রনির আখড়া

রনির আখড়া

উপন্যাস ডিসেম্বর ২০১৩

দীপন জুবায়ের|

upponnasরনি আমাদের দলের সব থেকে ডানপিটে ছেলে। বলতে গেলে ও একাই আমাদের দলটা মাতিয়ে রাখে। আষাঢ়ে গল্পের জন্য ও বিখ্যাত। অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প ও এমনভাবে বলে যে বিশ্বাস না করে উপায় থাকে না। ওর কথা বলবার ঢংও সবার থেকে আলাদা। ওর আর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, এক জায়গাতে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। কোনো না কোনো কাজে সবসময় লেগে আছে। রনি আমাদের গ্রামে বেশিদিন আসেনি, বছরখানেক হবে। ওর আদিবাড়ি মাহমুদপুর নামের এক গ্রাম। বছরখানেক আগে ওর বাবা ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পর ওর মা দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের গ্রামে এসে স্থায়ী হয়। আমাদের সমবয়সী বলেই বোধ হয় প্রথম থেকে ওর প্রতি আমাদের কৌতূহলটা একটু বেশি। পরদিন খেলার মাঠে গিয়ে দেখি ও হাজির। আমরা খেলার আয়োজন করছি আর ও মাঠের এক কোণে গুটিসুটি বসে আছে। ওর প্রতি কেন জানি আমার কৌতূহলটা ছিল একটু বেশি। আমি গুটি গুটি পায়ে ওর সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম। ন্যাড়া মাথায় খালি গায়ে চুপচাপ বসে আছে। ঠিক ওইসময় ওকে দেখে আমার কেমন যেন একটু মায়া হলো। ওর হাতে একটা পাখি মারার গুলতি। ছোটবেলা থেকেই এই জিনিসটার প্রতি আমার খুব আগ্রহ। ওর সামনে বসে জিজ্ঞেস করলাম, এই, তোর নাম কিরে? রনি। ওর কথা বলবার মধ্যে একটুও জড়তা নেই। তোরা এখন থেকে এই গ্রামেই থাকবি? জানি না। আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। মনে করেছিলাম ও আমাকে ভয় পাবে। কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আমাকে একটুও পাত্তা দিচ্ছে না। আমি তো তখনও জানি না ওর বাবা নেই। বললাম, তোর মাকে কাল দেখেছি, তোর বাবা আসেনি? তাকে তো দেখলাম না? বাবা নেই। নেই মানে? মারা গেছে। ওর হাতের গুলতির দিকে তাকিয়ে কথাটা এমনভাবে বলল যেন বাবা মারা যাওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আমি মনে মনে চমকে উঠলাম। আজব চিড়িয়া তো ! কারও বাবা-মা নেই শুনলেই আমার কান্না পেয়ে যায়। আমি আগবাড়িয়ে ওর সাথে ভাব জমাবার এত টেষ্টা করছি, অথচ আমার দিকে ওর কোন খেয়াল নেই। রনি, তুই ক্রিকেট খেলতে পারিস? পারি। প্রথম থেকেই ও এক কথায় সব উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। খেলবি আমাদের সাথে? খেলব। চল আমার সাথে। দেখি কেমন খেলিস। রনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল। আমার সাথে এমনভাবে মাঠে এলো যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় আসা, খেলার কোন ইচ্ছেই নেই। লিটন, মিলন, সজীব, আলম সবাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকালো। রনি আমার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। লম্বায় ও আমার থেকে একটু বেশি। ওদের সবার সাথে রনির পরিচয় করিয়ে দিলাম। ওদের মুখ দেখেই বুঝলাম, কারও ইচ্ছে না রনিকে দলে খেলতে নেয়। সবার অমত সত্ত্বেও আমি জোর করে ওকে দলে ঢুকিয়ে নিলাম। সবার ধারণা রনি ক্রিকেট খেলতে পারে না। খেলার শুরুতেই কেন জানি আমার ইচ্ছে হলো রনি বলিং করবে। অন্য সবাইকে উপেক্ষা করে ওর হাতে বল তুলে দিলাম। সবাই মিটিমিটি হাসছে। হঠাৎ আমার রোখ চেপে গেল। রনির পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম, বোলিং কর, সবাইকে আউট করে দিবি। এদের বুঝিয়ে দে তুই খেলতে পারিস। আমার কথার জোরে কি না জানি না, প্রথম বলেই ও যখন লিটনকে বোল্ড করে দিলো তখন তো সবার মুখে মাছি যাবার মতো অবস্থা। খুব খুশি হয়েছিলাম আমি। যেন এই কৃতিত্ব আমার। লিটন আমাদের টিমের সব থেকে ভালো ব্যাটসম্যান। প্রথম থেকেই ও রনিকে একটু অপছন্দ করছিলো। আউট হওয়ার পর রনির ওপর রাগে-অপমানে ফুঁসতে লাগলো। ব্যাটিং করতে গিয়েও রনি তাক লাগিয়ে দিল। এভাবেই ও আমাদের দলে ভিড়ে গেল। সবাই যার যার বাড়ি ফিরে গেলাম। আমি বাড়ি ঢোকার পর থেকেই শুধু রনির কথা মনে পড়ছে। মনে মনে ওর সম্পর্কে আরও কৌতূহল বোধ করলাম। ওর কী সাহস, চিন্তা করতেই আমার গা শিরশির শুরু হলো। এই ভর সন্ধ্যায় অন্ধকারের ভেতর একা বাগানে ঢুকে গেল। রনির কথা মনে হতেই আমার গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল। ওর যদি কিছু হয়? কেন জানি না, ওর প্রতি একটা অদ্ভুত মমতাবোধ করছি। মাথার ভেতর ওর চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। স্যারের কাছে পড়তে বসে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ায় বকুনি খেতে হলো। রাতে ঘুমাবার জন্য বিছানায় গিয়ে মাথার মধ্যে ওর চিন্তা, মনটা আরও খারাপ হলো। অন্যদিন বিছানায় যেতেই ঘুমিয়ে পড়ি, আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না। বিছানায় শুয়ে মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম, ওর যেন কোন বিপদ না হয় খোদা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ওদের বাড়ি একবার যেতে হবে, অবশ্যই যেতে হবে। এখন থেকে ওকে যেন কেউ অপমান না করে, যেন কেউ কষ্ট না দেয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।

