রঙ বাহরী শীতের পাখি

রঙ বাহরী শীতের পাখি

প্রচ্ছদ রচনা জানুয়ারি ২০১৩

মাসুম কবীর

অতিথি পাখি কাকে বলে সে তো তোমরা সবাই-ই নিশ্চয়ই জানো? আমরা যাকে অতিথি পাখি বলে চিনি, সেই পাখিকে ইংরেজিতে বলে মাইগ্রেটরি বার্ড (গরমৎধঃড়ৎু নরৎফ)। শুদ্ধ বাংলায় যার মানে দাঁড়ায় পরিযায়ী পাখি। প্রতি বছর শীতকাল এলেই আমাদের আশপাশের জলাশয়, বিল, হাওর, পুকুর ভরে যায় নানা রঙবেরঙের নাম না জানা পাখিতে। তুমি হয়তো ভাবতে পারো, যাযাবর এই পাখিরা আমাদের দেশে শীতের ছুটি কাটাতে আসে। কারণ তোমারও তো ঠিক ওই সময়ে স্কুলে ছুটি থাকে। চলে যাও তোমার নানু-দাদু বা গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু আসলে ছুটি বা অবসর কাটাতে নয়, এই পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের দেশে হাজির হয় নিজেদের জীবন বাঁচাতে। প্রতি বছর শীতকালে আমাদের দেশে বেশ অনেক অতিথি পাখি আসে। ওরা আসে মূলত হিমালয়ের পাদদেশ আর রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে। এই পাখিগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনই সুন্দর এদের গায়ের বাহারি রঙ। ওদের দেখলেই মন ভরে যায়। চলো, সেসব বাহারি রঙের পাখির গল্প শুনে নেয়া যাক। পৃথিবীতে প্রায় ৫ লাখ প্রজাতির পাখি আছে। আমাদের দেশে মোট পাখি আছে প্রায় ৬২৮ প্রজাতির। এর মধ্যে ২৪৪ প্রজাতির পাখিই স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বাস করে না। এরা আমাদের দেশের পরিযায়ী পাখি বা অতিথি পাখি। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে এরা আমাদের দেশে আসতে শুরু করে। আর তারপর মার্চ-এপ্রিলের দিকে ওদের দেশে বরফ গলতে শুরু করলে ফিরে যেতে থাকে নিজেদের দেশে। পাখিদের একটা সুবিধা কি জানো? কোনো দেশে যেতে ওদের কোনো পাসপোর্ট বা ভিসা লাগে না। আবার যাতায়াত খরচ বা কোনো রকম চেকিংয়ের ঝামেলাও ওদের পোহাতে হয় না। তাই প্রতি বছর এসব অতিথি পাখি বিশ্বের অনেক দেশ থেকেই ঝাঁকে ঝাঁকে এ দেশে চলে আসে। কী মজা ওদের তাই না! কিছু কিছু পাখি তাই প্রতি বছর ২২ হাজার মাইল পথ অনায়াসে পাড়ি দিয়ে চলে যায় দূরদেশে।

অতিথি পাখি কেন আসে আগেই বলেছি অতিথি পাখি ছুটি কাটাতে নয় বরং বেশ কিছু প্রাকৃতিক কারণে আমাদের দেশে বা অন্যান্য দেশে যেতে বাধ্য হয়। কেন বাধ্য হয়, এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই করবে তুমি। সেই কেন’র উত্তর দেবার আগে বলতো, শীত এলে তুমি কী কর! নিশ্চয়ই সোয়েটার জ্যাকেট পরে ফেল। আর সুযোগ পেলে ঢুকে যাও লেপ অথবা কম্বলের মধ্যে। কিন্তু প্রচণ্ড শীতে পাখিরা কী করবে! ওদের তো আর সোয়েটার, জ্যাকেট, লেপ, কম্বল কিছুই নেই! তাই শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মরার চেয়ে ওরা চলে যায় এমন দেশে যেখানে শীত কিছুটা কম। যেখানে ওরা সোয়েটার বা গরম কোনো কাপড় না পরেই অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারে