রানা এলো শহরে

রানা এলো শহরে

গল্প আগস্ট ২০১২

চেমন আরা..



সাত বছরের ছোট ছেলে রানা। ঠিক হয়েছে তার বড় চাচার সঙ্গে ঢাকা যাবে। এক অভাবিত আনন্দে, এক অজানা শঙ্কায় শিহরিত হয় সে বারবার। রাতে ঘুম আসতে চায় না।
নদীর ঘাটে কেরায়া নাও বাঁধা হয়ে গেছে। সকাল হলেই তারা রওনা দেবে এই নাওয়ে চড়ে।
রানাদের বাড়ির লাগোয়া একটা গাং। সবাই বলে মনাই নদী। এই গাঙেই নাও বাঁধা হয়েছে। ঘর থেকে মাঝিদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। রাতে তারা নাওয়ে থাকবে। রেঁধে বেড়ে খাবে।
অনেকক্ষণ বিছানায় এদিক ওদিক করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে রানা। বিছানা বলতে রান্নাঘরের কোনায় পড়ে থাকা একটা ভাঙা তক্তপোশ আর তেল চিটচিটে একটা বালিশ। এখানে মা-বেটা রাতে শোয়।
রানার মা সারাদিনের কাজ কাম সেরে কখন যে তার পাশে এসে শুয়েছে তা সে টেরও পায়নি।
সকালবেলা আজানের শব্দে আর মোরগের ডাকে রানার ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙতেই সে ধড়মড় করে উঠে বসে। পাশে মা শুয়ে আছে। আলতো করে তার ডান হাতটা তার পেটের ওপর রাখা ছিল। সে ওঠার সময় খুব সাবধানে মার হাতটা সরিয়ে দেয়।
রানা জানে তার চাচাজীও এখন উঠে পড়বেন। উঠেই খাল পাড়ে তার জন্য তৈরি নতুন পায়খানায় যাবেন। ওখান থেকে এসে উঠানে চাপকলে অজু করে নামাজ পড়বেন।
তারপরই তারা রওনা হবে ঢাকার পথে।
সে আস্তে করে তক্তপোশ থেকে নেমে বাড়ির পেছনে চলে যায়। ওখানে বেত ঝাড়ের মধ্যে মুখে ছালা লাগানো সবার জন্য একটা পায়খানা আছে। সে পেশাব পায়খানা সেরে আসতে আসতে তার মা-ও বিছানা থেকে উঠে যায়। এমন সময় চাচাজীর ডাক শোনা যায় কইরে, রানা উইঠা পড়। অহনই আমরা যাইয়াম গা।
সঙ্গে নেয়ার মতো রানার কোনো কাপড় চোপড় নেই। পরনে একটা ময়লা প্যান্ট, গায়েও তেমনি ময়লা একটা ছেঁড়া শার্ট। সুতরাং তার দেরি হয় না। রানার মা ছেলেকে উঠানে নিয়ে চাপকল থেকে পানি নিয়ে মুখ হাত ধুয়ে দেয়। চোখের কোনায় লেগে থাকা পিছুটি পরিষ্কার করে দেয়। পরে রান্নাঘর থেকে একটা সরিষা তোলের বোতল এনে ওর মুখে-মাথায় কিছু তেল দিয়ে ধোপদুরস্ত করে দিতে চেষ্টা করে। রানার মার দিকে তাকাতে ইচ্ছা করে না। তাকালে কান্না আসবে যে। মার মুখখানা বিষণœ, মলিন। চোখগুলো ফোলা ফোলা। দেখলেই আন্দাজ করা যায় সারারাত ছেলের আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনায় কেঁদেছে।
গতকাল তার খেলার সাথী রেজা তাকে বলেছিল, তুই দেইখ্যা লইস, এ গাঁ ছাইড়া তুই কোনো হানে যাইত পারবি না। তর চাচাজী বড় মানুষ। তাইন কি তরে লইয়া যাইব? হুদাহুদি কইছইন। আর লইয়া গেলেও তর ওহানে ভালা লাগবো না। কিন্তু কই না তো। এহন তক তো মনে কোন খারাব ভাব আইতাছে না। এখন রানার মন চায় রেজাকে কইতে দ্যাখলি তো। চাচাজী হাছা কথাই কইছইন। হাছাই আমি ডাহা যাইতাছি।
