সজীবের সফর

সজীবের সফর

গল্প মে ২০১১



এই সজীব! ওঠ বাবা ওঠ। নামাজের সময় চলে যাচ্ছে যে, তাড়াতাড়ি নামাজ পড়ে নে। ফজরের নামাজের সময় সজীবের মা ডাকলেন সজীবকে।
মায়ের ডাকে ঘুম থেকে জেগে উঠল সজীব। অজু করে নামাজের জন্য দাঁড়াল সে। আজ সজীবের মনটা বড্ড বিষন্ন লাগছে, মাথাটা প্রচণ্ড ব্যথা করছে, প্রায় অর্ধরাত নির্র্ঘুম কেটেছে তার। একটি দুঃশ্চিন্তা তাকে ঘুমাতে দেয়নি।
প্রতি বছরের মত এবারও তাদের স্কুল থেকে শিক্ষা সফরে যাচ্ছে। সজীবের আশা ছিল এইবারের শিক্ষা সফরে সে যাবেই। কেননা অর্থাভাবে ইতঃপূর্বে কখনো যেতে পারেনি। তাই এবার অনেক আগে থেকে শ’দুয়েক টাকা জমা করে রেখেছিল। কিন্তু জনপ্রতি পাঁচশত টাকা ধার্য করায় সজীবের যে আশায় গুড়েবালি। তাই ওর এতো দুঃশ্চিন্তা। অভাবের সংসারে মায়ের কাছ থেকে  এতো টাকা চাওয়া সম্ভব নয়, এটা জানে সে। সহপাঠীরা প্রায় সবাই যাচ্ছে, শুধু যেতে পারছে না সজীব। এতে ওর মনটা ভীষণ বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। ওর ইচ্ছে হচ্ছিল উচ্চস্বরে কাঁদতে। কিন্তু পারল না। ওর ভেতর থেকে কে যেন বলে দিল, সজীব! ধৈর্য ধর, তুমিও একদিন সফরে যাবে। তুমি না মেধাবী ছাত্র, তোমার মুখে কান্না মানায় না।
সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে কাক্সিক্ষত ১২ ফেব্রুয়ারি চলে এলো। বন্ধু রিয়াজের মুখে শুনেছে রাত ১০টায় তারা রওয়ানা হবে। সজীবের মন চাইল যাওয়ার সময় বন্ধুদের সাথে দেখা করবে। অন্তত যাত্রা মুহূর্তের আনন্দটা বন্ধুদের সাথে উপভোগ করবে। বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে রাত ৯টায় বন্ধুদের সাথে দেখা করল। সবাই আজ বেশ প্রফুল্ল। সবার মনেই আজ অনাবিল আনন্দ বিরাজ করছে। সজীব কষ্টকে বুকে চেপে সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলল। গাড়ি ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে বন্ধু রিয়াজ, মাসুদ হাত বাড়িয়ে বলল, সজীব, তুই যাচ্ছিস না তাই আমাদেরও খুব কষ্ট হচ্ছে। তুই সাথে থাকলে আনন্দটা পরিপূর্ণ হতো।
মন খারাপ করিস না, তোদের শিক্ষা সফর সফল হোক এই দোয়া করি। আর ফিরে এসে আমাকে ভ্রমণের গল্প শোনাবি, কেমন? এরপর কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল সজীবের মন। গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেল ও।
ধীরে ধীরে চলছে গাড়ি, তাকিয়ে আছে সজীব পথপানে, গাড়ির দিকে। এক সময় দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল গাড়িটা। ক্রমেই ঝাপসা হয়ে এলো সজীবের দু’চোখ। সজীব ভাবছে, আর চাদরে চোখ মুছতে মুছতে রাস্তা পার হচ্ছে। এমন সময় এক হায়েনারূপী ট্রাক সজীবের কোমল দেহের ওপর দিয়ে নির্দ্বিধায় চলে গেল। একটু মায়াও হলো না সর্বনাশীটার। নির্মমভাবে পিষ্ট করল সজীবকে, সজীবের সকল স্বপ্নকে। রিয়াজ মাসুদরা যখন খুলনায় ভ্রমণে ব্যস্ত, ওদিকে তখন সজীবের বাড়িতে কান্নার রোল। সজীবের মায়ের বুকফাটা আহাজারিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত।
খুব যতœসহকারে সজীবকে গোসল করাল প্রতিবেশীরা। কেননা আজ সে বহু দূরের সফরে যাবে। সাদা রঙের পোশাকে মুসাফির বেশে সাজানো হলো সজীবকে। সবাই মিলে রেখে এলো তাকে সেই দূর দেশে, যে দেশ থেকে  কেউ ফেরে না কোন দিন। দু’দিন পর বন্ধুরা যখন ফিরল, ততক্ষণে সজীব পরপারে। অঝোর ধারায় কাঁদছে সবাই। ছাত্ররা তাদের প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে, শিক্ষকরা তাদের প্রিয় ছাত্রকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল।
অথচ রিয়াজ, যে কি না সজীবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কাঁদছে না, নিশ্চুপ। নির্বাক দাঁড়িয়ে। কান্নার ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। সবার সাথে সেও গেল সজীবের কবরে।
কবরের মাটি খামচে ধরে চিৎকার করে বলল, সজীব। তুই না গল্প শুনবি? আমি এসেছি, এসেছি তোকে গল্প শোনাতে। তুই কোথায় সজীব! তুই কো-থা-য়!
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