পুরো শীতকালটা। অতিথি পাখিদের দূরদেশে যাওয়ার এটাই প্রধান কারণ। তাছাড়া এ সময়টাতে শীতপ্রধান এলাকায় খাবারেও দেখা যায় প্রচণ্ড অভাব। কারণ শীতপ্রধান এলাকায় এ সময় তাপমাত্রা থাকে অধিকাংশ সময় শূন্যেরও বেশ নিচে। আর তুষারপাত বা তুষারঝড় তো লেগেই আছে। তাই কোনো গাছপালা জন্মাতে বা বাঁচতে পারে না। আর গাছপালা না থাকলে প্রাণীরা বাঁচবে কেমন করে! ফলে শীত এলেই উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া, ইউরোপ, এশিয়ার কিছু অঞ্চল, হিমালয়ের আশপাশের কিছু অঞ্চলের পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে চলে আসে কম ঠাণ্ডা অঞ্চলের দিকে। বসন্তের সময় মানে মার্চ-এপ্রিলের দিকে শীতপ্রধান অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করে, কিছু কিছু গাছপালা জন্মাতে শুরু করে। ঘুম ভাঙতে শুরু করে পুরো শীতকালে ঘুমিয়ে থাকা অনেক প্রাণীর। ঠিক এরকম এক সময়ে অতিথি পাখিরা নিজ বাড়িতে ফিরে যায় দলবলসহ। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জানো, হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়েও এসব পাখির নিজের বাড়ি চিনতে একটুও ভুল হয় না। সেটা আবার আরেক রহস্য মানুষের কাছে।

অতিথি পাখিরা কিভাবে পথ চিনে নেয় অতিথি বা পরিযায়ী পাখিদের কাছে কম্পাস, মানচিত্র বা সেক্সট্যান্ট যন্ত্র কোনোটাই নেই। কিন্তু তারপরও তারা বসন্তের সময় ঠিক ঠিক নিজের বাসা চিনে ফিরে আসে। অথচ মানুষের পক্ষে এইসব যন্ত্র ছাড়া সমুদ্রে বা স্থলে হাজার মাইল চলাচল করা খুব কষ্টসাধ্য। সে যাকগে, অনেকদিন ধরেই বিজ্ঞানী, গবেষক বা পাখি বিশারদরা এই বিষয় নিয়ে রহস্যের মধ্যে আছেন। তোমরা কেউ কেউ হয়তো ভাবছ, অতিথি পাখির কাছে বিষয়টা জিজ্ঞেস করে নিলেই তো ঝামেলা চুকে যায়! কিন্তু পাখিদের সঙ্গে মানুষের ভাষাগত পার্থক্যের কারণেই সে চেষ্টায় খুব বেশি লাভ হবে না বুঝতেই পারছ! তবে মানুষ কিন্তু তারপরও বসে না থেকে নানান গবেষণা করে এই রহস্য সমাধানের চেষ্টা করেছেন। গবেষকরা বলছেন, সমুদ্রের নাবিক যেমন কম্পাস ব্যবহার করে পথ চলে এই পাখিদের দেহে সেরকম কিছু একটা জন্মগতভাবেই আছে। যা তাদের পথ চলার সময় দিক চিনতে সাহায্য করে। তাছাড়া তারা সূর্য ও তারার অবস্থানের ওপরই নির্ভর করে। পরিষ্কার মেঘমুক্ত রাতে যখন আকাশে নক্ষত্র দেখা যায় তখন পরিযায়ী পাখিরা নির্বিঘেœ পথ চলতে পারে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু আকাশ মেঘলা থাকলে নক্ষত্র ঢাকা পড়ে। এ সময় এসব পাখি আকাশ থেকে নিচে কোনো নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সমুদ্রের ওপর দিয়ে উড়ে চলা পাখিরা এক্ষেত্রে দিকভ্রান্ত হয়। তাই এ সময় অনেক দূরের কোনো লাইটহাউজের শক্তিশালী আলোর দিকে তারা পথ ভুল করে চলে আসে দলে দলে। মেঘলা কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে লাইটহাউজের গ্লাসে আঘাত পেয়ে হাজার হাজার পাখি মারা পড়ে। তাই অতিথি পাখিদের এই অপমৃত্যু রোধে কিছু কিছু পাখিপ্রেমী সংগঠন লাইটহাউজে নিরাপদ আলো ব্যবহার করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

