রোহিঙ্গা শিশু

রোহিঙ্গা শিশু

গল্প তৌহিদুর রহমান জুন ২০২৩

চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গা শিশু এতিম। এতিম মানে তাদের মা-বাবা কেউ নেই। তাদের পিতা-মাতাকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা হত্যা করেছে। অসংখ্য শিশুর সামনেই তাদের পিতা-মাতাকে হত্যা করা হয়েছে। নির্যাতন চালানো হয়েছে তাদের মা-বোনদের উপর। এমনকি অনেক পরিবারের বয়স্ক সকল সদস্যকেই হত্যা করেছে অহিংসনীতির ধ্বজাধারীরা।

ছলিমুল্লাহ আর আয়াতুল্লাহ হলো সহোদর দু’ভাই। তাদের বয়স একজনের আট অন্যজনের দশ বছর। মা-বাবা ভাই-বোনসহ পরিবারের সকলকেই তাদের সামনে হত্যা করেছে শান্তির ধব্জাধারী সৈনিকরা। গেরুয়াধারী জানোয়াররা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর শুয়োরদের সাথে হাত মিলিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হিংস্র এই জানোয়ারদের হাত থেকে বাঁচতে তারা দুই ভাই পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে তাদের গ্রামের পাশের আকিয়াবের গভীর জঙ্গলে। চোখের জলে তাদের রাত কাটে, দিন যায়। কিভাবে বাঁচবে তারা জানে না। জানে না এই গভীর জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কোথায় যেতে হবে। আজ তিন মাস হলো তারা এই জঙ্গলে আটকে আছে। এতো দিন লতা-পাতা, ফলমূল খেয়ে তারা কোনো মতে জানে বেঁচে আছে। বাঁচার আশা তাদের ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। অনেক বার সাহস করে দু’ভাই যেদিকে রাতে আলো জ্বলে সেদিকে যেতে চেয়েছে। কিন্তু সিংহ, বাঘ, সাপ, হায়েনার চেয়েও হিংস্র গেরুয়াধারী জানোয়ারদের ওদিকে ফিরে যেতে তারা সাহস পায়নি।

তবে তারা দু’ভাই একে অপরের জন্য প্রাণ দিতেও আজ তৈরি হয়ে গেছে। কখনো একে অপরকে ছেড়ে যাবে না এই তারা পণ করেছে। একটু একটু করে হাঁটতে হাঁটতে তারা লোকালয় থেকে বেশ অনেকটা দূরে আকিয়াবের গভীর বনে ঢুকে পড়েছে। অনেক চড়াই-উতরাই পার করেছে তবু একে অপরের হাত কখনো ছাড়েনি। তাদের দু’ভাইয়ের বরাবরই ছিল গলায় গলায় মিল। ছোটকাল থেকেই কেউ কাউকে মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দেয় না। একজন আড়াল হলেই অন্যজন ডাকলেই সে যেখানেই থাকুক চলে আসে। এখন বনের মধ্যে দু’ভাই একে অন্যের প্রাণ। খাবার খুঁজতে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম ও রাতের ঘুম সবই তারা এক সঙ্গেই করে। দিনের বেলায় হাতের আশপাশে যা পায় তাই খেয়ে তাদের দিন কাটে। জঙ্গলের লতা-পাতা, ডালপালা দিয়ে তারা মাটি থেকে একটু উপরে গাছের ডালে ঝুপড়ি বানিয়েছে। রাতে তারা দু’জন জড়াজড়ি করে সেখানেই শুয়ে থাকে। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে সামান্য সময়ের জন্য কখনো একজন একটু দূরে গেলেও অন্যজন তাকে চোখে চোখে রাখে। খাবার-দাবার যা সংগ্রহ করে একটুও কমবেশি না করে দুজনে সমান ভাগ করে খায়। অসুখ-বিসুখ, বিপদ-আপদে একে অপরের সহায়ক তারা।

