করবো না করবো ভেবে পাই না। এমন সময় কলিং বেল বেজে ওঠে। আমার স্ত্রী বলে ওঠে, 

তোমার সাইবার যোদ্ধা চলে এসেছে বোধ হয়। যাও, তাদেরকে নিরাপত্তা দাও। চেষ্টা করে দেখো এই অভাগা জাতিটাকে কিছু দিতে পার কিনা, যাও।

আমি নতুন এক স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠি। হ্যাঁ আমাকে পারতেই হবে, এই অমিত সম্ভাবনাগুলো নিরাপত্তা দিতে হবে। ওদেরকে গাইডলাইন দিতে হবে। আমার দেশকে উপহার দিতে হবে একঝাঁক সাহসী তরুণ।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