বিশ্ব অতিথি পাখি দিবস পরিযায়ী পাখিরা শুধু বাংলাদেশে নয় সারাবিশ্বেই প্রতি বছর ভ্রমণ করছে। প্রতি বছরই তারা শীতপ্রধান অঞ্চলের তীব্র শীত থেকে বাঁচতে উড়ে যাচ্ছে হাজার হাজার মাইল দূরের কোনো উষ্ণ অঞ্চলের দিকে। সাদা চোখে কিছু না বোঝা গেলেও পাখিদের এই ভ্রমণের একটা আন্তর্জাতিক গুরুত্ব আছে। এই গুরুত্ব অনুধাবন করে অতিথি পাখিদের জন্য পাখিপ্রেমীরা ‘বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস’ পালন করছেন। ২০০৬ থেকে এই দিবসটি পালিত হচ্ছে। সে বছর ৯ এপ্রিল কেনিয়ার লাইকিপিয়াতে দিবসটি জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে ৪৬টিরও বেশি দেশ অংশ নিয়েছিল। ২০০৭ সালের ১২ থেকে ১৩ মে এই দিবসটি পালন করা হয়। ‘বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব’ নামের একটি সংগঠন দেশের বিভিন্ন স্থানে পাখি মেলা বা পাখি উৎসবের আয়োজন করে আসছে বেশ কিছু দিন ধরে। ইতোমধ্যেই তারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, মিরপুর সিরামিক লেক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, হাকালুকি হাওর ও বাইক্কা বিল প্রভৃতি স্থানে এই মেলা ও উৎসবের আয়োজন করেছে। এই উৎসবে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, পাখির রেস, ভিডিও ও ছবি দেখে পাখি চেনা, পাখিবিষয়ক কুইজ ও রচনা প্রতিযোগিতা প্রভৃতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যে যেভাবেই এই পাখিদের নিয়ে দিবস পালন করুক না কেন সবারই উদ্দেশ্য প্রায় একই। আর তা হচ্ছে, অতিথি পাখিদের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করা।

আমাদের বন্ধু অতিথি পাখি আমাদের বন্ধু। কিন্তু কেন তা কি জান? অতিথি পাখি আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নানাভাবে রক্ষা করে। ভাবছ সেটা কিভাবে? যে কোনো পরিবেশে উদ্ভিদ বা প্রাণী একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে বেশি হলেই সে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়। অর্থাৎ সেই পরিবেশে কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ টিকে থাকতে পারে না। যেমন ধর, কোনো একটা পরিবেশে একসঙ্গে ছোট গাছ, পোকামাকড়, ব্যাঙ, সাপ, বাজপাখি যদি পরিমাণ মতো বাস করে তাহলে ওই পরিবেশটা ঠিকঠাক টিকে থাকবে। কারণ খাদ্য-শৃঙ্খল অনুযায়ী পোকামাকড় খাবে ছোট গাছ, ব্যাঙ পোকামাকড়কে খাবে, ব্যাঙকে খাবে সাপ এবং সাপকে খাবে বাজপাখি। এভাবে ওই পরিবেশটা স্বাভাবিক থাকবে। কিন্তু কোনো কারণে যদি ওই পরিবেশে কোনো পোকামাকড় না থাকে তাহলে ব্যাঙ বাঁচতে পারবে না। আর ব্যাঙ না পেলে সাপ বাঁচবে কিভাবে! একইভাবে বাজপাখিও পড়বে