মামুর বাড়িতে থাকার সময় থাইক্যা সে শুনে আসছে ঢাকায় তার একজন চাচাজী আছেন। তাইন ম্যালা পয়সাওয়ালা মানুষ। মস্ত বড় বিদ্বানও।
সে কোনদিন তার চাচাজীকে চোখে দেখেনি। এই প্রথমবার সে চাচাজীকে দেখলো। জন্মের পর থেকে সে মায়ের সঙ্গে মামুর বাড়িতে ছিল। চাচাজী বাড়িতে এসে তাদের নিয়ে এসেছেন এখানে।
সাধারণত এই এলাকার গৃহস্থ বাড়িগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে না। মেয়ে পুরুষ সবাই খুব অলসভাবে দিন কাটায়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে কোন ধারণাও নাই এদের।
কিন্তু রানার কাছে গাঁয়ের অন্য বাড়ি থেকে তাদের বাড়িটা বেশ সাফ সুতরো মনে হচ্ছে। লোকজন বলাবলি করে, চাচাজী আইছইন বইলা নাহি ঘরদোর পয় পরিষ্কার অইছে। গরু রাখার কামলা গফুর বলে, জানস রানা, তর এই চাচা বাড়িত আইলে আমরাও ইচ্ছামত মাছ-গোশত খাইতে পারি। মাছ তরকারির অভাব অয় না। না অইলে সারা বছর মরিচ গোঁড়া দিয়া ভাত খাইতে অয়। দ্যাশের মানুষজন তর চাচাজীকে খুব মান্য গণ্য করে। সে দ্যাশের কোন মানুষের মধ্যে তর চাচাজীর আদল খুঁজে পায় না।
কিন্তু চাচাজীকে তার খুব ডর লাগে। এহন কেমুন করে চাচাজীর লগে বসে ঢাকা যাবে, সে ভেবে পায় না। সে অতি কষ্টে সাহসে বুক বাঁধে। সে যাবেই ঢাকা। তার যেতে হবেই।
নাওয়ে ওঠার পর তার ভয় ডর আস্তে আস্তে কমে আসে যেন। তাদের বিদায় দেয়ার জন্য বাড়ির লোকজন সব ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। সবাই গাঙের ঘাটে ভিড় করে আছে। তাদের কথাবার্তার কলকলানিতে গাঙের ঘাট মুখর। মেয়েরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে। এদের দলে তার মাও আছে। রানা একবার আড় চোখে মাকে দেখে নেয়। তার চোখে পানি আসে। সে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। নাও ছাড়ার সাথে সাথে মাঝিরা মেশিন চালু করে দেয়।
পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্রের অচিনপুরে যাওয়ার মত রানা যাচ্ছে ঢাকায়, শ্যালো নাওয়ে চড়ে। এত বড় নাওয়ের বেবাক জায়গা খালি পড়ে আছে। গুটিশুটি মেরে রানা ছইয়ের নিচে এক কোনায় গিয়ে বসে।
শ্যামলা রঙের গোলগাল চেহারার ছেলে রানা। চোখ জোড়া বড় বড়। এখন সেই চোখ জোড়া যেন বিস্ময়ে, আতঙ্কে আরও ছানাবড়া হয়ে ওঠে। এতবড় নাওয়ে আগে সে কোন দিন ওঠেনি। তার মামুর বাড়িতে একটা ডিঙি নাও আছে। ঐ নাও দিয়ে মামুরা মাছ ধরতে যায়। পাহাড়ের নামছায় গিয়ে গরুর জন্য খড়-বিচালি কেটে আনে। সে মনে মনে বলে এমুন সুন্দর নাওয়ের কাছে ওডা একডা নাও নাহি। কেমুন সুন্দর রাজহাঁসের নাহান সাঁতার কাইটা কাইটা তির তির কইর‌্যা নাও যাইতাছে। একটা ভোঁ ভোঁ আওয়াজও তার কানে আসছে।
