সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকার আগস্ট ২০১১

আবুল আসাদ.......

১. আমার কিশোর বয়স হলো পঞ্চাশের দশক। তবে ৬০-এর দশকের দুই-এক বছরও হয়ত এর মধ্যে যোগ হবে। তখন আমরা ছোটবেলা থেকে ঈদটা ভিন্নভাবে দেখেছি। এখন চতুর্দিকে সব জায়গায় শুনি যে, উৎসব হলো ঈদের প্রধান আকর্ষণ। আমরা এটা মনে করিনি। আমরা মনে করতাম ঈদের দিন সকালে উঠতে হবে, গোসল করতে হবে, তারপর নতুন জামা-কাপড় পরে ঈদগাহে যেতে হবে নামাজ পড়তে। আর নামাজ কেন, এটা এক মাসের সিয়াম সাধনার পর আনন্দের। পুণ্যের দিকটা এখানে বেশি। এক মাস ধরে যে আল্লাহর হুকুম আমরা পালন করেছি, এর পরে আমাদের শাওয়াল মাসের এক তারিখ ঈদের মাধ্যমে রোজা পালন শেষ হলো। হ্যাঁ, নতুন কাপড় পরা (গ্রামের সবার নতুন কাপড় হতো না)- এটা আমরা তখন মনে করিনি। আমাদের কাছে তখন প্রধান ছিল যে এটা পুণ্যের জন্য, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য এটা করতে হবে। দুই ঈদেই আমরা এটাকেই সামনে রেখেছি।
২. তখন তো দায়িত্ব ছিল না। এখন অনেক দায়িত্ব। নিজের পরিবারের দায়িত্ব আছে, আত্মীয়স্বজনের দায়িত্ব আছে, প্রতিবেশীর আছে। ঈদ এলে এখন নিজের কথাই ভুলে যাই। পরিবারের কার জন্য কী দরকার, আত্মীয়স্বজনের জন্য কী করতে হবে, প্রতিবেশীর জন্য কী করতে হবে- এই দিকটাই এখন আমার কাছে প্রধান হিসেবে দেখা দেয়। তবে এদিকটা সামনে রেখেই করি যে, এ সবই পুণ্যের জন্য, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এটা আমাদের ভেতরের পেরেশানি। দায়িত্ব পালনের পেরেশানি। ঈদ উৎসব পালনের তাগিদ এসব থেকেই আসে।
৩. অনেক পার্থক্য আছে। এখন তো নতুন কাপড়, গিফট, কার কতটা ভালো পাঞ্জাবি হলো, কার ভালো কাপড় হলো- এই প্রতিযোগিতাই বেশি। আর এই প্রতিযোগিতার মধ্যে কিন্তু আমাদের ওই সময়ের মত পুণ্যের দিকটা মুখ্য হয়ে আসে না। এই প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে একটা বেদনাও আছে। আমি প্রতিযোগিতায় হেরে গেলে বেদনা হবেই। আমিও ঈদের জন্য কাপড় কিনেছি, আরেকজন আমার চেয়ে বেটার কাপড় কিনেছে, আমার ছেলেমেয়েরা কাপড় কিনেছে। এটাকেই মুখ্য করে দেখছি বলে সে অনুপাতে প্রতিযোগিতাটাও বেড়েছে। এর ফলে ঈদের যে আনন্দটা আগে ছিল এখন কিন্তু সেই আনন্দটা নেই। তার স্থলে বেদনা এসে দেখা দিচ্ছে। আমার কাপড়টা, আমার জুতা বা টুপিটা আরেকটু ভালো হলো না কেন? অমুকেরটা তো কত সুন্দর! এই উৎসব প্রাধান্য পাওয়ায় প্রতিযোগিতা বেড়েছে। প্রতিযোগিতা বাড়ার কারণে বেদনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ঈদের নির্মল আনন্দটা হারিয়ে যেতে বসেছে। আমি মনে করি এটা এক ধরনের বিকৃতি, এক ধরনের সরে আসা। মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে আসা। এটাকে আমি একটা মেজর পার্থক্য বলে মনে করি এবং এটা ক্ষতিকর।