বিপদে। আবার বিপরীতভাবে পোকামাকড় বেশি থাকলেও বিপদ। কারণ তা মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর নানাভাবে ক্ষতি করে। অনেক দূরদেশ থেকে এসে অতিথি পাখি খাদ্য হিসেবে অনেক পোকামাকড় ও ছোট ছোট জলজ উদ্ভিদ খায়। জলাশয় বা পুকুরে জলজ উদ্ভিদ এমনিতে বেশ দরকারি। এসব জলজ উদ্ভিদ পানিতে অতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করে। কিন্তু জলজ উদ্ভিদের পরিমাণ যদি বেশি হয়ে যায় তাহলে তা পানির পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তখন জলজ উদ্ভিদ শ্বসনের সময় পানি থেকে অক্সিজেন নেয়। ফলে পানিতে বসবাসকারী মাছ বা অন্যান্য প্রাণী অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। আর তারা পোকামাকড় খাওয়ার কারণে প্রাকৃতিকভাবেই পোকামাকড়ের সংখ্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আবার অতিথি পাখির মল জলাশয়ের মাছের প্রিয় খাবার। এই খাবার খেয়ে অনেক মাছ বেঁচে থাকে। আর প্রাকৃতিক দৃশ্যের কথা নতুন করে আর কী বলব। অতিথি পাখি যখন ঝাঁক বেঁধে তাদের বিচিত্র স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে চলে সেটা অবশ্যই পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্যের একটি। এই দৃশ্য দেখার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় তখন হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমায়।

আমাদের অতিথি পরিযায়ী পাখিরা আমাদের অতিথি। হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ থেকে একটু আশ্রয়ের জন্য চলে আসে আমাদের দেশে। কিন্তু কিছু নিষ্ঠুর লোক এসব পাখিকে শিকার করে অর্থের লোভে বা নিছক শিকারের আনন্দে। এদের আবার ‘সৌখিন শিকারি’ গালভরা নামে ডাকা হয়। তবে শুধু সৌখিন শিকারিরাই নয় অনেক পেশাদার শিকারি অতিথি পাখিদের যত্রতত্র শিকার করে টাকার লোভে। তুমিই বলো অতিথিদের সাথে কি কেউ এরকম অমানবিক আচরণ করে? অতিথি পাখি আমাদের দেশে সারা বছর থাকে না ঠিকই, তবে আমাদের দেশে সারা বছর না থাকলেও আমাদের দেশের মানুষ কিন্তু ওদের কম ভালোবাসে না। তাই তারা ওদের মিষ্টি মিষ্টি দেশী নামও দিয়ে দিয়েছে। কয়েকটা অতিথি পাখির নাম শোনোই নাÑ বালি হাঁস, লেঞ্জা হাঁস, পাতারি হাঁস, বৈকাল হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ধূসর রাজহাঁস, ভূতি হাঁস, চিতি হাঁস, বারো ভূতি হাঁস, বৌমুনিয়া হাঁস। এতো গেলো কেবল কতোগুলো অতিথি হাঁসের নাম। আবার কতোগুলো অতিথি কবুতরও আছে। ওদের নামগুলোও এরকমই মিষ্টিÑ জাল কবুতর, গঙ্গা কইতর। আরো আছে পান্তামুখী, লালশির, নীলশির, রাঙ্গামুরি, পাথরঘুরানি বাতানÑ আরো কতো মিষ্টি মিষ্টি সব নাম! কিছু কিছু পাখির অবশ্য পুরোটুকু নাম দেয়নি, বিদেশী নামগুলো দেশী বানিয়ে নিয়েছে। যেমন, কমন কূটের নাম দিয়েছে কালো কূট, স্পটেড ক্রেকের নাম দিয়েছে চিত্রা ক্রেক, আবার ওয়াটার রেইলের নাম দিয়েছে তারা জলছড়ি