শেখদের শখ

শেখদের শখ

গল্প সেপ্টেম্বর ২০১৪

মতিন সৈকত

Shiekhরৌদ্রতপ্ত ঊষর মরুর ধূসর বুক চিরে মরুভূমির জাহাজ রাখসী ঊর্ধ্বশ্বাসে রকেটের গতিতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নেশায়। ময়দানের চার পাশে লাখ লাখ দর্শনার্থীর ভিড়। বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনায় সকলের চোখের তারা ঝিলিক মারছে। কার উট চ্যাম্পিয়ন হবে? কার গলায় বিজয়মালা ঝুলবে? একশত নির্বাচিত উট নানান সাজে বিচিত্র রঙে বিচিত্র ভঙ্গিতে নির্ধারিত সময়ে এই দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমেছে। রণদামামার কড়া আওয়াজে কান ঝালাপালা। নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিযোগী উটের মালিকেরা বসে উন্মাদনা আর উত্তেজনার স্নায়ুচাপে ভুগছেন। ঐতিহ্যের মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন বিলিয়ে দিতেও যেন প্রস্তুত। সময় সময় আল্লাহর কাছে মুনাজাত করছে। হে আল্লাহ, তুিম আজকের এই প্রতিযোগিতায় আমার ইজ্জত রক্ষা কর। আমার উট যেন ফার্স্ট হয়। আমার পরিশ্রম যেন সার্থক হয়, তুমি বিজয়ের মালা অন্তত এবার আমার জন্য বরাদ্দ কর। আনন্দ উৎসবের ঢল নেমেছে। ধনাঢ্য শেখেরা ভীষণ উৎফুল্ল। তাদের আয়োজন দেখার জন্য চারদিকে প্রচণ্ড ভিড়। হঠাৎ হুইসেল বেজে উঠল। উট ছুটছে তো ছুটছে। একটি অন্য টিকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে বিজয়ের নেশায় বিভোর হয়ে জ্ঞান শূন্যতার মতো। প্রতিটি উটের পিঠে একেকজন নিষ্পাপ নিরপরাধ মাসুম শিশু বসে ভীষণভাবে দুলছে। চার কি পাঁচ বছর বয়সী অসহায় সব শিশুরা ভীষণ ভয়ে মৃত্যুর মতো যন্ত্রণার কান্নার রোলে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে। শিশুদের আর্তনাদ এবং মুক্তি পাওয়ার চেষ্টায় হাত পা ছোড়াছুড়িতে উটগুলো ভয় পেয়ে ক্রমশ দ্রুত আরও দ্রুত ছুটছে। শিশুগুলো যেন পালাতে না পারে সে জন্য তাদেরকে বেঁধে রাখা হয়েছে। উটের পিঠের সাথে আঁটসাঁটভাবে। দুপুরের কড়া রোদে মরুভূমির মাটি কামারের হাঁপরের মতো যেন আগুনে পোড়ানো লাল লোহাটির মতো জ্বলন্ত হয়ে আছে। প্রতিযোগিতা তুমুল জমে উঠেছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি শিশুর কান্নার মাতম থেমে গেছে। জ্ঞান হারিয়ে উটের পিঠে লুটিয়ে পড়ছে। দূর হতেই ঠিক দেখা যায়। উটের ক্লান্তি নেই। সারা বছরের ট্রেনিং শেষে আজ এ প্রতিযোগিতায় ছুটছে তো ছুটছেই। জয়ী হতেই হবে। সবচেয়ে এগিয়ে আছে সম্রাট রাখসী। তার পিঠে বসে আছে বাংলাদেশের এক শিশু ফরিদ। ফরিদ ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অভাবী সংসারের সন্তান ফরিদ শৈশবে আব্বা-আম্মাকে হারিয়ে দূর সম্পর্কের ঢাকার এক মামার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল। মামা তাকে বেহুদা পোষতে নারাজ। পাঁচ বছর বয়সী শিশুকে দিয়ে কোন কাজ করানো যায় না তাই তিনি চিন্তিত। এমনি সময় সুযোগ এলো ফরিদকে বিক্রির। বিদেশে মানুষ বিক্রির এক দালাল জুটলো। এ প্রতারক একযুগ মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করে দেশে এসেছে। ঐ দেশে উটের দৌড় প্রতিযোগিতায় অবুঝ শিশু সাপ্লাই দিতে পারলে মোটা অঙ্কের টাকা কামাই করা যায়। আর এসব শিশু চতুরতায় সহজেই সংগ্রহ করা যায়, বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশ থেকে। দালালটি চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশে এসে শিশুপাচারে মন দিল। ভাব জমিয়ে তুলল কিছুসংখ্যক নি¤œবিত্তের পরিবারের