upponnasদুই. সকালে পড়ছিলাম। যখন ভাল লাগে না তখন ক্লাসের বইয়ের নিচে একটা পছন্দ মত গল্পের বই নিয়ে পড়া শুরু করি। এতে করে সময় তরতর করে কেটে যায়। তবে খুব সাবধানে পড়তে হয়। মাঝে মাঝে মা আমার ঘরে এসে দেখে যায় আমি পড়ছি নাকি অন্য কাজে ব্যস্ত আছি। আজ একটা বইয়ে বেশ জমে গিয়েছিলাম। কিভাবে যে সময় কেটে যাচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না। নিবিষ্ট মনে বইটা পড়ছি হঠাৎ শুনতে পেলাম ঘরের বাইরে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি রনি। নিশ্চয়ই কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। ফালতু কারণে রনি কখনও আমাকে ডাকতে আসে না। কয়েকদিন আগে আমাকে চুরি করে ডাকতে এসে বেচারা মায়ের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিলো। তারপর তো আমাদের দু’জনের অবস্থাই নাস্তানাবুদ। সেদিন থেকে রনিকে বলে দিয়েছি খুব সতর্ক থাকতে হবে। কিছুতেই মায়ের কাছে ধরা পড়া যাবে না। এজন্য খুব বেশি দরকার না হলে ও আমাকে ডাকতে আসে না। যখন নিতান্ত না ডাকলেই নয় তখন বাড়ির সামনের বাঁশবাগানে দাঁড়িয়ে দু’বার হাততালি দিলেই আমি বুঝতে পারি কোন ঘটনা আছে। দিপু, দেরি করিস না, দ্রুত বেরিয়ে আয়। রনির ফিসফিস কণ্ঠ শুনতে পেলাম। দ্রুত গল্পের বইটা গোপন জায়গাতে লুকিয়ে রেখে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজার ফাঁক দিয়ে আশপাশে কোথাও মাকে দেখলাম না। নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ঘরের পেছনে এসে দু’জনেই ভোঁ দৌড় দিলাম খেলার মাঠের দিকে। মাঠে সবাই অপেক্ষা করছে। কিরে দিপু, তুই এত দেরি করলি কেন? স্কুলের মাঠে আমাদের লিগ খেলা আছে। লিটন একটু রাগের সাথে বলল। চল, চল আর দেরি করা যাবে না। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি বললাম। আমরা দৌড়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে স্কুলের মাঠে পৌঁছে গেলাম। দেখি একেবারে এলাহি কাণ্ড, সমস্ত মাঠ ভরা দর্শক, একপাশে বসে একজন মাইকে কমেন্ট্রি দিচ্ছে। মাঠে পৌঁছুতে দেরি করবার জন্য বড় ভাইদের কাছে বকা শুনতে হলো। আজকের লিগে খেলবে ছয় দল। সীমিত ওভারের খেলা, মাত্র ছয় ওভার। আজ দিনের মধ্যেই সব খেলা শেষ করতে হবে। প্রথম খেলা আমাদের দলের সাথে শ্রীরামপুরের। ঠিক দশটা থেকে খেলা শুরু হয়ে গেল। সব দলে প্লেয়ার মাত্র ছয়জন করে। টসে জিতে ওরা আমাদের ফিল্ডিং-এ পাঠালো। আমি দলের অলটাইম উইকেট কিপার। আমাদের বোলিং সাইট বেশ শক্ত। রনি, লিটন, সজীব, মিলন সবাই বোলিংয়ে পারদর্শী। ওপেনিং বোলিংয়ে এলো রনি। ভালোভাবেই ওর ওভার শেষ করলো। এক ওভারে প্রতিপক্ষের রান মাত্র দুই। একে একে সবাই বোলিং করলো। ছয় ওভার শেষে ওদের রান হলো মাত্র ২৬। মাইকে ধারাভাষ্যকার বেশ জোরাল গলায় আমাদের খেলার প্রশংসা করছে। ওপেনিং ব্যাটিংয়ে নামলো রনি আর সজীব। প্রথম ওভারের তিন বলে কোন রান নেই। চতুর্থ বলে রনি প্রচণ্ড মার হাঁকাল, চার। আমরা চিৎকার করে উঠে দাঁড়ালাম। প্রথম ওভার শেষে রান দাঁড়াল ৭। আমরা জিতে যাওয়ার ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। তৃতীয় ওভারে যখন দলীয় রান ১৮, সজীব ক্যাচ আউট হয়ে গেল। এরপর নামল মিলন। তিন বলের মাথায় আবার আউট, এবার রনি। দলীয় রান ১৯। হাতে আছে ২ ওভার, রান করতে হবে ৮। আমি ব্যাট হাতে মাঠে নামলাম। সবার মধ্যে তুমুল উত্তেজনা। আমার বুক দুরুদুরু করছে। রনি স্ট্রাইকে। প্রথম দুই বলে কোন রান নেই। পরের বলও ডট। চতুর্থ বলে রনি বাউন্ডারি হাঁকালো। অল্পের জন্য ছয় হলো না। মাঠের বাইরে তুমুল চিৎকার, উত্তেজনায় সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে । শেষ ওভারে রান দরকার ৪। স্ট্রাইকে আমি। উত্তেজনায় বুক ফেটে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। মাঠের বাইরে থেকে আমাদের অন্য খেলোয়াড় ও সমর্থকরা আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে। মনে সাহস ফিরে পেলাম। বোলার বল করার জন্য দৌড় শুরু করতেই আমি উইকেট ছেড়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলাম। যা হবার হবে, সমস্ত শক্তি দিয়ে বলে হিট করলাম। বল বাউন্ডারির বাইরে। আমার মনে হলো, আমি স্বপ্ন দেখছি। প্রথম খেলা জিতে গেলাম। এখন অন্য দুই দলের খেলা, আমাদের বিশ্রাম। দ্বিতীয় ম্যাচে দারুণ প্রতিযোগিতা করেও হেরে গেলাম। আমার দল পয়েন্টে পিছিয়ে গেল। প্রথম ম্যাচে এত ভালো খেলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠতে পারলাম না। আমাদের সবার ভীষণ মন খারাপ। আমার তো গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মাঠে দর্শকদের সাথে বসে অন্যদের খেলা দেখতে হবে। ঠিক তখনই একটা অপ্রত্যাশিত সুযোগ এসে গেল। যে ছয় দলের খেলা তাদের মধ্যে একটা দল খেলতে পারছে না, কোন একটা সমস্যার জন্য। খেলা কমিটি আমাদের বললো, যদি আমাদের ইচ্ছে থাকে তবে ওই অনুপস্থিত দলের টাই কিনে খেলতে পারি। আমরা তো আনন্দে লাফ দিয়ে উঠলাম, দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার এই মোক্ষম সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যায় না। সবাই মিলে দ্রুত টাকা ম্যানেজ করে টাই কিনে ফেললাম। সেমি-ফাইনালে খেলার সুযোগ হয়ে গেল। এবার খুব সহজেই ম্যাচ জিতে গেলাম। এখন সামনে ফাইনাল। সবার মধ্যে তীব্র উত্তেজনা। ফাইনাল খেলা শুরুর আগে বেশ কিছুক্ষণ ধরে নতুন করে মাঠ সাজানো হলো। মাঠের কোথাও ফাঁকা নেই, অনেক দর্শক। টস জিতে আমরা ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথম ওভারে রনি দুই চার মেরে আউট হয়ে গেল। এবার নামলো লিটন। আমরা সবাই সজীব, লিটনের দিকে চেয়ে আছি। ওরাই এখন মূল ভরসা। ওরা একটানা দুই ওভার খুব ভালো খেলল। চতুর্থ ওভারে লিটন আউট