মৌমিতার চিঠি

মৌমিতার চিঠি

গল্প অক্টোবর ২০১৪

আবিদ আজম

পরম প্রিয় বন্ধুরা, বাংলাদেশের হাজার শিশুর পক্ষ থেকে আন্তরিক সমবেদনা জানাচিছ তোমাদের। জানি, তোমরা মোটেও ভালো নেই। ভীষণ কষ্ট আর আতঙ্কে কাটছে তোমাদের দিন। নিজের আপন ভূমিতে চোখের সামনে ছোট্ট বন্ধুদের অস্বাভাবিক মৃত্যু দেখলে নিশ্চয়ই কেউ ভালো থাকতে পারে না। তোমরা ভালো নেই জেনে আমরাও ভালো নেই। ভালো থাকবো কী করে? অস্ত্র-বোমার আঘাতে নিষ্পাপ শত শিশুর শরীর মুহূর্তেই লাশে পরিণত হচ্ছে তোমাদের দেশে, টেলিভিশনের পর্দায় এমন দৃশ্য দেখে দুঃখে আমাদের হৃদয়েই যেন রক্ত ঝরে পড়ছে। কান্নার নীরব শোকে আমাদের দু’চোখ ভিজে যাচ্ছে। তোমাদের জন্য শুভকামনা আর প্রার্থনা করা ছাড়া আমাদের আর কিইবা করার থাকতে পারে! আমরা বাংলাদেশের শিশুরা বড়ই নিরুপায়, তোমাদের করুণ অবস্থা দেখে আমরা দারুণ অসহায়বোধ করছি। শত শত শিশুবন্ধুর রক্তমাখা চেহারা প্রতিদিন পত্রিকায় বড় করে ছাপা হচ্ছে, টেলিভিশনের খবরে চোখ বুলালেই মৃত-আহত শিশুদের ছবি দেখে আমরা যেন শোকে পাথর হয়ে গেছি। হত্যাকারী মানুষরূপী দানবদের ঘৃণা জানানোর ভাষা যেন আমাদের জানা নেই। নিরপরাধ শিশুরাই যেন খুনি ঘাতকদের অন্যতম টার্গেট। ওদের হৃদয়ে কী বিন্দুমাত্র মায়া হয় না, খুনিদের অবুঝ সন্তান কিংবা ভাইবোনদের কেউ এভাবে মেরে ফেললে কেমন লাগতো! কী নির্দয় ও নিষ্ঠুর ওরা। বাংলাদেশে বসে আমরা যখন আনন্দে হেসে-খেলে দিন কাটাচ্ছি, ঠিক তখন তোমরা তীব্র ভয় আর আতঙ্কের ভেতর দিন কাটাচ্ছ। মৃত্যুর প্রহর গুনে চলতে হচ্ছে তোমাদের। এর কি কোন শেষ নেই? মানবতার পক্ষে বিশ্ব বিবেক কবে জেগে উঠবে? যারা হিং¯্র ওই খুনিদের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্বে ভূমিকা রাখছে না, তাদের পরিণতিও কি এমন হতে পারে না? পরম করুণাময় প্রভুর কাছে তোমাদের জন্য প্রার্থনা করছি-ফিলিস্তিনের শিশুদের রক্ষা করো, রক্ষা করো, রক্ষা করো...। এটুকু লিখে কলম থেমে গেল মৌমিতার। আর কিছু লিখতে পারছে না না সে। কত কিছুইতো লেখার ছিল গাজার ফিলিস্তিনের হাজার হাজার মাইল দূরের বন্ধুদের উদ্দেশে। টেবিলে বসে পড়ায় মনোযোগ দিতে না পেরে চিঠি লিখতে বসেছে সপ্তম শ্রেণীতে পড়–য়া আদুরে সিরাজুম মুনীরা মৌমিতা। গাজার শিশু গণহত্যার খবর শোনার পর থেকেই ওর জগৎটা যেন থমকে গেছে। টেলিভিশনে প্রথমদিন খবরটা দেখে একেবারে কেঁদে ফেলেছিল সে। বাসার সবাই অবাক হয় ভীষণ। ছোট ভাই আনন্দ মৌমিতার কান্না দেখে প্রথমে হাসলেও পরে বিষয়টা বুঝতে পেরে সরি বলেছে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়–য়া আলী আহসান আনন্দের অবশ্য এতোকিছু বুঝবারও কথা নয়। শত চেষ্টা করেও মৌমিতা বিষয়টা ভুলে থাকতে পারে না। খেলাধুলা তো বন্ধই সেই থেকে, স্কুলে গেলেও সে মনমরা হয়ে শ্রেণিকক্ষে বসে থাকে। কেউ যদি বলে কী হয়েছে, মৌমিতা নীরব থেকে বলে কিছু হয়নি-অন্যরা তার এই কষ্টের বিষয়টা বুঝতে পারবে কি না ভেবে সন্দেহ হয় তার। খুব কাছের কয়েক বন্ধু অবশ্য মৌমিতার মন খারাপের কারণ জানে। মৌমিতার মা পড়ার টেবিলের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, এখন ঘুমিয়ে পড় মা মণি, সকালে তো স্কুল। Ñ আমার ঘুম আসে না আম্মু, চোখ বুজলেই ফিলিস্তিনের শহীদ শিশুর রক্তমাখা চেহারা ভেসে ওঠে। মেয়ের সঙ্গে কথা বাড়ান না মা। মেয়েকে তিনি বোঝেন, এটুকু ছোট্ট মেয়ের আবেগকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজের অজান্তেই তিনি চোখের পাতা ভিজিয়ে ফেলেন। গতকাল খুব সকালে উঠে মায়ের সঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় শেষে হাত তুলে মুনাজাতে কী কান্নাকাটিই না করলো মৌমিতা। ফিলিস্তিনের শিশুদের যেন আল্লাহ রক্ষা করেন। মেয়েকে মা ভালোবাসা মিশিয়ে শাসনের স্বরে ডাকেনÑ Ñ মৌমি মা, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। না, আজ রাতে আর খাওয়া হবে না মৌমিতার। শুয়ে পড়লে আশ্চর্যজনকভাবে দুই চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে তার। মৌমিতা এখন ফিলিস্তিনের এক ধ্বংসস্তূপের সামনে। চারদিকে হাহাকার, হতাহত মানুষের চিৎকার। তার ভেতর গোলাপ ফুলের মতো ফুটফুটে আহত এক শিশুকে দেখতে পেল মৌমিতা। বোমার আঘাতে রক্তাক্ত ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেল সে। ছেলেটি এখুনি হয়তো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। শহীদি মর্যাদা নিয়ে পরম প্রভুর কাছে চলে যাবে। মৌমিতা ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা কণ্ঠে বললো, চলো তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই...। কথা বলার শক্তি নেই ছেলেটির। অনেক কষ্টে এক চোখ খুলে বললো, আমার নাম জারিফ। আমি আল্লাহর কাছে চলে যাচ্ছি। আমাকে যারা মেরেছে আমি তাদের কথা বলে দেবো, সব বলে দেবো। দুনিয়াতে কাউকে বলে লাভ হয়নি, আমি সবার কথা বলবো। বিচার দিনে তিনি কাউকে ছাড়বেন না...।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