রূপান্তর

রূপান্তর

তোমাদের গল্প জুলাই ২০১৫

ওয়াসিম আকরাম#

তপু ক্লাস টেনে পড়ে। ক্লাস শেষে বাসায় ফেরার পথে তার বন্ধু রোমান ফিসফিস করে বলল, তপু আজ একটান দিয়ে যা। রোমান তপুর প্রিয় বন্ধু। রোমান সিগারেট খায় তপু তা জানত, কিন্তু তপুকে কখনো এর আগে সিগারেট সাধেনি। তপু প্রথমে না করলেও এক অজানা কৌতূহল আর রোমানের সামনে নিজের বড় হয়ে ওঠা প্রমাণ করতে বিদ্যালয়ের পাশের গলিতে দাঁড়িয়ে খুব কায়দা করে দিল জীবনের প্রথম টান। টান দিতেই কাশি। রোমান শিখাল কাশি না দিয়ে কিভাবে ধোঁয়া টানতে হয় আর ছাড়তে হয়। তপুর নিকট খুব একটা ভালো লাগল না, কিন্তু পুরো একটা সিগারেট শেষ করে ফেলল। সেই থেকে শুরু, প্রথম প্রথম রোমান ও অর্নবদের সঙ্গে, ওদের পয়সায়। এরপর একা একা এবং নিজের হাত খরচের টাকায়। এভাবে নিয়মিত অভ্যাস, যাকে বলে একেবারে ‘চেইন স্মোকার’। জানতে পেরে মা কাঁদেন, বাবা বকেন। এক সময় তপুও ভাবল আর সিগারেট খাবে না। একটা-দুইটা করে কমাতে কমাতে ছেড়ে দেবে, কিন্তু তা আর হলো না। এসএসসি পরীক্ষার আগে হঠাৎ তপুর সিগারেট খাওয়া বেড়ে গেল। পরীক্ষা শেষ, হাতে আড্ডা দেয়া আর সিগারেটের পর সিগারেট খাওয়া ছাড়া কোন কাজ নেই তার। পরীক্ষার ফলাফলও অনেক খারাপ হলো। বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলো একটা তৃতীয় সারির কলেজে, কিন্তু লেখাপড়ায় মন বসল না তার। পরিচয় হলো নতুন বন্ধুদের সঙ্গে। বাসায় থাকতে ইচ্ছে করত না তার। একদিন বন্ধুরা নিয়ে গেল নতুন এক জায়গায়। সেখানে পরিচয় হলো নতুন আরেকটি বস্তুর সঙ্গে, বন্ধুরা যাকে মজা করে বলত ‘ছয় ইঞ্চি’ বা ‘ডাইল’, ধীরে ধীরে তপু ডুবে গেল সেই ফেনসিডিলে। ফেনসিডিল খাওয়ার জন্য কোচিং আর টিউটরের নাম করে ক্রমাগত টাকা চাইত বাসায়।
বাবার খুব কষ্ট হতো টাকার জোগান দিতে, কিন্তু তপু তখন নাছোড়বান্দা। এসে গেল এইচএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার মাত্র মাসখানেক আগে দেখে তার অনেক বই-ই নেই, কখন বিক্রি করে দিয়েছে ফেরিওয়ালার নিকট, অথবা বাবার কাছ থেকে টাকা নিলেও কেনাই হয়নি কোন কোনটি। কোনোমতে পরীক্ষা দিল এবং বুঝতে পারল, এবার পাস আর হবে না। বুঝতে পেরে তপু আরো বেপরোয়া হয়ে গেল। কখনো রাত করে বাসায় ফেরে, কখনোবা ফেরেই না। টাকার জন্য এর কাছে, ওর কাছে ধারদেনা করতে শুরু করল। বাবার অসুখের কথা বলে, ছোট ভাইয়ের পরীক্ষার কথা বলে দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঁচশ-হাজার টাকা ধার চাইত। তাতেও কুলিয়ে উঠতে না পেরে যুক্ত হলো এলাকার টানা পার্টির সঙ্গে। সন্ধ্যা লাগার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুর নিয়ে শুরু করত ছিনতাই। বাবার সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ, মাঝখানে শুনল, রেল হাসপাতালে মায়ের পিত্তথলির অপারেশন হয়েছে। দেখতে যায়নি, এর মধ্যে দেখা তপুর কলোনির এক বন্ধুর সঙ্গে নাম অনিক। সে একটি বাস কোম্পানির ম্যানেজার। অনিক তপুকে অনেক