শীতের কথা শীতের ব্যথা    -ড. রফিক রইচ

শীতের কথা শীতের ব্যথা -ড. রফিক রইচ

বিশেষ রচনা জানুয়ারি ২০১৬

শীতের রাজকীয় রঙিন বর্ণিল বাহারি জামা কাপড় পরা ছটফটে ছোট বন্ধুরা, বেশ কিছুদিন পর আবার তোমাদের জন্য দু-কলম লিখছি। আজকের লেখাটি শীত নিয়েই শুরু করি এবং শীতের নানা ফুলের রেণু গায়ে মেখে এবং হরেক রকম পিঠা খেতে খেতে শেষ করতে চাই। লেখাটি শুরু করি পবিত্র কুরআনের দু’টি আয়াত দিয়ে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনের সূরা কামারের ৪৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন, আমরা পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি করেছি তা পরিমিত পরিমাপে সৃষ্টি করেছি। অর্থাৎ একটু বেশিও করিনি আবার একটু কমও করিনি। আবার যে জিনিসকে যেখানে রাখা দরকার সে জিনিসকে সেখানেই রাখা হয়েছে। যে জিনিসকে যতটুকু সময় রাখা দরকার তাকে ততটুকুই রাখা হয়েছে। তবে এসব কিছুই মানুষের জন্য, মানুষের শিল্পিত বেঁচে থাকবার জন্য করা হয়েছে। সেদিক থেকে আমাদের এ দেশের ঋতু বৈচিত্র্যের বিষয়টিও একই রকম। এসব ঋতুর সাথে আমাদের খেয়ে পরে বেঁচে থাকার বিষয়টি জড়িত। এর কোন হেরফের হলে আমাদের বেঁচে থাকাসহ জীবন যাপনে আসবে অনেক অসঙ্গতি তথা বিপদ আপদ। দুঃখের কথা হলো এখন অনেকটা সে রকমই আমরা লক্ষ্য করছি। অবশ্য এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনের সূরা রোমের ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে স্থলভাগ এবং জলভাগে যা কিছু পরিবর্তন হচ্ছে তা তোমাদের দুই হাতের কামাই। অর্থাৎ আইলা, সিডর, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রকার দুর্যোগের জন্য মূলত আমরা মানুষেরাই দায়ী তথা আমাদের দুই হাতের কামাই। ঠিক একইভাবে বর্তমান সময়ে ঋতু বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অনিয়ম অসঙ্গতি। ঋতুগুলো আর রাজার মত দাপটে নয় প্রজার মত সাধারণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ যে ঋতুর যতটা সময় থাকার কথা সে ঋতু ততটা সময় থাকছে না। আবার যে ঋতুতে যেটা চোখে পড়ার কথা বা উপলব্ধি করার কথা সেটা সে ঋতুতে দৃশ্যমান হচ্ছে না। ফলে এর খারাপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমাদের ওপরে।
অনন্য সম্ভাবনার উৎস আমার ছোট বন্ধুরা তোমরা তো জান আমাদের দেশে ছয়টি ঋতু আছে। এগুলোর সবগুলোর নামই তোমরা জান। তবে এসব ঋতুগুলোর মধ্যে গ্রীষ্ম, বর্ষা এবং শীত এই তিনটি ঋতুই বেশি করে চোখে পড়ে, আমাদের জীবনকে নানাভাবে আলোড়িত করে।
এখন শীতকাল। গত শীতকালেও তোমাদের জন্য আমি লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল শীতের জাদুকর। হয়তো মনে হয়েছে। সেখানে শীতের সব বিষয় উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিলাম। বুঝতেই পারছো আজকের লেখাটিও শীতকাল নিয়ে লিখবো তবে লেখাটিতে আসবে একটু ভিন্নতা।
