সজীবের মহাকাশ জার্নি

সজীবের মহাকাশ জার্নি

সাইন্স ফিকশন খন্দকার নূর হোসাইন মে ২০২৩

নিকষকালো রাতের আঁধারে পিনপতন নীরবতায় স্থির হয়ে আছে নীল পুকুরের পানি। পাড়ে গজিয়ে ওঠা ঝোপের আড়ালে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। সামনে লাশের সারি। একটু আগে খুন করেছি ওদের। হাতে এখনো তাজা রক্তের গন্ধ। কানের কাছে আরো দুটো মশা এসে গান শোনাচ্ছে, ঠাস করে মারতেই চ্যাপটা হয়ে গেল একটা। এ নিয়ে ছয়টা লাশ পড়লো। সবগুলোই মশা। খুব জ্বালাতন করছিল হতচ্ছাড়াগুলো। 

বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। আব্বুর রাগী মুখটা আপাতত দেখতে চাই না। ডিনার করলে তাঁর রাগ চলে যাবে, তখন বাড়ি ফিরবো। আজও সিহাবের সাথে মারামারি হয়েছে। ক্লাস টুয়ে পড়ে সে। মায়ের কথায় হোমওয়ার্ক করিয়ে নেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে আমার কাছে পড়তে বসে। পড়া শেখানোর জন্য থাপ্পড় দিলে সে-ও ফেরত দেয়। শুরু হয় মারামারি। সিহাব আমার পাঁচ বছরের ছোটো, মারপিটে আমার সাথে পারবে কেন? মার খেয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। এখানেই হার মেনে যাই। আজ বেশ জোরে থাপ্পড় দিয়ে ফেলেছি। আব্বুর রুমে ওকে নিয়ে বসেছিলাম। দু’জনের হাতাহাতিতে ধাক্কা লেগে আব্বুর সাধের অ্যাকুরিয়ামটা পড়ে ভেঙে গেছে। আমি বড়ো বলে শাস্তিটা আমারই হবে। হাত ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালে দেখলাম, রাত নটা বেজে গেছে। গ্রামে এটা অনেক রাত। ডিনার শেষে আব্বু এ সময় বই পড়েন। আশপাশে কারো সাড়াশব্দ নেই।  উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরলাম। বাড়ি ফিরতে হবে, বেশি দেরি করলে আব্বুর রাগ পুনরায় ফিরে আসতে পারে। হঠাৎ পুকুরের পানিতে লাল আলো জ্বলে উঠলো, ওপর থেকে এসেছে। থমকে দাঁড়ালাম। ভূত নাকি? হার্টবিট ওঠানামা করতে লাগলো আমার। আস্তে আস্তে পুকুরপাড়ে নেমে এলো অদ্ভুত আকৃতির মহাকাশযান। কিছুটা ইল মাছের মতো। দরজা দিয়ে নেমে এলো সিঁড়ি। বেঁটে শরীরে ডিমের মতো মাথাওয়ালা দুটো প্রাণী দেখা গেল দরজায়। এলিয়েনের কথা বইয়ে পড়েছি, কিন্তু বিজ্ঞান এখনো এলিয়েনর অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারেনি। আমিই প্রথম মানুষ হিসেবে এলিয়েন দেখলাম মনে হচ্ছে। একি, ওরা আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেন? এত ভাবাভাবির দরকার নেই। খারাপ কিছু ঘটার আগে ভালোই ভালোই এখান থেকে কেটে পড়তে হবে। পেছন ঘুরে দৌড় দিলাম, জোঁকের মতো ওরাও আমার পেছনে আসছে। বারবার পেছনে তাকাতে গিয়ে গাছের শেকড়ে বেঁধে পড়ে গেলাম। এলিয়েন দুটো আমার কাছে পৌঁছে গেছে। উঠে দাঁড়ালাম। স্পষ্ট বাংলায় বলল একজন, ‘আমাদের সাথে আসতে হবে।’

‘এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? আমি কোথাও যাচ্ছি না।’ ঝাঁঝের সাথে বললাম। কাছ থেকে এলিয়েন দুটোর রোগা পাতলা শরীর ও বেঁটে রূপ দেখে সাহস বেড়ে গেছে আমার। ভেবেই নিয়েছি, এরা আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। মারপিটের জন্য রেডি আমি। চ্যাপটা নাকের এলিয়েন দুটো এসবের ধারে কাছেও গেল না। বেরসিকের মতো ধরে কাঁধে নিলো। রোগা-বেঁটে হলেও গায়ে এদের অসুরে শক্তি। পাটকাঠির ন্যায় কাঁধে করে মহাকাশযানে নিয়ে এলো আমাকে। ভেতরে জটিল যন্ত্রাংসে ঠাসা। চারপাশে যন্ত্রাংশ দিয়ে সাজানো বেডে আমাকে শুইয়ে দিলো একজন। একটু পরই ঘুম চলে এলো। 

