রেশম মথ ও রেশমি সুতা । রফিক রইচ

রেশম মথ ও রেশমি সুতা । রফিক রইচ

প্রচ্ছদ রচনা নভেম্বর ২০১৮

জ্ঞান পিপাসু বন্ধুরা, তোমাদের জন্য আজকের লেখাটি একটি ছোট্ট ছড়া দিয়ে শুরু করছি। ছড়াটি হলো-

রেশমি সুতা তৈরি করে
সাদা রেশম মথ
মিহি সুতা ছাড়তে একে
কে দিয়েছে পথ।

এই সুতাতে গরদ কাপড়
রঙিন জামা হয়
দেশ বিদেশে সুনাম তারই
কম তো কিছু নয়।

রেশম পোকা পোকা-তো নয়
এই প্রাণীটা সোনা
এমন প্রাণী আল্লাহ ছাড়া
বানাবে কোন জনা।

এই প্রাণীকে জানো
আল্লাহকে, মানো।

হ্যাঁ বন্ধুরা এবার আসো তাহলে এই প্রাণীটা সম্পর্কে আমরা কিছুটা জানি। এই প্রাণীটা আর্থ্রোপোডা পর্বের ইনসেকটা শ্রেণীর লেপিডপটেরা বর্গের একটি মহা মূল্যবান পতঙ্গ। এর ইংরেজি নাম হলো সিল্ক ওয়ার্ম বা রেশম কীট। এই পোকার বৈজ্ঞানিক নাম হলো- বোমবিক্স মোরি। মোরি মানে হলো এরা তুঁত গাছের পাতা খেয়ে বাঁচে। এই জাতের মথের একটি গুটি থেকে সাধারণত ৬০০-১০০০ মিটার লম্বা রেশমি সুতা পাওয়া যায়। এক কেজি রেশম সুতা তৈরি করতে প্রায় ৫০,০০০টি গুটি দরকার হয়। এই রেশম সুতা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের লক্ষ্যে রেশম পোকা লালন পালন করাকে রেশম চাষ বলে। রেশম চাষের ইংরেজি শব্দ হলো সেরিকালচার। আভিধানিক অর্থ হলো সেরিসিন এর চাষ। রেশম সুতার মূল গাঠনিক উপাদান হলো সিরিসিন। এই সিরিসিন এক ধরনের প্রোটিন। এই সিরিসিন, রস আকারে পোকার মুখ থেকে বের হয় এবং বাতাসের সংস্পর্শে এসে শক্ত হয়ে সুতায় পরিণত হয়। তাহলে আরো সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয়, যে প্রাণী সিরিসিন নামক প্রোটিন বস্তু তথা সুতা উৎপাদন করে তাদের লালন পালন করাকে বলে সেরিকালচার বা রেশম চাষ। বুঝতে পেরেছ আমার প্রিয় বন্ধুরা।

খ্রিষ্ট জন্মের প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে চীন দেশে সর্বপ্রথম রেশম সুতা আবিষ্কার হয়। চীন দেশের লোকেরা গোপনে গোপনে কাউকে না জানিয়ে তারা দুই থেকে আড়াই হাজার বছর পর্যন্ত সুতা ও কাপড় তৈরি করতো। বহুদিন পর্যন্ত চীনারা রেশম সুতা তৈরির কৌশল পাহারা দিয়ে রাখতো। তাদের দেশে রেশম পোকার ডিম বা রেশম মথ বিদেশে পাচার করার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। তারপরেও এটি আর শুধু তাদের কাছেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর পর দু’জন ইউরোপীয় পাদ্রি গোপনে রেশম সুতা তৈরির কৌশল জেনে নেন। তারা গোপনে ইউরোপে রেশম পোকার ডিম ও তুঁত গাছের বীজ নিয়ে এসে রেশম চাষ শুরু করেন। তারপর ভারত থেকে শুরু করে অনেক দেশে এই রেশম চাষের প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ে এবং রেশম সুতা তৈরি ও কাপড় প্রস্তুত অব্যাহত থাকে। বর্তমানে এই রেশম চাষ সারা বিশ্বে আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

বন্ধুরা বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে প্রচুর রেশম চাষ হয়। সুতা থেকে দামি দামি কাপড় জামা ইত্যাদি তৈরি হয়। এ জন্য রাজশাহীকে রেশম নগরী বলে। এই রেশম উৎপাদনের শহর হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য রাজশাহীগামী একটি ট্রেনের নামকরণ করা হয়েছে সিল্ক সিটি বা রেশম নগরী।

আগামীর গবেষক বন্ধুরা! এবার আমরা এই প্রাণীটির জীবনচক্র জেনে নেই। অর্থাৎ এরা কিভাবে জন্ম হওয়ার পর থেকে বড় হয়।

