রুমির কান্না  -শরিফ আহমাদ

রুমির কান্না -শরিফ আহমাদ

তোমাদের গল্প ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ঐ  মেয়েটার নাম রুমি। পুরো নাম রোমানা শিরিন রুমি। ক্লাস ফাইভে পড়ে। পাঠান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। রুমির ক্লাসে ৫০ জন ছাত্রছাত্রী। ওর রোল নম্বর ৩। রুমি মধ্যম গড়নের মেয়ে। আকাশের চাঁদের মতো চেহারা। বয়স ৯ হলেও কথাবার্তায় মনে হয় আশি বছরের বুড়ি। তার পাকনা কথা শুনলে সবাই অবাক হয়। বিশ্বাসই করতে চায় না যে তার বয়স ৯। এই কয় দিন আগেও রুমি এমন ছিলো না। একদম ছিলো শান্ত এবং সহজ সরল। তার কম কথা বলা নিয়ে বাবা-মা টেনশন করতেন। এখন মেয়ের মুখে কথার খই ফুটতে দেখে তারা খুশি। রুমির কথা- ওতো আগের মতো আর ছোট্ট বাচ্চা নয়। যে টিকটিকি দেখে কান্না জুড়ে দেবে। বিড়াল দেখে আঁতকে উঠবে। আসলে মা-বাবার কাছে সন্তান কখনো বড় হয় না। অনার্স পড়ুয়া সন্তানকেও খোকাখুকি মনে হয়। তবু তাদের ধারণা নতুন প্রাইভটে টিচারের দক্ষতায় সব হচ্ছে। রুমি ২০ নম্বর রোল থেকে তিনে এসেছে। তাই টিচারের প্রতি তারা সন্তুষ্ট। রুমির টিচারের নাম আহসান। আসলেই তিনি যোগ্য মানুষ। ছেলেমেয়েদেরকে তার মতো গড়তে চেষ্টা করেন।
আজ মন ভালো নেই রুমির। জানালার ধারে বসে আছে। গ্রিল ধরে তাকিয়ে আছে ছোট্ট বাগানটার দিকে। এক মনে ভাবছে বাগানটার কথা। বাগানটা তার ভীষণ প্রিয়। নিয়মিত বাগানের গাছে পানি দেয় সে। গাছে ফুল ফুটলে তার আনন্দ আর দেখে কে? ছোট্ট বাগানে ঘুরে বেড়ায়। ফুলগুলোকে আদর করে। তাদের কানে কানে কবিতা আবৃত্তি করে। রঙিন ডানার প্রজাপতি ঘুরে বেড়ায়। টুনটুনি, দোয়েল, শালিক, ঘুঘুরও দেখা মেলে। সবার আগমনে রুমি খুব খুশি। মনে হয় তার মতো সুখী পৃথিবীতে দুটো নাই। রুমির ধারণা যারা ফুল ছিঁড়ে, গাছ কাটে তারা ভালো মানুষ নয়। তার বাবা আবদুল মোনায়েমও নয়। এই যে কাল রাতে বাবা বললেন সব গাছ কাটবেন। বাড়ি সংস্কার করবেন। শুনে তার মন খারাপ হয়। এ জন্যই আজ মন ভালো নয়। স্কুলেও যায়নি। মা শরীর খারাপ ভেবে কিছু বলেননি।
বিকেলে আহসান স্যার এলেন। রুমি পড়তে বসলো। পড়ায় একটুও মন বসছিলো না। বিষয়টা স্যারের নজর এড়ালো না। তিনি নরম সুরে বললেন, কী হয়েছে রুমি? মন খারাপ কেন? কী ব্যাপার বলো তো? গাছ ...গা...ছ... আমতা আমতা করছে রুমি। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো বাবা সব গাছ কাটবেন...। এতোটুকু বলেই ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলো রুমি। তার চোখে জলের ঢেউ দেখে স্যার বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কান্নার আওয়াজ শুনে ঘরে আসেন তার মা। ভেবেছে স্যার মেরেছে। স্যার তাকে অভয় দিয়ে বললেন, চিন্তা করো না। আমি তোমার আব্বুকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবো। তিনি অবশ্যই আমার কথা রাখবেন। গাছ আর কাটবেন না। সুস্থ জীবনের জন্য। সুন্দর পরিবেশের জন্য।