চারদিকে বেশুমার পানি আর পানি। ঐ দূরে দেখা যায় কাজলা রঙের পাহাড়। মাঝে মাঝে পানির মধ্যে দ্বীপের মত টিলার ওপর দু’চারটা চালাঘর, টিনের ঘর নিয়ে গৃহস্থ বাড়ি। সব বাড়ির সঙ্গে গরুর গোয়াল ঘর, খড়ের গাদা দেখা যায়। রানা তন্ময় হয়ে ছইয়ের জানালা দিয়ে এসব দেখছে। তার চাচা মাঝিদের ঘর গেরস্থির খবর নিচ্ছেন। রানা মনে মনে বলে, চাচাজী তো হকখল সময় ডাহা থাকঅইন। তয় ডাহার ভাষায় কথা কইতাছইন ন্যা কেন।
নাও এখন গাঁও ছাড়িয়ে বাঁক পেরিয়ে বড় হাওরে এসে পড়েছে। আরেক তামাশা এখন। কত যে নাও এদিক ওদিক যাওয়া-আসা করছে তার গনাগুনতি করতে পারে না রানা। কোনটায় সওয়ারি যাচ্ছে। কোনটায় বিয়ের বাদ্যি বাজনা বাজে। কোনটা যায় সওদাপাতি বিকিকিনি করতে। জেলে নাও যাচ্ছে মাছ ধরতে। কোন কোন নাও থেকে মাঝিরা হাঁক ছাড়ে কোন গাওয়ের নাও এডা। নাওয়ের মাঝিরা উত্তর দেয়, মামুদপুর থুধ সাব যাইতাছইন ডাহায়। এই সব হুনে রানার কী যে ভাল লাগে! মনের মধ্যে খুশির পায়রা বাকুম-বাকুম করে যেন।
এসব দৃশ্য রানা আগে কোনদিন দেখেনি। তাদের গাঁও তো বছরে ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে। এই সময় ছোটরা বাড়ির উঠান ছাড়া আর কোথাও যেতে পারে না। মাঝে মাঝে কাছে বিছে এ-গাঁ ও-গাঁ মা বা অন্য কারো সঙ্গে বেড়ানিতে যায় শুধু। গাঁয়ের বড়রাও সপ্তাহে একদিন শুধু ফেরি নাও ভাড়া করে মধ্যনগর বাজারে যায় সওদাপাতি কেনাকাটার জন্য। অন্য সময় বাড়িতে শুয়ে-বসে কাটায়।
এতক্ষণ ধরে চাচাজী শুধুু মাঝিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। রানার দিকে খেয়ালই করেননি। তার পরনের কাপড় চোপড় খুব ময়লা। সারা গায়ে চুলকানি। নাক দিয়ে সর্দি ঝরছে। রানার দিকে তাকাতে তার মনটা খারাপ হয়ে যায়।
রানাকে বলেন, এত গিদরের মতো আইছস তুই? বাড়িতে সাবান সুবান আছিল না? আমারে তো তুই শরমে ফেলবি দেখছি। বকা খেয়ে রানা শরমে মাথা নিচু করে নখ খুঁটতে থাকে। একটুক্ষণ পর তিনি আবার নরম হয়ে আদরের সুরে রানাকে বলেন, গিদরের মতো তো আইছস। এহন ক তর কেমন লাগছে, বাড়ির লাগি মন পুড়ে?
না, মাথা নেড়ে রানা উত্তর দেয়।
শ্যালো নায়ের মাঝি চারজন।
একজন সামনে ইঞ্জিন ঘুরাচ্ছে। আর একজন বালতি করে পানি তুলে তুলে একটা প্লাস্টিকের বালতিতে জমাচ্ছে। রানার ভীষণ ইচ্ছে করে একটু ছইয়ের বইরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সাহসে কুলায় না।
এখন আর হাওরের অথৈ পানি শ্যালো নাওয়ের তির তিরানী রানাকে নিবিষ্ট করে রাখতে পারে না।
গায়ের চুলকানি, নাকের সর্দি তাকে বেসামাল করে তুলছে। ভয়ও লাগছে চাচাজী তার এসব দেখে যদি বকেন। পেশাবও ধরছে। পেটে চাপ দিচ্ছে।
এক সময় চাচাজী নিজেই জানতে চান, পেশাব করবি? স্যুটকেস খুলে ছোট একটা রুমাল দিয়ে বলেন, নে এড্যা লগে রাখ। নাকে পানি আইলে মুইছ্যা ফেলাইস। নখ দিয়ে গা চুলকাবি না। আয় তো দেখি আমার ঠাঁই। তর নখ কেমুন দেহি।
হায় আল্লাহ এতো দেহি বেজায় ময়লা। যেমুন লম্বা তেমনি ময়লা জইম্যা আছে নখের ভেতরে। রানা কাছে আসতে কেমন এক আঁশটে গন্ধ তার নাকে এসে লাগে।
