মুগ্ধর শালিক    -তমসুর হোসেন

মুগ্ধর শালিক -তমসুর হোসেন

গল্প ডিসেম্বর ২০১৫

সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো। বৃষ্টি দেখতে জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ।
একটানা রিমঝিম শব্দে তার মনটা আনমনা হয়ে যায়। গাছের পাতা ঘরের চালে জলের নাচন দেখে সে ছবি আঁকার কথা ভাবে। ভেজাকাক আর হাঁসের ছবি এঁকে সারাটা দিন কাটিয়ে দিতে মনস্থ করলো সে। রঙ পেন্সিল বের করে খাতায় একটা কাকের ছবি আঁকলো সে। কিন্তু কাক না হয়ে ওটা হলো গাঙ শালিক। রান্না সেরে ঘরে এলে মাকে মুগ্ধ বললো,
‘এই দেখো কাক এঁকেছি।’
‘ওমা এটা তো শালিক।’
‘তুমি ভুল বলছো। এটা পাতিকাক।’
‘কাকের ঠোঁট এমন। ছবি দেখে প্র্যাকটিস করো।’
মায়ের কথাই ঠিক। ওটা মেটে ঘুঘু হলেও হতে পারে। তবে ভালো করে দেখলে হট্টিটির মনে হয়। ছবিতে ব্যস্ত থাকায় মুগ্ধ বৃষ্টির কথা একেবারে ভুলে গেছে। বাইরে তাকিয়ে সে দেখলো বৃষ্টি আর বাতাসের দোলায় গাছের শাখা দুলছে। হঠাৎ একটা শালিক বাজের তাড়া খেয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো। ভয়ে শালিকটা কাঁপছে। তার ঘাড়ের কাছে ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। শালিকটার এ দশা দেখে মুগ্ধ মাকে ডাকতে লাগলো।
‘মা, জলদি আসো। দেখো শালিকের কী হয়েছে।’
‘তোমার নাস্তা নিয়ে আসছি। এখন রঙের কাজ করো।’
‘দেখে যাও, কে যেন শালিককে জখম করেছে।’
মা এসে অবাক হলেন। শালিকটা মরার মতো পড়ে আছে। মুগ্ধ রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু জখম এতটা গভীর যে রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। হলুদ আর তেল লাগিয়ে মা রক্ত বন্ধ করলেন। বাবা বললেন, ওকে স্টিচ দেয়া দরকার। এখানে পশু হাসপাতাল নেই। তবে নিকটেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। বৃষ্টিতে ভিজে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন বাবা। মামুন কাকু ওখানকার ডাক্তার। উনি জখমে স্টিচ দিয়ে দিলেন। খাওয়ার ওষুধও দিলেন। মুগ্ধর কাজ হলো ওকে নিয়মিত ওষুধ খাওয়ানো। এখন গ্রীষ্মের ছুটি। মুগ্ধ ব্যস্ত হয়ে পড়লো। লিব্যাক সিরাপ এক মিলিলিটার করে দিনে চারবার। ভাসকো দৈনিক হাফ চামুচ। আর নিউপ্রিন ক্রিম লাগাতে হয় দিনে দুইবার। ঝানু নার্সের মতো শালিকের যতœ করতে লাগলো মুগ্ধ। গজ আর কটন দিয়ে ব্যান্ডেজ করা ওর কাছে কোন বিষয়ই না। ফরসেপ দিয়ে ওকে খাওয়ানো বেশ পছন্দ করছেন বাবা। বাবা ওসব পারেন না। তবে বাবার তদারকি মুগ্ধকে অবাক করে।
পনেরো দিনে ক্ষত শুকিয়ে গেলো। মামুন কাকু দেখে বললেন, ওর বাহুতে ফ্রাকচার হয়েছে। পাখির ডাক্তার দেখালে ভালো হয়। ভেটেরিনারি সার্জনের সাথে কনসাল্ট করলে মন্দ হয় না। জেলা সদরের ভি.এস শালিকের জয়েন্টে অপারেশন করলেন। বেশ খরচ করতে হলো বাবাকে। মুগ্ধর দিকে খেয়াল করে বাবা সব করলেন। মুগ্ধরও কাজ বেড়ে গেলো। অপারেশনের পর শালিকটা দুর্বল হয়ে পড়লো। কেমন করে ওকে সুস্থ করে তোলা যায় মুগ্ধর একটাই ভাবনা। ফড়িঙ আর মথ ধরে এনে শালিককে খাওয়ায় সে। কিন্তু শালিকটা মনে হয় সুস্থ হবে না। সুস্থ হওয়ার কোন চেষ্টা ওর মধ্যে নেই। হতাশ হয় মুগ্ধ। বাবাকে বলে,
‘ওর বিষয়ে তুমি কি কিছু ভাবছো?’
‘কি ভাববো? আমি কি ডাক্তার?’
‘ডাক্তারকে মোবাইল করো। না খেলে ও তো মারা যাবে।’
‘তুমি তো চেষ্টা করছো। দেখো কি হয়।’
‘ওতে কোন কাজ হবে না। না খেলে আমি কি করবো?’