আজ ক’দিন হলো আশপাশের ফল-মূল, শিকড়-বাকড় ইত্যাদি খাওয়ার মতো আর কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না তারা। তাদের হাতের নাগালের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। খাবারের খোঁজে দূরে যেতেও তাদের গা কাঁপে। হয়তো মানুষ নামের কোনো জানোয়ার তাদের দেখে ফেলবে এই ভয়ে। ভাগ্যে না থাকলে যা হয় আর কি? সেদিন হলো কি সারা দিন চেষ্টা করেও তাদের ভাগ্যে কোনো খাবার জুটলো না। একদম খালি হাতেই সেদিন ফিরতে হলো তাদের দুজনকে। সব এলাকায় পাহারা বসানোতে তারা গ্রামের দিকে কোনোভাবেই যেতে সাহস পায় না। দু’একটু ফল-মূল যা জমানো ছিলো দু’দিন ধরে বসে বসে খাওয়াতে তাও সব শেষ হয়ে গিয়েছে। রাতে দুজনেরই নিরুম্ব খালি পেটে থাকতে হলো। পেটে খাঁ খাঁ-করা ক্ষুধা নিয়ে দুজনই বসে রইলো। তার ওপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। আচমকা কয়েক দিন ধরে হাড়-কাঁপানো শীত পড়তে শুরু করেছে। সেই সাথে প্রচণ্ড কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস জঙ্গলের গাছের ডালে বানানো তাদের ঝুপড়ির ভেতর দিয়ে বইতে শুরু করলো। এ থেকে নিজেদেরকে বাঁচানোর কোনো উপায় তারা দুজনে বের করতে পারলো না।

ক্ষুধা ও শীতের যন্ত্রণায় আর টিকতে না পেরে আয়াতুল্লাহ বললো, ক্ষুধা পাওয়া একটা বড্ড বাজে ব্যাপার ভাই। আবার একই সাথে ক্ষুধা আর ঠাণ্ডা, তারপর ঝড়ো হাওয়া এ সব আরো বেশি আমাদেরকে কাহিল করে দিচ্ছে, তাই না ভাই? ধুত্তোরি, বলতো ভাই এখন কি করি? বলল বড় ভাই আয়াতুল্লাহ।

ছলিমুল্লাহর আর কিইবা করার আছে? শেষে ফিসফিসিয়ে ভাইয়ের কানে কানে বললো, চলো ভাই, একটা কাজ করি। আমরা শুয়ে পড়ি। ঘুমোনোর চেষ্টা করি। কাল সকাল হওয়ার একটু আগেই না হয় আমরা খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়বো। বন থেকে ফল-মূল, শাক-পাতার নিশ্চয় কিছু না কিছু জোগাড় হয়ে যাবে। 

এতো কথা বললে আর হবে কি? মুখের কথায় তো আর চিঁড়ে ভেজে না! আয়াতুল্লাহর চোখে এক রত্তি ঘুম নেই। ক্ষুধা, প্রচণ্ড ক্ষুধাই তার পেটটাকে মোচড়াতে লাগলো। মনে হচ্ছে খালি পেটে ভুটভাট একটা শব্দ হয়েই চলেছে। তার ওপর দাঁতে দাঁত লেগে শীতে ঠকঠক করে কাঁপছিলো সে। কারণ তাদের কাছে গায়ে দেওয়ার মতো কোনো গরম কাপড় ছিলো না। দু’ভাইয়ের গায়ে ছিলো পাতলা দুটি টিশার্ট। এতে কি আর শীত মানে, মানে না। গাছের ডালে বানানো ঝুপড়িতে শুয়ে থাকলে হবে কি, ঘুম না আসাতে চোখ দুটো ছিলো খোলা। হঠাৎ ঝুপড়ির ফাঁক দিয়ে দূরে অনেকটা দূরে লাল-নীল আলোর একটা আভা আয়াতুল্লাহর চোখের তারায় ঝিলিক দিয়ে উঠলো।

খালি পেটে কি আর ঘুম আসে, তাই ছলিমুল্লাহও উঠে বসলো। তারও চোখে পড়লো আলোটা। একটু অবাক হয়ে সে ডাকলো ভাইকে। ওই যে ভাই, দূরে যে আলোটা দেখা যাচ্ছে, ওটা কি? ওটা কি কোনো ভোজের অনুষ্ঠান? সেই আবার জবাব দিলো, আমার মনে হচ্ছে, ওটা একটা গ্রাম। আর লাল-নীল আলোটা হচ্ছে ভোজের অনুষ্ঠানের লাইটিং।