তিনি দাড়ি কামানোর বাক্স খুলে কাঁচি বার করে রানার নখ কেটে দেন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন। নাও এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের পথে।
মাঝ পথে বিশ্বম্ভরপুর রাজারের ঘাটে মাঝিরা নাও ভেড়ায়। নাওয়ের তেল ফুরিয়ে গেছে। এখান থেকে তেল কিনবে। মাঝিরা নাওটা পাড়ের কাছাকাছি একটা জায়গায় রেখে ডাঙায় ওঠে।
ঘাটে চাচাজীও নেমে গেছিলেন, উঠে এসে বললেন, ভুগ লাগছে তর? অহন খাইবি, আয়।
পথে খাবার জন্য নাদেরা বু হাঁসের গোশত ভুনা ও খিচুরি রেঁধে দিয়েছে। মাঝিদের কাছ থেকে একটা বর্তন চেয়ে নিয়ে রানার চাচাজী রানাকে ভাত দেন। একটা বাটিতে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে দেন।
নিজেও টিফিন কেরিয়ারের মুখের ঢাকনায় ভাত নিয়ে চামচ দিয়ে খেতে বসেন। রানা খুব সাবধানে সুন্দর করে আস্তে আস্তে ভাত খায়। তার ভাত খাওয়া দেখে চাচাজী খুব খুশি। বলেন, বা তুই ত দেখি খুউব সুন্দর কইর‌্যা ভাত খাওন শিখছস। ভাত খাইয়া ছইয়ের বাইরে যা। হাত মুখ ধুইয়া কুলি কইর‌্যা আইসা হুইয়া পড় কতক্ষণের লাগি।
এক ঘণ্টার মধ্যে নাও এসে সুনামগঞ্জের ঘাটে লাগে। মাঝিদের ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে ওদের সঙ্গে দু’চারটা কথাবার্তা বলে ওরা নেমে আসেন নাও থেকে। রানা ভাবে, কী আজব তামাসা। এত মানুষ, এত ঘরদোর। পানি চিহ্ন নাই কোনো হানে। ঘাট থেকে নেমে কিছু কাঁচা সড়ক পার হয়ে তারা উঠে বসে একটা রিকশায়।
রিকশা চলছে। দুই ধারে দোকানপাট, বাড়িঘর আরও কত কিছু! সব কিছু মিলে অজপাড়া গাঁয়ের ছেলে রানার এক বিস্ময়কর অনুভূতি। কিছুক্ষণের মধ্যে রিকশা এসে থামে একটা পাকা বাড়ির সামনে। তারা রিকশা থেকে নেমে এ বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ায়। দারজায় ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে একজন বুড়ো কিসিমের লোক চাচাজীকে বুকে জড়িত ধরেন। রানা পেছনে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঐ ঘরে ঢুকে তাকে ও বাড়িতে বসিয়ে রেখে চাচাজী কোথায় যেন গেলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন চুপচাপ বইস্যা থাক। আমি অহনই আইতাছি। স্যুটকেসটা রাইখ্যা গেলাম, দেইখ্যা রাখিস।
রানার ভয় ভয় লাগছে। যদিও এ বাড়ির লোকটিকে চাচাজীর মতই ভাল মনে হয়। তিনি এসে মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বললেন, ভয় পেয়ো না, এখনই তোমার চাচাজী আসবেন।
একটা সুন্দর পলিথিনের ব্যাগ হাতে নিয়ে চাচাজী ঘরে ঢুকেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাজার থেকে রানার জন্য নতুন প্যান্ট-শার্ট কিনে এনেছেন। এখান থেকেই সাফ-সুফ করে ঢাকায় নিয়ে যাবেন।