৪. সাইমুম সিরিজটা আসলে আমি লিখেছি এমন একটা সময়ে, আসলে যখন আমি পরিকল্পনা করি ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে আনতে হবে। তখন মনে করেছি কাজটা কঠিন হবে। এই জন্য আমি মনে একটা কিছু লিখতে চাই যাতে নতুন জেনারেশনের মধ্যে আমরা যে আলাদা জাতি, আমরা মুসলমান, আমাদের যে আলাদা পরিচয় আছে,- এই জিনিসটা যাতে করে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় সেই বিষয়টাকে সামনে রেখে আমি সাইমুম সিরিজের পরিকল্পনা করি। এবং আমি চেষ্টা করেছি যে, এই সাজেশন সৃষ্টির জন্য যা যা করার দরকার, এই যেমন এর মধ্যে সবকিছুই আছেÑ রোমাঞ্চ আছে, হিস্ট্রি আছে, তারপর এখানে গোয়েন্দা উপন্যাসের সব উপাদানই আছে। কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য হলো সবাইকে একটা দিকনির্দেশনা দেয়া। নিজের আত্মপরিচয়ের দিকে মানুষকে ফিরিয়ে আনা, বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের এখান থেকেই (এই দায়িত্ববোধ থেকেই) আমি আমার বইতে এই উদ্দেশ্য যাতে পূরণ হয় সেভাবেই সিরিজটিকে এগিয়ে নিচ্ছি।
৫. সাইমুম সিরিজ নিয়ে তো অনেক মজার ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে। আমি দেখেছি যে পাঠকেরাও লেখককে পরিচালনা করেন। এটা আমি বই লিখতে যেয়ে অনুভব করলাম। এত বেশি চিঠি আমি পাই, চিঠিতে তারা পাত্র-পাত্রী সম্পর্কে, কাহিনী সম্পর্কে মন্তব্য করেন। এই মন্তব্য আমাকে অনেক সময় কিন্তু নতুন একটা ডাইমেনশন ক্রিয়েট করে। আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে আমাদের একজন খুব প্রবীণ পাঠক আমার একটা বই (কোন খণ্ড আমার মনে নেই) একজন নায়িকাকে নিয়ে আমি সমস্যায় পড়েছিলাম যে একে নিয়ে আর সামনে এগানো যাবে কি না। আর সামনে এগোলে কাহিনীর ক্ষতি হবে কি না। অন্য দিকে তার প্রতি এমন একটা সিমপ্যাথি তৈরি হয়েছে যে, তাকে মেরে ফেলাও কঠিন। আবার তাকে জীবিত রেখে সামনে চলাও কঠিন। এমন একটা সঙ্কটে আমি পড়ি লিখতে যেয়ে।
এই অবস্থায় আমি তাকে মেরেও ফেললাম না, বা কাহিনীর মধ্যেও রাখলাম না। আউট অব সিন করে দিলাম। হয়তো তাকে অন্য দেশে পাঠিয়ে দিলাম কিংবা অন্য কাজে অন্য দিকে সরিয়ে দিলাম। তখন আমার সেই প্রবীণ পাঠক আমাকে বললেন যে, আপনার এটা ঠিক হয়নি। একজন মানুষকে সারাজীবন এভাবে বেদনার মধ্যে রাখা ঠিক হয়নি। এটা পাঠকেরাও মেনে নেবেন না। আপনি তাকে ফেরত নিয়ে আসেন। কাহিনীতে ফেরত আনার পর যদি তাকেসহ কাহিনী নিয়ে এগোতে না পারেন তবে তাকে মেরে ফেলেন।
