রোজাদার

রোজাদার

প্রচ্ছদ রচনা জুলাই ২০১১

আবদুল ওহাব আজাদ

আসিফ সাহেব অফিস থেকে ফিরে ইফতারির টেবিলে শিহাবকে না পেয়ে শিহাবের আম্মুকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার, ইফতারিতে শিহাবকে দেখছি না। ও কোথায় গেল?

শিহাবের আম্মু নরম সুরে বললেন, ও তো কিছুক্ষণ আগে টিফিন বক্সে ইফতারি নিয়ে বাইরে গেল। বলল, ‘আমি এক্ষুনি ফিরবো।’

আসিফ সাহেব রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গেলেন। ছেলে ইফতারি নিয়ে কোথায় যেতে পারে? কোনো উত্তর মেলাতে পারলেন না তিনি।

মাগরিবের আজান হলো, আসিফ সাহেব বাসার অন্যদের নিয়ে ইফতারিতে বসলেন। পরে নামাজ সেরে তিনি একটু বিশ্রামের জন্য বিছানায় গেলেন। কিছুক্ষণ পর শিহাব ধীর পায়ে বাসায় ঢুকলো। আম্মু বললেন, এই তো আমাদের শিহাব ফিরে এসেছে!

আসিফ সাহেব বিছানা ছেড়ে এসে শিহাবকে ধমকের সুরে বললেন, কী ব্যাপার তুমি কাউকে না বলে ইফতারি নিয়ে কোথায় গিয়েছিলে?

শিহাব কোনো উত্তর দিলো না।

আসিফ সাহেব রেগে বললেন, কী হলো, উত্তর দিচ্ছ না কেন?

শিহাব এবার মুখ খুলল, ‘আমি ইফতারি নিয়ে বস্তিতে আমাদের কাজের বুয়াদের বাসায় গিয়েছিলাম। ওদের তো তুমি আমাদের বাসায় আসতে নিষেধ করে দিয়েছ।

হ্যাঁ দিয়েছি, কারণ ওরা চোর, বদমাশ!

মোটেও না, ওরা চোর না।

তাহলে আমার বিছানার তলা থেকে ৫০০ টাকার নোট কে চুরি করলো?

আমি।

তুমি?

হ্যাঁ আমি।

তুমি টাকা নিয়ে কী করেছ?

একটা গরিব ছাত্রকে দান করেছি।

এ কথা আমাকে আগে বললে পারতে?

বিনা দোষে ওদের চাকরিটা নষ্ট করে দিয়েছো আব্বু। মূলত ওদের কোনো দোষ নেই, আমি স্কুলে আমার শিক্ষকদের কাছে শুনেছি, এই রোজার মাসে বেশি দান করলে বেশি বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। গরিব অসহায়কে ইফতারি দিলে আল্লাহ পাক অতিশয় খুশি হন। আসিফ সাহেব আর কথা বলতে পারলেন না। শিহাব অশ্রুসিক্ত চোখে বলল, আব্বু পারলে বুয়াদের টাকাটা ফিরিয়ে দাও। ওরা খুব কষ্টে আছে।

শিহাবের আম্মুও একই সুরে বললেন, জরিনা মেয়েটা বড্ড ভালো। হঠাৎ করে তুমি ওকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দিলে।

আসিফ সাহেব এ কথার কোনো উত্তর দিলেন না। বিছানায় গিয়ে আবার চুপচাপ শুয়ে পড়লেন। পুরনো ঘটনা তার মনে পড়ে গেল। সত্যি তো তিনি কাজের বুয়ার প্রতি অবিচার করেছেন। সেদিন অফিসে যাওয়ার সময় বেডের তলায় ৫০০ টাকার নোট না পেয়ে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে জরিনাকে অনেক কটু কথা বলেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, তোমরা চোরের জাত, তোমাদের কোনো বিশ্বাস নেই।

জরিনা বারবার আর্তনাদ করে বলেছিল, সাহেব মিথ্যে অপবাদ দেবেন না, আমি টাকা চুরি করিনি। আমি রোজাদার, আর রোজাদার কখনো চুরি করতে পারে না।

আসিফ সাহেব সেদিন তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলেন, উহ: চোরের আবার বড় গলা! তুমি চোর, তোমার ছেলেমেয়েরাও চোর, আর কোনো চোরের স্থান এ বাড়িতে নেই। আজই তোমার পাওনা নিয়ে এ বাসা ছেড়ে চলে যাবে, কাল থেকে তোমায় যেন আর কাজে আসতে না দেখি।

তারপর থেকে কখনো আর জরিনা শিহাবদের বাসায় কাজ করতে আসেনি। শিহাব মাঝে মধ্যে বস্তিতে গিয়ে জরিনাকে দু-দশ টাকা দিয়ে এসেছে।

সে রাতে আর আসিফ সাহেবের ঘুম হলো না। বিছানায় শুয়ে তিনি এ-পাশ ও-পাশ করতে লাগলেন।

শিহাবের আম্মু জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার, তুমি অমন করছো কেন?

আসিফ সাহেব জবাব দিলেন, শিহাবের আম্মু, আমি বড় একটা ভুল করে ফেলেছি।

এর পর কথা চলল আরো কিছুক্ষণ। পরদিন সকাল।

সকালের সোনারোদে বস্তির ঘাসগুলো শিশির মেঘে চিক চিক করছে। সেই ভেজা ঘাস দু’পায়ে মাড়িয়ে বস্তির দিকে চলেছেন আসিফ সাহেব। বস্তির তখনো সবার ঘুম ভাঙেনি।

জরিনা তার দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ভাবছে। অন্য কোথাও কাজের সন্ধানে তাকে যেতে হবে, বসে থাকলে তার চলবে না। ছোট ছেলেমেয়েদের মুখে তো কিছু দিতে হবে।

জরিনা তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না। আসিফ সাহেবের গলা শুনতে পেলো জরিনা।

জরিনা, জরিনা- বাসায় আছ নাকি?

জরিনা মাথায় ঘোমটা টেনে বলল,

সাহেব, সাহেব আপনি আইছেন! খালাম্মা, মনা উনারা ভালো আছেন তো?

জরিনা শিহাবকে মনা ডাকে।

আসিফ সাহেব ব্যথিতের মতো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ সবাই ভালো আছে। তা জরিনা, তুমি যেন কোথাও বের হচ্ছিলে?

কামে যাবো সাহেব। গরিব মানুষ, কাজ-কাম না করলে খাবো কী?

আসিফ সাহেব জরিনাকে বললেন, আর তোমাকে অন্য কোথাও কাজে যেতে হবে না জরিনা, তুমি এক্ষুনি আমাদের বাসায় যাবে।’

জরিনার চোখে পানি এসে গেল। সে অধিক উৎসাহে বলল, এসব আপনি কী কইতাছেন সাহেব, আমিতো চোর?

ও কথা বলে আর আমাকে লজ্জা দিও না জরিনা। আসলে সেদিন ওই টাকা তুমি চুরি করোনি, ওই টাকা নিয়েছিল আমার ছেলে শিহাব।

আমাগো মনা?

হ্যাঁ, ও টাকা নিয়ে নিজে খরচ করেনি, একজন গরিব ছাত্রকে দান করেছিল। আমি অহেতুক তোমাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি।

সাহেব।

হ্যাঁ জরিনা, আজ বুঝলাম, প্রকৃত রোজাদার কখনো চোর হতে পারে না, কখনো খারাপ কাজ করতে পারে না, কখনো না।

আসিফ সাহেবের চোখ দুটো নিজের অজান্তে আর একবার ছল ছল করে উঠলো।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