আয়াতুল্লাহ বুঝিয়ে বললো তাকে। হ্যাঁ, ওটা একটা ভোজের অনুষ্ঠানের লাইটিংই বটে, তবে ওখানে আগুনও আছে! আগুন!! মানে আগুনও জ্বলছে। ওহ, এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় আগুন মানেই হলো আরাম! আমাদের তো আবার এখানে আগুন জ্বালাবার উপায় নেই। রাতের বেলায় অনেক দূর থেকেই আগুন মানুষের চোখে পড়ে। আগুন জ্বাললেই তো ধরা পড়ে যাবো আমরা।

বড় ভাই আয়াতুল্লাহর আজ ক’দিন ধরে খুব জ্বর। তার উপর পেটে দানাপানি পড়েনি মোটেই। সে ছোট ভাই ছলিমুল্লাহকে বললো, ভাই, জ্বর আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় আমি বড্ড কাহিল হয়ে গেছি। দুদিন পেটে মোটে দানাপানি পড়েনি। আমি আর নড়তে পারছিনে। তা ছাড়া হাড় কাঁপুনি দেয়া শীত আমাকে চেপে ধরেছে। পা তুলে দাঁড়াতে পারছিনে আমি। ভাই, তুমি কি যাবে না আমার জন্য সেখানে একটু খাবার আনতে। ভোজের আসরের আশপাশে অনেক উচ্ছিষ্ট খাবারই পড়ে থাকে- তুমি খেয়েও এসো আর আমার জন্য একটু নিয়েও এসো। তুমি তো আমার চাইতে অনেক সাহসী।

ছলিমুল্লাহ বললো, না ভাই, আমি তোমাকে ফেলে যেতে পারবো না, মরতে হলে দু’জনে এক সাথেই মরবো।

জ্বরের কারণে আয়াতুল্লাহর হাঁটার মোটেও শক্তি নেই। সে বললো, আমি হয়তো মরেই যাবো।  তখন তুমি তো আর একা এখানে থাকতে পারবে না ভাই। তখন কি হবে? তার চেয়ে ওদিকে যাও। যা কপালে আছে তাই হবে। আমার জন্য একটু কষ্ট কর না ভাই। আয়াতুল্লাহ মনে-প্রাণে চাচ্ছে সে মরে গেলেও তার ভাইটা যদি কোনোভাবে প্রাণে বেঁচে যায়। তাই সে তাকে সরিয়ে দিতে চাচ্ছে।

ছলিমুল্লাহ মগ পুলিশকে বড্ড ভয় পায়। দু’জন মগ পুলিশকে তার মায়ের উপরে পাশবিক নির্যাতন করতে দেখেছে সে। সেই দৃশ্য ছলিমুল্লাহ এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না। তাই পুলিশের ধারে কাছেও যেতে চায় না সে। একটু বেশি গরম রাখার জন্য লতাপাতার স্তূপের মধ্যে নিজেকে আরও একটু সেদিয়ে নিলো ছলিমুল্লাহ। তবুও শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো সে, নিশ্চয় ওটা একটা ভোজের অনুষ্ঠান! খুব সম্ভব গাঁয়ের লোকেরা হয়তো ওখানে মহাধুমধামে খাওয়া দাওয়া করছে। একটু অবাক হলো ভাবতে গিয়ে, এমনতো হতে পারে ওটা একটা লঙ্গরখানা। তাও যদি না হয় তবুও ভোজের অনুষ্ঠান যদি হয় তবে লোকেরা খাবারের কিছু উচ্ছিষ্ট আশপাশে মাটিতে ফেলে দিতে পারে অবশ্যই। তাহলে তো সে অন্ধকারে চুপি চুপি চলে যেতে পারে ঐ খাবার আনতে।