করে বুঝিয়ে বলল, এ পথ থেকে ফিরে আসতে, চিকিৎসা নিতে। তপু হেসেই উড়িয়ে দিল অনিকের কথা। মাঝে দু-দুবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ল সে। একবার টানা পার্টির মহাজন ছাড়িয়ে নিলো, আরেকবার চালান করে দিল কোর্টে। অনেক ঝামেলা শেষে মুক্তি পেল তপু, ফিরে দেখে বস্তির যে ঘরটাতে থাকত, সেটা দখল হয়ে গেছে। কয়দিন এর ঘরে, ওর ঘরে থেকে ফুটপাথে ঠাঁই হলো তপুর। শরীরে শক্তি নেই, হাত কাঁপে, পা কাঁপে। ছিনতাই করতে পারে না। মহাজন আর দলে নেয় না। দু-একবার রক্ত বিক্রি করেছে। গাড়ির পার্টস চুরিও বাদ দেয়নি। এরপর ভিক্ষা শুরু করল। ভিক্ষার টাকায় গাঁজা আর ঘুমের ট্যাবলেট ছাড়া আর কিছুই হয় না তার। হঠাৎ একদিন দুপুর বেলা তপুর সামনে এসে দাঁড়াল একটা সিএনজি ট্যাক্সি। সেখান থেকে নেমে দাঁড়াল তার বাবা। বাবার বয়স যেন এক ধাক্কায় বেড়ে গেছে প্রায় ২০ বছর। তপুর দুই চোখে পিঁচুটি আর তার বাবার চোখভরা টলটলে পানি। কোনো কথা হলো না, বাবার সঙ্গে ট্যাক্সিতে চড়ে সোজা বাসায়। বাসায় ঢোকার সাথে সাথে ডুকরে কেঁদে উঠল মা। তপু আর পারল না, ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের বুকে। তিন দিন কেবল ঘুমাল সে। কার কাছ থেকে খবর পেয়ে বাবা তপুকে নিয়ে গেল চিকিৎসকের কাছে। সারা শরীরে চর্মরোগ আর বুকে বাসা বেঁধেছে যক্ষ্মা। নেশার অভাবে প্রতিদিন সন্ধ্যায় যেন পাগল হয়ে যেত তপু। মনে হতো নিজের মাংস নিজে চিবিয়ে খাবে। চোখের ভেতর পেরেক ঢুকিয়ে দেবে। একদিন মাটিতে পড়ে খিচুনির মতো হলো। চিকিৎসক একটা ঠিকানা দিলেন। সেখানে গিয়ে দেখল, তপুর মতো আরও অনেকে। তপুর বাবা তপুকে সেখানে রেখে এলেন। সেখানে একসঙ্গে তারা নিজেদের কথা বলত, নেশার কথা বলত, নেশামুক্ত জীবনের কথা বলত। চিকিৎসক যারা আসতেন, তারা স্বপ্নের কথা বলতেন। বদলে যাওয়ার কথা বলতেন। তপুর ধারণা হতো, এগুলো সম্ভব নয়। একজন চিকিৎসক তপুকে পরামর্শ দিলেন, নেশা করা অন্য রোগের মতোই একটি রোগ, এ রোগের চিকিৎসা আছে। নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি অপরাধী নয়, সে রোগী, পরিবার আর সমাজের ভালোবাসাই পারে তাকে সুস্থ করে তুলতে। এ কথাটি তপুর মনে যেন নতুন শক্তি এনে দিল। তপু বদলাতে শুরু করল। মা-বাবার ভালোবাসা, চিকিৎসকদের পরামর্শ আর নিজের আত্মবিশ্বাসে নেশাকে না বলতে শিখল তপু।
এক সময় তপু ওখান থেকে ছাড়া পেয়ে বাসার ফিরে আসে। কম্পিউটার মেরামত করার প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি দোকানে চাকরি নেয়। এখন তপু নিজেই একটি কম্পিউটার মেরামতের দোকান দিয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেনি তপু, কিন্তু ছোট ভাইটা ডাক্তার হতে চায়। তপুুর স্বপ্ন যে করেই হোক ওকে ডাক্তার করা। দুই বছর ধরে তপু পুরোপুরি নেশামুক্ত, নেশা তো দূরের কথা সিগারেটও ছুঁয়ে দেখে না এখন। এখন ভালো আছে তপু, ভালো আছে মা-বাবা, ভালো আছে ছোট ভাইটি..।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