তোমরা জান কিছুদিন আগেই সফলতা ও সচ্ছলতার ঋতু হেমন্ত বিদায় নিলো শীতকে সুস্বাগতম জানিয়ে। অদৃশ্য কি যেন এসে শরীরটা কাঁপিয়ে দিলো। গরম কাপড় চোপড় কোথায় আছে শুরু হলো তার খোঁজ করা। আর্দ্রতার অভাবে চারিপাশটা কেমন রুক্ষতায় ভরাট হয়ে যায়। গা হাত-পা কেমন অমসৃণ হয়ে যায়। আশপাশের সবুজের শামিয়ানা খুলে পড়ে। ধূসরতায় ছেয়ে যায় এ দেশ। এ সময় প্রকৃতিকে বড়ই বেমানান দেখায়। ভোরবেলায় প্রকৃতির শরীর কুয়াশায় চাদরে ঢাকা থাকে। প্রকৃতির সবুজ কার্পেট সবুজ ঘাসে পা দিলে চকচকে স্বচ্ছ শিশিরে পা দুটো ভিজে শীতল হয়ে যায়। ভোরের আকাশে সূর্যের দেখা পাওয়া যেন ভাগ্যের ব্যাপার। গ্রামের বুড়ো-বুড়িসহ অভাবী সব বয়সের মানুষেরা এমনকি শহরের ফুটপাথের মানুষগুলো খর কুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করে এ সময়। তেমন জরুরি কাজ-কর্ম ছাড়া সহজে বিছানা কেউ ছাড়তে চায় না। লেপ কম্বল মুড়িয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে। ছোট সোনারা তবে তোমাদের মত ছেলে মেয়েরা ভোর বেলাতে পাখিদের সাথেই ওঠে পড়ে এবং জ্বলন্ত চুলার পাশে বসে তাপ নেয়ার চেষ্টা করে এবং মা-খালাদের বানানো পিঠা বড়ই আনন্দে মুখ ভরে ভরে খেতে থাকে। আশা করি তোমরাও এর বাইরে নও আবার বড়রাও এর বাইরে নয়। তবে তোমরা যারা শহরে থাক তাদের ক্ষেত্রে এর চিত্রটা একটু ভিন্ন। অনেকের বাবা-মা চাকরিজীবী হওয়ার কারণে পিঠাপুলি বানানোর অত সময় থাকে না। সে ক্ষেত্রে বাহিরের কনফেকশনারির দোকান বা ভালো রেস্তোরাঁ থেকে এসব পিঠা কিনে এনে এগুলো খেয়ে স্বাদ মেটানোর চেষ্টা করে থাকে। তবে যাই বল গ্রামের মতো এ মজাটা শহরে পাওয়া যায় না।
ভোর বেলাতে ভাগ্যগুণে যখন কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্যের আগমন ঘটে তখন এর সোনালি নরম মিষ্টি আলোয় চকমকে আলোকিত হয়ে ওঠে প্রকৃতি। পাড়াগাঁয়ের আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই এ আলোর মিষ্টি উঞ্চতার লোভে বাড়ির উঠানে বা বাড়ির বাহির আঙিনায় সমবেত হতে থাকে। সাথে থাকে মুড়কি মোয়া, মুড়ি পাটালিগুড়, খেজুরগুড়, নারিকেল মুড়ি। কুড়মুড়িয়ে খেতে থাকে আর মিষ্টি এ রোদ পোহাতে থাকে। মিষ্টি এ রোদের আলোয় সবুজ ঘাসে জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো দেখলে সৃষ্টিকর্তার কথা যে কারো মনে হবে।
ছোট বন্ধুরা কথায় আছে মাঘের শীতে বাঘেও ভয় পায়। পৌষের চাইতে মাঘে এ শীত বেশি হয়। তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে চলে যাওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। যারা সচ্ছল পরিবারের মানুষ তাদের খুব একটা কষ্ট না হলেও যারা গরিব মানুষ সারা দিন রাত যারা খেটে খুটে যা পায় তাই খায়, তাদের অবস্থা যারপরনাই খারাপ। শীতে তাদের কষ্টের যেন শেষ নেই। আবার যারা শহরের ফুটপাথে জীবন চালায় বা যারা পথের শিশু শীতে তাদের কষ্ট দেখলে তোমাদের ভালো থাকবার উপায় থাকবে না। তারা তোমাদের মত পিঠা পুলি পায় না, গরম কাপড়ও পায় না শীতে তাদের পাঁজর বেঁকে ওঠে ধনুকের মতো। একটি ছড়া শোনÑ
গরম কাপড় গায়ে চেপে শীতের পিঠা খাও যারা
শীতের কষ্ট কেমন কষ্ট টের বলকি পাও তারা?
