সকাল বেলার পাখির কথা

সকাল বেলার পাখির কথা

স্মরণ মে ২০১৩

সকাল বেলার পাখির কথা জাকির আবু জাফর

প্রথম যেদিন কবিতাটি পড়লাম, আমার ভেতরে এক ধরনের আশ্চর্য আবেগ পাখা মেললো। আমি অন্যরকম হয়ে ভাবতে থাকি। আর মুখে আওড়ায়Ñ আমি হবো সকালবেলার পাখি/সবার আগে কুসুম বাগে/উঠবো আমি ডাকি। কী আশ্চর্য! আমিই পাখি হয়ে যাবো! পাখি হবার ইচ্ছে এভাবে কবিতার ভেতর শুনতে পাবো ভাবিনি। অথচ তাই যেনো পাখা মেললো কবিতার ভেতর। আমি কবিতাটি পড়লামÑ আমি হবো সকাল বেলার পাখি সবার আগে কুসুম বাগে উঠবো আমি ডাকি। সূর্যি মামা জাগার আগে উঠবো আমি জেগে হয়নি সকাল ঘুমো এখন মা বলবেন রেগে। বলবো আমি আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাকো হয়নি সকাল তাই বলে কি সকাল হবে নাকো। আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে। বারবার পড়লাম। যতবার পড়ি ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে। তখন আর বয়স কত! কিশোর কাল আমার। কিশোরকালে নানা রকম স্বপ্ন মনের আকাশে ডানা ঝাপটাতো। সেই স্বপ্নের জগতে কবিতাটি আমাকে অভিভূত করে তুললো। আমি ক্রমাগত পড়তে থাকলাম। পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে গেলো। তারপর একদম কণ্ঠস্থ। সেই যে স্মৃতিতে কবিতাটি ঠাঁই নিলো আজো সে একেবারে জীবন্ত। একেবারে টাটকা। কতবার যে জীবনে পড়েছি কবিতাটি তার হিসেব নেই। আমার কৈশোর কেটেছে যে গ্রামে সে গ্রামটি ছিলো বাংলাদেশের প্রায় দক্ষিণ সীমানা। দক্ষিণ সীমানা বলছি কারণ আমাদের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। ফেনী নদীর পাড়ে আমাদের গ্রামটি। যদিও সেই গ্রাম আর আগের মতো নেই। ফেনী নদীই খেয়ে ফেলেছে গ্রামের একটি বিরাট অংশ। সে যাই হোক, এমন গ্রামে আমার জন্ম যেখানে পাখির ডাকে আমার সকাল হতো। ঘুম ভাঙতো পাখির গানে। আবার সন্ধ্যা হতো সেই পাখিরই কলরবে। পাখির কলকাকলি আমার ভেতর এমনভাবে প্রবেশ করেছে যে একসময় আমি পাখিদের সাথে থাকার পরিকল্পনাই করে ফেললাম। পাখিরা থাকে তো গাছের ডালে। আমি কি আর ডালে থাকতে পারি! তাহলে উপায়? উপায় একটা আছে- গাছের নিচে তো থাকতেই পারি। পাখির সাথে থাকার জন্য কতদিন আমি গাছের নিচে বনের ভেতর কাটিয়েছি তার কোনো হিসেব নেই। যে কারণে আমার খেলার সাথীরা আমাকে মানুষপাখি বলে ডাকতে শুরু করলো। শুধু পাখি নয় ফুল, বৃক্ষ, নদী এসব আমার অস্তিত্বের সাথে গেঁথে গেছে সেই কৈশোরেই। যখন ‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি’ পড়লাম পাঠ্য বইতেই, আমার সে কী আনন্দ! আমি ভাবলাম মনে হয় পাখি হওয়া সম্ভব। তখন আমার একটা ধারণা ছিলো কবিতা কোনো মানুষ লেখে না। পাখি হবার স্বপ্নের মতো কবিতাও আমার কাছে এক ধরনের স্বপ্ন ছিলো। ফলে যে কবিতাই পড়তাম যদি ভালো লেগে যেতো তা-ই মুখস্থ করে নিতাম। কাজী নজরুল ইসলামের নাম আমি প্রথম কবে শুনেছি আজ আর মনে নেই। তবে কবিতাটি পড়তে গিয়েই তাঁর নামটি চিরদিনের জন্য আমার হয়ে গেলো। নজরুল আমাদের জাতীয় কবিÑ এ কথার গুরুত্ব অতটা বোঝার বয়স আমার তখনো হয়নি। কিন্তু নজরুল যেই হোন সে যে আমার স্বপ্নের মানুষ এ কথা আমার ভেতর গেঁথে গেলো। আমি কবিতাটি পড়ি আর নজরুলকে ভাবি। আমার ভাবনার ভেতর নজরুল এতটা শিকড় গেড়ে বসল যে নজরুলকে আমি ভুলতেই পারছিলাম না। কবিতা পড়ার একটা ঢঙ আছে। গানের ঢঙ ভিন্ন। আমি এই কবিতাটি গানের মতো করে গাইতে থাকলাম। গাইছিÑ আমি হবো সকাল বেলার পাখি,... সেই বৃক্ষের তলে যার ডালে বসে ডাকছে নানা রকম পাখিরা। আমার ভীষণ আনন্দ হলো। আনন্দে উদ্বেলিত আমি। আপ্লুত। বনে বনে ফিরে একটি কবিতাকে গান করে তোলার আনন্দ আমি এখন কোথায় পাবো?