এরপর আমি নেক্সট খণ্ডে নায়িকাকে কাহিনীতে ফেরত আনলাম এবং সে কাহিনীর একটা অংশ হিসেবে ইন্তেকাল করল আর নতুন একজন এসে তার স্থানে বসল। কিন্তু আমি আবারও সমস্যায় পড়লাম, পাঠকেরা এটা মেনে নিতে রাজি হননি। শত শত চিঠি পেয়েছি এবং বহু জায়গায় পাঠকেরা আমাকে ঘেরাও করছে যে, ‘আপনি এই নায়িকাকে কেন মারলেন? আমরা আর সাইমুম পড়ব না।’ কিন্তু কাহিনীর প্রয়োজনে তাকে না মেরে উপায় ছিল না। এটা আমার সবচেয়ে বড় বিব্রতকর পরিস্থিতি সাইমুম নিয়ে। এরপর আমি সতর্ক হয়ে গেছি যে এত সিমপ্যাথি সৃষ্টি হওয়ার আগেই আমার কাহিনীর প্রয়োজনে তাকে যা করার তা করা। বেশি সিমপ্যাথি সৃষ্টি হলে পাঠকের রিঅ্যাকশন হয়।
৬. আসলে পদ্ধতি যেটা আমাদের কুরআনে এবং হাদিসে আছে- বাচ্চারা তখন ৭ বছরে উপনীত হয় তখন তাকে নামাজ পড়তে হুকুম করো। ১০ বছর হলে নামাজ না পড়লে তাকে প্রয়োজনে শাস্তি দাও। আসলে এটা কেন? এ কারণে যে, একটা ছেলে বা শিশুর একটা কেন্দ্র্র সৃষ্টি হওয়া দরকার। তার পরিচয়টা কী? এই যে ছেলেকে বাপ-মা বললেন যে নামাজ পড়ো। প্রভাব পড়ে যে নামাজ পড়তে হবে কেন? বাপ-মা পড়েন, দাদা-দাদীরা পড়েছেন। কাজেই আমাকেও পড়তে হবে। তাহলে আমি কে? আমি মুসলমান। এভাবে এই নামাজের তাগিদের মধ্য দিয়ে তার মধ্যে একটা আত্মপচিয়ের জন্ম হয়। এবং এটা যখন ১০ বছর বয়সে তাকে নামাজ পড়তে হুকুম করা হয় তখন আরও বেশি মনোসংযোগ সৃষ্টি হয়। এই বয়সে শিশুদের মনোসংযোগ বেশি থাকে। তারা তখন খুব অনুসন্ধিৎসু থাকে এবং তাদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন সৃষ্টি হয়।
একটি শিশুকে যদি সচ্চরিত্র করতে হয়, ভালো করতে হয়, তাহলে শিশু বয়সেই তার মধ্যে আত্মপরিচয়টাকে ঢোকাতে হবে এবং একটা কেন্দ্র (ডাইমেনশন) ঠিক করতে হবে। যাকে নৌকার একটা হাল বলে। হাল যদি না থাকে তবে নৌকা একটা নির্দিষ্ট দিকে যাবে না। তো সে জন্য শিশু বয়সে তার ঈমান ও আমলের একটা সমন্বয় হওয়া দরকার এবং এর মাধ্যমে সে আত্মপরিচয় শিখে যাবে। এটাই তাকে ভালো হওয়ার, ভালো পথে চলার, ভালো করার একটা ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
৭. যে নিজকে ভালোবাসে, সে তার পরিবারকে ভালোবাসে। যে পরিবারকে ভালোবাসে, সে সমাজ, আত্মীয়স্বজন ও দেশকে ভালোবাসে। আর দেশপ্রেমটা হলো আমি যেখানে যাব, যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছি, ঐ বাড়ির প্রতি আমার একটা ইনভ্যালেন্ট আকর্ষণ থাকবে। ঠিক যেমনি আমি যে গ্রামে বাস করেছি, সেই গ্রামকে আমি কোনোদিন ভুলব না। তেমনি যে দেশে আমি বাস করছি, সে দেশের প্রতি আমার দায়িত্ববোধ আছে। সেই দেশের প্রতি আমার ভালোবাসা আছে, এটাও সৃষ্টি হয় একজন ভালো মানুষের মধ্যে। কিন্তু মানুষ যদি ভালো না হয়, চরিত্রহীন হয়, নিজেদের সম্মান বিক্রি করতে পারে- সে তো তার দেশকেও বিক্রি করতে পারে।
দেশপ্রেমিক হতে হলে ভালো মানুষ হতে হবে। ভালো মানুষ হলে দেশপ্রেম থাকবে আর দেশের জন্য যেকোনো কুরবানি করতে পারবে। তাই সচ্চরিত্র হওয়া, ভালো হওয়া- এটা হলো প্রথম কাজ।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