এভাবে খাবারের চিন্তা মাথায় কিলবিল করতে থাকায় তার ক্ষুধা আরও একটু বেড়ে গেলো এবং কিছুক্ষণের মতো পেটে দাবন মেরে থাকা ক্ষুধাটা আবার চাগান দিয়ে উঠলো। এই মহাক্ষুধাটা তার মগ পুলিশের ভয়ের কথাটা পর্যন্ত বেমালুম ভুলিয়ে দিলো। সে পাতার ফাঁক থেকে বেরিয়ে ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, ভাই! আমিও আর ক্ষুধা পেটে এভাবে মোটেও থাকতে পারছিনে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় আমারও পেটটা চো চো করছে। তারচে বরং আমি গাঁয়ের দিকেই যাই। আর পারছিনে ভাই। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। দেখি কিছু খাবার জোগাড় করতে পারি কি না। যদি কপাল ভালো থাকে তাহলে হয়তো তোমার জন্যও কিছু নিয়ে আসতে পারবো। আর আমি যদি তাড়াতাড়ি না ফিরতে পারি, তাহলে তুমি জানবে নিশ্চয়ই আমি বিপদে পড়েছি। 

কথা তখনও শেষ করতে পারেনি ছলিমুল্লাহ, সঙ্গে সঙ্গে সেই লাল আলোর দিকে চোখ রেখে সোজা দৌড় দিল সে। একদৌড়ে সে প্রায় আলোর কাছাকাছি এসে গেলো। এরপর বুকে ভর দিয়ে খুব চুপচাপ এগোতে লাগলো যাতে কেউ তার চলার শব্দে টের না পায়। আলোর দিকে সে যতই এগোতে লাগলো, বুঝতে পারলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে খাবারের গন্ধ। পরম আগ্রহে নাক দিয়ে টেনে টেনে সে তার ঘ্রাণ গ্রহণ করতে লাগলো। সে নিজের জিব-ঠোঁট চাটতে লাগলো। সে মনে মনে বলতে লাগলো, আহ! খাবারের কী চমৎকার গন্ধ! মুখরোচক একটা স্বাদ আছে বটে! আহ, হা হা! অনুষ্ঠানের প্যান্ডেলের বাইরে ছলিমুল্লাহ গনগনে আগুনের চুলার কাছে অনেক কষ্ট করে গিয়ে পৌঁছল। মনে হচ্ছে যে, এই চুলায় কিছুক্ষণ আগেই রান্না-বান্না করা হয়েছে। ভাগ্যের কী চরম বিড়ম্বনা! চুলার আশপাশেই ছিলো কতকগুলো পাজি কুকুর। তারা কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠে লোকজনকে সতর্ক করে দিলো। ছলিমুল্লাহ রাগে গজগজ করে উঠলো, কী পাজি কুকুর রে বাবা! ডাকবার আর সময় পেলো না! হঠাৎ একটা লোক তীরের মতো ছুটে এলো এবং ছলিমুল্লাহর টুঁটি চেপে ধরে বুক বরাবর উঁচু করে তুলে ধরে বললো, এই চোরের বাচ্চা চোর! রোহিঙ্গার বাচ্চা রোহিঙ্গা! তুই আমার উঠোনে এসে কী করছিস?

ওহ! কিচ্ছু না। কিচ্ছু না। শুধুমাত্র একটু আগুনের আশায় এদিকে এসেছিলাম।

হাত জোড় করে আবার বলল, দোহাই, তুমি আমাকে মেরে ফেলো না। আমি এখানে কারো ক্ষতি করতে আসিনি। এই জ্বলন্ত আগুন দেখে এসেছি। নিজেকে একটু গরম করবো আর যদি একটু উচ্ছিষ্ট খাবার পাওয়া যায় এই আশায় এদিকে এসেছি। বিশ্বাস করো, মিনতি করে বলছি, আমাকে এখানে বিশ্রামের জন্য কিছুক্ষণ বসে থাকতে দাও। আমি ঠাণ্ডায় মরে যাচ্ছি। আমি এই ভয়ানক ঠাণ্ডায় নিজেকে একটু উষ্ণ করে নিতে চাই। তারপর আমি আবার যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে চলে যাবো। কখখনো তোমাদেরকে আর বিরক্ত করতে আসবো না।