নজরুলের প্রতি সেই আগ্রহ আমাকে আজো তাড়িয়ে বেড়ায়। সে দিন নজরুলকে একেবারে না জেনে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। তারপর জেনে সেই বিস্ময় আরো বেড়েছে। আরো রহস্যময় হয়ে উঠেছে নজরুল। নজরুলের বিষয়ে এ রহস্য হয়তো অনেক কিশোরের মনেই দানা বেঁধে থাকে। বড় হয়ে সে রহস্যের কিছুটা কূলকিনারা করে সবাই। আমিও করেছি। আমি জেনেছি নজরুল বিদ্রোহী কবি। তাঁর বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হবার পর গোটা ভারত উপমহাদেশে হৈ চৈ বেঁধে গেলো। বিদ্রোহী কবিতাকে ঘিরে শত শত আসর জমে গেলো। একজন পড়েন। বাকিরা শোনেন। শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। যে পড়েন তিনি বিস্মিত। যিনি শোনেন তিনিও বিস্ময়ে হা হয়ে যান। এমন কবিতা তো এর আগে কেউ লেখেননি। কেউ এমন উচ্চারণ করার সাহস করেননি। এক কবিতা লিখেই নজরুল রাতারাতি বিখ্যাত। নজরুল হয়ে গেলেন লক্ষ লক্ষ মানুষের নয়নমণি। অজস্র মানুষের প্রিয়পাত্র। নজরুলকে জানতে গিয়েও বিস্ময় কম জাগেনি। ছোটবেলায় পিতাকে হারিয়ে একরকম নিঃস্ব হয়ে গেলেন তিনি। তাঁর নাম হয়ে গেলো দুখু মিয়া। দুখু মিয়ার দুখের শেষ ছিলো না। যে কারণে তাঁকে ছোটবেলা থেকেই অর্থ সংগ্রহ করতে হয়েছিলো। মক্তবে শিক্ষকতা করেছেন। মসজিদে আজান দিয়ে বেড়িয়েছেন। তারপর লেটোর দলে যোগ দিয়ে গান করেছেন, গান লিখেছেন। এভাবে তাঁর লেখাপড়াও তেমন এগোয়নি। অথচ কী আশ্চর্য! এ বালকই একদিন কবি হয়ে গেলেন। হলেন বিদ্রোহী কবি। হলেন আমাদের জাতীয় কবি। জাতীয় কবির এ কবিতাটি আজো আমি পড়ি। আজো আমার পাখি হবার ইচ্ছে জাগে। আজো আমি বিস্ময়ে নজরুলের দিকে তাকাই। যখন নজরুল বলেনÑ আমরা যদি না জাগি মা/কেমনে সকাল হবে/তোমার ছেলে উঠলে মাগো/রাত পোহাবে তবে। আহা! মনে হয় এইতো স্বাধীনতার কথা। এইতো সাহসের কথা। এইতো এগিয়ে যাবার কথা। নজরুল আমাদের জাগরণের কথা বলেছেন। জেগে থাকার কথা বলেছেন। বলেছেন অন্যকে জাগিয়ে দিতে। সবার আগে জাগতে হবে আমাকেই। আমিই বা আমরাই যদি জাগতে না পারি অন্যরা জাগবে কিভাবে? কিশোরকালে এ কথার ভেতরগত মর্ম বুঝিনি। বুঝিনি তবু ভালো লেগেছে। আজ যখন বুঝি তখন আরো ভালো লাগে। আরো আনন্দ জাগে। সেই সাথে বেদনাও কি কম! বেদনা দু’দিক থেকে। প্রথমত আমরা সত্যিকারার্থে সবাই ঘুমিয়েই আছি। কেউ জাগিনি। দ্বিতীয়ত কাজী নজরুলকে যতটা মর্যাদা এবং সম্মান দেয়ার কথা আমরা তা আজো দিতে পারিনি। এ দু’টো বেদনা আমাকে ক্লান্ত করে। ভাবিয়ে তোলে। তবে আশার দিক হলো ধীরে ধীরে জাগছে আমাদের কিশোরেরা। আমাদের মানুষেরা। কাজী নজরুল ইসলাম- চিরদিন তিনি আমাদের প্রিয় কবি। আমাদের জাতীয় কবি। আমাদের স্বাধীন চেতনার কবি। আমাদের আত্মার কবি। নজরুল চির আনন্দের এবং চির বেদনার কবি। তাঁকে আমরা ভুলি না। ভুলবো না। কিশোর থেকেই নজরুল আমাদের হৃদয় দখল করে নেয়। যেমন নিয়েছে আমার। এবং আমাদের।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