রেইল। আরো আছে পেড়িভুতি, চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নর্থ গিরিয়া, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল প্রভৃতি। এই পাখিগুলো কোনোটাই একটা আরেকটার চেয়ে কম সুন্দর না। কিন্তু দেখো, কয়েকটা পাখির নাম বলতে গিয়েই কতোক্ষণ সময় লাগলো, আর সবার কথা বলতে গেলে তো একটা আস্ত বই লিখতে হবে! তারচেয়ে বরং কয়েকটা অতিথি পাখির কথা বলি তোমাদের। গার্গেনি : এর দেশী নাম গিরিয়া হাঁস। এই হাঁসটার মূল বাড়ি হলো ইউরোপ আর এশিয়ার পশ্চিমের দেশগুলো। কিন্তু এরা কোনোভাবেই এক জায়গায় থাকতে চায় না। খালি দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। সেই ইউরোপ থেকে এরা দল বেঁধে উড়ে উড়ে চলে আসে আমাদের দেশে। মাঝে মাঝে চলে যায় অস্ট্রেলিয়াতেও। আর এদের ভ্রমণের দলটাও হয় বেশ বড়োসড়ো। মজার ব্যাপার হলো, পুরুষ গিরিয়া হাঁস চিৎকার-চেঁচামেচি ভালোই করতে পারে। কিন্তু নারী গিরিয়া এ ব্যাপারে একেবারেই আনাড়ি। সে কেবল একটু-আধটু প্যাঁক প্যাঁক ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। রুডি শেলডাক : অন্য নাম বালি হাঁস। বালি হাঁসেরা বাস করে ইউরোপ, মধ্য এশিয়া আর উত্তর-পশ্চিম চীনে। আর শীত এলেই আমাদের দেশে এসে ঘুরে যায়। অবশ্য দিনদিন ইউরোপে বালি হাঁস কমে যাচ্ছে। তবে গিরিয়া হাঁস যেমন দলবেঁধে থাকতে পছন্দ করে, এরা কিন্তু ঠিক তার উল্টো। এদের পছন্দ একা একা থাকা, কিংবা জোড়ায় জোড়ায় থাকা। পরিভ্রমণে বের হওয়া ছাড়া এরা সাধারণত বড়ো একটা দল বাঁধে না। তবে তিব্বত ও মঙ্গোলিয়ায় এই পাখিকে কিন্তু পবিত্র পাখি বলে মনে করা হয়। বৌদ্ধদের কাছেও এই পাখির বিশেষ গুরুত্ব আছে। এই পাখি তাদের কাছেও এক পবিত্র পাখি, নাম ব্রাহ্মিণী পাখি। হট্টি-টি : এই হট্টি-টি পাখির টি-টি-টি ডাক কিন্তু খুবই বিখ্যাত। আর ওর আরো একটা নাম আছে, তিতির পাখি। আরেকটি নাম সোশিয়েবল ল্যাপউইং। ছোট্ট এই পাখিটা মূলত মাটিতেই বাস করে, মাটি থেকে পোকা-মাকড় ধরে ধরে খায়। ওরা বাস করে রাশিয়া আর কাজাখাস্তানে। আর শীতে বেরিয়ে যায় গরম জায়গার খোঁজে। তারপর রাশিয়ার কাছেপিঠে যতো গরম দেশ আছে, সব দেশেই যায় কোনো না কোনো হট্টি-টি পাখি। বাংলাদেশে তো আসেই, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, আর্মেনিয়া, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, সিরিয়া, সুদান, তুরস্ক, ইসরায়েল, ওমান এমনকি ইরিত্রিয়ায়ও যায়! দেখলে তো, এই হট্টি-টি পাখিরা কতো দেশ ঘোরে! সাদা মানিকজোড় : বিদেশী নাম হোয়াইট স্টর্ক। সাদা মানিকজোড় এক মস্ত বড়ো আকারের পাখি। ওর একটা লম্বা লাল লেজও আছে। প্রধান খাবার পোকা-মাকড়, সাপ, ব্যাঙ, আরো কিছু পিচ্চি পিচ্চি প্রাণী এমনকি ছোটোখাটো পাখিও! তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই মহা খাদক পাখিটা আবার তেমন কোনো শব্দই করতে পারে না, কেবল হিস্স্ করে একটা মৃদু শব্দ করতে পারে। এই বিশাল আকৃতির মানিকজোড়েরা থাকে ইউরোপ, আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম এবং এশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে। আর শীতকাল এলে এশিয়ার আরো পশ্চিমে চলে আসে ওরা, চলে আসে বাংলাদেশ আর ভারতে। মানিকজোড়দের খাবারের কথা শুনে ওদেরকে খারাপ ভাবতে শুরু করার কারণ নেই। মানুষ ওদের অনেক ভালোবাসে। ঈশপের দুটো গল্পতে তো ওরাই মূল চরিত্র। আবার মিসরেও কিন্তু ওদেরকে মনে করা হতো আত্মার প্রতীক। মিসরকে চিনতে পারছো তো? ড. মোহাম্মদ মুরসি এখন যে দেশের প্রধান হিসেবে দক্ষতার সাথে দেশ পরিচালনা করছেন। আর গ্রিসে ওদের এতোই শ্রদ্ধা করা হতো, কেউ মানিকজোড়কে মারলে তাকে ওরা মৃত্যুদণ্ডই দিয়ে দিতো! রাঙ্গামুরি : রাঙ্গামুরি হাঁসের একটি প্রজাতি। ওদের আসল বাসা ইউরোপ আর মধ্য এশিয়ায়। তবে শীতকালে ওরা যখন শীতের ঠেলায় ঘর ছাড়ে, তখন চলে আসে হয় বাংলাদেশের দিকে নয়তো পশ্চিম আফ্রিকার কোনো দেশে। কখনো কখনো একেবারে আফ্রিকায়। রেড ক্রেস্টেড পোচার্ড নামেও এটি পরিচিত। স্বভাবে ওরা খুবই মিশুক। সবসময় দলবেঁধেই ঘোরাঘুরি করে। আবার অনেক সময় অন্যান্য হাঁসকেও মিশতে দেয় ওদের সঙ্গে। পানির বিভিন্ন উদ্ভিদ ওদের প্রধান খাবার। ওরা কিন্তু যেন তেনভাবে খায় না, রীতিমতো ডাইভ দিয়ে দিয়ে খায়। অবশ্য অনেক প্রজাতির হাঁসই এভাবে পানিতে ডাইভ দিয়ে ভাসমান উদ্ভিদ বা পোকা ধরে ধরে খায়। এসব হাঁসকে বলা হয় ডাইভিং হাঁস। বড়ো গুলিন্দা : বড়ো গুলিন্দার অন্য নাম ইউরাশিয়ান কার্লিউ। বাস ইউরোপ ও এশিয়ার উত্তরাঞ্চলে। ওদের বেশি দেখা যায় ব্রিটেন আর আয়ারল্যান্ডে। আর ঘুরতে বের হলে যায় আফ্রিকা ও ইউরোপ-এশিয়ার দক্ষিণে। সেই সূত্রেই ওরা আসে আমাদের দেশে। বড়ো গুলিন্দারাও বেশ মিশুক জাতের পাখি। মিশুকদের মধ্যেও ওরা একটু বেশিই মিশুক। ওরা সাধারণত কাদার ভেতর ঘুরে বেড়ায় আর যেই পোকা-মাকড় দেখে, কপ করে খেয়ে ফেলে।

অনেক অতিথি পাখির কথাই তো শুনলে, এরা যেমন সুন্দর, তেমনই সুন্দর এদের গায়ের রং। তবে এরাই কেবল নয়, সব অতিথি পাখিই কিন্তু এমন সুন্দর দেখতে, আর খুবই সুন্দর ওদের গায়ের রঙ। এমনি এমনি তো আর ওদের দেখতে মানুষের ভিড় লেগে যায় না! কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে একদিন আব্বু-আম্মু কিংবা ভাইয়ার সঙ্গে গিয়েই দেখো না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকে। আর এত দূরে যদি আব্বু-আম্মু যেতে না দেয় তাহলে একদিন অন্তত বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে ঘুরে এসো। কিংবা তোমার এলাকার কোনো বিলের ধারে চলে যেতে পারো। তখন দেখবে, যখন অতিথি পাখিরা সবাই একসঙ্গে জটলা বেঁধে থাকে, কেউ পাখা ঝাপটায়, কেউ কিচিরমিচির করে আর কেউ পানিতে দাপাদাপি করে, তখন কী সুন্দরই না লাগে ওদের দেখতে!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