শপথ

শপথ

গল্প ডিসেম্বর ২০১২

মো: খলিলুর রহমান.. নাইমুল হক রাসেল অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। দুষ্ট ছেলে হিসেবে সর্বত্র পরিচিত চঞ্চল রাসেল এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষের অথবা নিজ আবাসিক এলাকার দুষ্টমিজনিত যেকোনো ঘটনার জন্য সন্দেহভাজনদের তালিকার শীর্ষস্থানে অবস্থান করে তার নাম। তার দুষ্টমির শিক্ষা গুরুর নাম না জানা গেলেও সে যে এলাকার দুষ্টের শিরোমনি এতে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। পড়াশোনাতে রাসেল রীতিমতো অমনোযোগী হিসেবে নিজের অবস্থান অক্ষুণœ রেখে আসছে। ক্লাসে ৭০ জন ছাত্রের মধ্যে তার অবস্থান ৬৭তম। তার মানে সে পেছনের দিক থেকে তৃতীয়। সুযোগ পেলে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চৌধুরীবাড়ীর বাগানের বটগাছের ডালে আড্ডার ক্লাসের আয়োজন করা হয়। সম্ভবত এখান থেকেই সকল ছিঁচকে চুরির মহাপরিকল্পনা করা হয়, বাজে বাক্যালাপের গবেষণা করা হয়। ‘আচ্ছা, আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে আমাদের চুরি করার মতো কী কী জিনিস রয়েছে?’ তথ্য শাখার দায়িত্বে থাকা টিটুর উদ্দেশে রাসেলের জিজ্ঞাসা। ‘মাজেদ চাচার মাচার শসা, রিনু খালাম্মার বাঁকা নারিকেলগাছের ডাব, কাসেম চাচার খেজুরগাছের রস আর তেমন কিছু না।’ টিটুর সাদামাঠা উত্তর। আচ্ছা, তোমরা শোন, সিনেমা দেখার জন্য তো কমপক্ষে ৫০০ টাকার দরকার, আমি মনে করি মল্লিক চাচার বাগানের সুপারি বিক্রয় করে এর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। রাসেলের কথায় সবাই মৌন সম্মতি প্রকাশ করল। বটগাছের ডালের এই আসরে রাসেল, টিটু ছাড়াও উপস্থিত রয়েছে জনি, মামুন, আমিন, ইমন, দীপু ও নান্টু। ‘রাসেল, দেখ দেখ মোল্লা রাশেদ আসছে, বাঁচতে চাইলে দৌড়ে পালাও। তোমাকে এমন জ্ঞান দেবে যে, সকল বাঁদরামি ছুটে যাবে’ নান্টুর একটানা কথা। সত্যিই তো, আমাকে খাইছে রে... বলে দৌড়ে পাশের ঝোপে রাসেলের আত্মগোপন। মুহাম্মদ রাশেদুজ্জামান, রাসেলের নিকটতম প্রতিবেশী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র রাশেদ। মেধাবী এবং চরিত্রবান ছেলে হিসেবে এলাকায় তার জুড়ি নেই। নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে রাশেদ চেষ্টা করে রাসেলও যেন তার মতো মেধাবী ও চরিত্রবান হয়। এ জন্য ভালো পড়াশোনার পাশাপাশি ভালো মুসলমান হওয়ার জন্য রাশেদ মাঝে মাঝে রাসেলকে পরামর্শ ও উপদেশ দিয়ে থাকে এবং এ জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও  করে। আর এতেই রাসেল রাশেদের ওপর বিরক্ত এবং সুযোগ পেলেই রাশেদকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। সামনে না হলেও রাসেল রাশেদকে ‘মোল্লা রাশেদ’ বলে ডাকে। এসব ব্যাপারে রাশেদ অবগত থাকার পরও তা রাসেলকে বুঝতে দেয় না। রাশেদ তার প্রচেষ্টা সমানভাবে চালিয়ে যেতে থাকে। কারণ সে বিশ্বাস করে যে চেষ্টা অব্যাহত রাখলে আল্লাহ তাকে নিরাশ করবেন না এবং রাসেল একজন ভালো ছাত্র তথা ভালো মানুষ হবে। ছাত্রদের দুই গ্র“পের সংঘর্ষের জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। এ জন্য রাশেদের এই অসময়ে বাড়ি আসা। রাশেদ দূর থেকেই রাসেলের অবস্থান এবং পলায়ন অবলোকন করেছে। তবুও না দেখার ভান করে আস্তে আস্তে বটগাছের সম্মুখে এগিয়ে আসছে। রাশেদ বটগাছের কাছাকাছি আসতেই নান্টুসহ বাকিদের একযোগে সালাম, ‘আস্সালামু আলাইকুম, রাশেদ ভাইয়া কেমন আছেন?’ সালামের জবাব দিয়ে রাশেদের উত্তর ‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি, তোমরা কেমন আছো?’ আমরাও ভালো, সবার সমস্বরে উত্তর। আচ্ছা, রাসেল কোথায়? ‘ভাইয়া, রাসেলের সাথে আমাদের ২-৩ দিন দেখা নেই, এখানেও আসে না, সম্ভবত পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত’। রাশেদের প্রশ্নের জবাবে নান্টুর পরিপক্ব মিথ্যে কথা। কথা দীর্ঘায়িত না করে বাড়ির দিকে এগোতে থাকে রাশেদ। একটু পরই ঝোপ থেকে রাসেল বেরিয়ে আসে আর উল্লাসের সাথে বলতে থাকে, ‘নান্টু ভালোই তো বলতে পারিস, এত বড় পাকা মিথ্যুক হয়েছিস যে, শয়তান তার কাজের জন্য তোকে মোটা বেতনে নিয়োগ করতে পারে।’ রাসেলের গণিত শিক্ষক মাহমুদ স্যারের একটি ঘোষণায় ছাত্রছাত্রীদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। বছরের প্রথম তিন মাস শেষ হওয়ায়, এ পর্যন্ত ক্লাসে শেষ হওয়া গণিতের সিলেবাসের ওপর স্যার একটি পরীক্ষা নেয়া খুবই প্রয়োজন বলে মনে করেন এবং আগামী দশ দিন পর আগত সোমবারে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেন। স্যারের ঘোষণার সাথে প্রকাশ্যে কেউ বিরোধিতা না করলেও মধ্যম ও সবচেয়ে দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীরা অপ্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করল। রিরোধিতাকারীদের চেহারা ভীত শঙ্কিত, কারণ তারা খুব ভালো করেই জানে যে, পরীক্ষা দেয়া মানে ফেল করা। বিরোধিতাকারীদের দৃষ্টি এখন রাসেলের দিকে। কারণ তারা বিশ্বাস করে যে, রাসেল ইচ্ছে করলে এ সমস্যা থেকে তাদের মুক্তি দিতে পারে। মূলত রাসেল নিজেও এই দলের একজন সদস্য। মাতব্বর গোছের কিছু সহপাঠী রাসেলকে অতীতের মতো এবারও কিছু একটা করার অনুরোধ জানায়। ‘আমি কিছু করতে পারব এই মুহূর্তে তা তোমাদের নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, তবে আমি চেষ্টা করে দেখব।’ রাসেলের বিচক্ষণ উত্তর। এরই মধ্যে দুই দিন অতিবাহিত হলো। হাতে আছে পরীক্ষার বাকি আর আট দিন। একদিকে চলছে ভালো ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষায় আরো ভালো করার প্রচেষ্টা আর অন্য দিকে চলছে পরীক্ষা বানচালের গভীর ষড়যন্ত্র। পরীক্ষা বানচাল বাস্তবায়ন কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে রাসেল। এ ছাড়াও রয়েছে আমিন, সিয়াম, নান্টু ও মামুন। সম্পূর্ণভাবে আর্থিক সহায়তা করবে ‘ডলার মানসুর’। মানসুরের বাবা যুক্তরাষ্ট্র থাকেন বিধায় সবাই মনে করে মানসুরের সব টাকাই মার্কিন ডলার। তাই সহপাঠীদের দেয়া তার সম্মানসূচক নাম হলো ‘ডলার মানসুর’। রাসেলের নির্দেশনায় পরীক্ষা বানচালের সম্পূর্ণ পরিকল্পনা চূড়ান্ত। পরিকল্পনার সারমর্ম হলো বিদ্যালয়ে আসার পথে স্যারের শরীর গোবর মিশ্রিত পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া হবে। এমন একস্থানে এই কর্ম সাধন করা হবে যেখান থেকে স্যার বাড়িতে গিয়ে পুনরায় প্রস্তুতি নিয়ে বিদ্যালয়ে আসতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। তাই স্যারের পক্ষে বিদ্যালয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও পরীক্ষা নেয়া কোনোভাবেই সম্ভব হয়ে উঠবে না। সকল জল্পনা কল্পনা শেষে আজই হলো সেই পরীক্ষা বানচালের দিন। সবাই প্রস্তুত। গাছের ডালে বালুর ব্যাগ নিয়ে রাসেল। অন্যরা ঝোপের আড়ালে। হ্যাঁ, মাহমুদ স্যার প্রায় তাদের নিকটতর থেকে নিকটতম হচ্ছেন। রাসেল সবাইকে কাজ শুরু করার ইঙ্গিত দেয়া মাত্রই একদিকে ধুলা ছিটানো শুরু হল আর অন্য দিকে গোবর পানি দিয়ে স্যারের পুরো শরীর ভিজিয়ে দেয়া হলো। স্যার বিব্রত, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এবার প্রস্থানের পালা, রাসেল সবাইকে কেটে পড়ার ইশারা করল এবং ডাল থেকে নামতে শুরু করল। হঠাৎ ডাল ভেঙে রাসেল মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার মাথা ফেটে গেছে, রক্তে নিজের জামাকাপড়সহ মাটি ভিজে যাচ্ছে। রাসেল জ্ঞান হারাল। এ অবস্থায় তাকে দ্রুত থানা সদর হাসপাতালে নেয়া হলো। শরীরের যাবতীয় অংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ফলাফল হলো এই, ‘তার ডান হাত ও বাম পা ভেঙেছে, তবে মাথায় গুরুতর কোনো ক্ষতি হয়নি।’ রাসেল ছাড়া তার পরিবারে রয়েছে ছোটবোন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী ফাহিমা, মা গৃহিণী আর বাবা ঢাকাতে একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরিরত। ডাক্তার বলেছেন রাসেলের সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার জন্য প্রায় দেড় মাস হাসপাতালে অবস্থান করতে হবে।  মা চিন্তিত হয়ে পড়লেন এই দীর্ঘ সময় কে রাসেলের সাথে হাসপাতালে থাকবে? শুরু থেকে রাসেলের চিকিৎসার যাবতীয় কাযক্রমের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিল রাশেদ। রাশেদ নিজেই স্বপ্রণোদিত হয়ে হাসপাতালে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করল। হাসপাতালে ভর্তির আজকে দ্বিতীয় দিন। রাসেলের মাথা, ডান হাত ও বাম পায়ে ব্যান্ডেজ। শরীরে এখনো প্রচণ্ড ব্যথা। ডাক্তার বলেছেন রাসেলের সাথে লোকজন এখন দেখা করতে পারবে কিন্তু কথা বলা যাবে না। রাসেলের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকগণ পর্যায়ক্রমে রাসেলকে হাসপাতালে দেখে যাচ্ছেন। এলেন মাহমুদ স্যার, রাসেলের মাথায় আস্তে হাত রাখলেন। স্যারের চোখে চোখ পড়তেই রাসেলের সমস্ত ঘটনা মনে পড়ল, তার চোখ দিয়ে অশ্র“ধারা বইছে, স্যারও নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। ডুকরে কেঁদে উঠলেন, তাদের দু’জনের চোখের পানি উপস্থিত অন্যদের চোখকেও অশ্র“সিক্ত করেছে। দুরন্ত রাসেল আজ তার সমস্ত স্বভাবসুলভ ব্যস্ততাকে বিসর্জন দিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। দীর্ঘদিন তাকে এ অবস্থায় থাকতে হবে। একঘেয়েমি ও বিরক্তকর অবস্থা যাতে না হয় সে জন্য রাশেদ হাসপাতালে অবস্থানের সময়কে নানান ধরনের বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজের মাধ্যমে অতিবাহিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যেমন, কখনও রাসেলকে জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী শুনানো, কখনও