রানার হাতে ব্যাগটা দিয়ে বলেন, ওহানে গোসলের ঘর আছে। ঢুইক্যা তর ময়লা কাপড় গুলান খুইল্যা এডায় ভইর‌্যা রাখ। আর নয়া গুলান পইরা নে।
এই বলে তাকে নিয়ে গিয়ে গোসলখানার দরজা খুলে ঢুকিয়ে দিয়ে আসেন।

রানা নতুন প্যান্ট-শার্ট পরে বেরিয়ে আসে গোসলখানা থেকে। নতুন পোশাকে তার চেহারা বদলে গেছে। গেঁয়ো গ্রামীণ ভাবটাও অত নেই।
এই বাড়িতে দুপুরের ভাত খেয়ে তারা বাসস্ট্যান্ডে যাবে সিলেট যাওয়ার জন্য। টেবিলে ভাত দেয়া হয়েছে। সবাই ভাত খাবে এখন। মহা মুশকিলে পড়লো রানা। সে কি কোনদিন চেয়ার-টেবিলে ভাত খেয়েছে, না দেখেছ! সংকোচ জড়তা তাকে অসহায় করে তোলে। টেবলিটাও উঁচা। খুব সাবধানে ভাত খায় রানা। চাচাজী ভাত খেতে খেতে গল্প করছেন এই বাড়ির লোকটির সঙ্গে। তার দিকে একবারও তাকান না। সালুনপাাতি পাতে দিচ্ছেন এইবাড়ির লোকটি। চাচাজী তাকে ভাইজান করে ডাকছেন। সে খাওয়া শেষে রান্না করে গামলায় রাখা পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে আসে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে এখান থেকে তারা যাবে বাসস্ট্যান্ডে, তাদের গন্তব্য সিলেট শহর।
রানার জন্য তো এও বিস্ময়! সে তো আগে কোনো দিন বাস দেখেনি। তাদের গাঁয়ের বাড়ির লাখারী ঘরের সমান, দেইখতে কচ্ছপের নাহান একটা গাড়ি। গাড়ির মধ্যে নরম গদি আঁটা অনেক চেয়ার। বাসে উঠে সে ও তার চাচাজী পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে। তার দেখার শেষ নাই। সামনে পেছনে কত মানুষ। তার ভাইয়ের মতো একটা ছেলে বাসের পৈঠায় দাঁড়িয়ে সমানে চিৎকার করছেÑ সিলট, সিলট। যাইবার অইলে অহনই চইল্যা অ্যাহেন। বাস অহনই ছাইড়া যাইব। একটা অন্ধ ভিখারি এসে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে হাত পাতে। চাচাজী সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা টাকা বের করে দিলে ফকিরটা দোয়া করতে করতে পেছন দিকে সরে যায়।
চাচাজী রানার কাছে জানতে চান কিছু খাবে কি না। সে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায় মুখে কিছু বলে না। এখন পর্যন্ত সে চাচাজীর সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। চাচাজী আবার বলেন, এরে কয় বাস বুঝলি? হফায় তো আইলি, আরও কত রঙ তামাসা দেখবার পারবি।
রানা চুপ চাপ। সে শুধু দু’চোখ ভরে দেখছে দুনিয়ার আজব খেল-তামাসা। বাস চলছে সিলেটের পথে। সিলেট আসতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। রাস্তায় রাস্তায় বিজলিবাতির আলো। ঘরে, দোকানে আলোতে ঝলমল করছে। তার চোখে ঝিলিক মারে। এসব দেখে তার মন মগজে কোন বুদ্ধি আর কাজ করে না। তারা বাস থেকে নেমে একটা দোকানে ঢুকে। চাচাজী কন, এডা নাহি ভাতের হোটেল। ল, আমরা কিছু খাইয়া লই। রাইত দশটায় আবার আমাগো রেলগাড়িতে চড়ন লাগব। তার পরেইতো ডাহা। আইজ তুই রেলগাড়িও দেইখ্যা ফেইলবি। রানা রেলগাড়ির নাম শুনেছে!