আমাকে ধরে আনা এলিয়েন দুটো আবার জাগিয়ে দিলো। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছি, বেশ ফ্রেশ লাগছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। মহাকাশযানে ওঠার পর সময় ছিল, নটা বিশ মিনিট দশ সেকেন্ড। এখনও তা-ই আছে, একটুও বাড়েনি। তবে কি মহাকাশযান আলোর গতিতে ছুটছে? আলোর গতিতে ছুটলে সময় থেমে যায়। বয়স এক সেকেন্ডও বাড়ে না। জান্নাতিরা চিরতরুণ থাকবে, তাদের সময়ের শেষ হবে না। নিশ্চয়ই এর চেয়ে বহুগুণ ভালো প্রযুক্তি ব্যবহার করবেন মহান রব। আমাদের বিজ্ঞানের চেয়ে অনেক এগিয়ে এই এলিয়েনরা। ঘড়ির দিকে আবার তাকালাম, নটা বেজে বাইশ মিনিট। এর মানে গতি কমে এসেছে মহাকাশযানের। বিশ মিনিট পর নতুন গ্রহের মাটিতে পা রাখলাম। এখানে সবকিছু সবুজ, আকাশ লালচে। বেঁটে এলিয়েন দুটো আমাকে বিশাল ল্যাবরেটরি রুমে রেখে গেল। প্রথমবারে মতো ওদের প্রধান বিজ্ঞানীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো একজন। বিজ্ঞানী মোয়ালেম স্বরে বললেন, ‘সজীব, আমাদের সবুজ গ্রহে তোমাকে স্বাগতম। দুঃখিত, এভাবে তুলে আনার জন্য।’ 

কী বলব বুঝতে পারলাম না। বিজ্ঞানী জানালেন, মানুষের ওপর গবেষণার জন্য আমাকে আনা হয়েছে। কাজ শেষে আবার পৃথিবীতে দিয়ে আসবে। আমার কোনো ক্ষতি করবে না।  পৃথিবী থেকে আনা কিছু খাবার খেতে দিলো ওরা। বিস্মিত হলাম, মহাকাশ জার্নির পরও এখন পর্যন্ত ক্লান্তি আসেনি। খাওয়া শেষ হলে দেরি না করে আমার দেহটা ল্যাবরেটরি রুমের জটিল কিছু যন্ত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। 

শূন্যে ভাসছি, হাতে, পিঠে ও বুকে সুচের মতো কিছু গেঁথে গেল। ব্যথায় চিৎকার করে উঠলাম। এদের বাধা দিয়ে লাভ নেই, ভাগ্যের ওপর নিজের সবকিছু ছেড়ে দিলাম। বিশেষ মেডিসিনের প্রভাবে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলে নিজেকে ঝোপের মধ্য আবিষ্কার করলাম। পাশেই গ্রামের নীল পুকুর। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কোথায় মহাকাশযান ও সবুজ গ্রহ? তবে কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম? মনে পড়ল সিহাবের সাথে মারামারি করে এখানে এসেছিলাম। এরপর ঘুমিয়ে হয়তো স্বপ্ন দেখেছি। রাত নটার দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এখন ভোর পাঁচটা বাজে।

ভুল ভাঙলো একটু পরই। হাতে, বুকে ও পিঠে এখনো ব্যথা আছে। মাত্র আট ঘণ্টায় অন্য গ্রহ থেকে ঘুরে এসেছি। তবে কি মহাবিশ্বের স্রষ্টার কাছে অসম্ভব কোনো কিছু থাকতে পারে? মনে পড়ে গেল সূরা মাআরিজের ৪ নম্বর আয়াতের কথা। ফেরেশতা এবং রূহ আসমানে ঊর্ধ্বগামী হয় এক দিনে, যা পৃথিবীর পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।

উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। পুকুরের পাশের রাস্তা যেন এক রাতেই পিচঢালা সড়ক হয়ে গেছে। আমার বয়স মাত্র আট ঘণ্টা বেড়েছে, এতটুকু সময়ে শরীরে চোখে পড়ার মতো কিছুই পরিবর্তন হয়নি। 

এর মধ্যে পৃথিবীর বয়স কত বছর বেড়েছে এখনো জানি না। ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, গাছপালা থেকে শুরু করে সবকিছুর পরিবর্তন লক্ষণীয়। রাস্তার পাশে কলেজ কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন পোস্টার দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। ক্লাস শুরু ১ সেপ্টেম্বর ২০২৭। বুঝতে বাকি রইলো না, পৃথিবীতে এখন ২০২৭ সাল চলছে। আমি ২ জুন ২০২২ রাতে নীল পুকুরপাড়ে লুকিয়ে ছিলাম। পাঁচ বছর পর পৃথিবীতে ফিরে এসেছি, অথচ বয়স মাত্র আট ঘণ্টা বেড়েছে। 

পাশে কারো নড়াচড়ার শব্দে ভাবনায় ছেদ পড়ল। আমার বয়সী একটা ছেলে বিস্ময়ে বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওটা আর কেউ নয়, সিহাব।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