রুমি ছোট থেকেই অন্য রকম। প্রকৃতি-পাগল। ও কান্নার সময় যদি পাখি ডাকতো কান্না থামিয়ে দিতো। মুগ্ধ হয়ে শুনতো তার গলা। এক দিনের ঘটনা, রুমি তার মায়ের সাথে নানাবাড়ি যাচ্ছিলো। কাছেই তার নানাবাড়ি। এ বাড়ি আর ও বাড়ি এই রকম দূরত্ব। হঠাৎ তার নানার দেখা হলে আলাপ শুরু করেন তার মা। রুমি হাত ছাড়া পেয়ে একটু পিছিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে পুকুরপাড়ে পৌঁছে। পুকুরের শাপলা ফুল তুলতে নামে। পা পিছলে সামান্য পানিতে পড়ে। একাই ওঠে। ফুল ছিঁড়ে ভেজা শরীরে ফিরে আসে। তাকে কাকভেজা অবস্থায় দেখে মা ও নানা দুইজনইে অবাক হন। কথায় মগ্ন হওয়ায় তারা এতোটা খেয়াল করেনি। তার হাতে ফুল দেখে কারো বুঝতে অসুবিধা হলো না যে সে পুকুরে গিয়েছিলো। ডান পায়ের জুতা না থাকাটাই সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। পরে তার নানা পুকুরের মাঝখান থেকে জুতাটা তুলে দেন। এবং মেয়েকে সাবধানে রাখতে বলেন। ঐ ঘটনার পর থেকে তার মা রুমিকে চোখে চোখে রাখেন। একা কোথাও যেতে দেন না। বাইরে না যেতে পারাটাই তাকে বাগানের দিকে ঝুঁকে দিয়েছে আরো। আর বাবা সেই বাগান রাখতে চান না। এটা কি মানা যায়?
রুমি জানে না স্যার তার বাবাকে ব্যাপারটা বুঝিয়েছেন কি না। তাই রাতে আস্তে আস্তে বাবার কাছে গেলো। কিভাবে শুরু করবে ভাবছে। তাকে নীরব দেখে তার বাবাই আগে বললেন, কিরে রুমি কিছু বলবি? হ্যাঁ বাবা। তা চুপ করে আছিস কেন বল না? তুমি গাছ কেটো না বাবা। দুর পাগলি! বাগানে সাপ, বিচ্চু, ভূত-টুত আসবে। কোন সময়ে কার কি ক্ষতি করে বলা যায় না। ঐ পরশু দিন এক লোকের মৃত্যুর কথা শুনোনি! ও সাপের কামড়েই মরেছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাগান কেটে বাড়ি সংস্কার করবো।
রুমির আগেই মনে হয়েছিলো তার বাবা নিষ্ঠুর। সিদ্ধান্ত বদলাবেন না। আর এখন সরাসরি কথাটা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লো। তার কান্না দেখে বাবা- মা দুইজনেই অবাক। তার মায়ের মনে হলো ও তখন স্যারের কাছে এ জন্যই বুঝি কেঁদেছে। কি যেন গাছের কথা বলছিলেন স্যার। ভালো করে শুনেননি তখন। এখন রুমির মুখে আবার কথাটা শুনে ব্যাপারটা বুঝলেন। মেয়ের বাগানপ্রীতি দেখে তার মনটা নরম হলো। মেয়ের পক্ষ নিয়ে তিনি বললেন কি দরকার আছে গাছ কাটার? রুমি যখন এতো করে বলছে বাগানটা থাক না! আবদুল মোনায়েম সাহেব প্রথমে রুমির কান্না পরে তার মায়ের কথায় একটু অন্যমনস্ক হলেন। খানিক ভেবে বললেন, ঠিক আছে কাটবো না এক শর্তে। কী শর্ত জানতে চাইলো রুমির আম্মু। মোনায়েম সাহেব এবার মেয়েকে কাছে টেনে তার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন, তুমি বাগানে বেশি যাবে না। আর রাতে তো ভুলেও যাবে না ঠিক আছে? হু। মাথা নেড়ে রুমি বাবার বুকে মুখ লুকালো ...।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