শেষ বিকেল   -ইব্রাহীম বিন রশীদ

শেষ বিকেল -ইব্রাহীম বিন রশীদ

তোমাদের গল্প জানুয়ারি ২০১৬

শীতের শেষ বিকেলে কোকিলের কুহুকুহু তানে বসন্তের আগমন। চারদিকে ফুলের সুঘ্রাণ আর পাখিদের গান। গাছের ডালপালায় সবুজের ছড়াছড়ি। এরকমই বাংলার ছয় ঋতুর পালাবদলের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে পাভেল। বাবা শফিক আহমেদ। অনেক টাকা পয়সার মালিক। ঢাকায় চারতলা বাড়ি আছে। তখন পাভেল তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র।
পাভেলের মা ছিলেন দুনিয়ার সব মায়ের চেয়ে যেনো একটু আলাদা। নিজে প্রতিদিন কুরআন-হাদিস পড়তেন। আর রাতে পাভেলের লেখাপড়া শেষ হলে বিভিন্ন নবী-রাসূলসহ সাহাবাদের গল্প শোনাতেন। সেই হযরত ওমর, হানজালা, খাব্বাব ও মুয়াজ রা:-এর সত্যের বাণী শুনাতেন। অনেক সময় পাভেলের অবুঝ মনে ভাবতো, আমার মা এতো ভালো কেন? যদি ক্ষণিক বাইরে থাকি, তাহলে কেন চিন্তায় এত অস্থির হয়ে পড়েন। এভাবে প্রায় সময়ই পাভেল নিজের কথা নিজের সাথে বলতো। ওর মা যেমন হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন, পাভেলও ওর মাকে ভীষণ ভালোবাসে। মা-বাবা এবং পাভেলকে নিয়ে তাদের ছোট্ট সংসার। পাভেলের বাবা বড় একজন ব্যবসায়ী। হাসি-খুশি আর সুখে ভরা ছিল যেনো তাদের সংসার। কিন্তু খোদার দেয়া এই রহমতের সংসারে নেমে এলো তিমির রাতের হাতছানি।
একদিন পাভেল ও তার মা স্কুল থেকে রিকশা করে ফিরছিলেন। এমন সময় পেছন থেকে একটি ট্রাক তাদের রিকশাটা ধাক্কা দেয়। পাভেলকে বাঁচাতে গিয়ে তার মায়ের আর শেষ রক্ষা হলো না। তার মা ঐ ট্রাকের নিচে পড়লেন। সাথে সাথে এই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে গেলেন পরপারে। তখন আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যায় পাভেলের কান্নায়। তিনজনের সংসারে এখন দু’জনের বসবাস।
সেই থেকে তার বাবা ঢাকার বাড়ি, জমি বিক্রি করে গ্রামে চলে আসেন। স্থায়ীভাবে পাভেল ও তার বাবা গ্রামে বসবাস শুরু করেন। গ্রামের পাশে বাজারে তার বাবা একটি বড় মুদি দোকান দেন। আর সেই থেকে পাভেলের প্রায় একাকী জীবনের সূচনা। গ্রামের অনেক মুরব্বিদের অনুরোধে এবং ছেলের কথা চিন্তা করে তার বাবা শফিক আহমেদ আর একটি বিয়ে করেন। প্রথম প্রথম তার সৎমা তাকে খুব আদর করতেন। বছরখানেক যাওয়ার পর পাভেলের একটি সৎভাই দুনিয়ায় আসে। সে থেকেই পাভেলকে তার সৎমা হাতে আঘাত না করলেও কথার ছুরি দ্বারা আঘাত করেন। তখন অবুঝ মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। অবুঝ মনে সে কি অব্যক্ত যন্ত্রণা, তা পাভেল ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ অনুভব করতে পারে না। বাবা জিজ্ঞেস করলে সৎমায়ের ভয়ে কিছু বলত না। একদিন বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি এসে হালকা কিছু ভাত খেয়ে চলে যায় নদীর কিনারে। ক্লাসে স্যার একটা অঙ্ক সামান্য ভুল হওয়ার জন্য প্রহার করেছেন। মা নেই, সৎমায়ের বঞ্চনা-গঞ্জনা, সব মিলে আজ পাভেলের মনে ভীষণ কষ্ট। তার মায়ের কথা আজ খুব বেশি মনে পড়ছে। সেই হাসি খুশি দিনগুলোর কথা মনে পড়তেই পাভেলের আঁখিজলে বুক ভেসে যায়। শ্রাবণের বারিধারা দু’চোখ দিয়ে প্রবাহিত হয়। নিজেকে ভীষণ একা অসহায় মনে হয়। নদীর তীরে পা দু’টি ঝুলিয়ে বসে থাকে পাভেল। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য হেলে পড়ছে। শেষ বিকেলে সূর্যের বিদায়লগ্নে শত কষ্ট নিয়ে বসে আছে পাভেল। নিবিড়ভাবে দেখছে লাল সূর্যটা কিভাবে বিদায় নিচ্ছে। সূর্যের লাল রঙে ছেয়ে গেল নদীর বুক। পানিগুলোকে মনে হয় রক্তের তরঙ্গ। কিছুক্ষণের মধ্যে পৃথিবীর বুকে নেমে এলো তিমির রাত। সন্ধ্যা নেমে এলো, রাতের আঁধারে চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। বাড়ির দিকে রওনা দিল পাভেল। পথে অন্ধকারে না দেখে একটা বিষাক্ত সাপের গায়ে পা দিতেই সাপটি দংশন করল পাভেলকে। পাভেল ভীষণ যন্ত্রণায় রাস্তায় ওপর শুয়ে পড়ে। যন্ত্রণায় ছটফট করে। এই তিমির রাতে তার কান্না কেউ শুনলো না। আস্তে আস্তে সমস্ত শরীর বিষে ছেয়ে গেল। পরম শান্তির নিদ্রায় ঢলে পড়লো পাভেল। শেষ বিকেলের বিদায় শেষে তিমির রাতে দখিনা হিম বাতাসে উড়ে গেল প্রাণপাখি। চলে গেল দূরে, বহু দূরে। সেথায় নেই কোন বেদনার হাহাকার, জীবন চলার পথে শত ব্যস্ততা। সেখানে শুধু আছে পরম সুখের নিঁদ আর নীরবতা।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