শীতের লাল জামা     -তমসুর হোসেন

শীতের লাল জামা -তমসুর হোসেন

গল্প জানুয়ারি ২০১৭

সিয়ামদের নতুন ভিটেয় দারুণ বেগুনের আবাদ হয়েছে। বাবা সবজির আবাদে খুব পারদর্শী। মওসুমি ফসলের সাথে সহযোগী সবজির চাষ করে বাবা জেলায় প্রথম হয়েছেন। আষাঢ়ে বন্যা হওয়ায় বাবা বুঝতে পেরেছেন শীতে সবজির ক্রাইসিস হবে। সে জন্য তিনি ভাদ্রের মাঝামাঝি থেকে বেগুনের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। সেডের ভেতর বেগুনের কোমল চারা মাতিয়ে তোলা বেশ কষ্টকর। বৃষ্টির আঘাত থেকে চারাগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে হয়। অন্য দিকে রোদের মসৃণ আলোয় তাদের বৃদ্ধিকে রাখতে হয় অব্যাহত। পচা গোবরের সাথে রাসায়নিক সার মিশিয়ে তিনি নমনীয় চারার গোড়ায় ঝুরঝুর করে ছিটিয়ে দেন। একদিকে চারা বাড়িয়ে তোলা, অন্যদিকে জো বুঝে চাষবাস চালানো খুবই কঠিন বিষয়। এসব করে বাবা যে বেগুন লাগালেন অঘ্রাণে ঝাঁকালো ডালপালায় তা ক্ষেত ভরিয়ে তুলেছে। গাছে বেগুন ধরেছে প্রচুর। বাজারে বেগুনের বেশ চাহিদা। বেগুন নিয়ে বাজারে যেতে হয় না। সবজির দোকানদাররা বস্তা বোঝাই করে বেগুন নিয়ে যায়।
সারাদিন সিয়াম বাবার পিছু পিছু থাকে। সকালে বাবা যখন জমিতে আসার জন্য তৎপর হয় তখন সেও জামা পরে তৈরি হয়। সাইকেলে চড়ে গল্প করে বেগুন ক্ষেতের দিকে আসে। সিয়ামের মুখে গল্পের খৈ ফোটে। রাতে মা ভাপাপুলি তেলপিঠা তৈরি করেছে। পায়েস খৈ-মুড়ি খেয়ে খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলেছে সিয়াম। মা জানে মনে পড়লে সিয়াম পিঠার বায়না ধরবে। সে জন্য টিফিন বক্সে করে মা পিঠে দিয়েছে। বেলা বাড়লে টঙঘরে বসে সে মজা করে পিঠা খেয়ে গুন গুন গান গায়। টুনটুনির সাথে তাল দিয়ে গান গেতে তার মন্দ লাগে না। গোলপাতার ফাঁকে পুষ্ট কালচে বেগুন আর খয়েরি ফুল ওর মনে খুশির জোয়ার এনেছে। কখন থেকে একটি ছেলে তার পাশে দাঁড়িয়ে আপনমনে গান শুনছে সিয়াম টেরই পায়নি। ছেলেটি দেখতে দুর্বল কিন্তু চেহারায় লাবণ্য আছে। দুটো চোখে তার হৃদয়কাড়া মায়ার চপলতা। অপলক চোখে দেখছে ছেলেটি। পরনে সাদা গেঞ্জি আর সবুজ প্যান্ট। পুরনো হলেও পোশাক বেশ পরিচ্ছন্ন। সিয়াম তাকে কাছে ডেকে নেয়। চেহারায় সংকোচ নিয়ে কাছে আসে ছেলেটি। কিন্তু টঙঘরের চৌকিতে বসতে চায় না। সিয়াম তাকে হাত ধরে কাছে বসায়। টিফিন বক্স থেকে পিঠা বের করে ওকে খেতে দেয়। বড় লজ্জা ছেলেটির। একদম খেতে চায় না। সাম্য মৌন ছবিতে গভীর দুঃখ মাখা। যা অবলোকন করে সিয়ামের মন বেদনায় ভরে যায়। সিয়াম ওকে বলে,
‘পিঠা খাও। লজ্জা করছো কেন? মা বানিয়েছে।’
‘আমার মাও পিঠা বানাবে।’
‘বানালে ডাকবে আমাকে। খেয়ে দেখো। খুব মজা লাগবে।’
‘খাবো না। মা রাগবে। তুমি খাও।’
‘আমার মায়ের বানানো পিঠা খেতে মানা?’
