শিশু-কিশোরদের ঈদ উদযাপন

শিশু-কিশোরদের ঈদ উদযাপন

প্রবন্ধ নিবন্ধ ড. মোজাফফর হোসেন এপ্রিল ২০২৩

ঈদ আনন্দের উৎসব।

এই ধারণাটা শিশু-কিশোররা প্রথম লাভ করে পরিবার থেকে। তারপর  সমাজ থেকে। পরিবার ও সমাজ মিলে ঈদ আনন্দের একটা আবহ তৈরি হয়। এই আবহ তৈরি হওয়ার আগেই বাবা-মায়ের কাছে কানে কানে শিশুরা ঈদ আগমনের খবর শোনে। তখন অনেক শিশুই প্রশ্ন করে বাবা, ঈদ কী? মা ঈদ কী?। বাবা-মা বুঝিয়ে দেয়- ঈদ হলো মুসলমানদের প্রধান উৎসব। আনন্দের উৎসব। ত্যাগের উৎসব। এই উৎসব বিশ্বমুসলিমের ঐতিহ্য। আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে ভালোবাসার আনুষ্ঠানিক বন্ধন। ক্ষমা ও ত্যাগের মিলনমেলা। ধনী-দরিদ্র সম্পর্কের উন্নয়ন। ঈদ আসার বেশ কিছুদিন আগে থেকে ঘরে ঘরে ঈদের এসব কথা প্রচার হয়। শিশু-কিশোররা এসব কথা শোনে। কিছু কথা মনে রাখে। কিছু কথা মনে থাকে না।

পরিবারের বড়রা ঈদ আগমনে নিজেরা আগে উষ্ণ হয়। তারপর ছোটদের আদর করতে করতে ঈদ আগমনের উষ্ণ বার্তা বুঝিয়ে দেয়। তখন শিশুমনে ঈদের আঁচড় লাগে। ঈদ নিয়ে শিশুমন কৌতূহলী হয়ে ওঠে। তারা খুঁটে খুঁটে দেখতে চায়, ঈদের সময় কী কী হয়। কিভাবে হয়। নিজের সাজসজ্জা। ঘরের দরকারি সাজসজ্জা। ঘরদুয়ার ধোয়ামোছা। কাপড়চোপড় ধোয়া। বাড়ির চারপাশের উঠান-খলাকে পরিচ্ছন্ন করে তোলা, ইত্যাদি ঘটে। নিজের চোখে একটা পরিবর্তন দেখে। তারা লক্ষ করতে থাকে খেলার সাথীদের সাজ সাজরব। বড়দের মুখে হাসি। এসব সাজসজ্জা ও পরিবর্তন দেখতে দেখতে ঈদ সম্বন্ধে  কচিমনে একটা ধারণা জন্মায়। লক্ষ করতে থাকে, ঈদ আসতে আসতে সবকিছু কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। মানুষের ব্যস্ততা বাড়ছে। স্কুল-কলেজ ছুটি হচ্ছে। দান সদকা বাড়ছে। দরজির দোকানে মেয়েদের ভিড় বাড়ছে। সকলের চোখে মুখে খুশি খুশি ভাবের একটা আভা প্রকাশ পাচ্ছে। সবকিছু মিলে শিশুমনে ঈদের অভিজ্ঞতা জমতে থাকে।

ঈদ সমাগত হতে হতে শিশু-কিশোর পুলকিত হয়ে ওঠে। ঈদ আনন্দের দোলাচল অঙ্গপ্রত্যঙ্গে প্রকাশ করে। শিশুমনে ঈদের মূল আকর্ষণ নতুন জামা-জুতা। সেই জামা-জুতার নিশ্চয়তা পাওয়া গেলে আনন্দের বাঁধ ভেঙে যায়। ঈদের আগে অনেকের জামা-জুতা খুব তাড়াতড়ি হয় না। আগেভাগে যাদের জামা-জুতা হয় না তাদের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করে। বাবা-মাকে বারবার তাগাদা দেয়। জামা-জুতা কিনে দিতে হবে। অবশেষে যখন জামা-জুতা পাওয়া যায় তখন তাদের আনন্দ দেখে কে। সেই জামা-জুতা ঈদের আগেই বারবার পরা। আবার খুলে যতেœ রাখা। অন্যকে দেখানো। কার জামাজুতা বেশি সুন্দর এই নিয়ে প্রতিযোগিতা করা। এরকম ঘোরের ভিতর দিয়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। একদিন ঈদও চলে আসে। 