সাথে। উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে ঘন ঘন তার যাতায়াত। দুর্গত লোকদের মধ্যেও তার আনোগোনা। শেষে একদিন খবর পেলো ফরিদের। ফরিদের পাতানো মামার সাথে দেখা করে নগদ পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে ক্রয় করে নেয়। মামা কোমল অবুঝ ফরিদকে বুঝিয়েছেÑ সে সুন্দর জায়গায় যাবে, মজার মজার খাবার খাবে, আরামে থাকবে। দালাল এক সপ্তাহ এখানে থেকে ফরিদের সাথে বিভিন্ন প্রলোভনের মাধ্যমে এটা সেটা কিনে দেয়ার মাধ্যমে সখ্য গড়ে তুলল। দু’জনের ভালোবাসার চমৎকার সম্পর্ক। এরই মধ্যে ফরিদ তার দালাল মামাকে বেশ আপন লোক হিসেবে জেনে নিয়েছে। দালাল ফরিদকে তার সন্তান পরিচয় দিয়ে ভিসা পাসপোর্ট করে ফরিদকে নিয়ে আরব আমিরাতে পৌঁছে গেল। তারপর অনেক টাকার বিনিময়ে ফরিদকে বিক্রি করে সে কেটে পড়ে। পাঁচ বছর বয়সের অবুঝ ফরিদদের কান্নায় চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। তার ওজন কম রাখার জন্য তার মালিক খাবার কমিয়ে তাকে শুকাতে শুরু করল। আঁধার ঘরে মাসের পর মাস কাটানোর পর আজ এল সেই নির্দিষ্ট কুখ্যাত শেখদের বর্বরোচিত উটের দৌড় প্রতিযোগিতার সকাল। ফরিদ অনেক পরে বুঝতে পারল তার মামা এবং দালালের সম্পর্কটা। আম্মার জন্য আব্বার জন্য, দেশের জন্য, মামার জন্য তার এ অবস্থার জন্য খুব কষ্ট হয়। অবাধ্য পশুর মতো ফরিদ মুক্তি চায়। কিন্তু কোনো পথ নেই, আজ সে উটের ওপর উঠে দেখতে পেল তার মতো অনেক শিশু কান্নার রোল তুলেছে। সেও ডুকরে কাঁদেেছ কিন্তু উপায় নেই। তথাকথিত শেখদের শখ মেটাতে তারা মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে। প্রতিযোগিতা শুরু হলো। প্রত্যেকটি শিশুকে উপোস রেখে শারীরিক নির্যাতন করে অসুস্থ করে তুললো। রাখসী সব ক’টিকে অতিক্রম করে ছুটছে। বিজয়ের নির্দিষ্ট সীমারেখায় পৌঁছাতেই মরণ চিৎকার দিতে দিতে ফরিদ রাখসীর ওপর থেকে জ্ঞান হারিয়ে রশি পিছলিয়ে পড়ে গেছে মরুর তপ্ত বালুরাশিতে। পেছনে তীব্র বেগে ছুটে আসা আরেকটি উটের তীক্ষè ক্ষুরের চরম আঘাতে মাসুম কোমল অবুঝ ফরিদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। ‘রাখসী’ চ্যাম্পিয়ন হলো, বিপুল করতালি আর উল্লাসে পুুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান জমে উঠল। রাখসীর গলায় ফুলের মালা। রাখসীর মালিকের বিজয় জুটল। রাখসীর মালিক শেখ সাহেবের দুরস্ত শখ মিটল। উটের পিঠের কোন শিশুরই বাঁধন কাটা হলো না। রাখসীকে নিয়ে বিজয় উল্লাসে তার কর্তৃপক্ষ ছুটে চললো। ফরিদের কথা কেউ মনে করেনি। কোন ফাঁকে রাখসী ছুটে গেল ফরিদের কাছে। সেখানে পৌঁছেই সে তার উঁচু মাথা নিচু করে ফরিদকে জিভ দিয়ে চাটতে লাগল। টপটপ করে কয়েক ফোঁটা পানি চোখ দিয়ে বেরিয়ে এলো রাখসীর। অসহায় নিষ্পাপ ফরিদের অকাল মৃত্যুতে সে ভীষণ ক্ষেপে গেল। তার মালিক শেখসহ উপস্থিত সকলকে তাড়িয়ে নিতে লাগল। রাখসী তার অবলা ভাষা আর উত্তেজিত আক্রোশে প্রতিবাদ জানাল উটের দৌড় প্রতিযোগিতায় আর যেন কোনো অবোধ শিশুর ব্যবহার না করা হয়। এ মুহূর্তে এরূপ পাষণ্ড শেখদেরকে পায়ের তলায় পিষে মারতে তার ইচ্ছে করছে। সে ফরিদের পাশে দাঁড়িয়ে বিজয়ের প্রাপ্য সমস্ত উপঢৌকন সে ফরিদের জন্য যেন সঁপে দিতে চায়। বিলাসপ্রবণ শেখদের অমার্জনীয় উল্লাসের সকল কলুষস্মৃতি আজ তার পশুজীবনেও বইতে পারছে না যেন। সে মনে মনে ভাবে আমরা তো পশু হয়ে মানুষের কাছে অসহায়। আর মানুষ মানুষের কাছে কত অসহায় হয়ে যায়।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