রেজাউলের অভিমান

রেজাউলের অভিমান

গল্প জুন ২০১৫

তোফাজ্জল হোসাইন #

রেজাউলের মন ভালো নেই। কারো সাথে কোনো কথা নেই। নাশতা না খেয়েই কোনো মতো বই ব্যাগ গুছিয়ে স্কুলের উদ্দেশে রওনা হলো। রেজাউলের আম্মু আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছুই দেখলেন। খুশি হলেন ছেলের ওপর। যাক, এতদিনে নিজের কাজ নিজেই করা শিখেছে। বুঝতে শিখেছে। তার মানে সে বড় হচ্ছে। পাশাপাশি একটু চিন্তায়ও পড়ে গেলেন তিনি। ছেলের মনটা অমন থমথমে কেন? আজ সকালে উঠে কারো সাথে একটা কথাও পর্যন্ত বলেনি। অথচ অন্য দিন ঘুম থেকে উঠেই সারা বাড়ি মাতিয়ে তোলে। ব্রাশ, গোসল, নাশতা সেরে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এরপর চারজন একই সাথে বের হয়- রেজাউলের আব্বু, আম্মু, রহিমা ও রেজাউল। তখন বাড়ি থাকেন কেবল দাদী।
মধ্যবিত্ত পরিবার। রেজাউলের আব্বু পাশের বাড়ির ফাতেমার বাবার ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে করে তার কাজে চলে যান। রহিমা স্কুলে পাশের বাড়ির রতœার সাথে রওনা দেয় আর রেজাউলের আম্মু রেজাউলকে ওর স্কুলে পৌঁছে দেন। আগে রহিমাই নিয়ে যেতো রেজাউলকে। কিন্তু রহিমা গত বছর অন্য স্কুলে ভর্তি হওয়ায় রেজাউলের আম্মুকেই এখন রেজাউলকে স্কুলে আনা-নেয়ার কাজটা করতে হয়। যদিও একাই সে এখন স্কুলে যেতে পারে।
আজই প্রথম এই স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলো। তাই বাড়ির সবাই-ই বেশ বিস্মিত এবং কিছুটা চিন্তিতও। সকাল থেকে নেই কোনো হাঁকডাক। সবচেয়ে বড় কথা, রেজাউল আজ নাশতা করেনি। অন্যান্য সকল বিষয়ই সবাইকে খুশি করলেও এই একটি বিষয়ে সবাই বেশ চিন্তিত। কী এমন ঘটলো রেজাউলের? কারো ওপরে কি ও মন খারাপ বা রাগ করেছে? কার ওপর? কেন?- এসব কোনো প্রশ্নের জবাব কারো জানা নেই।
ইশ্! ছেলেটা না জানি আজ ক্ষুধায় কতো কষ্ট পায়!
রেজাউলের আব্বু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এপাশ-ওপাশ মাথা ঝাঁকিয়ে তার কাজের উদ্দেশে রওনা দিলেন।
রেজাউলের আম্মু কিছুক্ষণ দরোজা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরোজা বন্ধ করে দিলেন।
দাদী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী বউমা, আজ রেজাউল একাই স্কুলে গেলো, তুমি সঙ্গে যাওনি?’
আম্মু জবাব দিলেন, ‘না আম্মা, রেজাউল যে বড় হচ্ছে।’
‘উ-হুঁ বউমা, ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো ঠেকছে না। নিশ্চয়ই দাদুভাইয়ের কিছু হয়েছে।’
আম্মু সে কথার জবাব না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
রেজাউল স্কুলের খোলা গেট দিয়ে প্রবেশ করলো। রহিমা স্কুলের পাশে দোকানদার চাচাকে কিছু টাকা দিয়ে বলল, রেজাউল কিছু খাবার চাইলে দিয়ে দিবেন। রহিমা ভেতরে উঁকি দিয়ে ছোট ভাইকে কোথাও দেখলো না। ক্লাসে চলে গেছে তাহলে। ওরও ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। তাই আর দেরি না করে নিজের স্কুলের দিকে চলল।
প্রতিদিনের মতো বাসায় ফিরল রেজাউল। কলিংবেল চাপতেই রেজাউলের আম্মু এসে দরোজা খুলে দিলেন। আম্মুর দিকে তাকালোও না ও। মুখ গোঁজ করে আম্মুর পাশ ঘেঁষে ভেতরে প্রবেশ করলো। রুমে ঢুকে ধীরে ধীরে ড্রেস চেঞ্জ করলো। টেবিলে ভাত ঢাকা ছিলো। এগিয়ে গেলো সেদিকে। প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে। পেটের মধ্যে যেনো একশটা ছুঁচো দাপাদাপি করছে। এতো ক্ষিধে আগে কখনও লাগেনি ওর। ঢাকনা তুলেই সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে রাখলো। না, খাবে না ও। দরোজার দিকে নজর বুলালো, আম্মু দেখে ফেলেননি তো? রেজাউল স্কুলেও কিছু খায়নি। দোকানদার চাচা টিফিনে পাউরুটি ও কলা খেতে দিয়েছিলো। ফিরিয়ে দিয়েছে ও।