শীতের কষ্ট কারে বলে জানে পথের ছেলে
খড়কুটোতে আগুন জ্বেলে হাত দুটো দেয় মেলে।
খড় কুটোতে নিভলে আগুন জানটা ওঠে চমকে,
করবে কি যে পায় না ভেবে যায় যে জীবন থমকে।

ছোট সোনামনিরা তোমরা যারা অনেকটা সচ্ছল পরিবারের সদস্য তারা সাধ্যমত এ শীতে এদের গরম কাপড় চোপড়সহ সাধ্যমত সব সহযোগিতার হাতকে প্রসারিত করবে। শীতে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ প্রায় সব এলাকাতেই বৃদ্ধ মানুষগুলোর অবস্থা ও কোলের শিশুগুলোর অবস্থা খুব নাজুক হয়ে পড়ে। এদের অনেকেই এ শীত সইতে না পেয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। আক্রান্ত হয় নানা শীতকালীন জটিল রোগে। কাজেই তোমাদের বাবা-মাকে এ বিষয়ে কিছুটা সহযোগিতার জন্য বলবে। তোমাদের কথা তারা আরো বেশি শুনবে। সবাই মিলে তাদের সহযোগিতা করলে এ শীতের কষ্ট তারা কাটিয়ে উঠতে পারবে।
আমার ছটফটে ফুটফুটে স¦প্নবাজরা তোমরা জান আমার প্রিয় ঋতু হলো শীতকাল। শীতকালে আমার পথচলা আনন্দময় হয়। আমি ঝড় দেখে ভীষণ ভয় পাই। আবার অতি বৃষ্টি ভালো লাগে না। গরমের সময় বহু কষ্টে পার করতে হয় আমাকে। শীতের এ সময়ে এ বিষয় আমাকে স্পর্শ করে না। হয়তো তোমাদেরও না।
শীতের এ সময়টাতে প্রকৃতির সবুজ সতেজ রূপ আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় নষ্ট হয়েছে কিন্তু আমার মনে হয় এ রূপ আরো বৃদ্ধি পায়। দেখ এ সময়টাতে সবুজের সমারোহ উঁকি দিতে শুরু করে। তা ছাড়া আবাদে বিস্তীর্ণ জমি মাঠের পর মাঠ সরষে ফুলে ফুলে ভরাট হয়ে যায়। দেখলে চোখ জুড়ে যায়। মন ভরে যায়। ইচ্ছে করে দৌড়াতে সরষে ফুলের ভেতর দিয়ে। সর্ষে ফুলের পাশাপাশি হরেক বর্ণের রাজকীয় সব ফুলের সমারোহ চোখে পড়ে এ শীতকালেই। আবার পুষ্পরাজ বসন্তের শুরুটাও এ সময়ই শেষ দিকেই হয়। সূর্যমুখী, ডালিয়া, রজনীগন্ধা, দোপাটি, অতসী, চন্দ্রমল্লিকা, কসমস, গাদা ফুলসহ নানা বাহারি ফুলের সৌরভে মৌমাছি মাতাল হয়ে ওঠে। চারিদিকটা কেমন সজ্জিত হয়ে ওঠে যেন। আর এ সময় আল্লাহর প্রকৃতির নিয়ামত মধু, এ ফুলগুলো থেকে মৌমাছিরা তৈরি করে। আমরা সে মধু খেয়ে উপকার পাই। আল্লাহর গুণগান গাই। আবার বেদানা, আপেল, কমলা, আঙ্গুর, আমলকী, কামরাঙ্গা, পেঁপে, কলা ইত্যাদি সুখাদ্য ফলের মৌসুম এই শীতকাল। এগুলো খেয়ে আমরা ভালো থাকি। রসনার তথা জিহ¦াকে তৃপ্ত করি।