ছলিমুল্লাহকে এতোটা শীতার্ত ও অসহায় দেখাচ্ছিলো যে, রহম-দিল লোকটি তার জন্য দুঃখ বোধ না করে পারলো না। এটা আগে ছিল একটা মুসলমান বাড়ি। লোকটা সম্প্রতি জীবন বাঁচানোর জন্য বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছে। তার পরিবারেরও অনেক সদস্য সামরিক জঙ্গিদের হাতে নিহত হয়েছে। লোকটা হাতের বর্শাটা নামিয়ে নিয়ে বললো, বেশ তো ভালো কথা। তুমি যদি প্রতিজ্ঞা করো এ গায়ের লোকদের কোন ক্ষতি করবে না, তাহলে তুমি আগুনের ধারে অল্প একটু বসে থাকতে পারো। কিন্তু একটা শর্ত, যখনি তুমি উষ্ণ বোধ করবে, তুমি আপসে আপ যেদিক থেকে এসেছিলে সেদিকে ফিরে যাবে। লোকটা জানে ছেলেটা এখানে থাকলে নির্ঘাত মারা পড়বে, তাই সে ছেলেটাকে এই শর্ত দিলো। 

ছলিমুল্লাহ ভাষা খুঁজে পেলো না কিভাবে এমন দয়ালু মানুষটির তারিফ সে করবে। সে আগুনের পাশে ঝপ করে বসে পড়লো। সে পাশে পড়ে থাকা আরও কিছু লাকড়ি যোগাড় করে তাতে ফুঁ দিয়ে আগুনটাকে আরো গনগনে করে তুললো। ছলিমুল্লাহ তো মহাখুশি! এমন আরাম অনেক দিন তার কপালে জোটেনি। তার ওপর আবার ঠিক তার হাতের নাগালেই একটা হাড় পড়ে ছিলো। তাতে আবার সামান্য গোশতোও লেগে ছিলো। আহ কী সুমধুর ঘ্রাণ! ভাবতেই পারছিলো না সে। তার মনে হচ্ছিল আল্লাহ যেনো তার ভাগ্যের দরজা খুলে দিয়েছে! কিছুক্ষণ সে বেশ আয়েশ করে হাড়টা চাটলো। টুকরো হাড়ের সাথে লেগে থাকা একটু একটু পোড়া গোশতোও ছিল। ওহ, তার কাছে এটা যেন জীবন বাঁচানো অমৃত খাবার বলে মনে হচ্ছিলো। হাত-পা কাঁপানো শীতে প্রায় জমে-যাওয়া শরীরটাও বেশ এর মধ্যে গরম হয়ে উঠেছে। যত কিছুই বলা হোক না কেন, এমন তৃপ্তি আর আরাম সে অনেক দিন হলো পায়নি। সবই তার কপাল! 

হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সেই লোকটি ডাক দিয়ে বললো, এখনও তুমি গরম হওনি বুঝি?

ছলিমুল্লাহ বললো, না, এখনো পুরোপুরি শরীর আমার গরম হয়নি।

তাছাড়া আরও কিছু হাড় তার চারদিকে পড়ে ছিলো, যাতে সামান্য সামান্য গোশতোও লেগে ছিলো। যা দেখতে পেয়ে ওর চোখ দুটো কেমন যেনো চকচক করে উঠেছে। সে মনে করেছে এক ফাঁকে ওগুলো থলেতে ভরে নিয়ে সে এখান থেকে হাঁটা দেবে। এটা পেয়ে তার ভাই নিশ্চয় খুব খুশি হবে!

সহৃদয় লোকটি বললো, ঠিক আছে তাহলে আরও একটু সময় তোমাকে দিতে পারি। এরই মধ্যে তুমি শরীর গরম করে নাও। বলে লোকটা চলে গেলো। লোকটা ছেলেটাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে, যাতে অন্য কেউ তাকে দেখে না ফেলে। 

আবার সব চুপচাপ। চারদিক নীরব। মাঝে মাঝে দূর থেকে দু’একটা গুলির ফুটুস ফাটুস শব্দ আসছিলো এই যা। এ ছাড়া ছলিমুল্লাহর হাড় চেটে খাওয়ার চুক চুক শব্দ ছাড়া আর কিছুই তার কানে আসছে না।

লোকটা আরো ত্রিশ মিনিট বাদে ফিরে এসে বললো, তুমি কি এখনও গরম হওনি? 