হোটেলে বসে তারা রাতের ভাত খায়। তারপর রেলস্টেশনে আসে। ঢাকাগামী রেলগাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ছাড়ার বেশি দেরি নাই। তারা একটা কামরায় উঠে পড়ে। অবাক থেকে অবাকতর হয় রানা। অথৈ পানির মধ্যে একটা ছোট টিলার ওপর তাদের ঘর। কয়েক ঘর আত্মীয়স্বজন নিয়ে সীমাবদ্ধ চৌহদ্দির মধ্যে রানার গতিবিধি ছিল সীমিত। রানা মনে মনে ভাবে, মায় যদি তারে চাচাজীর লগে আইতে না দিতাইন তাইলে, হে জনমেয়ও এসব আজিব তামাসা দেখবার পারতা না। এসব ভাবতে ভাবতে সে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
সারাদিন তার ছোট শরীরটার ওপর অনেক ধকল গেছে। একটা নতুন স্বপ্ন বুকে পুষে সে মায়ের আঁচল ছেড়েছে। তাই, হয়তো সারাদিনের ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়েনি।
সকালবেলা ধল পহর থাকতেই রানাকে তার চাচাজী ডেকে তুলেন। উইঠ্যা পর, ডাহায় আইয়্যা পরছি আমরা। অহন নামঅন লাগব। ধড়মড় করে উঠে বসে রানা। ডাহা আইছে সে, এডা ডাহা। চোখ কচলাতে কচলাতে সে চারদিকে তাকায়। না, সে কিছু বুঝবার পারে না।
গাড়ি থামতেই তারা গাড়ি থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে চলে আসে।
এবার যাত্রা তার বহুদিনের স্বপ্নে দেখা চাচার বাড়ির পথে। যেহ গাড়িতে তারা যাচ্ছে তার নাম নাহি বেবিট্যাক্সি। তরে সব গাড়িতে চড়াইলাম। রিকশা, বাস, রেলগাড়ি, বেবিট্যাক্সি বুঝলি। চাচাজী বলেন। সারাটি রাস্তা রানা পার করেছে মন্ত্রমুগ্ধের মতো। দালানকোঠা, মানুষজন, রাস্তাঘাট সব মিলে সে এখন এক নতুন দুনিয়ার যাত্রী। চাচাজীর বাড়ির সামনে এসে বেবিট্যাক্সি দাঁড়াতেই একটা সংকোচ, একটা অসহায় আর্ত অনুভূতি রানাকে বিচলিত করে তোলে। এতক্ষণ ধরে তার চাচাজী একেবারেই তার ছিলেন। চাচাজী কারো কথা ভাবেননি, কারো সঙ্গে কথা বলেননি। রানাই ছিলো তার সর্বক্ষণের সাথী।

এহন বাড়িতে আইছইন। চাচী আম্মা, ভাইজান, আফারা সব থাকঅইন এহানে, তারে দেখইখ্যা কি জানি কইবেন, এহানকার কাউকে তো সে চেনে না।
দ্যাশের বাড়িতে চাচী আম্মার কতা কেউ ভালা কয় না। দ্যাশ থাইকা মানুষ আইলে খুব নাহি খারাপ ব্যবহার করঅইন।
রানার ভয়ে বুক কাঁপতে শুরু করে। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে ধুলায় ধূসর হয়ে আছে পায়ের চামড়া। স্পঞ্জের স্যান্ডেলের জোড়াটাও পুরনো।
চাচাজীর বাড়িটা দালান। বাড়ির ভিটায় কালোজিরা আর সাগু দানার মতো কালো সাদা কি সব চকচক করছে।
এসবের ওপর দিয়ে পুরনো স্যান্ডেল, ময়লা পা নিয়ে সে হাঁটবে কেমন করে বুঝতে পারে না, চিন্তিত হয় রানা।
ঘরে ঢুকেই চাচাজী চাচী আম্মার খোঁজ করেন। ঢাকাইয়া ভাষায় কাজের বুয়াকে বলেন দেখ কাকে নিয়ে এসেছি। এখন থেকে আমাদের এখানে থাকবে। স্কুলে পড়বে। আমরা বাসায় না থাকলে ওর দিকে একটু নজর রেখো।
রানা শরমে সংকুচিত হয়ে তার চাচাজীর পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। এরই মধ্যে চাচী আম্মাও এসে পড়েন। বলেন, ওমা, এত ছোট ছেলেকে কোত্থেকে নিয়ে এলে?