‘অন্যের জিনিস খেলে মা রাগ করে।’
‘আমি বুঝি পর? আমাকে বন্ধু করে নাও তুমি।’
‘ঠিক বলেছো? তাহলে আজ থেকে তুমি বন্ধু হলে।’

দু’জনে মিলে মজা করে পিঠা খায়। বেগুন খেতের পাশেই শান্তর বাড়ি। মেহেদি কাঁটাঘেরা টিনের বাড়িতে দাদী আর মায়ের সাথে থাকে শান্ত। গুবাক তরু আর চিরল পাতার নারকেলের ছায়ায় বাড়িখানা উজ্জ্বল হয়ে থাকে। শান্তর বাবা দূরের শহরে চাকরি করেন। বাবার অল্প আয়ে তাদের সংসার চলে। বাড়িতে সামান্য জমি আছে। তাতে আবাদ হয়। তার সাথে বাবার পাঠানো টাকায় দিন কেটে যায়। সিয়ামদের ভেষজ গাছপালা আর ফলের বাগান আছে। সেখানে ফল ফুলের সমারোহ। পাখি আর প্রজাপতির মেলা বসে সেখানে। শান্তকে পেয়ে ভালোই হলো। প্রজাপতির পেছনে ঘুরে ফুর্তিতে সময় কাটতে লাগলো। শান্ত ওকে বাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়ির পেছনে ছোট্ট পুকুর। টলটলে পানিতে মাছেরা ঘাঁই দেয়। পুকুরের পাড় দিয়ে পুষ্ট গুবাক গাছে ছাঁচি পান ঝুলে আছে। বহেরা আমলকী গাছে ঝুমঝুম ফল ধরে আছে। শান্তর মা সিয়ামকে দেখে খুশি হয়। মলা মুড়কি খৈ খেতে দেয় ওকে। শান্তর একটা কাঠের ঘোড়া আছে। দড়ি ধরে টানলে কী সুন্দর শব্দ করে হাঁটে। ঘোড়াটার পিঠে চড়ে একজনে ঠেলতে হয়। শান্ত বলে, যারে যা ঘোড়া জামপাতায় মোড়া, যদি না যাস পা করবো খোঁড়া। শান্তর সাথে সিয়ামও বলে। সিয়ামদের ভেষজ বাগানে বুলবুলি বাসা করেছে। লালমুখো বুলবুলিটা তিনটে ডিম দিয়েছে। ওরা বুদ্ধি করেছে বুলবুলির বাচ্চাকে কথা শেখাবে। সিয়ামের কাক্কু পাখিদের কথা শেখাতে পারে। শান্তর সাথে সখ্য করে তার খুব ভালো লাগছে। ওরা গরিব হলেও সংসারে সচ্ছলতা আছে। অল্প জিনিসকে ওরা গুছিয়ে মনোরম করে তুলতে পারে। ভেতর আঙিনায় ফুটে থাকা গন্ধরাজের সুগন্ধ সিয়ামের মনকে পাগল করে তোলে। সে শান্তর সাথে আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। বাড়ি ছেড়ে ধানক্ষেত। ধানক্ষেত পেছনে ফেলে বিলের ধারে বেদেপল্লী। সেখানে সাপখেলা আর বাঁশির সুরে বাড়ি ফেরার কথা ভুলে যায় তারা। বেদের ছেলেমেয়েরা বিলে মাছ ধরে। শালুক তুলে নাড়ায় পুড়ে খায়। সিয়াম শান্ত ওদের সাথে শালুকপোড়া খায়। সিয়ামকে খুঁজতে বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কোথায় গেলো সিয়াম। খুঁজে খুঁজে বাবা ওদের দেখা পান। বাড়ি ফেরার নাম নেই। আত্মভোলা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আবাদ ভালো হওয়ায় বাবার মনে অনেক আনন্দ। সবার জন্য গরম কাপড় কিনবে বাবা। সবার বায়না জানছে কাজের ফাঁকে। মা একটা উলেন সোয়েটার নেবে। কাক্কু নেবে জিন্সের জ্যাকেট। দাদীর গ্রামীণ শাল হলেই চলবে। সিয়াম কিছুই বায়না করছে না। সিয়াম আগেই শোরগোল বাধিয়ে ফেলে। কিন্তু এবার সে তেমন করছে না কেন? নিশ্চয় একটা কারণ আছে। হয়ত ওর বেশি কিছু চাওয়ার আছে। ক’দিন থেকে একটা নতুন ছেলের সাথে ও খেলাধুলা করে। একসাথে পিঠা খায়। পথ ভুলে অনেক দূরে চলে যায়। সিয়ামকে এতটা ঘনিষ্ঠ হতে দেখা যায়নি কারো সাথে । ছেলেটির সাথে খেলতে নিজকে ভুলে যায় সে। তবে কি ওর জন্য সিয়ামের কোনো চাওয়ার আছে। শান্তকে বাবা চেনে। ওরা দূর সম্পর্কের আত্মীয়। শান্তর মা বড় ভালো মেয়ে। এ তল্লাটে অমন মেয়ে আর হয় না। আগে ওদের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিলো। এখন আর তেমনটা নেই। সিয়ামের সাথে বন্ধুত্বের কারণে ওকে শীতের পোশাক কিনে দিতে চায় বাবা। তাহলে সিয়াম খুশি হবে। অমন গুণধর ছেলের সাথে মিশলে সিয়ামের একগুঁয়ে ভাবটা কেটে যাবে। সিয়ামকে কাছে ডেকে বাবা প্রশ্ন করে:
‘তোমার জন্য জামা কিনবো। কেমন জামা নেবে?’