ভাবনায় পড়ে গেলো ছলিমুল্লাহ। জঙ্গলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডার কথা মনে হতেই চুপসে গেলো সে। আগুনের আরো কাছে গুড়ি মেরে সরে এসে বসলো সে। আবার কাকুতি-মিনতি তার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়লো। বললো, শুধু আর একটু আমাকে এখানে থাকতে দাও। 

লোকটি কথা না বাড়িয়ে বললো, আচ্ছা! 

এর কিছুক্ষণ পর ছলিমুল্লাহ চারদিকে পড়ে থাকা হাড়গোড় গুছিয়ে থলেতে ভরে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছিলো। লোকটা তার থেকে কিছু দূরে একটা টুলে বসেছিলো। এজন্য সে অবশ্য লোকটাকে একবার ডাক দিয়েছিলো। কিন্তু সে দেখলো লোকটা ঘুমে নাক ডাকছে। তাই সে আর তাকে ডাকলো না। আরও একটু সময় সে আগুনের পাশে বসে খাবার টুকাচ্ছিল। একটা গুলির আওয়াজ শুনে লোকটা এবার উঠে মাথা তুলে বললো, যথেষ্ট হয়েছে! আর নয়, তুমি নিশ্চয়ই এতক্ষণে যথেষ্ট গরম হয়ে উঠেছো।

ছলিমুল্লাহ ততক্ষণে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলো এভাবে আর এখানে থাকা চলবে না। তাহলে লোকটা হয়তো ক্ষেপে যাবে এবং তাকে মারধর করে তাড়িয়ে দেবে। তাই লোকটার চোখ বরাবর সোজাসুজি তাকিয়ে সে সরাসরি বললো, সততাই হলো সর্বোত্তম সহায়, দয়ায় পরম ধর্ম। সরকারি স্কুলে এসব কথা শিখেছে সে।

এতে লোকটা মনে হলো বিরক্ত হলো না। তবে ছলিমুল্লাহর কথার কোনো জবাবও দিল না লোকটা। কি যেন ভাবছিল লোকটা। 

এরপর মনে কোনো রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব না রেখে সত্য কথাটাই বললো ছলিমুল্লাহ, এখন সত্যিই আমি খুবই গরম হয়ে উঠেছি। তবুও এখন আর আমি ওই গভীর জঙ্গলে ফিরে যেতে চাইনে। সেখানে আমার প্রায়ই মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়, বিশেষ করে যখন আমি ক্ষুধার্ত থাকি। এটা আমার মোটেও ভালো লাগে না। তুমি কী এই গ্রামে মানে তোমার কাছে আমাকে থাকতে দিতে পারো না? আমি তোমার অপকার তো করবোই না, বরং উপকারই পাবে আমার কাছ থেকে।

আমি অবশ্যই তোমার বাড়ির কাজে সব ধরনের সাহায্য করবো। বন থেকে লাকড়ি যোগাড় করতেও সাহায্য করবো। আমি কথা দিচ্ছি, আমি কখনও কারো কোনো ক্ষতি করবো না, চুরিও করবো না। শুধু তোমাকে আমি এটুকুই অনুরোধ করবো রান্নাঘরের কোনায় উনুনের পাশে একটু জায়গার জন্য। আর তোমাদের খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলে না দিয়ে, নষ্ট না করে আমার জন্য একটু রাখবে। তাতেই চলবে আমার। আমি হবো আশুতোষ। অল্পেই তুষ্ট থাকবো আমি। এছাড়া আর কোনো কিছুর দরকার আমার নেই। ছলিমুল্লাহর কথা শুনে লোকটা খুব তীক্ষèভাবে, খুব ভালো করে তার দিকে তাকালো এবং মনে মনে বললো, না, ছেলেটা সত্যি কথাই বলছে।

