যে গাছ হাঁটতে পারে

যে গাছ হাঁটতে পারে

চিত্র-বিচিত্র মিনহাজ উদ্দীন জানুয়ারি ২০২৪

মানুষের মতো হাঁটতে পারে গাছ। শুনতে অবাক লাগলেও বাস্তবে এমন গাছ রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার গহিন অরণ্যে ছড়িয়ে রয়েছে এমনই এক আশ্চর্য উদ্ভিদ প্রজাতি, যারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম। আর এই বিশেষ ক্ষমতার জন্যই সাধারণ মানুষের কাছে এই উদ্ভিদ প্রজাতি পরিচিত ওয়াকিং পাম নামে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই উদ্ভিদ প্রজাতির নাম ‘সক্রেটিয়া এক্সোরিজা’ বা ক্যাশাপোনা।

স্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী এই গাছটি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি হলেন ব্রাতিস্লাভার স্লোভাক অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের প্যালিওবোটানিস্ট পিটার ভ্রানস্কি।

ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটো থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বন সুমাকো বায়োস্ফেয়ার রিজার্ভ। এখানেই এই অদ্ভুত গাছের সন্ধান পেয়েছেন জীবাশ্মবিদ পিটার ভ্রানস্কি।

সত্তরের দশকের শুরুর দিকে এই সংরক্ষিত অরণ্যে গবেষণা করতে গিয়ে আশ্চর্য এই উদ্ভিদ প্রজাতির সন্ধান পান পিটার ভ্রানস্কি। শুধু এই উদ্ভিদ প্রজাতিই নয়, সঙ্গে ব্যাঙ, আরশোলাসহ একাধিক নতুন প্রাণী প্রজাতিরও আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। ভ্রানস্কি সে-সময় দাবি করেন, তার আবিষ্কৃত এই নতুন উদ্ভিদটি স্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম। তার এই দাবিকে সে-সময় সাদরে গ্রহণ করেনি বিজ্ঞানীমহল।

১৯৮০-এর দশকে ইকুয়েডরের এই আমাজনিয়ান অরণ্যে পুনরায় একটি অভিযান চালান জীববিজ্ঞানী জন এইচ বোদলে। তিনিই দীর্ঘদিন এই অরণ্যে অবস্থান করে পর্যবেক্ষণ করেন এই বিশেষ গাছের গতিবিধি এবং তাদের জীবনপদ্ধতি। বোদলের নেপথ্যেই সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে গৃহীত হয় চলমান উদ্ভিদের অস্তিত্বের কথা।

ভ্রানস্কি জানান, দুই মাসের এ বিপজ্জনক অভিযানে তিনি প্রায় ১৫০ প্রজাতির নতুন জীবের সন্ধান পান। তিনি এক দিনে প্রায় ৩ ঘণ্টা গাড়িতে আর ১৫ ঘণ্টা নৌকায় চড়ে, পায়ে হেঁটে জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করে এই গাছের দেখা পান। এগুলো এক ধরনের পাম গাছ।

এই বনের গাছগুলো জে আর আর টলকিনের মহাকাব্য ‘লর্ড অব দ্য রিংস স্যাগা’য় বর্ণিত গাছের মতো সারা বন হেঁটে বেড়ায়! বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন ভ্রানস্কি। শুরুতেই তিনি পান অনাবিষ্কৃত ৩০ মিটারের একটি জলপ্রপাত, নতুন একটি টিকটিকি ও ব্যাঙের প্রজাতি।

ভ্রানস্কি জানান, মাটি ক্ষয় হয়ে যাওয়ার কারণে গাছগুলোর শিকড় থেকে জন্ম নেয় নতুন নতুন শিকড়। নতুন শিকড়গুলো মাটির প্রায় ২০ মিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং সেগুলো থেকে জন্ম নেয় নতুন গাছ। তিনি বলেন, ‘ঠিকমতো সূর্যের আলো এবং ঊর্বর মাটি থাকলে একটি গাছ জন্ম নিতে সময় লাগে প্রায় দুই বছর।’

আয়তন বা পরিধির দিক থেকেও শেকড়গুলো যথেষ্ট মোটা। অনেকটা হাতির শুঁড়ের মতো। পাশাপাশি অত্যন্ত দ্রুত নতুন নতুন ঠেসমূল তৈরি করতে সক্ষম ‘ওয়াকিং পাম’। একদিকে যেমন এই উদ্ভিদ নতুন উদ্ভিদ তৈরি করে, তেমনই পুরোনো ঠেসমূল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় গাছের দেহ থেকে। অন্যদিকে গাছের মূল কাণ্ড ধীরে ধীরে সরে যায় তার মূল অবস্থান থেকে। এভাবেই প্রতিদিন অল্প অল্প করে স্থান পরিবর্তন করে এই গাছ।

সাধারণভাবে ১৮-২০ মিটার বা ৬০-৭০ ফুট লম্বা হতে পারে এই উদ্ভিদ। অবশ্য ইকুয়েডরের এই উদ্ভিদ প্রজাতির বাহ্যিক গঠন অনেকটা বাংলার সুন্দরী জাতীয় ম্যানগ্রোভ গাছের মতো। সুন্দরী ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ হওয়ায় যেমন শ্বাসমূল দেখা যায় তাদের দেহে, তেমনই দেখা যায় ঠেস মূলের উপস্থিতিও। ওয়াকিং পামও একইরকম।

পরিসংখ্যান ও গবেষণা বলছে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই সেন্টিমিটার সরণ হয় সেই গাছের। কখনও আবার দিনে ৩ সেন্টিমিটার পর্যন্তও অবস্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম ওয়াকিং পাম। বছরের হিসাবে এই দূরত্ব কম নয়। সাধারণত নিজের অবস্থান ২০ মিটার পর্যন্ত সরে যায় এই গাছ।

তবে চলমান উদ্ভিদই সুমাকো বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের একমাত্র আশ্চর্য নয়। বিভিন্ন গাছের পর গবেষণা করতে গিয়ে বনে ঘুরতে ঘুরতে মেরুদণ্ডী পর্যায়ভুক্ত দু’টি নতুন ধরনের প্রাণীর অস্তিত্বও আবিষ্কার করেছেন ভ্রানস্কি ও গার্সিয়া। একটি গিরগিটি জাতীয়, অন্যটি নতুন এক প্রজাতির ব্যাঙ। এই অরণ্য ছাড়া এদের দেখতে পাওয়া যায় না বিশ্বের আর কোনো প্রান্তেই। আর সেই কারণেই একুশ শতকেরও শুরুতে ইকুয়েডরের এই সংরক্ষিত অরণ্যকে ‘হার্ট অফ দ্য ইউনেস্কো’ নামে ঘোষণা দেওয়া হয়।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