আম্মু আড়াল থেকে দেখলেন সব। তিনিও সকাল থেকে না খেয়ে আছেন। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রইলেন। রেজাউলের খুব কষ্ট হচ্ছে। হাঁটতে গেলে মনে হচ্ছে ঘুরে পড়ে যাবে। তবুও জোর করে হেঁটে বাড়ির দক্ষিণ পাশে আমগাছের নিচে গিয়ে চৌকিতে বসলো।
রুমের পাশ দিয়ে যেতেই রেজাউলের আম্মুকে ডাকলেন তার দাদী। রেজাউলের আম্মু রুমে প্রবেশ করে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘কিছু বলবেন আম্মা?’
দাদী বললেন, ‘রেজাউল দাদুভাই ফেরেনি স্কুল থেকে?’
‘ফিরেছে আম্মা।’
‘নাশতা করেছে?’
এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়েন রেজাউলের আম্মু।
‘আমার ঘরেও তো এলো না আজ।’
‘আম্মা আপনি একটু দেখেন না কী হয়েছে ওর? ছেলেটা আমার সকাল থেকে না খেয়ে আছে।’
‘আচ্ছা আমি দেখছি। এখন কোথায় আছে ও?’
‘আমগাছের নিচে গিয়ে বসেছে।’
‘রহিমা কি ফিরেছে?’
না এখনো ফেরেনি।’
‘রাজ্জাককে কিছু জানিয়েছো?’
আবারো এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়েন রেজাউলের আম্মু।
‘আপাতত ওকে কিছু জানানোর দরকার নেই। তাহলে কাজ ফেলে চলে আসবে। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না বউমা, আমি দেখছি কী করা যায়।’
দাদী জোরে জোরে রেজাউলকে ডাকতে ডাকতে তার কাছে গিয়ে মজাদার খাবার নিয়ে হাজির হলেন। আদরমাখা সুরে বললেন, রেজাউল দেখ তোর জন্য কি নিয়ে এসেছি। একটু তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে নে দাদুভাই। রেজাউল একবার মুখ তুলে তাকালো এদিকে। তারপর আগের অবস্থায় ফিরে গেলো। এমন কী হয়েছে যে না খেয়েই থাকতে হবে? আমাকে বল দেখি কি করা যায়। রহিমা মেরেছে তোকে? তোর মা কি বকেছে ? না তোর আব্বা কিছু বলেছে? নাকি স্কুলের কেউ মেরেছে ? এবারও রেজাউল কোনো কথা বলল না। রাগ করে বলল, কেন রাতের কথা তোমার মনে নেই? দাদী ভেবে পান না। কী কথা রাতে হয়েছে? আমার তো মনে নেই দাদু একটু খুলে বলবি। ‘তোমাকে-আম্মুকে রাতে বলেছিলাম; আমাকে যেন রোজা রাখার জন্য ডাকা হয়। তোমরা আমাকে ডাকনি কেন?’ রেজাউলের অভিমানী সুর। দাদীর তখন মনে হলো, রেজাউল তো তাদের রাতে বলে রেখেছিলো, তাকে যেন রোজা রাখার জন্য ডাকা হয়। রমজানের নতুন চাঁদ দেখার পর থেকে রেজাউল ও তার বোন রহিমার মনে খুব আনন্দ ছিলো। সবার সাথে রোজা রাখতে পারবে, একসাথে বসে ইফতার করতে পারবে। হাসি খুশি মনে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যায়। রেজাউল তার আম্মু ও দাদীকে বলে যেন সেহরি খাবার জন্য তাদের ডাকা হয়। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখে সকাল হয়েছে।
দাদী বললেন, ‘আমাদের ভুল হয়ে গেছে। কথা দিচ্ছি, আজকে অবশ্যই তোমাকে ডেকে তুলবো।’ দাদীর কথায় রেজাউল আশ্বস্ত হলো। ছোট মানুষ রোজা রাখার ইচ্ছা করেছে। রোজা রাখতে পারুক আর না পারুক অন্তত সেহরি তে তাকে ডাকা উচিত ছিলো। এটা ঠিকই বুঝতে পারলেন রেজাউলের দাদী। প্রথম রোজার ইফতারের সময়ও প্রায় কাছাকাছি। তাই রেজাউলকে খাওয়ার জন্য খুব বেশি পিড়াপিড়িও করলেন না দাদী। ক্ষুধার্ত আর শুকনো মুখে সবাই ইফতারের জন্য অপেক্ষা করছে। রেজাউলের আনন্দের শেষ নেই। রোজা রাখতে না পারলেও সারাদিন উপোস থেকে ইফতারের আনন্দ সে ঠিকই পাচ্ছে। আরো মজার ব্যাপার হলো আজকে সেহরিতে তাকে ডাকা হবে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