ভাল ছাত্র হওয়ার গুরুত্ব বুঝানো, ভাল ছাত্র ও ভাল মানুষ হওয়ার কৌশল, জানা-অজানার বিভিন্ন তথ্য প্রদান প্রভৃতি। পরিকল্পনার আলোকে রাশেদ তা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। রাসেল পৃথিবীতে মানুষ যে মানুষের জন্য এত কিছু করতে পারে আগে রাসেল তা কখনও উপলব্ধি করতে পারেনি। রাশেদ এখন তার নিকট ফেরেশতা। আর তাই বিপদের এই বন্ধুর কথা রাসেল অক্ষরে অক্ষরে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে আর বাস্তবজীবনে তা মানার চেষ্টা করে। যেমন সেদিন রাশেদ রাসেলকে নামাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য় সম্পর্কে ধারণা দেয়ার পর রাসেল নিজ থেকেই বলে উঠল, ‘ভাইয়া আমার তো এ অবস্থাতেই নামাজ আদায় করা জরুরি তাই না?’ হ্যাঁ, অবশ্যই, কারণ কেবল দু’টি অবস্থাতেই নামাজ না পড়লে আল্লাহ ক্ষমা করবেন। একটি হলো কোন রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে যেটুকু সময় রোগী অজ্ঞান অবস্থায় থাকে ওইটুকু সময়ের নামাজ আর একটি হলো যে সময়ে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না অর্থাৎ পাগল হলে। যেহেতু তুমি বর্তমানে এই দু’টি অবস্থার কোনোটিরই আওতাভুক্ত না, সেহেতু তুমি নামাজ বাদ দিলে অবশ্যই আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। আমি তোমাকে ওযুর ব্যবস্থা করছি, তুমি ইশারায় নামাজ আদায় কর। রাসেল নামাজ আদায় করল, এটাই হলো রাসেলের জীবনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোন নামাজ আদায়। হাসপাতালে ভর্তির পর ১০-১২ দিন অতিবাহিত করল রাসেল। সর্বক্ষণ অস্থিরতার মধ্যে কাটানো রাসেল এখন মানসিক ও শারীরিক উভয় দিক থেকেই স্থির। আস্তে আস্তে তার শারীরিক সুস্থতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পাশাপাশি তার মানসিক অবস্থার ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে। এ শুধু তার দুর্ঘটনার ব্যাপার নয়, তা হলো তার জীবনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। রাশেদের সহযোগিতায় সে তার প্রকৃত জীবনদর্শনের সন্ধান পেল। তার কাছে জীবন এখন খেলনা নয়, অর্থবহ। আর এ পরিবর্তনের উপলব্ধি রাসেল থেকেও রাশেদের অনেক বেশি। রাত-দিন একটানা রোগীর পাশে থাকার প্রেক্ষিতে সৃষ্ট শারীরিক কষ্ট, মানসিক প্রশান্তি দ্বারা ম্লান হয়ে যায় রাশেদের। আজকে রাসেলের হাসপাতালে ২৮ দিন পূর্ণ হলো। অন্য দিনের তুলনায় একটু আগেই এশার নামাজ পড়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ও। রাত ১টা বেজে ১০ মিনিট। হাসপাতালের পুরো ওয়ার্ডে ছায়া অন্ধকার। রোগী ও রোগীর স্বজনরা সবাই একযোগে ঘুমের নিকট নিজেদেরকে সমর্পণ করল। রাসেল তখন এক সুন্দর স্বপ্নে বিভোর। রাসেলকে স্কুলের সকল ছাত্রছাত্রীর প্রতিনিধি হয়ে শপথবাক্য পাঠ করতে হবে। এ জন্য রাসেলের স্কুলে প্রধান শিক্ষকের কক্ষের সামনে শপথবাক্য পাঠ করানোর জন্য একটি সুন্দর মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। রাসেল এখনো বিদ্যালয়ে এসে পৌঁছায়নি তাই বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সবাই রাসেলের জন্য অপেক্ষায় রত। এদিকে  নান্টু, আমিন রাসেলকে প্রথমে বিদ্যালয়ে না যাওয়ার জন্য প্ররোচনা দেয়, তাতে তারা সফল না হওয়ায় চূড়ান্তভাবে বাধা দিলো। রাসেল সব বাধাকে অতিক্রম করে বিদ্যালয়ে আসতে সক্ষম হয় এবং শপথ শুরু করে, ‘আমি অত্র বিদ্যালয়ের সকল ছাত্রছাত্রীর পক্ষে শপথ করিতেছি যে, আমরা ভালো ছাত্র হব, ভালো মানুষ হব এবং সমাজে মানুষের কল্যাণে নিজেদেরকে উজাড় করে দেব।’ এতক্ষণে রাশেদের ঘুম ভেঙে যায়। রাসেলের শপথের বাক্যগুলো সে স্পষ্টভাবে শুনতে পায় আর মনে মনে বলতে থাকে, ‘প্রভু তোমার শপথ সফল করুন।’ রাসেল ডান দিক থেকে বাম দিকে কাত হয়ে আবার নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে হাসপাতালে রাশেদের ৪০টি দিন কেটে যায়। দীর্ঘ সময় অবস্থানের প্রেক্ষিতে রাসেলের ওয়ার্ডের অন্যান্য ১৫টি বেডের রোগী ও আত্মীয়স্বজনদের সাথে রাশেদের আত্মার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের যেকোনো সমস্যায় সম্ভাব্য ক্ষেত্রে রাশেদের সহযোগিতার হাত ছিল প্রসারিত।  এদিকে ডাক্তার বলেছেন রাসেল প্রায় সুস্থ হয়ে গেছে। আর মাত্র তিন দিন পর তার হাত ও পায়ের ব্যান্ডেজ খোলা হবে এবং ওই দিনই সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে। রাসেলকে নাশতা করানোর পর রাশেদ নিজেও সকালের নাশতা সেরে নিলো। তারপর জাতীয় দৈনিকে চোখ বুলাচ্ছিল। হঠাৎ রাশেদের মোবাইল ফোন বেজে উঠল, একনজর দেখেই বুঝতে পারল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসিফের ফোন। ফোন রিসিভ করা হলো, কথা হলো এবং আস্তে আস্তে রাশেদের চেহারায় অন্ধকার নেমে এলো কারণ আগামী কালই রাশেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু। তাই রাশেদকে আজকের মধ্যে ঢাকা পৌঁছতে হবে। রাসেল, রাসেলের আম্মা ও রাসেলের ওয়ার্ডের লোকজন অল্পসময়ে এ বিষয়ে অবগত হলো। রাশেদকে এখনই বাড়িতে গিয়ে তার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সম্পূর্ণ প্রস্তুতিসহকারে আবার হাসপাতালে আসতে হবে। পরিকল্পনা মোতাবেক রাশেদ বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে বেলা ২টায় হাসপাতালে পৌঁছল। বেলা ৩টায় তাকে ঢাকাগামী বাসে উঠতে হবে। রাশেদ রাসেল এবং তার আম্মাকে ওষুধ সেবনের নিয়মাবলি বুঝিয়ে দিচ্ছি। সবার চোখে পানি। কিন্তু রাসেলের চোখের পানির সাথে রয়েছে সজোরে কান্না। রাসেলের কান্না দেখে রাশেদ আর চোখের পানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না। সব মিলিয়ে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এ যেন আন্তরিকতাপূর্ণ ভাবাবেগের গভীর বিস্ফোরণ। যাওয়ার শেষ মুহূর্তে রাসেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রাসেলের মাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘খালাম্মা আপনাকে এক নতুন রাসেল দিয়ে যাচ্ছি, খুব তাড়াতাড়ি তার প্রতিফলন দেখবেন, ইনশাআল্লাহ।’ কয়েকদিন পর রাসেল সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল। আগামীকালই সে স্কুলে যোগ দেবে, তাই সহপাঠী নজরুলের থেকে আগামীকালের বিভিন্ন বিষয়ের পড়া সম্পর্কে অবগত হলো। প্রথম দিনেই সে সব স্যারের পড়া দিতে পেরেছে। তাই রাসেলের স্কুল এক নূতন রাসেলকে আবিষ্কার করল।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