লোকটি বেশ শান্ত গলায় বললো, তাহলে তো ভালোই হলো! তুমি যদি কথা দাও আমার সেবা করবে এবং আমার আদেশ মেনে চলবে, তাহলে তোমাকে আমি দেবো নিরাপত্তা, উষ্ণতা আর দেবো খাবার, যা না হলে তোমার চলে না এবং যা খেয়ে তুমি বেঁচে থাকতে পারো।

তখন থেকেই ছলিমুল্লাহ লোকটির সঙ্গে থাকতে লাগলো। রাত ফুরিয়ে সকাল হলো। ছলিমুল্লাহ আর ফিরে গেলো না গভীর জঙ্গলের ঝোপ-ঝাড়ের ঝুপড়িতে। কিন্তু দিন পেরিয়ে যখন সূর্য ডুবে গেল এবং চারদিকে গাঢ় অন্ধকার করে রাত্রি নেমে এলো, তখন তার কানে কিসের যেন করুণ সুর বেজে উঠল। আর সেই সুরটা যেন গভীর জঙ্গলের ওদিক থেকেই আসছে বলে তার কাছে মনে হলো যেদিকে সে তার ভাই আয়াতুল্লাহকে রেখে এসেছে। রাত যতই গভীর হতে লাগল বাতাস ভারি করা করুণ সুর ততই ছলিমুল্লাহর মনকে আচ্ছন্ন করে তুলতে লাগল। তার ভাই আয়াতুল্লাহ তাকে যেন বারবার আর্তনাদ করে ডেকে ডেকে বলছে, ভাই, যেখানে যত দূরেই থাক না কেন, যদি আমার কথা তোমার মনে পড়ে আর বাতাসের করুণ সুর শুনতে পাও তখন তুমি বুঝবে যে, তোমার প্রাণাধিক প্রিয় ভাই আয়াতুল্লাহ তোমাকে আকুলভাবে ডাকছে। 

আয়াতুল্লাহর মনে আশা আছে, তার ভাই দূরের ওই গ্রাম থেকে তার জন্য আগুন আর উচ্ছিষ্ট খাবার নিয়ে ফিরে আসবেই আসবে। জ্বরের ঘোরে সে বারবার করুণ সুরে ডাকছে তার ভাইকে।  

রাত গভীরে ছলিমুল্লাহ তার ভাইয়ের কথা মনে করে আর স্থির থাকতে পারল না। বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে ছলিমুল্লাহ চুপি চুপি বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে উচ্ছিষ্ট খাবারের থলেটা হাতে করে। ওদিকে বাড়ির আশপাশের পাজি কুকুরগুলো জেগেই ছিল। তারা ছলিমুল্লাহকে দেখতে পেয়ে একসাথে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। ছলিমুল্লাহ প্রাণপণ দৌড়াতে লাগল। সাথে কুকুরগুলো পাল্লা দিয়ে তাকে তাড়া করে ফিরছে।

লোকটাও টের পেয়ে গিয়েছিল। সেও চোর চোর, রোহিঙ্গার বাচ্চা! রোহিঙ্গা বাচ্চা! বলে চিৎকার করতে লাগল।

আশপাশের বাড়ির লোকজন চিৎকার চেঁচামেচিতে উঠে পড়েছিল। তারাও রোহিঙ্গার বাচ্চা! রোহিঙ্গার বাচ্চা! বলে চিৎকার করতে লাগল। 

‘রোহিঙ্গার বাচ্চা!’ শব্দটা মিয়ানমারে বেশ জনপ্রিয়। শব্দটা শোনামাত্র গেরুয়াধারী জঙ্গিরা ঘর থেকে বের হয়ে আসে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। 

আশপাশে অবস্থানরত মিয়ানমারের পুলিশরা বেশ সতর্ক হয়ে উঠেছে। তারা যেখানে যে অবস্থায় ছিল অস্ত্র হাতে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সহসা পাশের পুলিশি চৌকি থেকে কয়েকটা গুলির ফটাফট শব্দ শোনা গেল। 

সহসা আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে একটা বুকফাটা আর্তনাদ আকিয়াবের গভীর জঙ্গলের বুক ভেদ করে ঊর্ধ্ব আকাশে উঠে গেল, ‘ভাইয়া, আমি খাবার নিয়ে আসছি।’ 

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