শীতকালের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো খেজুর রস। এটি একটি মিষ্টি উপাদেয় পানীয় হিসেবে এদেশে বেশ জনপ্রিয়। ভোরবেলায় ঠান্ডা খেজুর রস খেয়ে কাঁপতে কাঁপতে মিষ্টি রোদে দাঁড়িয়ে রোদ পোহাতে সবার ভালো লাগে। তবে এ রস খেতে সতর্ক থাকবে সবাই। কারণ গাছিদের এ রস সংগ্রহ স্বাস্থ্যসম্মত নয়। বাদুড়সহ নানা পাখি সেগুলোতে মুখ ঢুকিয়ে জীবাণু প্রবেশ করায়। যা খেয়ে আমাদের মারাত্মক অসুখ-বিসুখ হতে পারে। বিশেষ করে নিপা ভাইরাসের কারণে প্রতি বছর এ রস খেয়ে অনেক মানুষ মারা যায়। কাজেই নিজেদের খেজুর গাছ থাকলে এ রস স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে সংগ্রহ করে খাবে। বন্ধুদেরকে দেবে। যারা গ্রামে থাকে তারা এটা করতে পারবে কিন্তু যারা শহরে থাকে তাদের জন্য এটা কষ্টকর। তবে খেজুর গুড় ও এর পায়েসের স্বাদ শহুরে বন্ধুরা নিতে ভুল করবে না। তাহলে শীতের মজাটা বোঝা যাবে না।
আমার আলোকিত বন্ধুরা, তোমরা অনেকে শীতের ছুটি কাটাতে এবং শীতের নানান পিঠা খেতে গ্রামে যাও আবার কেউ গ্রাম থেকে শহরে বেড়াতে আস পিঠার পুঁটলি বেঁধে বন্ধুদের দিতে- এটা আমাদের এ দেশের বহু দিনের রীতি। নানা রকম পিঠা পুলির গন্ধে বাড়িঘর মৌ মৌ করে। আমি আগেই বলেছি কিছুদিন আগেই হেমন্ত বিদায় নিলো। এখন মাঠ ভরা ধান নেই এখন গোলা ভরা ডোল ভরা ধান। আর এ নতুন ধানেই পিঠা পুলি তৈরি করে গ্রাম্য বধূরা। ভাপা পিঠা, চিতাই পিঠা, কুশলি পিঠা, পাটিসাপটা, দুধপিঠা, খোলা পিঠা, তেলের পিঠা, কন্যাভোগ, শাশুড়িভোগ, মেরা পিঠাসহ কত রকম পিঠা যে এ শীতে তৈরি হয় তার হিসাব নেই।
শীতের সময় তাজা রঙিন শাকসবজিতে মাঠ ঘাট, বাড়ির আশপাশ রঙিন হয়ে ওঠে। রঙিন হয়ে ওঠে আমাদের জিব। শরীর হয়ে ওঠে সতেজ এবং মসৃণ। আর্দ্রতার অভাবে শরীরে যে রুক্ষতা আসে রঙিন এসব সবজি প্রচুর পরিমাণে খেলে রুক্ষতাকে পরাজিত করা যায় সহজেই। তা ছাড়া নানা রোগব্যাধি থেকে দেহকে সুরক্ষা করা যায়। শিম, লাউ, মুলা, গাজর, পেঁপে, আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শালগম, লালশাক, পালংশাক, বেগুন, টমেটো, ধনিয়াপাতা, সরিষা শাক, মটরশাক, খেসারি শাক, বরবটি ইত্যাদি শীতকালীন সবজিতে ছেয়ে যায় আশপাশ বাজার ঘাট।
আমাদের দেশের সব ঋতুতেই কমবেশি অতিথি পাখি আসে। তবে বেশি আসে এই শীতকালে। এরা আসে বাঁচার জন্য, থাকার জন্য নয়। এসব পাখি এসে শীতকালকে করে তোলে উপভোগ্য ও আনন্দময়। বাহারি এসব পাখির উড়ন্ত চলাফেরায় কারো কারো কাছে এ সময় মনে হতে পারে এ দেশটি পাখির দেশ। পাখিদের দেশ। এসব পাখি এ দেশের রামসাগর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চরকুকরিমুকরি, নিঝুমদ্বীপ, ফকিরহাট, চিতলমারী, বাগেরহাট, সিলেট