বলবো, সব বলবো। আগে ওকে একটু সাফ-সুফ করে কিছু খেতে দাও। বহু কষ্ট করে এসেছি আমরা। কালকে ফজরের আজানের সময় বাড়ি ছেড়েছি। সারাক্ষণই পথে।
ঢাকায় আসার পর থেকে রানার শুধু দেশের জন্য মন কাঁদে। সেই ছোট গ্রাম, অভাবের সংসার, মায়ের বিষণœ চেহারা, হাওরের অথৈ পানি তাকে শুধু ডাকে।
একটু ভাল লাগেনা তার। জেলখানা দেখেনি সে। তবে শুনেছে জেলখানায় মানুষকে বন্দী করে রাখে। চাচাজীর বাড়িকে তার জেলখানা, জেলখানা মনে হয়।
দেশের বাড়িতে চাচী আম্মারে সবাই খারাব কইলেও চাচী আম্মারে তার অত খারাব লাগে না। পয়লা দিন তো চাচী আম্মাই তারে সাবান সুবান দিয়ে গোসল করিয়ে দিছেন। তার ভয় বড় আফা, ছোট আফারে। সব সময় তারা তারে বকা ঝকা করঅইন। আফারা ঘরে থাকলে তার খুইব ভয় লাগে। ইচ্ছামতো কিছু করা যায় না।
আজব শহর ডাহা। বাড়িতে সে গাঙ্গে নাইমা ইচ্ছা মতো সাঁতার কাইটা গোসল করেছে। আর এহানে গোসল কইরতে হয় গোসলখানায়, সবাই কয় বাথরুম। চাবির নাহান কল ঘুরালে পানি আসে। আবার উল্টা দিকে ঘুরাইলে পানি বন্ধ অইয়া যায়। মুখ-হাত ধোয়ার সময় গোসলের সময় বেশি পানি খরচ করন যা না। একটু বেশি পানি খরচ কইরলে বাড়ির সবাই মন্দ বলেন।
গোসলখানার এক কোনায় সাদা রঙের চেয়ারের নাহান কী একটা পাতা। রানা পয়লা দিন বুঝবার পারেনি ঐডা কী। ভয় পাইছিল পায়খানা ধরলে, পেশাব ধরলে সে কী কইরবে।
চাচী আম্মা তারে শিখায়ে দিছিলেনÑ বলছিলেন, এই পায়খানা। ওখানে কেমুন করে বইসতে অয় তাও কইয়া দিলেন।
তারপরেও এই বাড়ির কাউকে তার আপন মনে হয় না শুধু চাচাজী ছাড়া। সব সময় ভয় ভয় করে। ঘরের চকচকে দেয়াল যদি একটু ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়, অথবা দরজায় হাত পড়ে অমনি সবাই চিৎকার করে ওঠে। উঠতে বসতে, খাইতে, শুইতে সব সময় শাসন আর শাসন। খাইতে বইলে আফারা কন এই রানা এত ভাত খাস কেন? বেশি ভাত খাইলে পেট ফেটে মরে যাবি। কম কম ভাত খাস। পায়খানায় গেলে চাচী আম্মা দাঁড়িয়ে থাকঅইন সাবান দিয়ে হাত ধুইছে কি না দেখবার লাগি। আর লেখাপড়া করার জন্য চাচাজীও বকাঝকা করেন। তবে এই বাড়িতে চাচাজী ছাড়া তার আর কাউকে ভালা লাগে না।
একদিন আফুদের চাচাজী খুব বকা দিলেন।
গাঁও গেরামে কত এভাবে তার ছোটকালটা কেটেছে। ওর মামুরা খুব গরিব। বুড়ো বয়সে কাদের তার প্রথম বৌয়ের অমতে ওর মাকে বিয়ে করে ফেলেছে। কিন্তু ছেলেমেয়েদের ভয়ে এতদিন বাড়িতে আনতে পারেনি। এবার আমি গিয়ে ওদের কষ্ট দেখে নিয়ে এসেছি। তারা ওর মাকে এখনো ভুলবশত ঘরে উঠতে দেয়নি।
ঘরের সঙ্গে রান্নাঘর থাকলে ঘর কালি ঝুলিতে ভরে যায়। এর জন্য আমি একটা আলাদা রান্নাঘর করে দিয়ে এসেছি। ঐ রান্নাঘরের এক কোনায় ওর মা ও ছেলেটা রাতে ঘুমাতো। এইতো অবস্থা ওর। মানবিক কারণেও তো এমন ছেলেকে আমার দেখা উচিত। ওর সঙ্গে তোরা যা শুরু করেছিস আমার পক্ষে বোধ হয় ওকে আর রাখা সম্ভব হবে না।