হলো। এবার আমি নামলাম। দলীয় রান ২২। পরের ওভারে যোগ হলো আরও ৭ রান। শেষ ওভারে আমাদের ইচ্ছেমত পিটিয়ে খেলতে বলা হলো। শেষ ওভারের তিন এবং পাঁচ নম্বর বলে সজীব দুই ছয় হাঁকালো। ছয় ওভার শেষে আমাদের দলীয় রান হলো ৪৪। আমরা যতটা আশা করেছিলাম তার থেকে বেশি। মাইকে একটানা সজীবের নাম বলা হচ্ছে। সমস্যা ঘটলো রনির প্রথম ওভারে। দুই চারের সাথে এগার রান দিলো। কিছুটা হতাশ হলাম। এর পরের দুই ওভারে আরও তিন চারের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের রান দাঁড়াল ২৬। একটাও উইকেট পড়েনি ওদের। চতুর্থ ওভারে লিটন বোলিংয়ে এলো। এ ওভারে ঘটে গেল এক অভাবনীয় ঘটনা। পর পর দুই উইকেট তুলে নিয়ে লিটন আমাদের সাহস ফিরিয়ে দিলো। ওর ওভারের শেষ বলে আরও এক উইকেট পেল। এর পরের ওভার মিলনের। কোন উইকেট ছাড়াই ওভার শেষ হলো। রান হলো মাত্র ৪। শেষ ওভারে আবার লিটন বোলিংয়ে এলো। জিততে হলে ওদের দরকার ১৩ রান, হাতে বল আছে ৬টা। এ ওভারেও লিটন ভয়ঙ্কর বোলিং করে দুই উইকেট তুলে নিয়ে প্রতিপক্ষের ইনিংস গুটিয়ে দিলো। খেলা শেষ, আমরা চ্যাম্পিয়ন হলাম। অনবদ্য বোলিংয়ের জন্য লিটন ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলো। ট্রফি তুলে দেয়া হলো আমাদের ক্যাপ্টেন সজীবের হাতে। বেলা ২টা বাজে। প্রচণ্ড ক্ষুধায় পেট জ্বলছে। বিজয়ের আনন্দে কোন দিকে খেয়াল নেই। ট্রফি হাতে নিয়ে হৈ হৈ করতে করতে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি এসে শুনলাম নানা বাড়ি গেছে। খাবার ঘরে আমার জন্য খাবার রেডি করা আছে। গোসলের কথা ভুলে খাওয়া শুরু করে দিলাম। কোনরকমে গোসল সেরে একদৌড়ে আবার মাঠে গেলাম। মা বাড়ি নেই, এই সুযোগ আর পাবো না। খেলা নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সবাই হৈ হৈ করে হোটেলে যেয়ে নাস্তা করলাম। সন্ধ্যা নামার একটু পরেই বাড়ি ফিরে পড়তে বসলাম। upponnasতিন. আমাদের বিলে রনি প্রায়ই মাছ ধরতে যায়। মাঝে মাঝে খাল থেকে মাছ ধরে আনে। কখনও নিজেরা খায়, কখনও সুবিধা মত কিছু বিক্রি করে। গত সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে রনি আমাকে ওর সাথে একদিন মাছ ধরতে নিয়ে যাবে, কথা দিয়েছিলো। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। মাছ ধরার কোন অভিজ্ঞতা আমার নেই। এজন্য মাছ ধরার ব্যাপারে আমার কৌতূহলটা একটু বেশি। আজ মা বাড়ি নেই, পড়াশুনার চাপও নেই। দ্রুত খাওয়া শেষ করে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। রনিদের বাড়ি গিয়ে দেখি ওর পাখি মারা গুলতিটা ছিঁড়ে গেছে, ও বসে সেটা ঠিক করছে। রনির মা আমাকে খুব ভালোবাসেন। মুখে সর্বদা একটা গভীর কষ্টের ছাপ, তবু আমাকে যখনই দেখেন হেসে কথা বলার চেষ্টা করেন। এসো বাবা, বসো। তোমার মা ভালো আছেন তো? হ্যাঁ, ভালো আছে। রনির মা একটা মলিন আটপৌরে শাড়ি পরে আছে। শাড়ির কয়েক জায়গা খুব যতœ করে তালি মারা। রনির ছোট বোনটা উঠানের এক কোণে কয়েকটা ভাঙা হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে খেলা করছে। ওর সারা শরীরে বালি চিকচিক করছে। দিপু চল। রনি উঠে দাঁড়াল। মাছ ধরতে যাবি না? আমি জিজ্ঞেস করলাম। এখন না, একটু পরে। ওর সংক্ষিপ্ত উত্তর। এখন তাহলে কোথায় যাবি? চল না, দেখি কোথায় যাওয়া যায়। তুই গুলতি দিয়ে পাখি মারতে পারিস? খুব ভালো পারি না। বুঝতে পারলাম ও কোথায় যেতে চায়। চল, আজ আমার কাছে শিখবি। আমরা ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। রনি অবিরাম কথা বলে যাচ্ছে, সবই তার পাখি শিকারের ঘটনা। ওর প্যান্টের পকেট ভর্তি মাটির গুলি। আমরা হাঁটতে হাঁটতে বড় বাগানের কাছে চলে গেলাম। এই রনি, আমি এই বাগানের ভেতর ঢুকবো না। ওখানে ছোটদের যাওয়া নিষেধ। আমার ভয় করে। রনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হা হা করে একচোট হেসে নিলো। ও যেন আমার অবস্থা দেখে খুব মজা পেয়েছে। কেন? ছোটদের বাগানে যাওয়া নিষেধ কেন? কে নিষেধ করেছে? হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো। চল আমি যাব। যদিও বললাম তবু মন খুঁত খুঁত করছে। রনি সামনে আমি পেছনে। কথা বলতে বলতে আমরা বাগানের বেশ খানিকটা ভেতরে ঢুকে গেলাম। চারদিকে ঘন বাঁশ গাছ। পাখির কিচিরমিচির ছাড়া অন্য কোন শব্দ কানে আসছে না। আমাদের গ্রামের কেউ কখনও এই বাগানে ঢোকে না। আমি ঢুকেছি জানতে পারলে মা কঠিন শাস্তি দেবেন। কোনভাবেই মাকে জানতে দেয়া যাবে না। পাখি মারার আগে চল তোকে একটা জিনিস দেখাবো। রনির চোখে রহস্যের হাসি। কিন্তু আগে তোকে কথা দিতে হবে, কারও কাছে ব্যাপারটা বলা যাবে না। আমার মনের দ্বিধা তখনও কাটেনি। রনি তো প্রায়ই একা একা বাগানে চলে আসে। ওর তো কিছু হয়নি! ও যখন সাথে আছে ভয়ের কিছু নেই। মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিলাম। ঠিক আছে চল, কারও সাথে বলবো না। আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। পায়ের নিচে শুকনা বাঁশপাতা পড়ে মচমচ শব্দ হচ্ছে। বাঁশগাছ এত ঘন যে বাগানে সরাসরি সূর্যের আলো ঢুকতে পারে না। এই বাগানে আমার একটা ছোট্ট বাড়ি আছে। এখন তোকে সেখানে নিয়ে যাব। রনির কথাগুলো কেমন যেন রহস্যময়। ভয়টা আবার ফিরে আসছে। কিন্তু এখন আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না। যা হবার হবে। হাঁটতে হাঁটতে সামনে একটা ছোট্ট মরা পুকুর পড়লো। পানির ছিটেফোঁটা নেই। বাঁশের পাতা পড়ে পড়ে ভরে গেছে। পুকুরের পাড় দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে। কিছুটা এগিয়ে দেখলাম চারদিক থেকে কয়েকটা বাঁশগাছ হেলে মাথা নিচু করে আছে। ঠিক কাঁচাঘরের খড়ের চালার মত। তার মধ্যে চারকোনায় চারটা মোটা খুঁটির ওপর একটা সুন্দর মাচা, বাঁশের তৈরি। মাচার চারদিক কলাপাতা দিয়ে একটা সুন্দর ছোট্ট কুঁড়েঘর বানানো হয়েছে। এই আমার বাড়ি, দ্যাখ তোর পছন্দ হয় কি না। পছন্দ হলে আজ থেকে এই বাড়ির মালিক তুইও। কিন্তু মনে থাকে যেন কাউকে বলা যাবে না। ও আমাকে আবার কথাটা মনে করিয়ে দিলো। সত্যিই ওর বাড়িটা আমার চমৎকার লাগলো। তুই এটা একা বানিয়েছিস? আমি জিজ্ঞেস করলাম। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তা না হলে বললাম কেন আর কেউ জানে না। আজ শুধুমাত্র তুই জানলি। চল ঘরে গিয়ে বসে দেখবি কেমন লাগে। বাড়ির পেছন দিকে সিঁড়ির মত ব্যবস্থা করা হয়েছে, বাঁশ দিয়ে। ঘরে ঢুকে দেখি এক কোনায় ছোট্ট একটা মাটির কলসি। কলসি ভর্তি মাটির গুলি। পাশে মোটা একটা লাঠি। মাচার ওপর খড় দিয়ে কিছুটা উঁচু করে তার ওপর একটা ছোট্ট বিছানা, বসার জন্য। সব মিলিয়ে ওর ঘরটা আমার কাছে দারুণ মনে হলো। তোর এই ঘরের জন্য আমি একটা নাম ঠিক করে ফেলেছি। আমি বললাম। তোর নামের সাথে জড়িয়ে এই ঘরের নাম দিলাম “রনির আখড়া”। কী, পছন্দ হয়েছে? রনি হো হো করে হেসে উঠলো। সাথে আমিও। নাম খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু শুধু আমার নাম থাকলে তো হবে না। এই ঘরের মালিক তো তুইও। ঘরের নাম হবে “রনি ও দিপুর আখড়া”। আবার দু’জন হাসি। চারদিকে শুধু পাখির কিচিরমিচির শব্দ। আমার মনে হলো এটা আমাদের গ্রামের ভেতর আর একটা ছোট্ট গ্রাম। শান্ত, নির্জন, স্বপ্নপুরির মত। ছোটবেলা অনেক বইতে স্বপ্নপুরির গল্প পড়েছি। সেগুলো কি এর মতই শান্ত-নির্জন? এত সুন্দর ঠাণ্ডা হাওয়া সেখানে আছে? আমার গ্রামের ভেতর যে এত চমৎকার একটা জায়গা আছে, রনি না থাকলে হয়ত কোনদিন জানতেই পারতাম না। চল পাখি মেরে আসি। রনি উঠে দাঁড়াল। আমার আরও কিছুক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করছিলো। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। মাথার ভেতর কি একটা চক্কর দিলো? সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে পায়ে জুতা পরে নিলাম। পুকুরের পাশ দিয়ে রনি হাঁটা শুরু করলো, আমি ওর পিছু পিছু। রনির পাখি মারার হাত খুব ভালো, কয়েক মিনিটের মধ্যেই বুঝতে পারলাম। ও কয়েকবার চেষ্টার পর একটা পাখি ঘায়েল করে ফেলল। দৌড়ে পাখিটার কাছে গেলাম। ওটার মাথার দিকে লালচে রং। রনি পাখিটা মাটি থেকে তুললো। আঘাত লেগেছে ওটার বাঁ পায়ে। পা-টা বেঁকে গেছে, সোজা করতে পারছে না। পাখিটা আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল। বাড়ি যেয়ে যেভাবেই হোক মাকে রাজি করাতে হবে। রনির হাত থেকে পাখিটা নিয়ে নিলাম। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে হয়। ওর শরীরটা কী সুন্দর নরম! এই পাখি মানুষ যে কিভাবে বন্দুক দিয়ে মেরে খায়, আমার মাথায় আসে না। এত সুন্দর একটা প্রাণী খেতে ইচ্ছে হয়! পাখিটা নিয়ে আমরা বাগান থেকে বেরিয়ে এলাম। বেশ বেলা হয়ে গেছে। হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরে রনি বললো, তুই বিশ্বাস কর আমি এখন আর পাখি মারি না। আজ শুধু তোর জন্য এটা মারলাম। ছোটবেলা না বুঝে অনেক পাখি মেরেছি। এখন খারাপ লাগে। তোর কাছে একটা অনুরোধ, তুই এটাকে অনেক যতœ করে পুষবি। ওরা আমার খুব আপন হয়ে গেছে। তোকে আজ যেখানে নিয়ে গেছিলাম ওটাই আমার সত্যিকারের বাড়ি। আর এই পাখিগুলো আমার খুব আপন। কাউকে যেন বলিস না আমার বাড়িটার কথা। এখন বাড়ি যা, বিকেলে আসিস। আমি পাখি হাতে বাড়ির পথ ধরলাম। রনি মূর্খ হলেও মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলে যা ঠিক ঠিক বুঝতে পারি না। সামান্য একটা পাখি মারার জন্যে ওর মন খারাপ দেখে আমি সত্যিই বেশ অবাক হয়েছি। যেসব শিক্ষিত মানুষরা বন্দুক দিয়ে শুধুমাত্র আনন্দ করার জন্য পাখি মারে, তাদের থেকে রনি অনেক ভালো। upponnasচার. পাখিটা নিয়ে প্রথম দিন বেশ ঝামেলা পোহাতে হলো। মাকে খুব সহজে রাজি করাতে পারলাম না। পাখিটা বাড়ি নিয়ে যাবার পর একটা ছোটখাট হৈ চৈ পড়ে গেল। সবার খাওয়া ঘুম হারাম করে দেবার জোগাড়। ওটার একটা নামও ঠিক করে ফেললাম। নাম রাখা হলো টুনি। মাকে রাজি করানো আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। বাবার মাধ্যমে মায়ের কাছে সুপারিশ করতে হলো। শেষমেশ এক শর্তে মাকে রাজি করানো গেলÑ পাখি পুষতে পারি কিন্তু কোনভাবেই পড়াশুনার ক্ষতি করা যাবে না। বিনাবাক্য ব্যয়ে শর্ত মেনে নিলাম। পাখিটা রাখবার জন্য সুন্দর একটা খাঁচার ব্যবস্থা করা হলো। অনেক কষ্টে ওর পায়ের ক্ষতটা সারিয়ে ফেললাম। কয়েকদিন পর দেখা গেল আমার থেকে মা-ই ওটাকে বেশি যতœ করছে। আমার আর চিন্তা নেই। ওর খাঁচার সামনে গেলে সুন্দর করে সবার দিকে তাকায়। দেখলে আদর করতে ইচ্ছে করে। এখনও ওকে খাঁচার বাইরে বের করার মত হয়নি, যদি উড়াল দেয়? টুনি বলে ডাকলেই কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। কয়েক দিনের মধ্যেই ওর প্রতি সবার প্রবল মায়া জন্মে গেল। ওর কখন কোন খাবার দিতে হবে সেটা আমার থেকে মা ভালো বোঝে। ওর যতেœর কোন কমতি নেই। আমি মাঝে মাঝে ওর জন্য ফড়িং ধরে আনি। ওর সামনে ফড়িং ছেড়ে দিলে কিছুক্ষণ লাফঝাঁপ করে ওটার সাথে খেলা করে। বাবাও সময় পেলে ওর সাথে খুনসুটি করে। মা কয়েকদিন পর পর ওকে পানি দিয়ে গোসল করিয়ে সুন্দর করে গা মুছে দেয়। তারপর ওকে কিছুক্ষণ রোদে রাখা হয়। ভেজা গায়ে যদি ও মাটিতে গড়াগড়ি দেয় তাহলে আর রক্ষে নেই, মা রেগে একেবারে টং হয়ে যায়। শুরু হয় ভীষণ বকাবকি। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখি আর মনে মনে হাসি। মা যখন ওকে বকাবকি করে তখন মনেই হয় না ও একটা পাখি। মনে হয় ওটা মায়ের আরেকটা সন্তান, মায়ের কথা না শোনায় ওর ওপর ভীষণ বিরক্ত। আমার যে কী ভালো লাগে! বকতে বকতে আবার ওকে কোলে নিয়ে খুব যতেœ গোসল করায়। একদিন টুনিকে পরীক্ষা করার জন্য খাঁচার বাইরে বের করে দেয়া হলো। আমি মায়ের সাথে দূরে যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। খাঁচার বাইরে এসে টুনি চারদিকে তাকাতে লাগলো। মনে হলো মাকে খুঁজছে। দূরে দাঁড়িয়ে ওর কাণ্ড দেখে মা তো ভীষণ খুশি। যাক এতদিনে সত্যি পোষ মেনেছে। উড়াল দেবার ভয় নেই। মা ওর সামনে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বলল, কিরে টুনি, আমাকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি? তুই যে বড্ড মায়ায় ফেলে দিলি দেখছি। ঠিক আছে যেতে না চাস তো আমার কাছে থাক। টুনির একটা অভ্যাস হয়েছে, ক্ষিধে পেলে কিংবা পানির দরকার হলে চিঁ... চিঁ... করে শব্দ করে। মায়ের যত কাজই থাকুক না কেন, চিঁ চিঁ শুনলেই ছুটে ওর সামনে দাঁড়ায়। মা ওর খাঁচার সামনে গেলেই ওর আনন্দ আর দেখে কে, লাফালাফি শুরু করে দেয়। এখম আমিও আর আগের মত বাইরে যাই না। পড়ালেখার পর যেটুকু সময় পাই টুনির পেছনেই শেষ হয়। রনিও কয়েকদিন ধরে ওর বাড়ির কাজে ব্যস্ত আছে। ও প্রতিদিন খালে মাছ ধরতে যায়। সংসারের অনেক দায়িত্ব ওর ওপর। এর মধ্যে একদিন মাত্র রনির সাথে ওর “বাগান ঘরে” গিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি এসে টুনিকে দেখে যায়। অঘটন ঘটল একদিন হঠাৎ করে। হায়! টুনিকে চিরতরে হারাতে হবে আমরা কেউ একটুও বুঝতে পারিনি। সেদিন সকালে পড়ালেখা শেষ করে মাঠে খেলতে চলে গেলাম। ফিরে দেখি মা বাড়ি নেই। টুনির খাঁচা খোলা। ভাবলাম মা হয়তো ওকে কোথাও নিয়ে গেছে। মা মাঝে মাঝে ওকে কোলে নিয়ে বেড়াতে যায়। আমি গোসল সেরে ঘরে বসে আছি। হঠাৎ দেখি মা উ™£ান্তের মত বাড়ির ভেতর ঢুকে হতাশ গলায় বলল, দিপু তুই এখন ফিরলি? এদিকে তো সর্বনাশ হয়ে গেছে। মা কেঁদে ফেলল। আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠল। মায়ের অবস্থা দেখে আমার বুঝতে বাকি থাকলো না টুনির কিছু একটা হয়েছে। মাকে নিয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কী হয়েছে ভালোভাবে বল তো মা? আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি স্বাভাবিক থাকার। মা কাঁদতে কাঁদতে বলল, সকালে টুনিকে খেতে দিয়ে একটু বাড়ির বাইরে গেছিলাম। এসে দেখি খাঁচার দরজা খোলা, টুনি নেই। সব জায়গা খুঁজে এলাম, কোথাও নেই। কেউ কিছু বলতে পারলো না। আচ্ছা তুমি ভালো করে মনে করো তো, ওকে খেতে দেবার পর খাঁচার দরজা খোলা ছিল নাকি বন্ধ ছিল? আমার বুকের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মনে হয় খোলা ছিল। কিন্তু ওকে কে নেবে? আমার আর বুঝতে বাকি নেই টুনির কী হয়েছে। হয়তো কেউ চুরি করেছে কিংবা পাশের বাড়ির শয়তান কুকুরটা মুখে করে নিয়ে গেছে। মাকে কিভাবে সান্ত¡না দেব? আমার মাথায় কিছু আসছে না। মায়ের অবস্থা দেখে আমার নিজের কষ্টের কথা ভুলে গেলাম। মাকে নিয়ে আবার চারদিক টুনিকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম। কোথাও বাদ রাখলাম না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। মা বাড়ি চলো। আমি কাল সারাদিন ওকে খুঁজে বের করব। কোথায় আর যাবে? দেখো আবার ফিরে আসবে। আমি মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মা আর কোন কথা বলছে না। নীরবে আমার সাথে বাড়ি ফিরে এলো। হয়ত বুঝতে পেরেছে টুনিকে আর পাওয়া যাবে না। রাতে বাবা বাড়ি ফিরে এসে সব শুনলো। মা তখনও কারোও সাথে কথা বলছে না। মুখটা থমথমে, গম্ভীর। বাবাও কোন কথা বলছে না, চুপচাপ বসে আছে। সারাদিন না খেয়ে আছি। পেটের ভেতর আগুন জ্বলছে, চোখে অন্ধকার দেখার অবস্থা। কিন্তু মাকে কিছু বলতে সাহস পাচ্ছি না। বাড়িতে রান্না হয়নি। upponnasপাঁচ. বড়রা বোধ হয় সহজে সবকিছু ভুলে যেতে পারে। টুনি হারিয়ে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই মা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। সেদিনের পর থেকে মা আর একবারও টুনির নাম উচ্চারণ করেনি। আমি কিন্তু এখনও টুনিকে ভুলতে পারিনি। মা-ও হয়ত আমার মতই ওকে ভুলতে পারেনি কিন্তু কাউকে সেটা বুঝতে দেয় না। টুনি বাড়িতে আসার পর থেকে আমার বাইরে খেলতে যাওয়া একেবারেই কমে গিয়েছিল। পাখিটা আমাকে ঘরকুনো করে দিয়েছিল। ও হারিয়ে যাওয়ার পর আবার আগের মত বাইরে খেলতে যাই। সকালে ঘুম থেকে উঠেই রনিদের বাড়ি গেলাম। ওকে পেলাম না। ছোট বোনটিও বাড়িতে ছিল না। ওর মাকে রান্নাঘরে পেলাম। খালা রনি বাড়ি নেই? আমার চোখে তখনও ঘুম ঘুম ভাব। কী ব্যাপার, তুমি এত্ত সকাল সকাল? না এমনিই। রনি কোথায় গেছে? ও তো একটু আগে বিলে গেল মাছ ধরতে। এখন তো প্রতিদিনই যায়। রনির মায়ের সাথে দু-একটা কথা বলেই বিলের পথ ধরলাম। রনির কথা মনে পড়ছে খুব বেশি। কয়েকদিন ধরে ওর সাথে বলতে গেলে দেখাই হয় না। বাড়ি থেকে বেরুতেই ইচ্ছে হতো না। যেটুকু সময় সব টুনির জন্য। বড় খালের একপাশে দাঁড়িয়ে মাছ ধরছে রনি। পেছন থেকে ডাক দিলাম। রনি আমাকে দেখে খুশি হলো। কিরে দিপু, তুই এখন