মুগ্ধর বাবা ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করেন পাখিকে কেমন করে খাওয়াবে। ডাক্তার ব্যস্ত হতে নিষেধ করেন। অপারেশনের পর রুচি কমে যাওয়া স্বাভাবিক বিষয়। আস্তে আস্তে রুচি বাড়বে। মানুষ এবং পশুর চিকিৎসার একই নিয়ম। কিন্তু মুগ্ধ মনে করে ডাক্তার পাখির বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। সে মামুন কাকুর কাছে চলে গেলো। তিনি একটা রুচির সিরাপ দিলেন। সিরাপের নাম পেরিডোন। পাঁচফোঁটা করে দৈনিক তিনবেলা খাওয়াতে হবে। দু’দিনেই ভালো কাজ হলো। খাবার মুখে তুলতে লাগলো শালিকটা। মা খুশি হয়ে বললেন,
‘বেশ তো খাচ্ছে তোমার পাখি।’
‘খাবে না! সিরাপ কি এমনি এনেছি। তোমরা তো বসে আছো।’
‘আমরা কি করবো?’
‘না বললে ডাক্তার ব্যবস্থা দেবেন?’
‘এখন খাওয়াও। এমন ছেলে ঘরে থাকলে সমস্যা কী।’
‘ওসব বলে ভুলিয়ো না। আমার অনেক কাজ।’
অপারেশনের তিন মাস পরও পাখিটা উড়তে পারছে না। ওড়ার চেষ্টাও করে না। ওর জন্য বাবা বড় দেখে খাঁচা কিনে এনেছেন। শালিক ওর মধ্যে বসে থাকে। একটু আধটু হাঁটে। কিন্তু ডানা ঝাপটায় না। মুগ্ধ ওকে টেবিলের ওপর রাখে। ও ওড়ার চেষ্টা করে না। মুগ্ধ খুব চিন্তিত হয়। বাবাকে বলে,
‘ওর দিকে খেয়াল করছো না কেন বাবা।’
‘বেশ তো খাচ্ছে এখন।’
‘ওতো উড়তে পারছে না।’
‘ধকল তো কম গেলো না। দেখা যাক কি হয়।’
‘ডাক্তারকে জানাবে। ওড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’
বাবা বিষয়টা জানালেন ডাক্তারকে। ডাক্তার কিছু উপদেশ দিলেন। শালিকের ডানা কিছুটা শক্ত হয়ে গেছে। নিয়মিত ব্যায়াম হওয়া দরকার। ওড়ার প্র্যাকটিসের জন্য মুক্ত জায়গায় ওকে রাখতে হবে। বাবা শালিকের জন্য বড় খাঁচা বানালেন। খাঁচায় ও ডিগবাজি খেতে পারবে। মুগ্ধর কাজ আরো বেড়ে গেলো। শালিককে মাঠে নিয়ে ওড়ার প্র্যাকটিস করাতে হবে। মাটিতে পড়ে শালিক যেন ব্যথা না পায়। নিয়মিত ব্যায়ামে শালিক সুস্থ হতে লাগলো। একা উড়তে যেতে পারে সে। মুগ্ধর আনন্দ দেখে কে। ও মাকে বললো,
‘ও এখন উড়তে পারছে।’
‘উড়তে পারলে ও কি এখানে থাকবে?’
‘যেখানে খুশি চলে যাবে।’
শালিকের চলে যাওয়ার কথায় মুগ্ধর মন ব্যথিত হয়। ওর প্রতি মুগ্ধর মনে মায়া সৃষ্টি হয়েছে। মা বোঝে মুগ্ধ ওর চলে যাওয়ার বেদনা ভুলতে পারবে না। তাই সে বলে,
‘ও চলে গেলে কী করবে?’
‘কি করবো মানে? পড়াশুনা করতে হবে না?’
‘এতো করে সুস্থ করে তুললে।’
‘তুমিও তো কম করলে না। তুমি কি করবে?’
শালিক সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠলো। এখন সে ইচ্ছেমতো উড়তে পারে। ওর এ অবস্থা দেখে বাবা বললেন,
‘ওকে ছেড়ে দেয়াই ভালো। বনের পাখি বনেই চলে যাক।’
‘বাবা, চলো তাই করি। ওকে আকাশে উড়িয়ে দাও।’
বাবা শালিককে আকাশে উড়িয়ে দিলেন। মনের আনন্দে উড়ে শালিক জাম গাছের ডালে যেয়ে বসলো। ওকে দেখে কয়েকটা শালিক এসে চারপাশে বসলো। ওদের সাথে সে অনেক দূরে উড়ে চলে গেলো। সারাদিন ওর সন্ধান পেলো না মুগ্ধ। ওর মনটা বিষাদে ভরে গেলো। শালিকের কথা ভাবতেই চোখে পানি আসতে লাগলো। আজ তার একটুও আনন্দ লাগছে না। ওকে দেখে মা বললেন,
‘মুখটা মলিন হয়েছে কেন?’
‘কিছু ভাল লাগছে না।’
‘কেন, অসুখ করেছে?’
‘না এমনিই। কেমন যেন খারাপ লাগছে।’
‘শালিকের কথা ভাবছো। ওসব ভাবতে হবে না। কাপড় ছেড়ে খেয়ে নাও।’
কলপাড়ে মুখ ধুয়ে খাঁচার কাছে দাঁড়ায় মুগ্ধ। ওকে অবাক করে খাঁচার ভেতর ঢোকে শালিক। আপন মনে কিচিরমিচির শব্দ করে। মা শালিককে বলে, ‘একটা কথা খেয়াল রেখো। সারাদিন বাইরে ঘুরবে আর রাতে এখানে থাকবে।’
মায়ের কথা একটুও ভুলে যায়নি শালিক। যেখানেই যাক না কেন সন্ধ্যা হলেই সে বাড়িতে ফিরে আসে। কী এক অনুপম মায়ায় তার মনটা বাঁধা পড়ে গেছে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