রানা অন্য কামরা থেকে সব শোনে। তার কান্না আসে। এহানে তার আপন কইতে আর কেউ নাই, চাচাজী ছাড়া। মায়ের কথা খুব বেশি করে মনে পড়ে তার। এই বাড়িতে চাচাজী ছাড়া আর একজনকে তার ভালা লাগে। সে হচ্ছে কাজের বুয়া ময়নাবু।
বাড়ির সবাই প্রতিদিন সকালে বাইরে চলে যায়। চাচী আম্মাও। বাসায় থাকে সে ও ময়নাবু শুধু। এই সময়টা তার খুব ভাল লাগে, কেউ থাকে না কেউ বকে না। ময়না বুয়া রান্নাঘরে কাজ করে। সে একটা পিঁড়ি পেতে বসে তার কাজ দেখে। কোথায় যেন সে বুয়ার সঙ্গে তার মায়ের আদর খুঁজে পায়। খুঁজে পায় পরম নির্ভরতা। এই সময়টা সে একটু সবাক হয়। ময়না বুয়াও তার সঙ্গে নানা ধরনের কথাবার্তা বলে। একদিন সবাই যখন ঘরের বাইরে চলে গেছেনÑ সে ময়না বুয়ার কাছে এসে পিঁড়ি পেতে বসে। ময়নার মা বলে, রানা ভাই, আপনার যহন ভুগ লাগবে আমারে কইবেন। আমি আপনারে আগেই ভাত দিয়া দিমু। কেউ কিছু বলবে না। আপারা, খালাম্মা আপনারে তম্বি করেনÑ আপনার ভালাইর লাগি। ঢাকায় থাকতে অইলে বহু কিছু জানতে অয়। যা আমাদের গাঁও গেরামে লাগে না। অহন ভাত খাইবেন আপনি?
না, চাচাজীর লগে খাইয়াম। রানা বলে, তয় আপনারে একটা কথা জিগামু বইলবেন?
হ বলুম না ক্যান। কন কী কইবেন।
রানা বলে আপনি ডাহায় কাম করবার আইছেন কহন? আপনার টিনের ঘর নাই! তার কথায় বুয়ার কী হাসি। সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। পরে বলে টিনের ঘর থাকইকলে বুঝি কাজ কইরতে আয়না ভাই। তয়, আমারে খাওয়াইব কেডা। আমার তো সোয়ামী নাই, জমি জিরাত নাই। এই রথই সম্বল।
রানা বুয়ার দুঃখ বুঝতে পারে। হ, আমার মায়েরও নাই কিছু। হেই লাইগ্যা তো আমাদের দিয়া দিছঅইন চাচাজীর লগে।
দুপুর বেলা সবাই যখন বাসায় ফিরে তখন রানা আবার গম্ভীর হয়ে ওঠে। কথাবার্তা বুঝে সুঝে বলে। ভাতও খায় সবার সঙ্গে একত্রে। বিকাল বেলা চাচাজী তাকে নিয়ে পড়াতে বসান। এই সময় চাচাজীকে তার ভাল লাগে না। পইড়লে কী অইব সে বুঝবার পারে না। অক্ষর, শব্দ কিছু মনে রাখতে পারে না। আরবি হরফগুলোও তার কাছে খুব কঠিন মনে হয়। কিন্তু পড়ার ব্যাপারে চাচাজী খুব কড়া। এখানে সে কোন প্রশ্রয় পায় না।
সারাদিনের শেষে রাতে রানার একটা আনন্দ লাগে। এই সময় সবাই টেলিভিশন দেখে। কিন্তু মাঝে মাঝে আফারা টেলিভিশন খুলতে দেন না। বলেন ছোট ছেলেদের হকল দিন টেলিভিশন দেহা নাহি ভালা না। শুধু ছোট বাচ্চাদের জন্য যে সমস্ত অনুষ্ঠান হয় ঐ সবই দেখতে দেন। রানাকে ভাল করতে সবাই চেষ্টা করে। এইভাবে চাচার বাড়িতে রানার দিন যায়। প্রাথমিক পাঠও বাসায় শেখান হয়ে যায়। জানুয়ারি এলে সে স্কুলে ভর্তি হবে। রানা মহা খুশি। সে পাঠ ব্যাগে ঝুলিয়ে স্কুলে যাবে। রানা স্বপ্ন দেখে মাকে নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন। মাকে চাচীর মতো সুন্দর শাড়ি পরানোর স্বপ্ন।


                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