এখানে? কেমন আছিস তুই? তোর সাথে তো অনেকদিন দেখা হয় না। পা থেকে জুতা খুলে ওর পাশে যেয়ে দাঁড়ালাম। ও যেখানটাতে দাঁড়িয়ে আছে সেখানটাতে বেশ কাদা। একটা পুরনো গামছা কাছা মেরে দাঁড়িয়ে আছে ও। ঠিক মাঝির মতো দেখাচ্ছে। রনির বাম পাশে একটা মাছের খাঁচা রাখা। খাঁচার মধ্যে কিছু জ্যান্ত মাছ লাফাচ্ছে। ও পানিতে জাল ফেলল। জাল ছুড়ে মারার মধ্যেও একটা বিশেষ কায়দা আছে, সবাই পারে না। কিছুক্ষণ পর ও ধীরে ধীরে জাল টেনে তুললো পানি থেকে। জালের মধ্যে ছোট ছোট কিছু মাছ লাফাচ্ছে। আমার ভেতর একটা অদ্ভুত শিহরণ জাগলো। ওকে পাকা মাঝির মতো লাগছে। আমি আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। প্যান্ট গুটিয়ে কাছা মেরে জামা খুলে ফেললাম। নদীতে নামতে আমি প্রচণ্ড ভয় পাই। সাপের ভয়। কিন্তু আজ কোন দিকে খেয়াল নেই। রনি যেখানে যায় আমি ওর পেছন পেছন খাঁচা হাতে দাঁড়িয়ে থাকি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর মাছ ধরা দেখতে ভালো লাগছে। বাড়ির কথা ভুলে গেছি, সেই সাথে টুনির কথাও। রনি অনবরত জাল ফেলে যাচ্ছে। বেশির ভাগ সময়ই কোন মাছের দেখা নেই। তবু ওর চেষ্টার শেষ নেই। আমার কাছে এটা শুধু আনন্দের বিষয় কিন্তু ওর কাছে রীতিমত জীবিকার ব্যাপার। ওর জালে কোন মাছ বাঁধলেই আমরা দ্রুত সেটা জাল থেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছি। ও আবার জাল ফেলছে। সূর্য মাঝ আকাশে এসে গেছে। আমার চামড়া পুড়ে যাওয়ার জোগাড়। রনি প্রতিদিন এই খটখটে রোদে দাঁড়িয়ে কিভাবে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাছ ধরে আল্লাহ মালুম। চল, বড্ড রোদ পড়েছে, বাড়ি চল। কাল দুপুর থেকে কিছু খাইনি। আর একটু দাঁড়ালে আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাব। কেন? রনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো। আমি আর দ্বিধা করলাম না। টুনির হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ওকে বলে ফেললাম। রনি একটুও অবাক হলো না। ওকে দেখে মনে হলো ও বোধ হয় আগে থেকেই জানতো এরকম কিছু হবে। চল যাই। কাল থেকে কিছু খাসনি আগে বললেই পারতিস। জাল গুটিয়ে কাঁধে নিলো। আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। দিপু, তোদের সাথে বোধ হয় আর বেশিদিন থাকতে পারবো না। ওর গলায় কী যেন ছিল। আমি চমকে ওর মুখের দিকে তাকালাম। তার মানে? এই গ্রামে বোধ হয় আমার আর থাকা হবে না। কেন? আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তোর কাছে আমার কোন কিছুই গোপন রাখি না। তুই তো জানিস আমাদের অবস্থা কেমন। তিনজন মাত্র মানুষ, তারপরও তিনবেলা ঠিকমতো খাওয়া হয় না। আমার মায়ের কষ্ট দেখতে আর ভালো লাগে না। কিছুক্ষণ দু’জনই চুপচাপ হাঁটলাম। মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে। তারপরও গলায় জোর এনে বললাম, অনেকদিন ধরে তোর আখড়ায় যাওয়া হয় না। আজ বিকেলে একবার যেতেই হবে। কী বলিস? আমি ওর মুখের দিকে আড়চোখে তাকালাম। ঠিক আছে, খাওয়ার পর আমার বাড়ি আয়। তুই কিন্তু অবশ্যই বাড়ি থাকবি। আজ একবার যেতেই হবে। কথাটা ঘুরিয়ে দিতে পেরে নিজের ওপর খুশি হলাম। রনি জিজ্ঞেস করলো, তোদের স্কুল খুলবে কবে? এই তো ছুটি প্রায় শেষ হয়ে এলো। আর দশ-বারো দিন বাকি আছে। রনি বেশিদিন স্কুলে পড়তে পারেনি। আর পড়াও হবে না কোনদিন। ওর কথা ভেবে আবার মনটা ভীষণ রকম খারাপ হলো। এত কষ্টের ভেতর দিয়ে কিভাবে যে হাসে ও ভেবে পাই না। upponnasছয়. দুপুরে খেয়ে আর এক মুহূর্ত দেরি করলাম না। রনিদের বাড়ি যেয়ে দেখি ওর জালের কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। ও বসে বসে সেগুলো সারাই করছে। আমাকে দেখে রনি উঠে দাঁড়ালো। জালটা ঘরে রেখে আসলো। তারপর বলল চল, আজ আখড়ায় গিয়ে গল্প করবো। আমরা আখড়ার পথ ধরলাম। আখড়ার কথা আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি। আমরা আখড়ায় যেয়ে বসলাম। পরিবেশ আগের মতই শান্ত নির্জন। চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির। দিপু, আমি হয়ত বেশি দিন নেই রে। আমার বুকটা স্যাঁত করে উঠলো। বললাম, কোথায় যাবি? আমার বড় মামা বগুড়ায় থাকে। মামা ওখানে আমাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। মাও রাজি হয়ে গেছে। কবে যাবি ঠিক করেছিস? হয়ত খুব শিগগির। বড় মামা আমাকে নিয়ে যাবে। তুই যেতে রাজি না হলেও নিয়ে যাবে? আমার মন না চাইলেও আমাকে যেতে হবে রে দিপু। মায়ের কষ্ট সহ্য হয় না। যদি ওখানে যেয়ে কিছু করতে পারি, তাহলে মাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমার বুক ভেদ করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কারোও কষ্টের কথা শুনলে বুকটা মুচড়ে ওঠে। ওখানে যেয়ে কী কাজ করবি? জানি না। মামার একটা দোকান আছে। হয়তো দোকানে কাজ করতে হবে। আমরা অনেক গল্প করলাম। কেটে যেতে লাগল সময় পল পল করে। upponnasসাত. জ্বর থেকে উঠবার পর শরীর বেশ দুর্বল। তিনদিন অনবরত ভুল বকেছি। জ্বর হলে মাকে ছাড়া কিছুই বুঝি না। এই তিনদিন আমাদের বাড়িতে একরকম রান্না খাওয়া বন্ধ ছিল। আমার জীবনে এত তীব্র জ্বর আগে হয়েছে বলে মনে পড়ে না। জ্বর থেকে ওঠার পর রনির কথা মনে পড়ল। এই ক’দিন রনির কোন খবর জানি না। শরীর এখনও জ্বরের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। মায়ের কড়া নির্দেশ এক মুহূর্তের জন্যও একা একা ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। কয়েকদিন বিশ্রাম আর