ঈদে বড়দের পাশাপাশি শিশুমনও বিচলিত হয়ে ওঠে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে কখন ঈদের দিন আসবে। মনে মনে গুনতে থাকে ঈদ আসতে আর কত দিন বাকি আছে। ভাবতে ভাবতে তারা ঈদের দিনের একটি পরিকল্পনা করে নেয়। কী কী করবে। কেমন করে করবে। এসব চিন্তায় চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে ঈদের অবয়ব। আনমনে শিশুমানসপটে ঈদের একটি ছবি আঁকা শুরু হয়ে যায়। সেই ছবিতে থাকে নতুন জামা-জুতা পরে, আতরসুরমা লাগিয়ে, নগদ টাকা নিয়ে ঈদগাতে যাওয়া। খুতবা শোনা। নামাজ আদায় করা। তবে শিশুমনের প্রধান আকর্ষণ ঈদগার পাশে জমে ওঠা কয়েক ঘণ্টার ক্ষণস্থায়ী ছোট্ট বাজার। যেখানে হরেক রকম মিষ্টিমিঠাই থাকে। খেলনা থাকে। মনিহারি দোকানিরা পশরা সাজিয়ে বসে থাকে। শিশুমন ফিরে ফিরে যেতে চায় সেই বাজারে।

সব শিশু-কিশোরের মনে ঈদের আনন্দ একইভাবে ধরা দেয় না। বহু শিশু-কিশোর আছে যাদের ঈদে নতুন জামা-জুতা জোটে না। নতুন জামা-জুতা না হওয়া দুঃখের। কষ্টের। এই কষ্টের কারণ দরিদ্রতা। অভাব অনটন। অভাব বুদ্ধিমান মানুষ কর্তৃক অন্য মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একধরনের অক্ষমতা। দুনিয়া সম্পদে ভরপুর। এই অঢেল সম্পদ সমানভাবে বণ্টন করা হয় না। অল্প কিছু মানুষ বুদ্ধি খাটিয়ে, অন্যায় করে, জোরযবরদস্তি করে দুনিয়ার বেশির ভাগ সম্পদ নিজেদের দখলে রাখে। সে কারণে পৃথিবীর বহু মানুষ সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহ সব মানুষকে সমান বুদ্ধি, সমান শক্তি দেননি। কিন্তু আল্লাহ বুদ্ধিমান, শক্তিমান মানুষকে দান সদকা করার নির্দেশ দিয়েছেন। জুলুম করতে বারণ করেছেন। এই বুদ্ধিমান সবল সক্ষম মানুষগুলোর অনেকেই আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মানে না। ফলে দুনিয়ার সম্পদের সুষম বণ্টনও হয় না। এভাবেই কুবুদ্ধির মানুষের পাকে পড়ে মানুষ দরিদ্র হয়। পৃথিবীতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি। কিছু পরিবার আছে যাদের একদিনের খাবারই ঠিকমত জোটে না। ওষুধ কিনতে পারে না। চিকিৎসা হয় না। শিক্ষাও হয় না। এইসব দরিদ্র পরিবারগুলো ঈদের আনন্দ অনুভব করতে পারে না। ঈদের সময় এই পরিবারের মানুষগুলোকে অন্য মানুষে মুখাপেক্ষী হতে হয়। এসব পরিবারের শিশু-কিশোররা ঈদে বিষণœ থাকে। তাদের মুখটা মলিন দেখায়। বন্ধুদের থেকে দূরে থাকতে চায়। কখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বন্ধুদের নতুন জামা-জুতার দিকে। কখনো মনের জোরে বন্ধুদের মিথ্যে বলে, আব্বা কিনে দিতে চেয়েছে। বাড়ি ফিরে বাবাকে জামার কথা বলতেই বাবা ধমক দেয়। তখন বাড়িতে দিনের আলোতেই নেমে আসে রাতের অন্ধকার। সুনসান নীরবতা। বাবা-মায়ের মুখও কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে যায়।

ঈদের বড় শিক্ষা অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। সেজন্য দরিদ্রদের দান করতে হয়। বিপদে আপদে তাদের পাশে দাঁড়াতে হয়। সবাই মিলে খুশির ঈদ, সেটাই প্রকৃত ঈদ। প্রকৃত আনন্দ।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