ও ময়মনসিংহের হাওরসহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিল ঝিল দিঘিতে এসে কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত করে তোলে। এদের মধ্যে বালি হ্যান্স, লাল চোখা, মৌলভীহ্যান্স, কালিহ্যান্স, কোরাজহ্যান্স, পিয়ং হ্যান্স, লালশীর, লেনজা হ্যান্স, নীলথ্রাস, মদনটেক, জলমুরগী, কাদাখোঁচা শামুক ভাঙা অন্যতম।
জ্ঞান সমুদ্রের ডুবুরিরা, আমি আগেই বলেছি শীত আমার প্রিয় ঋতু। ভালো লাগার সময়। কিন্তু প্রিয় এ ঋতুতে যা কিছু দৃশ্যমান যা কিছু উপভোগ্য ও আনন্দময় তার প্রায় সবগুলোই কমতে শুরু করেছে। আবার যা কিছু পাচ্ছি সেগুলোতেই রয়েছে জীবনকেন্দ্রিক নানা হুমকি। একটু বুঝিয়ে বলি- এই যেমন ধর এই শীতকালটা সময়ের দিক থেকে কমে আসছে। গরম কালের সময় বৃদ্ধি পাচ্ছে। শীতকাল এখন আসতে আসতেই যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত এ পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও নানা পরিবেশ দূষণের কারণেই এমনটি ঘটছে।
অপরিমিত গাছপালা কেটে, ইটের ভাটায় পুড়িয়ে একদিকে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, অন্য দিকে গাছপালার সংখ্যা কমছে। ইটের ভাটায় সব চাইতে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে খেজুর গাছ। ফলে এ গাছের সংখ্যা কমায় আগের মতো আর খেজুর রস পাওয়া যায় না। গাছিদের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। তাদের জীবনজীবিকা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। খেজুরের গুড় আর খেজুর গুড় নাইÑ হয়ে যাচ্ছে চিনির গুড়। এতে শুধু আছে খেজুর গুড়ের গন্ধ। ফলে খেজুর গুড়ের পায়েসের স্বাদও আর আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না।
টাটকা রঙিন শাকসবজি ও রঙিন ফলমূল যা পাওয়া যায় সেগুলোও বিভিন্ন রাসায়নিক যেমন ইনসেকটিসাইড, পেস্টিসাইড, ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও ফরমালিনে ভরা। সেগুলো খেতেও প্রাণটা চমকে ওঠে। একটি ছড়া শোন-
ফল পাকাতে ফল ধরাতে দিচ্ছে শুধু গরল
ইচ্ছা মত খাচ্ছে এ ফল কঠিন এবং তরল।
ফলের সাথে গরল খেয়ে
ক্যান্সারে প্রাণ যাচ্ছে ছেয়ে
ধুঁকে ধুঁকে মরছে মানুষ মরছে গায়ের মোড়ল।