মায়ের রুটিন মত চলতে হবে। আমার ঘর তালা বন্ধ থাকে, এখন মায়ের ঘরে থাকি। আজ প্রথম গোসল করলাম। খাওয়ার রুচি একদমই নেই। জ্বরে শরীর পুড়ে গেছিল, গোসলের পর একটু ভালো লাগছে। মুখে তিতা স্বাদ, কোন কিছুই খেতে ভালো লাগে না। ঘরে শুয়ে থাকতে আর ভাল্লাগছে না, মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। রনির বাড়ি একবার যাওয়া দরকার। কিছুটা হেঁটে খুব ক্লান্ত লাগছে। রাস্তার ওপর বসে পড়লাম। রনি বাড়িতেই ছিল। আমাকে দেখে ছুটে এল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। রনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর জ্বর সেরে গেছে? তুই ভালো হয়ে গেছিস? ওর আনন্দ দেখে আমার মন ভালো হয়ে গেল। সত্যি দিপু, কী যে অশান্তির মধ্যে ছিলাম এ ক’দিন। আমি তোকে সাথে করে না নিয়ে গেলে তুই অসুস্থ হতিস না। ওর কথাগুলো আমার খুব ভালো লাগল। তবুও বাধা দিয়ে বললাম, বাদ দে তো ওসব কথা, মাঝে মধ্যে জ্বর হওয়া ভালো। চল একবার তোর বাগান ঘরে যাব। বলিস কী! এই শরীরে কিভাবে যাবি? তুই কি পাগল হয়েছিস? ও অবাক হয়ে বলল, তবু আমি নাছোড়বান্দা, যাবোই যাব। রনি কিছুক্ষণ গাইগুই করে মিনমিনে গলায় বলল, আচ্ছা চল, তবে তাড়াতাড়ি চলে আসতে হবে কিন্তু? হু, চল। আমার আবার বাড়ি ফিরতে হবে, মা জানতে পারলে খবর আছে। রনির হাত ধরে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলাম। জোরে হাঁটার শক্তি আমার নেই। অল্প একটু পথ আসতে অনেক সময় লেগে গেল। রনির বাগান-ঘরের দিকে তাকালেই বোঝা যায় বেশ কিছুদিন এখানে কেউ আসে না। চারদিকে অযতেœর ছাপ, কলাপাতাগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তুই একটু দাঁড়া, আমি আসছি। আমাকে একা দাঁড় করিয়ে রেখে ও কোথায় ছুটে গেল। কিছুক্ষণ পর কয়েকটা নতুন কলাপাতা নিয়ে হাজির হলো। শুকনো পাতাগুলো সরিয়ে নতুন পাতাগুলো মেঝের ওপর পেতে দিল। ঘরটাকে এখন আবার আগের মতো সুন্দর দেখাচ্ছে। ও ভেতরে ঢুকতেই আমি উঠে বসলাম। কিন্তু বসে থাকতে না পেরে আবার শুয়ে পড়লাম। আমার অবস্থা দেখে রনি ভয় পেয়ে গেল। একদৌড়ে কোথা থেকে একটু পানি এনে আমার মুখে ছিটিয়ে দিল। কলাপাতার একটা অংশ ছিঁড়ে পাখার মত বানিয়ে আমাকে বাতাস করতে শুরু করল। একটু ভালো লাগতেই উঠে বসলাম। আর দেরি করার যাবে না, বাড়ি ফিরতে হবে। রনি, তুই আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়, একা যেতে পারব না বোধ হয়। ও আমার হাত ধরে বাগানঘর থেকে নিচে নামাল। সমস্ত পথ ওর হাত ধরে বাড়ি পৌঁছালাম। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম, শরীরে আর একফোঁটাও শক্তি নেই। একটু পরে মা এসে বকাবকি শুরু করল। আমি চুপ, বলার কিছু নেই। বকাবকি করতে করতে জোর করে মা আমাকে অনেকখানি ভাত খাওয়ালো। এটাই বোধ হয় অন্যায়ের শাস্তি। খাওয়ার পর একটু ভালো লাগছে। এখন একটা লম্বা ঘুমের দরকার। দুর্বল শরীরে গভীর ঘুম হয়। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না, একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছে। আমি বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না, বাবা-মাকে পাচ্ছি না। আমাদের বাড়িটা কোন দিকে? আমি দিশেহারার মতো চারদিক ছোটাছুটি করছি। গাছের ডাল ভেঙে পড়ছে মটমট করে, খুব জোরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। দেখতে দেখতে রাত নেমে এল। কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি গলার সবটুকু জোর দিয়ে ‘মা-বাবা’ ডেকে যাচ্ছি। এত জোরে ঝড় বইছে যে নিজের কথা নিজেই শোনা যাচ্ছে না। তবুও অবিরাম ডেকে চলেছি। মাথার ওপর একটা ডাল ভাঙার শব্দ হলো। দৌড়ে সরে গেলাম। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম ডালটা ভেঙে সেখানে পড়ল। আমি শিউরে উঠলাম। সরে না এলে আমি কি মারা যেতাম? আরও জোরে মা-বাবাকে ডাকছি। অন্ধকারের ভেতর কে যেন আমার হাত চেপে ধরল, আমি ভয় পেয়ে হাত ছাড়িয়ে নিতে যাব, দেখি রনি আমার হাত ধরে আছে। ও আমার সামনে এসে বলল, দিপু দৌড়া, আমি তোকে মা-বাবার কাছে নিয়ে যাব। মা-বাবা কোথায়? আমি জানি, আমার সাথে দৌড়া, আমি জানি। মা-বাবার কাছে আর যাওয়া হলো না, কার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না। সারা গা ঘামে ভিজে একাকার, গলা শুকিয়ে কাঠ। জানালার বাইরে থেকে আবার কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল। হাতের কাছে পানি ছিল, ঢক ঢক করে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে দেখি রনি ডাকছে। এ সময় তো ওর আসার কথা না! দিপু একটু বাইরে আয়। ও আবার ডাকল। অদ্ভুত ব্যাপার, ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম আর ওর ডাকে ঘুম ভাঙলো! বাইরে এসে দেখি রনি মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারাটা বড্ড মলিন লাগছে। কী ব্যাপার, তোকে ওমন দেখাচ্ছে কেন? একটা মজার ঘটনা ঘটেছে, একটু আগে আমি তোকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম, আবার ঘুমও ভাঙলো তোর ডাকে। মজার ব্যাপার না? আমি জিজ্ঞাসু মুখে ওর দিকে তাকালাম। কিন্তু ওর মুখের কোন পরিবর্তন নেই, আগের মত থমথম করছে। এবার ও মুখ খুললো, আজ দুপুরে বড় মামা এসেছে। বেশি দেরি করবে না, আমাকে নিয়ে এখনি রওনা হবে। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ আগের দেখা স্বপ্নের রেশ এখনও কাটেনি, এরই মধ্যে আরেকটা বড় ধাক্কা। কী বলিস তুই! আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছি না। মামা এসে ওকে নিয়ে যাবে শুনেছি কিন্তু এমন আচমকা আসবে ভাবতে পারছি না। আমার বাড়ি চল, দেখতে পাবি। ওর দিকে তাকিয়ে আছি, না, ও মিথ্যে বলছে না। ওর সাথে পরিচয় হবার পর থেকে কোনদিন ওকে এত বিমর্ষ দেখিনি। ওর বাড়ি এসে দেখি ভাঙা চেয়ারটা উঠানে। একজন বয়স্ক লোক চেয়ারে বসে আছে। গায়ের পোশাক দামি, দেখলেই বোঝা যায়। লোকটা হাসিমুখে আমার দিকে তাকালো। সালাম দিলাম, উত্তরে মাথা নিচু করল। রনির মামা ওদেরও সবার জন্য নতুন জামা-কাপড় এনেছে বোধ হয়। রনির ছোট বোনটা নতুন জামা পরে দৌড়াদৌড়ি করছে। ওর মা রান্নাঘরে বসে কিছু রান্না করছে মনে হলো। রনির মা এই লোকটার আপন বোন ভাবতে কষ্ট হয়। দু’জনের ভেতর কত ব্যবধান! লোকটা আমার নাম জিজ্ঞেস করল। আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে লোকটার ওপর। এই মানুষটাই রনিকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে, অনেক দূরে। ইচ্ছে করছে এখুনি লোকটাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে বের করে দিই। আমি নামটা বলেই এক লাফে রনির ঘরে ঢুকে গেলাম। ও নতুন জামা পরেছে, অদ্ভুত সুন্দর লাগছে ওকে। কিন্তু মুখটা ভীষণ মলিন। রনি একবারও আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মুখ নিচু করে ভেজা গলায় বললাম, আমার কথা মনে থাকবে তো তোর? নাকি ভুলে যাবি? ভেতর থেকে একটা কান্নার ঝড় ঠেলে উঠতে চাচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছি। একটা মলিন ব্যাগে ও সমস্ত জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে। তার ভেতর আমার দেয়া জামাটাও আছে। রনি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমি একটানা ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ও সত্যিই চলে যাচ্ছে! পেছন থেকে ওর শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বুঝতে পারলাম চেষ্টা করছে শরীরটাকে সোজা রাখতে, কিন্তু পারছে না। আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওর দু-চোখ ভেসে যাচ্ছে অশ্রুতে। ওর চোখের সামনে আমার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। কয়েক ফোঁটা পানি আমার হাতের তালুতে পড়ল। রনিকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি, হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। পানির ফোঁটাগুলো চিকচিক করছে। ও শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরলো। দিপু মনে রাখিস, তোর দেয়া জামাটা নিয়ে যাচ্ছি, যখনই তোর কথা বেশি মনে পড়বে ওটা গায়ে দিয়ে ঘুরব। আমি তোকে আর কী দেব? এমন কিছু আমার নেই যেটা তোকে দেয়া যায়। তোকে আমার বাগানঘরটা দিয়ে দিলাম। ঘরটার কথা তুই ছাড়া কেউ জানে না। যদি আমার কথা মনে হয় ওখানে যাস, কিন্তু একা যাবি। ওটা শুধুই তোর। ওটা যতœ করে গুছিয়ে রাখিস। রাখবি তো? হু। কথা বলতে পারছি না। বুকের ভেতর মোচড় দিচ্ছে। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। কোনরকমে ওর হাত ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ওর মামা দাঁড়িয়ে আছে, সাথে ওর মা। রনি আধছেঁড়া ব্যাগটা নিয়ে বাইরে এসে আমার পাশে দাঁড়াল। ব্যাগ থেকে গুলতিটা বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল, এটা তুই রাখ। আমার আর লাগবে না। বিনাবাক্যে ওটা নিলাম, জানি এটা রনির খুবই প্রিয়। ওদের বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ড মিনিট পাঁচেকের পথ। আমাদের বাড়ি থেকে আরও কাছে। সবাই একসাথে বেরিয়ে পড়লাম। আমার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। কিন্তু কোনদিকেই নজর নেই। এখনও মনে হচ্ছে আমি বোধ হয় কোন দুঃস্বপ্ন দেখছি, এখনই ঘুম ভেঙে দেখব সব মিথ্যে। আমরা দু’জন পাশাপাশি হাঁটছি। কারও মুখে কথা নেই। বাসস্ট্যান্ডের কাছাকাছি আসতেই আমি বললাম, তুই সামনে যা, আমি আসছি। রনি কোন কথা বলল না, সামনে এগিয়ে গেল। আমি টুপ করে রাস্তার পাশের এক দোকানে ঢুকে পড়লাম। এখান থেকে বাসস্ট্যান্ড পরিষ্কার দেখা যায়। ওরা দাঁড়িয়ে আছে, রনির মা ওর মামার সাথে কথা বলছে। একটু পরে বাস এসে গেল। রনির মা ওর মাথায় হাত দিয়ে কী যেন বলছে আর কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। ওর বোনটা বোধ হয় এখনও কিছু বুঝতে পারেনি, আগের মতই খুশি খুশি ভাব। নতুন জামা পেয়ে ওর কোনদিকে খেয়াল নেই। মায়ের আঁচল ধরে মামার দিকে তাকিয়ে আছে। রনি ওকে কোলে তুলে নিল। মুখে একটা চুমু দিয়ে নামিয়ে দিল। বাসে উঠবার আগে ও বারবার চারদিকে কাকে যেন খুঁঁজল। আমি জানি ও কাকে খুঁজছে, কিন্তু আমি আর ওর সামনে যেয়ে দাঁড়াতে পারব না। শেষবারের মত চারদিকে তাকিয়ে রনি বাসে উঠে গেল। আমি দোকানের ভেতর থেকে সব দেখতে পাচ্ছি পরিষ্কার। বাস ছেড়ে দিল। যতক্ষণ দেখা যায় ওর মা বাসের দিকে তাকিয়ে থাকল। রনির মা বাড়ির পথ ধরল, কোলে মেয়েটা। আমি দোকান থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমার হাতে রনির দেয়া গুলতি। শরীর খারাপ হলে আবার ভালো হয়, মন খারাপ হলেও ভালো হবার কথা। রনির জন্য আমার আজ থেকে যে ভীষণ রকম মন খারাপ হলো এটা কি কখনও ভালো হবে? পশ্চিম আকাশ লাল হয়েছে। একটু পরই সন্ধ্যা নামবে, তারপর রাত, গভীর অন্ধকার, ঠিক যেমন অন্ধকার এখন আমার বুকের ভেতর। আমি দুর্বল শরীর নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। বাড়ি ফেরা দরকার, মা ভীষণ চিন্তা করবে। কিন্তু আমার একটুও বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