পাখিদের কলকাকলিতে পরিবেশ মুখরিত হয়। পাখি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। পৃথিবীতে চেনা-অচেনা অনেক পাখি রয়েছে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করলেও আমাদের অনেক পরিচিত পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তেমনি একটি পাখি এলডেবরা হোয়াইট থ্রোটেড রেল। অবাক করা বিষয় হলো প্রায় এক লাখ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এলডেবরা হোয়াইট থ্রোটেড রেল পাখি আবার প্রকৃতিতে ফিরে এসেছে।
ভারত মহাসাগরের ওপরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রবাল দ্বীপ, আলডাবরা। এ দ্বীপে এক সময় বাস ছিল ‘হোয়াইট থ্রোটেড রেল’ পাখির। প্রায় ১ লাখ ৩৬ হাজার বছর আগে সমুদ্রের তলদেশে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় দ্বীপটি। বাসস্থান খুইয়ে হারিয়ে গিয়েছিল আকারে মুরগির মতো পাখিটিও। কিন্তু প্রকৃতিবিজ্ঞানীদের দাবি, আবার ফিরে এসেছে বিলুপ্ত হওয়া সেই ‘হোয়াইট থ্রোটেড রেল’ পাখি।
তবে এ ফিরে আসার কাহিনীও বিচিত্র। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার তারা অবলুপ্তির গহ্বর থেকে ফিরে এলো। বিশেষজ্ঞদের দাবি, লাখো বছর আগের ওই ঘটনার কয়েক হাজার বছর পরে পাখিটি আবার ফিরে এসেছিল। সে সময় সমুদ্রের পানি নেমে গিয়েছিল। পানি নামতেই দ্বীপটি আবার জেগে ওঠে। আর তখনই পাখিটি ফের রাজ্যপাট গড়ে তোলে ওই প্রবাল দ্বীপে।
এ দুই ঘটনার আগে পরের জীবাশ্ম খুঁজে পেয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে এখন তারা বলছেন, ‘আলডাবরা দ্বীপে পাখিটি এখনও রয়েছে।’
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, একে ‘ইটেরেটিভ ইভোলিউশন’ বলে। অর্থাৎ কোনও প্রাণীর উত্তরসূরিদের মধ্যে কোনও একটি প্রজাতির একাধিক বিবর্তন ঘটে এবং ইতিহাসের বিভিন্ন সময় ফিরে ফিরে আসে তারা। অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা গেলেও ‘রেল’ বা মাটিতে বসবাসকারী ছোট বা মাঝারি মাপের পাখিদের মধ্যে এমন নজির এই প্রথম। পাখিদের মধ্যেই এটি বেশ উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
জানা যায় রেল পরিবারের পাখিদের পূর্বপুরুষের বাস ছিল পূর্ব আফ্রিকার উপকূল থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে ভারত মহাসাগরের ম্যাদাগাস্কার দ্বীপে। এক সময় এদের সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, এরা দ্বীপ ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দেয়। কেউ উত্তরের দিকে উড়ে যায়, কেউ দক্ষিণে। কিন্তু এরা কেউই তেমন উড়তে পারত না। ফলে লম্বা রাস্তা পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই ভারত মহাসাগরে ডুবে যায়।
যারা পশ্চিমে যায়, তারা আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডে পৌঁছায়। কিন্তু অচেনা-অজানা জায়গায় গিয়ে বিপদে পড়ে। প্রাণ হারায় অধিকাংশই। তবে কারও কারও ভাগ্য ভালো ছিল। তারা মরিশাস, রিইউনিয়ন, আলডাবরা পৌঁছায় এবং সেখানে রাজ্যপাট গড়ে তোলে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা ওড়ার ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেলে। কারণ ওই সব দ্বীপে তাদের ওড়ার প্রয়োজন পড়ত না।
ফলে দ্বীপেই বন্দি হয়ে পড়ে। তাই দ্বীপ যখন সমুদ্রের তলদেশে ডুবতে থাকে, তারা আর পালানোর সুযোগ পায়নি। তত দিনে তারা আর একটুও উড়তে পারে না। ফলে দ্বীপের সঙ্গেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তারা। ঠিক যা ঘটেছিল, ডোডো পাখিদের ক্ষেত্রে। কিন্তু ডোডো যা পারেনি, তাই করে দেখিয়েছে ‘হোয়াইট-থ্রোটেড রেল’।
মারটিলের কথায়, ভারত মহাসাগরের ওপরে আলডাবরাই একমাত্র দ্বীপ, যেখানে এমন জীবাশ্ম রয়েছে, যা অবলুপ্তির প্রমাণ দেয় এবং দেখিয়ে দেয় সেখান থেকেও ফিরে আসা যায়।
প্রায় এক লক্ষ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এলডেবরা হোয়াইট থ্রোটেড রেল পাখি আবার প্রকৃতিতে ফিরে এসেছে। সমুদ্রসীমার উচ্চতা বৃদ্ধি এই পাখির প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণ বলে মনে করা হয়। কিন্তু বর্তমানে আবার এই উড়তে অক্ষম পাখিটির উপস্থিতি বিজ্ঞানীদের ভাবনায় ফেলে দিয়েছে, কেন এবং কিভাবে এই পাখিটি এত বছর পরে ফিরে এলো!
জুলজিক্যাল জার্নাল অব লিনিয়ান সোসাইটির গবেষণা মতে, এলডেবরা পাখির এই ফিরে আসা “পুনরাবৃত্তি বিবর্তন” এর ফলাফল।
কোন পাখির পূর্বপুরুষ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, সেই বিলুপ্ত পূর্বপুরুষের ডিএনএ কিন্তু পরবর্তী প্রজাতিতে রয়ে যায়। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে সেই পুরনো ডিএনএ আবার নতুনভাবে ফিরে আসতে পারে। কাজেই প্রায় একই রকম প্রজাতি থেকে সময়ের সাথে সাথে একাধিক এবং কিছুটা বিবর্তিত নতুন উত্তরসূরির আবির্ভাব ঘটা সম্ভব।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে এই বিবর্তনের ফলে ডাইনোসর এবং লোমশ ম্যামথ যেকোন সময় ফিরে আসবে। এই বৈজ্ঞানিক ঘটনা শুধুমাত্র সেইসব প্রজাতির ক্ষেত্রেই ঘটে যারা প্রায় তাদের পূর্বপুরুষের মতই দেখতে।
পুনরাবৃত্তি বিবর্তন এর আগে অন্যান্য প্রজাতি যেমন- কাছিমের ক্ষেত্রে লক্ষ করা গেলেও পাখিদের ক্ষেত্রে এই প্রথম।
শুধুমাত্র এলডেবরা পাখিরই ভারত মহাসাগর অঞ্চলের মহাসাগরীয় দ্বীপের সবচেয়ে পুরনো জীবাশ্ম রেকর্ড রয়েছে, যা থেকে এই পাখির বিলুপ্ত হওয়ার এবং পুনরায় ফিরে আসার পিছনে সমুদ্র সীমার উচ্চতা পরিবর্তনের প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া যায় যা একটি বিস্ময়কর ঘটনা।