রঙিন ঘুড়ি -নওরোজ ইরফান
ফিচার নভেম্বর ২০১৭
আমরা সবাই ঘুড়ি ওড়াতে দেখেছি। ঘুড়ি ওড়ানো একটি মজার শখ! আকাশে রঙবেরঙের বিভিন্ন আকারের ঘুড়ি ওড়াতে দেখা যায়। ঘুড়ি ওড়ানো নিয়ে আবার অনেকে পাল্লা দেয়। বড়দের ঘুড়ি ওড়ানো দেখে ছোটরা হয় আনন্দিত। ঘুড়ি ওড়ানো এখন উৎসবে পরিণত হয়েছে। ঘুড়ি হলো এক প্রকারের হালকা খেলনা, যা সুতা টেনে আকাশে ওড়ানো হয়। পাতলা কাগজের সাথে চিকন কঞ্চি লাগিয়ে সাধারণত ঘুড়ি তৈরি করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন উপাদান ও নকশার ঘুড়ি রয়েছে। বিশ^জুড়েই ঘুড়ি ওড়ানো একটি মজার খেলা। এছাড়াও বহু দেশে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে ঘুড়ি ওড়ানো একটি বিনোদনমূলক খেলা। বাংলাদেশে- বিশেষ করে পুরনো ঢাকায় পৌষ মাসের শেষ দিন ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব পালন করা হয়। এমন মজার একটি খেলার কথা জানতে পেরে তোমাদের মনে নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে ঘুড়ি ওড়ানোর খেলার ইতিহাস সম্পর্কে! ঘুড়ি অনেক পুরনো একটি খেলা। ধারণা করা হয় প্রায় ২,৮০০ বছর পূর্বে চীন দেশে ঘুড়ির সর্বপ্রথম উৎপত্তি ঘটেছে। পরবর্তীকালে এটি এশিয়ার অন্যান্য দেশ বাংলাদেশ, ভারত, জাপান এবং কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও ইউরোপে ঘুড়ি ওড়ানোর খেলাটির প্রচলন ঘটে প্রায় ১,৬০০ বছর পূর্বে। প্রথম দিকে ঘুড়ি কাগজ অথবা হালকা তন্তু জাতীয় সিল্কের কাপড় দিয়ে ওড়ানো হতো। ব্যবহৃত অন্যান্য উপাদানের অংশ হিসেবে ঘুড়িতে বাঁশের কঞ্চি কিংবা অন্যান্য শক্ত অথচ নমনীয় কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। এছাড়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সুতা কিংবা পাতলা দড়ি ব্যবহৃত হয়। ঘুড়ির কাগজটি হতে হবে পাতলা, যাতে ঘুড়ি হয় হালকা এবং বাতাসে ভাসার উপযোগী। অনেক দেশেই ঘুড়ি বানানোর জন্য সাদা কাগজের পাশাপাশি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রঙিন কাগজ ব্যবহারের রীতি দেখা যায়। এর মূল কারণ মনোরঞ্জন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি। আধুনিক কালের ঘুড়িগুলোয় সিনথেটিক জাতীয় পদার্থের প্রচলন রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে। কোনটি আকারে খুব বড় ও দেখতে নয়ন মনোহর। আবার কোনটি আকারে খুবই ছোট-যা দ্রুত উড়তে কিংবা প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ঘুড়ি ওড়ানোর ক্ষেত্রে অন্যতম বিশেষ বৈশিষ্ট্য মাঞ্জা। অন্য ঘুড়ির সুতা কাটার উদ্দেশ্যে সুতায় গাবের গুঁড়ো, আঠা ইত্যাদি মিশ্রিত বিশেষ মশলা মাখানোকে মাঞ্জা বলে। এই উপাদান মিশ্রিত সুতাটি রোদে শুকানো হয়। বিভিন্ন দেশে ঘুড়ির বিভিন্ন রকম নামকরণ রাখা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে যেসব ঘুড়ি রয়েছে তার মধ্যে আছে-চারকোনা আকৃতির বাংলা ঘুড়ি, ড্রাগন, বক্স, মাছরাঙা, ঈগল, ডলফিন, অক্টোপাস, সাপ, ব্যাঙ, মৌচাক, কামরাঙা, আগুন, পাখি, প্যাঁচা, ফিনিক্স, জেমিনি, চরকি লেজ, পাল তোলা জাহাজ, জাতীয় পতাকা। এতো গেলো বিভিন্ন রকমের ঘুড়ির কথা। এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে-ঘুড়ি আকাশে ওড়ে কিভাবে! ঘুড়িতে কাগজের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় কাঠির। সেই কাঠির সাথে বাঁধা থাকে সুতা। ওড়ানোর সময় ঘুড়িকে সুতা দিয়ে মাটি থেকে নিচের দিকে টান দেয়া হয়। বাতাসের গতির বিপরীত দিকে ওড়াতে হয় ঘুড়ি। বাতাস ঘুড়িকে তার দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। এই দুই দিকের টানে একটা ভারসাম্য তৈরি হয়। আর তার ওপর ভর করেই আকাশে ভেসে থাকে ঘুড়ি। ঘুড়ি ওড়াবার উৎসব বিভিন্ন দেশে পালিত হয়। অনেক দেশে এই উৎসবের একেক নাম দেওয়া হয়। নেপালে এই দিবসটির নাম দেওয়া হয় মাঘি, থাইল্যান্ডে সংক্রান্ত, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহসংক্রান্ত নামে উদযাপিত হয়। অবশ্য দেশ ভেদে এ উৎসবের ধরনে থাকে পার্থক্য। ঘুড়ি ওড়ানো খেলার প্রধান মজা প্রতিযোগিতায়। যাকে ঘুড়ি কাটাকাটির লড়াই বলা হয়। ঘুড়ি কাটাকাটির লড়াই সারা বছর দেখা গেলেও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি ভারত বর্ষীয় অঞ্চলগুলোতে ঘুড়ি উড়ানোর বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ঘুড়ির লড়াইয়ে সাধারণ একাধিক লড়াকু মাঞ্জা দেয়া সুতা দিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে একজন আরেকজনের ঘুড়িকে টানে অথবা ছেড়ে কাটার চেষ্টা করে। বিজয়ী ঘুড়ি আকাশে উড়তে থাকে আর হেরে যাওয়া অর্থাৎ কেটে যাওয়া ঘুড়ি আকাশে বাতাসে দুলতে দুলতে মাটিতে নেমে আসে। তখন ঘুড়ি কুড়িয়ে নেয়ার আনন্দই আলাদা। ঘুড়ি উৎসব আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব। এই উৎসব যেমন আমাদের আনন্দ দেয় তেমনি আমাদের সংস্কৃতিকেও বিশ্বের কাছে তুলে ধরে।
আরও পড়ুন...