মানুষের শান্তি স্বস্তি কমে আসায় শীতের পিঠাপুলির সংখ্যাও কমে আসছে। অতিথি পাখির সংখ্যাও দিন দিন কমে আসছে। কারণ এগুলোকে আমরা অমানুষের মতো যখন তখন গুলি করে বা ফাঁদ পেতে মেরে সাবাড় করে আহার করছি। পাখি শিকারজীবীর সংখ্যা দুই হাজার। সেটি ক্রমাগত বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। ফলে অতিথি পাখিগুলো খুঁজতে শুরু করছে নিরাপদ নতুন আবাসভূমি। ফলে অতিথি পাখির সংখ্যা কমে গিয়ে পরিবেশের ওপর পড়তে শুরু করেছে ক্ষতিকর প্রভাব, যা আমাদের বেঁচে থাকাকে করবে অশিল্পিত।
অন্য দিকে শীতের সময় খাল বিলের পানি কমে যায়। তাই মাছশিকারের ধুম পড়ে যায় এ সময়। কোথাও কোথাও একেবারে পানি শুকিয়ে শূন্য করে মাছ মারা হয়। পুকুর ডোবা, বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড়, নদ-নদী নালা কোনটাই এর বাইরে নয়। ফলে আমরা লক্ষ্য করছি মাছের প্রজাতির সংখ্যা দিন দিন কমছে। স্বাদু পানির জলাশয়গুলোতে ২৬০ প্রজাতির মাছের কথা বলা হলেও আসলে তা নেই। আমি নিজে একটি বিলের ওপর এক বছর কাজ করে মাত্র ৬৪ প্রজাতির মাছ পেয়েছি। তাহলে অন্য মাছগুলো কোথায় গেল? কাজেই ক্রমাগত অতি আহরণ করার ফলে দেশীয় মাছের সংখ্যা কমে গিয়ে আমাদের বেঁচে থাকা এবং পরিবেশের স্থির থাকাকে করেছে উদ্বিগ্ন। এই অতি আহরণে শামুক ঝিনুক থেকে শুরু করে কোন অর্থনৈতিক জলজপ্রাণীই আর নিরাপদ নয়। ফলে জীববৈচিত্র্যের ওপর আসছে বড় ধরনের আঘাত। যার ফলাফল পরিশেষে আমাদেরকেই ভোগ করতে হবে। যে কারণে লেখাটির শুরুতেই দু’টি কুরআনের আয়াত দিয়ে শুরু করেছিলাম। আসলে পৃথিবীতে সকল কিছুই পরিমিত পরিমাপে মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন কিন্তু আমরা মানুষেরাই সেগুলোকে পরিমিত পরিমাপে না ব্যবহার করে অতিমাত্রায় ব্যবহার ও নানা দূষণ ও অনিয়ম করে পৃথিবীকে করে তুলছি অস্থিতিশীল, যা আসলে আমাদের দুই হাতের কামাই। এ কামাই তোমাদের দিক থেকে যেন বন্ধ হয় সে ব্যাপারে আন্তরিক থাকবে। তবেই আমরা শীতকালকে শীতকালের মতই পাবো, ভোগ করতে পারবো। প্রিয় ঋতুর স্বাদ নিতে পারবো। পরিশেষে তোমাদের জন্য একটি ছড়া লিখে শেষ করছি-
“গাছ কম গাছি কম, রস কম কম
হয়নাতো পিঠা পুলি, নয় চম চম।
ফল মূল সবজিতে, বিষ ভরা বিষ
এই বিষ খেয়ে দেয়ে, করি হিস ফিস।
গুলি আর পাতা ফাঁদে, কাঁদে পাখি মন,
যারা আছে ভালো নেই, কাটছে না ক্ষণ।
পরিযায়ী পাখি তাই, আসছেই কম কম
ভয় পেয়ে পাখিদের, গাও করে ছম ছম।
বিল ভরা মাছ নেই, বিল মাছ শূন্য
মাছে ভাতে বাঙালি, এই কথা ক্ষুণœ।
মাছ আছে চাষ করা, স্বাদ তার নাই
চাষ ছাড়া বিল ঝিলে, মাছগুলো চাই।
এই দশা শীতকালে, চাইনাতো কেউ
দেখতে চাই সব খাঁটি সবুজের ঢেউ।”
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