রেশম পোকার জীবনচক্র চারটি ধাপে সম্পন্ন হয়। যেমন-

১. ডিম
২. শূককীট
৩. মূককীট
৪. পূর্ণাঙ্গ পোকা
পূর্ণাঙ্গ পোকার নাম হলো মথ।

এই রেশম পোকার রং উজ্জ্বল নয়। স্ত্রী মথ পাতা বা কাগজের ওপর চড়ে বেড়ায়। প্রথমে একটি পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী মথ বা রেশম পোকা কাগজ বা পাতার ওপর ডিম পাড়ে। স্ত্রী মথেরা সাধারণত ৪০০-৬০০ ডিম পাড়ে। ডিমের রং ফ্যাকাসে হলুদ। ডিম পাড়ার সময় এগুলো থাকে আঠালো। যে কারণে ডিমগুলো পাতা বা কাগজের ওপর লেগে থাকে।

রেশম-মথ২ ডিমগুলোকে একটি কাঠের কাঠবোর্ডের ডালায় করে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হয়। ১০-১২ দিন পর এই ডিম থেকে রোমহীন প্রায় সাদা রঙের ছোট ছোট পোকা বের হয় এদের শুয়োপাকা বা আমাদের দেশে এদের পলু পোকা বলে। এই পোকাগুলো খুবই চঞ্চল স্বভাবের হয়। তুঁত পাতা কুচি কুচি করে কেটে তাদের খেতে দিতে হয়। এরা ছোটাছুটি করে আর এই পাতাগুলো গোগ্রাসে খেতে থাকে। মাঝে মাঝে পুরনো পাতা এবং জমা হওয়া ময়লা সরিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হয়।

রেশম-মথ-৩

              রেশম পোকার জীবন চক্র

মোল্টিং অর্থ হলো ত্বক পরিবর্তন। দুই তিন দিন পর এই পোকা খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং প্রথমবার খোলস বদলায়। প্রথমবার খোলস বদলানোকে বলে স্থানীয় ভাষায় মেটে কলপ। পলু আরো এভাবে তিনবার খোলস বদলায়। এদেরকে যথাক্রমে দো-কলপ, তে-কলপ এবং শোধ-কলপ বলে। শোধ কলপের পর শক্ত ও পুষ্ট হয়ে ওঠা পলুকে বলে ‘রোজের পলু’। এই পলুর মাথাটা বেশ বড় হয় এবং তাতে মজবুত চোয়াল থাকে। এর সামনে থাকে তিন জোড়া আসল পা আর পেছনে থাকে পাঁচ জোড়া ফালতু বা নকল পা। চতুর্থবার খোলস বদলানোর পর এরা মূককীট এ পরিণত হতে শুরু করে। পলুদেরকে যে বাঁশের ডালায় পালা হয় তাকে চন্দ্রকী বলে। এতে অনেক কুঠরি থাকে। প্রতি কুঠরিতেই এই পোকাগুলো কিলবিল করতে থাকে। রেশম মথ গুটি থেকে বের হওয়ার পর মাত্র দু-তিন দিন বাঁচে। এ সময় এরা কিছু খায় না। এরপর স্ত্রী মথ ডিম দেয়ার পর স্ত্রী এবং পুরুষ মথ দু’টিই মারা যায়। রেশম চাষ করতে গেলে যাতে করে মথ গুটি কেটে বের হতে না পারে তার আগেই গুটি রোদে দিয়ে বা গরম পানিতে রেখে ভেতরের মথ মেরে ফেলতে হয়। তারপর রেশম গুটি পানিতে ভিজিয়ে নরম করে সেটি থেকে রেশম সুতা ছাড়িয়ে নেয়া হয়। অর্থাৎ রেশম সুতা সংগ্রহ করতে হয়। তবে ডিম পাড়ার জন্য যাতে পূর্ণাঙ্গ রেশম মথ থাকে তার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ রেশম গুটি রাখা হয়। তাহলে বন্ধুরা! আমরা জানলাম কিভাবে রেশম মথ পালন করতে হয় এবং রেশম মথ থেকে রেশমি সুতা পাওয়া যায়। আমি আগেই বলেছি রেশমি সুতা থেকে বাহারি গরদ কাপড় ও রাজকীয় সব রঙিন জামাসহ পরিধেয় নানা পোশাক তৈরি হয়, যা পরলে আমাদের দেহ ও মন রঙিন হয়ে ওঠে। ভালো লাগায় মধুময় হয় জীবন। তবে বন্ধুরা! দেখ একটি ছোট পোকার মধ্যেও কী ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সে নিরলসভাবে সোনালি হলদে রেশমি সুতা তৈরি করে যাচ্ছে, যা আমাদের প্রয়োজন মিটিয়ে আমাদের অর্থনীতির চাকাকে করেছে গতিশীল ও বেগবান। এই ক্ষমতা কে দিয়েছে এই পোকার মধ্যে একবার চোখ দুটো বন্ধ করে ভাবতো।
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