‘আমার তো জামা আছে বাবা। আবার কিনবে কেন?’
‘ওটাতো পুরনো হয়ে গেছে। নতুন একটা নেবে না?’
‘ওটাতো নতুনই আছে বাবা। এটা দিয়ে চলুক না।’
‘কী বলে রে আমার ছেলে! সবাই নতুন কাপড় পরবে। তুমি নেবে না?’
‘তুমি বরং শান্তকে গরম জামা কিনে দাও। ওর শীতের জামা নেই।’
‘তা না হয় দেবো। তুমি না নিলে কেউ নেবে ভাবছো?’
‘তুমি দিলে আমি না নিয়ে পারবো?’
শান্তর মা সিয়ামকে বাড়ি নিয়ে যায়। শীতের পিঠা খাওয়াবে ওকে। গাছের গুঁড়িতে আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে দু’জনকে বসতে দেয় শান্তর দাদী। মা উনুনে তেল দিয়ে আপনমনে পিঠা ভাজছে। গরম গরম পিঠা খেয়ে ওরা দাদীর কাছে গল্প শুনছে। দারুণ গল্প বলতে পারেন দাদী। ‘একটা বাঘ কখনই শেয়ালের সাথে পেরে উঠতে পারে না। তাই বাঘ ভাবলো সে মরে যাওয়ার ভান করবে। সে বউকে বললো, সে যেন ভাগ্নে শেয়ালকে তার সৎকার করতে বলে। শেয়াল তার সৎকার করলে বুঝতে পারবে বাঘ তাকে বোকা বানিয়েছে। শেয়াল আর শেয়ালনী বাঘের কাছে এসে মায়াকান্না করলো। তারপর শেয়াল বললো, বাঘ তো এমন করে মারা যায় না। বাঘ মরলেও ওর লেজটা একটু একটু নড়ে। মামা যদি মরে থাকে তাহলে লেজটা নড়ার কথা। লেজ না নড়লে তো সৎকার করা যাবে না। লোকে বলবে বাঘ মরেনি সৎকার কিসের? এ কথা শুনে বাঘ মনে করলো হতেও পারে শেয়ালের কথা। সে তো আগে কোনো দিন মরেনি। তাই সে আস্তে আস্তে লেজ নড়াতে লাগলো। তখন শেয়ালের বুঝতে বাকি থাকলো না বাঘ কী ফন্দি করেছে। সে শেয়ালনীকে নিয়ে ভালোয় ভালোয় কেটে পড়লো।’ গল্প শুনতে অনেক রাত হয়ে গেলো। তবুও ঘুম আসে না সিয়ামের চোখে। নরম কুয়াশায় ভেজা চাঁদের জোছনা তাকে টেনে নিয়ে যায় মনুষ্য আকৃতির আদমসুরতের রাজ্যে। যেখানে এক বুড়ি অনন্তকাল ধরে সুতোর চরকা কাটে। গল্পের ঢেউয়ে ভেসে সে কথার সাগরে চলে যায়। যেখানে নির্জন সৈকতে ঝিনুকের নূপুর পরে মৎস্যকন্যারা নেচে বেড়ায়। আগুনের পাশে বসে মুরগির কলিজা দিয়ে ভাত খেয়ে ওরা ঘুমিয়ে পড়ে। এক ঘুমে রাত কেটে যায়। সকালে জেগে ওরা দেখে শীতের লাল জামা পরে রক্তিম সূর্যটা নারকেল গাছের শাখায় মিষ্টি করে হাসছে।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